লোকপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ

agsmaad.com

মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে। কেন দ্যাখে তা সে বলতে পারে না। অন্য কোনো প্রাণী স্বপ্ন দ্যাখে কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে। কারো কারো মতে, মানুষের কল্প কাহিনির জগৎ সৃষ্টি হতে পেরেছে স্বপ্ন থেকে। কল্পকাহিনির জগৎ আসলে হলো, জেগে স্বপ্ন দেখা। সাহিত্যিকরা তাদের স্বপ্ন দেখার আনন্দকে ভাগ করে নিতে চান অপরের সাথে। ছোট শিশু কোনো কিছুকে দেখে বিস্মিত হলে মাকে ডেকে বলে, মা দ্যাখো। সে চায় তার দেখোর বিষয়কে মায়ের সাথে ভাগ করে ভোগ করতে। সাহিত্যিকরা সাহিত্য করেন এভাবে তাদের বিস্ময়কে অন্যদের সাথে ভাগ করতে। উপন্যাস লেখার মধ্যে এই প্রবণতা খুব প্রাধান্য পেতে পারে।

অনেকের মতে আমাদের দেশে উপন্যাস লেখা প্রচলিত হতে পেরেছে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে। কিন্তু আমাদের দেশে গল্প কাহিনির প্রচলন অনেক আগে থেকেই ছিল। ইউরোপে উপন্যাসের জন্ম হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। আমাদের দেশে আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনি সমূহ। যাকে ধরা হতে পারে উপন্যাসেরই মত। এসব কাহিনির মূলে আছে বাস্তব ঘটনা। এতে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের গ্রাম জীবন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনি অবশ্য গদ্যে লেখা হয়নি। লেখা হয়েছে পদ্যে। কিন্তু উপন্যাস লেখা হয় গদ্যে। ময়মনসিংহ গীতিকার অনেক কাহিনি বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল মুসলমান কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে। ড. দ্বীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (১৯২৩) ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশ করেন। মৈমনসিংহ গীতিকা সংকলন করেন চন্দ্রকুমার দে নামে জনৈক সংকলক । দ্বীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ভূমিকায় বলেছেন- অনেকে তাঁর এই কাজে ব্রতী হবার জন্যে করেছেন সমালোচনা। তারা বলেছেন, এসব পালাগান শোনে ছোটলোকেরা। বিশেষত মুসলমান কৃষকেরা।

ময়মনসিংহ গীতিকার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে, কারণ ময়মনসিংহ গীতিকার সংকলক চন্দ্রকুমার দে জন্মেছিলেন (১৮৮৯) তখনকার ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনার অন্তর্গত আইখর নামক গ্রামে। হুমায়ুন আহমেদ জন্মেছিলেন (১৯৪৮) নেত্রকোনায় তাঁর মামা বাড়িতে। বাঙালি মুসলমান হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসে তাই থাকা সম্ভব ময়মনসিংহ গীতিকার একটা প্রভাব। তিনি জন্মেছিলেন গল্পকাহিনিরই রাজ্যে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগমন শিকড়বিহীন নয়। সে সমাজে গল্পকাহিনি নিয়ে রচিত পালাগান (Ballard) যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। সাহিত্যের চর্চা তাই ছিল না, এরকমটি বলা যায় না। যদিও সে চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কবি আলাওল কাহিনি রচনা করেছেন যা উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত।

আলাওলের লেখায় পড়েছে মুসলিম সাহিত্যিক রচিত পূর্বী হিন্দি সাহিত্যের প্রভাব। আর পড়েছে ফারসি গল্প সাহিত্যের প্রভাব। তিনি ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ‘হস্ত পয়করনামা’। যা সাতজন রজপুত্রের কাহিনি। কিন্তু তাঁর এই অনুবাদে পড়েছে বাংলার প্রতিবেশের প্রভাব। তা কেবলই পারস্যের কাহিনি হয়ে থাকেনি। পূরী হিন্দি বাংলাভাষার খুব কাছাকাছি। বাংলার মুসলিম সাহিত্যিকদের ওপর শতাব্দীতে এই পূর্বী হিন্দি সাহিত্য হতে পেরেছে সাহিত্য চর্চার বিশেষ অনুপ্রেরণা। বাংলাভাষী মুসলমানের সাহিত্য চর্চার একটা পৃথক ইতিহাস আছে। হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য চর্চার মধ্যে আছে যার প্রভাব। এরকমই মনে হয়েছে আমার কাছে।

হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য বাংলাদেশে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তা পেতে পেরেছে, প্রধানত এর আখ্যায়িকার কারণে। যে আখ্যায়িকা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজজীবনের এবং চিন্তা চেতনার পটভূমিতে। যেটা তাঁর সমকালীন অন্য লেখকের লেখায় তেমন নিপুনভাবে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। হুমায়ুন আহমেদের ছিল গল্প জমাবার বিশেষ ক্ষমতা। মানুষ গল্প পছন্দ করে। গল্প একজন লেখককে করে তোলে পাঠক প্রিয়। হুমায়ুন আহমেদ অল্প সময়ের মধ্যে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন পাঠক প্রিয়। চরিত্র চিত্রণে তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, বিশেষ দক্ষতা।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের মূল্য’ নামক প্রবন্ধে (১৯৪১) বলেছেন- ‘সাহিত্যের ভেতর দিয়ে আমরা মানুষের ভাবের আকুতি অনেক পেয়ে থাকি এবং তা ভুলতেও বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে মানুষের মূর্তি যেখানে উজ্জ্বল রেখায় ফুটে ওঠে সেখানে ভোলবার পথ থাকে না। ….জীবন মহাশিল্পী। সে যুগে যুগে দেশে দেশান্তরে মানুষকে নানা বৈচিত্র্যে মূর্তিমান করে তুলছে… জীবনের এই সৃষ্টিকার্য যদি সাহিত্যে যথোচিত নৈপুণ্যের সঙ্গে আশ্রয় লাভ করতে পারে তবেই তা অক্ষয় হয়ে থাকে।

হুমায়ুন আহমেদের লেখায় মানব চরিত্র ফুটে উঠেছে। একারণেই তাঁর সাহিত্য স্থায়িত্ব পেতে পারে। সাহিত্যের লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘মানুষ যা জানে, তা মনে রাখবার বা অন্যকে জানাবার জন্য স্মরণযোগ্য সুসংলগ্ন ভাষায় গেঁথে রেখেছে। পূর্বাপর চলে আসছে যে-সব ঘটনা, তার সম্বন্ধে মানুষ যা-কিছু খবর পেয়েছে, তা সে সঞ্চয় করেছে ইতিহাসে, দেশে বিদেশের বিবরণ সম্বন্ধে তার জানা বিষয় টুকে রেখেছে ভূগোলে। মানুষ চিন্তা করে যা জেনেছে, বা দেখেশুনে যে-সব খবর পেয়েছে, তা ধরে রেখেছে- দর্শনে, বিজ্ঞানে নানাবিধ বর্ণনায় ।

কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা কেবল তো জানার বিষয় নিয়ে নয়, সে সুখ দুঃখ ভোগ করে, ভক্তি বা ঘৃণা অনুভব করে। এই সব বোধ নিয়ে তার হৃদয়ের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাকেও নে স্মরণীয় রূপ দিয়ে নিজের স্বভাবের পরিচয় দিতে চায়।… ভাষার ভিতর দিয়ে সেই স্বভাবকে প্রকাশ করার উপায় সাহিত্য।… সাহিত্য মুখ্যত মানুষের জ্ঞানের ভান্ডার নয়, বোধের ভাণ্ডার।’ হুমায়ুন আহমেদের লেখায় ফুটে উঠেছে তাঁর বোধের চিত্র। মানুষের সুখ দুঃখ, ভক্তি ও ঘৃণার চিত্রসমূহ। হুমায়ুন আহমেদের লেখায় প্রাধান্য পায়নি শ্রেণি সংগ্রাম। প্রাধান্য পায়নি মনোবিকলনের জটিলতা। ব্যক্তি মানব মনের উপলব্ধি পেতে পেরেছে প্রাধান্য। সামাজিক প্রতিবেশ, শিক্ষাদীক্ষা ও অবস্থার সাম্য সত্ত্বেও এক একটি মানুষ হতে পারে আর সকলের থেকে পৃথক। এই পার্থক্য যখন ফুটে ওঠে, তখন উপন্যাস পেতে পারে বিশেষ সার্থকতা।

