শিক্ষক অবমাননা

প্রথমে পত্রিকায় খবরটা পড়ে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে জনসম্মুখে কান ধরে উঠবোস করানো, এ তো ভাবতেই পারা যায় না। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের সংস্কৃতি নেমে গেছে কোনো রসাতলে! কিন্তু এখন আর তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এই শিক্ষক আসলে শিক্ষক হওয়ারই যোগ্য নন। কেননা, তিনি একজন ছাত্রকে কাসে এমনভাবে প্রহার করেন যে, ছাত্রটি অজ্ঞান হয়ে যায়। তার সহপাঠীরা তার মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। ক্লাস ফাইভে পড়া একটি ছাত্রকে বলা চলে শিশু। এ দেশের ফৌজদারি আইনে নারী-শিশু নির্যাতন অপরাধ হিসেবে গণ্য। এই শিক্ষকের এ জন্য অবশ্যই বিচার হওয়া যুক্তিযুক্ত। শিক্ষক যে ছাত্রকে প্রহার করেছেন, শিক্ষক সেটা নিজেই স্বীকার করেছেন (প্রথম আলো, ২১ মে ২০১৬)।

শিশুটি যখন প্রহারের যাতনায় স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করছিল তখন এই প্রধান শিক্ষক নাকি বলেছিলেন ‘ তোর আল্লাহ তোকে বাঁচাতে পারবে না’। একজন মুসলমান শিশুর পক্ষে প্রহারের যাতনায় আল্লাহর নাম স্মরণ করা খুবই স্বাভাবিক। তাকে যদি সত্যই বলা হয়ে থাকে যে, তোর আল্লাহ তোকে বাঁচাতে পারবে না, তবে সেটাকে অবশ্যই গণ্য করতে হবে ধর্ম অবমাননা বলে। বিশেষ করে বাংলাদেশে। কেননা, বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে ইসলাম হলো রাষ্ট্রধর্ম। তাই শিক্ষক যা করেছেন সেটাকে বলা চলে সংবিধান লঙ্ঘন; দেশের সর্বোচ্চ আইনকে অস্বীকার। তাই প্রথমে শিক্ষক অবমাননার ব্যাপারটা আমার কাছে যেভাবে প্রতিভাত হয়েছিল, এখন আর তা সেটা সেভাবে হচ্ছে না। জানি না, এই শিক্ষককে কেন পুনর্বহাল করা হয়েছে। আর স্কুল কমিটিকে করা হয়েছে বাতিল। এসব কিছু করার আগে ঘটনাটিকে নিয়ে ভালোভাবে তদন্ত করা উচিত ছিল; কিন্তু সেটা করা হয়নি। এই শিক্ষক যদি আমাদের দেশে একজন শিক্ষক না হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেরও হতেন, তবে তাকে দাঁড়াতে হতো আদালতের কাঠগড়ায়। কেননা, শিশু নির্যাতন সেখানেও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। বিএনপির ভাগ্য ভালো যে, এমপি ওই শিক্ষকের কানধরে উঠবোস করিয়েছেন, তিনি বিশ দলের জোটের কেউ নন। যিনি এটা করেছেন তিনি ১৪ দলেরই জোটভুক্ত এমপি। তিনি আর যাই হোন, একজন মৌলবাদী মুসলমান নন। তাই যা ঘটেছে তাকে ইসলামি মৌলবাদের অভিব্যাপ্তি হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে না। অবশ্য উনি যে দলের এমপি, সেই জাতীয় পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন ইসলামকে করা হয়েছিল রাষ্ট্রধর্ম। শেখ হাসিনা যেটাকে তুলে দিতে চেয়েও তুলে দিতে পারেননি।

