পরজীবী (Parasite) আক্রমণে আমাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যাধি হয়। মানুষ একসময় পরজীবীর আক্রমণে রোগ হওয়ার কাথা জানত না। সে মনে করত, অপদেবতা শরীরে ভর করে বলে রোগ হয়। কিন্তু রোগের কারণ না জেনেও মানুষ রোগের ওষুধ আকিষ্কার করতে পেরেছে। যেমন মানুষ একসময় জানত না, ম্যালেরিয়া রোগ কেন হয়। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ইনকারা ম্যালেরিয়া জ্বর হলে সিনকোনা গাছের ছাল চিবিয়ে খেত। অনেক পরে সিনকোনা গাছের ছাল থেকে ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধ কুইনাইন আবিষ্কৃত হয়। কুইনাইন একরকম জৈব ক্ষার পদার্থ। মানুষ একসময় ভেবেছে ভেষজ উদ্ভিদ রোগ সারাতে সাহায্য করে। কেননা, তাদের প্রভাবে দেহের এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, রোগ উৎপাদক অপদেবতা চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু এখন আমরা জানি, ভেষজ উদ্ভিদে থাকে এমন সব বস্তু, যা রোগ উৎপাদক পরজীবীদের মেরে ফেলে। ফলে মানুষ হতে পারে রোগমুক্ত।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকেরা এখনো পরজীবীর আক্রমণে রোগ হওয়ার তত্ত্ব মানেন না। কিন্তু যাদের বলা হয় এলোপ্যাথি চিকিৎসক, তারা সবাই পরজীবীর আক্রমণে রোগ হয়- এ কথা মানেন। তবে কেবল পরজীবীর আক্রমণেই যে রোগ হয় তা নয়। অন্য কারণেও রোগ হতে পারে। যেমন- কোনো জায়গার পানিতে আয়োডিনের অভাব হলে মানুষের গলগণ্ড রোগ হয়। এমনকি মানুষের চিন্তাশক্তিও কমে যেতে পারে। যদিও গলগণ্ড রোগে মানুষের মৃত্যু ঘটে না। কোনো পানিতে যদি আয়োডিন একেবারেই না থাকে, তবে সেই পানিতে ব্যাঙাচি কখনো ব্যাঙে পরিণত হয় না; ব্যাঙাচিতেই থেকে যায়। মানুষের বেশির ভাগই মারাত্মক ব্যাধি হয় পরজীবীদের আক্রমণে। এদের মধ্যে বেশির ভাগকে খালি চোখে দেখা যায় না। দেখতে হয় মাইক্রোস্কপের সাহায্যে। অতীতে মাইক্রোস্কপ ছিল না। মানুষের মনে সৃষ্টি হতে পেরেছিল অদৃশ্য অশরীরী অপ আত্মার প্রভাবে ব্যাধি হওয়ার ধারণা; যার পরিচয় পাওয়া যায় বনবাদাড়ে থাকা আদিম মানুষের চিন্তা-চেতনায়। মাইক্রোস্কপ আবিষ্কারের পরে অতি ক্ষুদ্র রোগ উৎপাদক পারজীবীদের দেখা সম্ভব হয়। ফলে রোগ উৎপাদনে পরজীবীদের ভূমিকা স্পষ্ট হতে থাকে।
ম্যালেরিয়া বহু পুরনো ব্যাধি। প্রথমে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি চিকিৎসক লাভেঁর আলজেরিয়ায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের দেহে ম্যালেরিয়া রোগ উৎপাদক পরজীবীগুলো দেখেন এবং বলেন, ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হলো একপ্রকার এককোষী প্রাণী বা প্রটোজয়া। কিন্তু বিষয়টি তিনি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারেন না। ম্যালেরিয়া রোগ যে পরজীবী প্রটজোয়া প্লাজমোডিয়ামের কারণে হয়, সেটা প্রমাণ করে দেখান ব্রিটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রস। রোনাল্ড রসের পিতা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারী। রোনাল্ড রসের জন্ম হয় ভারতে। কিন্তু তিনি লেখাপড়া শেখেন বিলাতে। বিলাতেই তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর আবার ফিরে আসেন ভারতে। ম্যালেরিয়ার কারণ নিয়ে তিনি গবেষণা আরম্ভ করেন। তিনি দেখান চড়াই ম্যালেরিয়া পাখির রোগ, আর তা হয় ম্যালেরিয়া রোগ জীবাণু বহনকারী বিশেষ প্রকার মশার কামড়ে। তিনি সুস্থ চড়াই পাখিকে ম্যালেরিয়া রোগ-জীবাণুবাহী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া রোগ হতে পারছে এটা পরীক্ষামূলকভাবে দেখাতে সক্ষম হন। সব মশা ম্যালেরিয়া রোগ-জীবাণু বহন করে না। অ্যানোফিলিস মশার মধ্যে স্ত্রী মশারা ম্যালেরিয়া রোগ-জীবাণু বহন করে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি (বর্তমানে কর্নানি) হাসপাতালে গবেষণাগারে অ্যানোফিলিস মশার দেহে প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখতে পান, ম্যালেরিয়ার রোগ উৎপাদক পরজীবীরা মশার পাকস্থলির প্রাচীর ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং মশার লালাগ্রন্থিতে