১৯৭১-এর যুদ্ধের পটভূমিকা নির্ভর করে হুমায়ুন আহমেদ রচনা করেছেন জোছনা ও জননীর গল্প। এতে আছে রাজনীতির কথা। কিন্তু জুড়ে বসেনি। এতে আছে আখ্যায়িকা। আছে মানব চরিত্রের বিচিত্র চিত্র। ১৯৭১- এর যুদ্ধ এদেশের রাজনীতিতে ছিল একটা খুবই জটিল বাস্তবতা। একদলের কাছে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ। আবার অনেক মানুষের কাছে এই যুদ্ধ প্রতিভাত হতে পেরেছিল ভারতের ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে। হুমায়ুন আহমেদের পিতা এই যুদ্ধকে মনে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। তিনি পুলিশে চাকরি করতেন। তিনি তখন ছিলেন পিরোজপুরে। তাকে মেরে ফেলে পাক সেনারা।

অন্যদিকে হুমায়ুন আহমেদের এক অতি প্রিয় মামা ছিলেন পাকিস্তানপন্থি । তিনি চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। হুমায়ুন আহমেদের পিতা মারা যাবার পর তিনি নেত্রকোনায় যান- হুমায়ূন, তার ভাই-বোন ও মাকে নিয়ে আসবার জন্যে। হুমায়ূনের এই মামা ছাড়া হুমায়ূনেরা রক্ষা পেতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু হুমায়ূনের এই মামাকে প্রাণ দিতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে, পাকিস্তানপন্থি হবার কারণে। হুমায়ূনকে পাক বাহিনী রাস্তা নির্মাণের জন্যে মাথায় করে ইট বহনে বাধ্য করে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের এসব ঘটনা সত্ত্বেও ১৯৭১- এর চিত্র এঁকেছেন অনেক নিরপেক্ষভাবে। তার লেখা হয়ে ওঠেনি কোনো বিশেষ রাজনীতির প্রচার পত্র। জোছনা ও জননীর গল্প এজন্যে পড়তে ভাললাগে অনেকেরই কাছে।

হুমায়ুন আহমেদের আর একটি বহুল পঠিত উপন্যাস হলো মাতাল হাওয়া। এতেও রাজনীতির কথা আছে। আছে হুমায়ুন আহমেদের ছাত্র জীবনের কথা। সে সময়ের তার ছাত্র জীবনের রাজনীতির পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- ‘ছাত্ররা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল ৪ ভাগে। ১. ছাত্র ইউনিয়ন, ২. ছাত্রলীগ, ৩. ইসলামী ছাত্রসংঘ ও ৪. ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)। ছাত্র ইউনিয়ন সম্বন্ধে তিনি বলেছেন- যারা এই দল করতো তাদের মধ্যে ছিল মেয়েলি ভাব। তারা ছিল পড়ুয়া টাইপ। রবীন্দ্রনাথ তাদের গুরুদেব। এরা পাঞ্জাবি পরা পছন্দ করত। পছন্দ করত গান বাজনা, মঞ্চ নাটক। এদের বাংলাভাষা ছিল শুদ্ধ। নদীয়া শান্তিপুর স্টাইল। যেকোনো বিপদ আপদে এরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে ছিল পারদর্শী। মিছিলের সময় পালানোর সুবিধার কথা বিবেচনা করে এরা সবসময় থাকত সব মিছিলের পশ্চাত ভাগে। এদের মধ্যে দুটি গ্রুপ আছে। মতিয়া গ্রুপ ও মেনন গ্রুপ। মতিয়া গ্রুপের ওপর আছে রাশিয়ার বাতাস অন্যদিকে মেনন গ্রুপের ওপর আছে চীনের প্রভাব (এখানে বর্ণনা দিতে যেয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটু গোলমাল করে ফেলেছেন। মেনন গ্রুপ তার বর্ণনায় মনে হতে পারে চীনপন্থি)। মতিয়া ও মেনন দুজনেই এখন হয়েছেন আওয়ামী লীগপন্থি। মতিয়া মন্ত্রী হতে পেরেছেন কিন্তু মেনন পারেননি।

ছাত্রলীগ সম্পর্কে হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন- এরা পেশিশক্তির চর্চা করে। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সামনে তারা খানিকটা হীনম্মন্যতায় ভুগে। মারদাঙ্গায় এবং হলের ক্যান্টিনে খাবার বাকিতে খাওয়ায় এরা বিশেষ পারদর্শী। এসময় এদের প্রধান কাজ ছিল এনএসএফ এর গুন্ডাদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা।

ইসলামী ছাত্রসংঘ সম্পর্কে বলতে গিয়ে হুমায়ুন বলেছেন- এরা মওদুদির বই বিলিয়ে দাওয়াত দেয়। পূর্বপাকিস্তানকে চায় হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে। দল হিসেবে এরা বেশ সুগঠিত। কথা বার্তায় মার্জিত। অনেকের বেশ ভালো পড়াশুনা আছে। এসএনএফ ছিল একটা খুবই গুন্ডা প্রকৃতির দল। তারা সমর্থন করত প্রেসিডেন্ট আইউবকে। এরা বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল মারদাঙ্গার রাজনীতিতে। এ দলের ছেলেরা বিশেষভাবে গণিকায় আসক্ত ছিল।

হুমায়ুন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু এরা (এসএসএফ) হোস্টেলে হুমায়ূনের ঘরে ঢুকে তার মূল্যবান বইপত্র ও বিছানা পুড়িয়ে দিয়েছিল। বইটাতে আছে এসএনএফ এর ছাত্রদের কুকীর্তির অনেক কথা। কিন্তু তবুও এই বইটি রাজনীতির বই হয়ে ওঠেনি। এতে আছে কাহিনির আকর্ষণ। আছে বিচিত্র চরিত্রের চিত্র। যা পাঠকের কৌতূহলকে ধরে রাখতে পারে।

হুমায়ুন আহমেদ ইসলামী ছাত্রসংঘ সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটা তাদেরকে ছোট করেনি; বরং করেছেন প্রশংসা। ইসলামী ছাত্রসংঘ যারা করতেন, তাদের অনেকের এখন বিচার করা হচ্ছে আলবদর, রাজাকার হিসেবে; যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। প্রমাণ করবার চেষ্টা হচ্ছে তারা ছিলেন মানবতাবিরোধি। হিংস্র প্রকৃতির ব্যক্তি। এখন দল হিসেবে এসএনএফ নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে।

আমি হুমায়ুন আহমেদের বেশি বই পড়িনি। তাঁর সাহিত্য মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হুমায়ুন আহমেদের একটি গল্প সংকলন আছে। গল্প সংকলনের নাম ‘উদ্ভটগল্প’। এই গল্প সংকলনের ভূমিকায় হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন- ‘যেকোনো উদ্ভট বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে। উদ্ভট মানেই তো রহস্যময়তা। দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে চার হয়। সেই চারে কোনো রহস্য নেই। কিন্তু যখন চার হয় না, যখন অন্যকিছু হয় তখনই মনে হয় খেলাটা জমে ওঠে। ভিন্ন ধরনের সেই খেলা আমার দেখতে ভালোলাগে। আবার অংশ নিতেও ভালোলাগে।’