আশ্রয় নেয়। মশা যখন মানুষকে কামড়ায়, তখন মশার লালা বেরিয়ে আসে এবং তা ম্যালেরিয়ার পরজীবীসহ রক্তে মেশে। মানুষ ম্যালেরিয়া রোগাক্রান্ত হয়। তার এই গবেষণাকর্মে সহযোগিতা করেছিলেন মহম্মদ বক্স নামে এক ব্যক্তি। যার নাম এখন কেউ মনে করে না। ম্যালেরিয়া রোগের কারণ নির্ণয় করতে পারায় ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনজনকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। এরা হলেন- উইলিয়াম সি ক্যাম্বেল (William C Campbell), সাটোশি ওমুরা (Satoshi Omura) এবং উউ তু (Yoyou Tu)। প্রথম দুজন যে ওষুধ আবিষ্কার করেছেন তা গোদ রোগের জন্য খুবই কার্যকর। মানুষের গোদ রোগ হয় ছোট এক প্রজাতির সুতাকৃমির আক্রমণে। রোগটির জন্য আগে কোনো ভালো ওষুধ ছিল না। কিন্তু এদের আবিষ্কৃত ওষুধ Artemisinin গোদ রোগ নিরাময়ের জন্য হয়ে উঠেছে অব্যর্থ।
অন্য দিকে উউ তু ম্যালেরিয়া রোগের জন্য অব্যর্থ ঔষধ Artemisia annua আবিষ্কার করেছেন। তিনি এটা আবিষ্কার করতে পেরেছেন প্রাচীন চীনের বুনো ঔষধির বিবরণ অনুসরণ করে। তিনি যে গাছটি থেকে এই ওষুধটি নিষ্কাশন করতে সক্ষম হয়েছেন তার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হলো অৎঃবসরংরধ ধহহঁধ। গাছটি সূর্যমুখী (Compositae) পরিবারভুক্ত। উউ তু হলেন একজন মহিলা চিকিৎসক। চীনে ছিল বিশেষ ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি। চীন সেই পদ্ধতি এখনো পরিত্যাগ করেনি। উউ তু পড়াশোনা করেছেন প্রাচীন চীনের চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে। আর তিনি প্রাচীন চীনের আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ অনুসরণ করে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য অব্যর্থ ওষুধ।
ম্যালেরিয়া কুইনাইন ও ক্লোরো কুইনাইন দিয়ে চিকিৎসা করে সারছিল না। কিন্তু Artemisinin দিয়ে সারছে। একটি হিসাব অনুসারে প্রতি বছর পৃথিবীতে ২০ কোটি লোক ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এখন Artemisinin ঠিক সময়ে সেবন করলে কারো মৃত্যু ঘটছে না। তাই তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো।
আমাদের দেশে কবিরাজেরা অনেক রকম গাছগাছড়ার সাহায্যে চিকিৎসা করতেন এবং এখনো করেন। মনে হয় এসব গাছপালা নিয়ে ভালোভাবে গবেষণা করলে রোগ নিরাময়ের জন্য অনেক ওষুধই আবিষ্কার হতে পারবে। মানুষ চিরকাল গবেষক ছিল না। অসুস্থ হয়ে সে নানা প্রকার গাছের পাতা, ছালম শিকড়, ফল খেয়েছে। এভাবে আবিষ্কৃত হতে পেরেছে নানা বুনো ঔষধি। কবিরাজি অনেক ওষুধ কাজে লাগে না। কিন্তু কিছু কিছু ওষুধ কাজে লাগে। এদের নিয়ে উউ তুর মতো কেউ যদি গবেষণা করেন, তবে হয়তো অনেক প্রকৃত ওষুধ আবিষ্কৃত হতে পারে। আমাদের কবিরাজি শাস্ত্রে বলে, ছাতিম (Alstonia scholaris, R. Br) গাছের ছাল খেলে ম্যালেরিয়া রোগ সারে। অতীতে ম্যালেরিয়া জ্বর (কম্পজ্বর) হলে মানুষ ছাতিম গাছের ছাল খেয়েছে। আমাদের দেশের গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করলে ম্যালেরিয়া রোগ নিবারণে ওষুধ পাওয়া সম্ভব হতে পারে। ম্যালেরিয়া অবশ্য এখন আর আমাদের দেশে আগের মতো মারাত্মক ব্যাধি হয়ে নেই। আনোফিলিস স্ত্রী মশা কীটনাশক ছিটিয়ে যথেষ্ট মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছে বলে আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া এখন আর আগের মতো মারণব্যাধি নয়। আমাদের দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যালেরিয়া পরজীবীবাহী মশা মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট কীটনাশক ছিটানো হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি তার সৈন্যরা এ দেশে যুদ্ধ করতে এসে ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা যাক। এরপর ১৯৬৪ সাল থেকে ডঐঙ নিয়েছিল তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে ম্যালেরিয়া পরজীবীবাহী মশক নিধনে বিশেষ উদ্যোগ; যার ফলে ম্যালেরিয়া আর এখন আগের মতো মারাত্মক ব্যাধি হয়ে বিরাজ করছে না।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/১৭ অক্টোবর ২০১৫