আমার মনে হয় কেবল ছোট গল্পই নয়, হুমায়ূনের উপন্যাসে পাশাপাশি থাকতে দেখা যায় বাস্তব জীবনের চিত্র। আবার সেই সঙ্গে রহস্য বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। উদ্ভট গল্প সংকলনে আছে সাতটি গল্প। এর মধ্যে একটি গল্পের নাম. সম্পর্ক। এতে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের চিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এর পাশে এসেছে অন্য আর এক জগৎ‍ থেকে এক মহিলা। যার কথা হচ্ছে মোবারক হোসেন নামক স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে। মোবারক হোসেন হলেন নান্দাইল রোড রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। তিনি তার স্ত্রীর সাথে মাছের তরকারি নিয়ে ঝগড়া করার পর বাড়িতে না শুয়ে শুতে এসেছে রেল স্টেশনে। সেখানে কথা হচ্ছে অন্য কোনো জগৎ থেকে আসা এক মহিলার সঙ্গে। তিনি বলছেন আগামী পৃথিবীতে কেবল মহিলারাই থাকবে। পুরুষরা নয়। আর তাই থাকবে না নারী পুরুষের দ্বন্দ্ব। থাকবে না ধর্ষণ, অ্যাসিড মারা, নাবালিকা হত্যার মতো কোনো অপরাধ। কিন্তু একটি বিষয়ে আমার বেশ খটকা লাগল। মহিলা বলছেন- মহিলাদের ভেতর দু রকম ক্রমোজম থাকে। এক রকম ক্রমোজম হলো ‘X’ আর অন্য রকম ক্রমোজম হলো “Y” । বংশ বৃদ্ধির জন্যে এক সময়, পুরুষ ও রমণীর প্রয়োজন হত, কিন্তু ভবিষ্যতে তা আর হবে না। গল্প কথায় জেরা নেই। কিন্তু তবুও বলতে হয়, মেয়েদের দেহ কোষে ‘Y’ ক্রমোজম থাকে না। সাধারণত থাকে দুটি করে ‘X’ ক্রমোজম। অন্যদিকে পুরুষ দেহকোষে থাকে ‘X’ এবং ‘Y’ ক্রমোজম। সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা নির্ভর করে পিতার ওপর, মাতার ওপর নয়। কারণ পিতার জনন কোষে যদি ‘Y’ ক্রমোজম থাকে এবং মাতার জনন কোষ যদি তার দ্বারা নিষিক্ত হয় তবে জন্ম হয় পুরুষ সন্তানের।

আমাদের দেশে অনেক সময় মাতাকে গঞ্জনা সহ্য করতে হয় কন্যা সন্তান জন্ম দেবার কারণে। কিন্তু সন্তান কন্যা হবে না পুত্র হবে তা বিশেষভাবে নির্ভর করে পিতার ওপর। মাতার ওপর নয়। হুমায়ুন সাহেবের গল্প পড়ে পুত্র বা কন্যা হবার ক্ষেত্রে পাঠকের মনে সনাতন ভ্রান্ত ধারণা প্রবল হতে পারে। তাই এ কথা বলা। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি পুরুষ ও নারীর সন্তান কেন উদ্ভব হয় সে সম্পর্কে জানতেন না, এটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। তিনি এই গল্পে (যদিও কাল্পনিক) দিয়েছেন তার অজ্ঞতার পরিচয়। গল্প গল্পই। দুই দুইয়ে সেখানে সব সময় চার হয় না। কিন্তু বাস্তব জীবনে দুইয়ে দুইয়ে চার না হলে আমাদের পড়তে হয় বিপাকে। কল্পনার জগৎ যদি আমাদের বাস্তব জগৎ থেকে খুব দূরে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়, তবে সেটা হতে পারে আমাদের জীবন যাত্রার জন্যে বিপদজনক। তাই গল্প কল্পনারও একটা সীমা থাকতে হয়।

উপন্যাসের অন্যতম ভিত্তি হলো রোমান্টিকতা। রোমান্টিকতা বলতে বুঝায় পাওয়াকে ছেড়ে না পাওয়ার পিছে ছোটা। হুমায়ুন রোমান্টিক লেখক নন, কিন্তু পাওয়াকে ছেড়ে না পাওয়ার দিকে ছোটার কিছুটা প্রবণতা তাঁর লেখাতেও প্রত্যক্ষ করা চলে।

শুনেছি, বিজ্ঞানভিত্তিক অনেক কল্পকাহিনি লিখেছেন হুমায়ুন আহমেদ। আমি সেগুলো পড়িনি। হুমায়ূন আহমেদের রং পেন্সিল নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন পড়েছিলাম। এই বইয়ের একটি প্রবন্ধের নাম নিষিদ্ধ গাছ। নিষিদ্ধ গাছ হলো গাঁজা গাছ। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নূহাশ পল্লির ঔষধী বাগানে দুটি গাঁজার গাছ লাগিয়েছিলেন। যা সেখান থেকে লাগানোর দুদিন পরে চুরি হয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এই প্রবন্ধে গাঁজার গাছ সম্পর্কে বেশ কিছু কথা লিখেছেন। যা পড়ে মনে হয়েছিল গাঁজা গাছের প্রতি ছিল তাঁর এক বিশেষ প্রীতি ।

হুমায়ুন আহমেদ একটি বই লিখেছিলেন বৃক্ষকথা নামে। এতে আছে গাঁজার গাছ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা। বইটা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। বইটি যখন অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়, তখন তা প্রথম দিনে বিক্রি হয়েছিল বিপুল সংখ্যায়। প্রথম দিনের বিক্রি দেখে অন্যপ্রকাশের সত্বাধিকারী মাজহার অবাক হন। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে ঘটে অদ্ভুদ কাণ্ড। যারা এই বই কিনেছিল, তারা সবাই বই ফেরৎ দিয়ে টাকা নিতে চায়। তারা বলে- হুমায়ুন আহমেদ’র কাছে গল্প চায়, বৃক্ষ বিষয়ক জ্ঞান চায় না। হুমায়ুন আহমেদ আসলে জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁর গল্প জমানো ক্ষমতার জন্যে।

জোছনা ও জননীর গল্প শুরু হয়েছে নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইতরাজউদ্দিন কাশেমপুরীকে নিয়ে। যিনি স্থূলকায় বেঁটে খাটো মানুষ। যার মুখভর্তি দাড়ি। দাড়ির রং সাদাও নয় কালোও নয়। মাথা সম্পূর্ণ কামানো। যার হাতে আছে একটি রাজহাঁস। রাজহাঁসটি তার হাতে কামড়াচ্ছে। গল্প জমে ওঠে এভাবেই। মাতাল হাওয়া উপন্যাসে গল্প শুরু হয়েছে হাজেরা বিবিকে দিয়ে। তিনি হলেন একজন ডাকসাইটে অ্যাডভোকেটের বৃদ্ধা মাতা। হাবিব সাহেব ময়মনসিংহ জজকোর্টর কঠিন ক্রিমিনাল লইয়ার।

জনশ্রুতি আছে, তিনি একবার একগ্লাস গরুর দুধকে সেভেন আপ প্রমাণ করে আসামী খালাস করে নিয়ে এসেছিলেন। দুধের সঙ্গে আসামির কী সম্পর্ক সেটা অস্পষ্ট। হাবিব সাহেবের মেয়ে নাদিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে অনার্স পড়েন। মেয়েটি কল্পনাপ্রবণ। এই উপন্যাসে সে একটি আকর্ষণীয়া চরিত্র। এই বইতে স্থান পেয়েছে মুসলমান সমাজে প্রচলিত অনেক বিশ্বাস। যা তাদের জীবন যাত্রাকে করেছে নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত। গল্পের আকর্ষণ সক্ষম হয় পাঠককে ধরে রাখতে।

পাকিস্তান আন্দোলনকে ঠিক কোনো ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক আন্দোলন বলা যায় না। পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্ব। দ্বি-জাতিতত্ত্ব অনুসারে দক্ষিণ এশিয়া হলো দুটি পৃথক জাতির বাস। একটি জাতি হলো হিন্দু আর একটি জাতি হলো মুসলমান। যেহেতু মুসলমানরা একটা পৃথক জাতি, তাই তাদের থাকতে হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। এর জন্যে গঠন করতে হবে একটা পৃথক রাষ্ট্র, পাকিস্তান। এই যুক্তিটা এসেছিল ইউরোপ থেকে। মুসলিম ধর্মচিন্তা থেকে নয়। হিন্দুরা মুসলমানকে ভারত ম্লেচ্ছ। হিন্দুদের মুসলিম ঘৃণা মুসলিম জাতীয়তাবাদকে তীব্র করেছিল। হিন্দু মহাসভার নেতা বীর সাভারকার বলেন- মুসলমানরা বিধর্মী। তারাএসেছে বিদেশ থেকে। এই বিধর্মী বিদেশিদের দক্ষিণ এশিয়া থেকে বিতাড়িত করতে হবে। হিন্দুদের ঘৃণা আর এই বিতাড়নের বাণী এই উপমহাদেশের মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ আরেছিল পাকিস্তান আন্দোলনে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর পাকিস্তানে মুসলিম সমাজজীবনে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সমাজজীবনে উদ্ভব হয় একটা নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সরকারি চাকরিজীবী শ্রেণি। এক সময় বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে ছিল কঠোর পর্দা প্রথা। কিন্তু এই প্রথা শিথিল হতে শুরু করে পাকিস্তান হবার পর। মুসলিম মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে আরম্ভ করে। জোর দিতে শুরু করে চাকুরির ক্ষেত্রে। তারা হতে চায় চিকিৎসক, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার। হুমায়ুন আহমেদের লেখায় এই সমাজজীবনের আলোড়ন ধরা পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সমাজজীবনের ইতিহাস এক নয়। হুমায়ুন আহমেদের লেখা তাই হয়তো ভালো লাগে না পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষের কাছে।

পশ্চিমবাংলার মানুষের কাছে হুমায়ুন আহমেদের বই আদ্রিত হলো কি না, সেটা নিয়ে তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ন হতে পারে না। অনেকে অভিযোগ তুলছে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা হুমায়ুন আহমেদের লেখা পড়তে আগ্রহী নন। কিন্তু তাতে কী আসে যায়। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নিজের দেশের পাঠকের কাছে নন্দিত। এত অল্প সময়ের মধ্যে আর কোনো সাহিত্যিক এতটা পাঠক নন্দিত হতে পেরেছেন বলে এদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে জানা নেই।

আমি এক সময় রাজশাহীর কোনো এক বইয়ের দোকানে নিয়মিত বসতাম। আমি ঐ বইয়ের দোকানে যেয়ে বসতাম, কারণ, ঐ দোকানের মালিক সেখানে বসে তার বইয়ের দোকানের যেকোনো বই পড়তে আমাকে সুযোগ দিত। বই কিনে পড়বার মতো আর্থিক সংগতি আমার ছিল না। সেখানে বই পড়বার সময় লক্ষ করতাম কমবয়সী বহু ছেলে মেয়ে আসত হুমায়ুন আহমেদের লেখা বই কিনতে। তাদের দেখে অনুমান করতে অসুবিধা হত না, হুমায়ূন আহমেদের পাঠক প্রিয়তা সম্বন্ধে। কিন্তু আমি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের হুমায়ুন আহমেদের বই খোঁজ করতে দেখিনি। অবশ্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা সাধারণভাবেই বই কিনতে আসতেন কম। হুমায়ুন আহমেদ একটি নতুন পাঠক শ্রেণি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। সেটা কম কৃতিত্বের কথা নয়।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