ইসলামে শিশু নির্যাতন সমর্থন করা হয় না। কথিত আছে, হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে একজন ইহুদি কিশোর মদিনায় প্রত্যেক দিন অজুর পানি নিয়ে এসে দিত। ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে ক’দিন সেটা দিতে পারে না। মহানবী ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে জেনে ছুটে যান তার বাড়িতে, তাকে দেখতে (আল-বুখারি)। এ থেকে বোঝা যায়, কিশোর বালককে ইসলামে কতটা আদ্রিত দৃষ্টিতে বিচার করবার পক্ষে। ইসলাম শিশু ও কিশোরদের প্রতি স্নেহশীল হতে শিক্ষা দেয়। আল-কুরআনে লোকমান হাকিমের নাম পাওয়া যায়। তবে তার সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেয়া হয়নি। আরবে লোকমান হাকিমের নামে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। লোকমান হাকিমের নামে যেসব গল্প প্রচলিত আছে, তাতে জীব-জন্তুর মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে নীতিশিক্ষা। অনেক ইসলামি চিন্তাবিধ তাই মনে করেন শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে গল্প-কাহিনীর মাধ্যমে। নিরসভাবে নয়। লোকমান হাকিমের গল্পের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় গ্রিক ঈশপ-এর অনেক কাহিনীর। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জঁ জাঁক রুশো (১৭১২- ১৭৭৮) শিশুদের শিক্ষা দিতে বলেছেন গল্পকথার মাধ্যমে। তার এই নীতি পেয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি; কিন্তু আমাদের এই প্রধান শিক্ষক কাস ফাইভের একটি ছাত্রকে কাসের মধ্যে পিটিয়েছেন নির্মমভাবে। তার তলপেটে মেরেছেন ঘুষি। ফলে সে কাসের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কাসের সহপাঠীরা তার মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। এরকম শিক্ষক কি আমাদের শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য? অথচ এ দেশে একদল কথিত প্রগতিশীল চিন্তক ব্যক্তি নিচ্ছেন তার পক্ষ। বিষয়টি আমাদের বিস্মিত করেছে। জানি না, তাদের প্রগতিশীলতার মানদণ্ড আসলে কী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা কী রকম হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে কবি দার্শনিক ইকবাল ১৯৩০-এর দশকে বিশেষভাবে বলে গিয়েছেন। কবি দার্শনিক ইকবাল ১৯৩৪ সালে ছয়টি লিখিত বক্তৃতা দেন, যা প্রকাশিত হয় লাহোর থেকে Six Lectures on Reconstruction of Religious Thought in Islam নামে। এই বক্তৃতামালার একটিতে তিনি বলেন যে, আল-কুরআনে জ্ঞানের উৎস হিসেবে তিনিটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হলো প্রত্যাদেশ, আর একটি হলো প্রকৃতি এবং অপর আর একটি হলো মানব ইতিহাস। ইসলামে শুধু প্রত্যাদেশকেই একমাত্র জ্ঞানের উৎস বলা হয়নি। ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় তাই থাকতে হবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস অনুশীলনের ব্যবস্থা। ইসলামি শিক্ষায় কেবলই ধর্ম চর্চার স্থান থাকবে; কিন্তু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও মানব ইতিহাস চর্চার কোনো সুযোগ থাকবে না, সেটা হতে পারে না। তিনি আরো বলেন, ‘আইনস্টাইনের গবেষণা বিশ্ব এবং দার্শনিক চিন্তায় নতুন উপাদান যোগ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে একালে এশিয়া এবং আফ্রিকার মুসলমানরা যে তাদের ধর্মবিশ্বাসের নতুন মূল্য যাচাই করবার প্রশ্ন তুলবে, তাতে বিস্মিত হাওয়ার কিছু নেই। … অতীতের সাথে যোগসূত্র না হারিয়ে ইসলামিক জীবনধারার সমগ্র রূপ সম্বন্ধেই আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এর জন্য আমাদের সামনে একটি পথই খোলা আছে, তা হলো অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও সশ্রদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করা এবং তারই মানদণ্ডে ইসলামের শিক্ষার মর্ম অনুধাবন করা। তাতে যদি আমাদের পূর্বসূরিদের সাথে আমাদের মতের মিল না হয়, তবে সে জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’ ইকবালের শিক্ষা-দর্শন আমার মনে হয় বর্তমান বাংলাদেশের জন্য হয়ে আছে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। তাই আমি কবি দার্শনিক ইকবালের মতামত এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

১৯৩০-এর দশকে ইকবাল যা বলেছিলেন, আমরা তা এখনো মনে রাখলে উপকৃত হবো, এরকমই আমার মনে হয়। ইকবাল কেবল কবি দার্শনিকই ছিলেন না, তার জীবনের একটি সময় কেটেছে ছাত্র পড়িয়ে। শিক্ষক হিসেবেও তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ এবং সে আমলের জার্মানির বিখ্যাত মিউনিখ (মুনসেন) বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট। বংশগত সূত্রে তার অন্যতম পূর্বপুরুষ ছিলেন কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ। তার অগ্রসর চিন্তাভাবনার জন্য পাঞ্জাবের একদল গোঁড়া মাওলানা তাকে কাফের বলে অভিহিত করেছিল; কিন্তু তিনি এ জন্য দমে যাননি। তিনি বলেন, ধর্মকে পালন করতে হবে সচেতনভাবে, অন্ধভাবে নয়।

ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার অনেক কিছুই আছে। এখানে যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা যুক্তিযুক্ত হবে না; কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানে মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্ব খ্রিষ্টান বিশ্বের চাইতে ছিল প্রভূত অগ্রসর, যার ইতিহাস অনুশীলন আমাদের জন্য হতে পারে যথেষ্ট শিক্ষাপ্রদ। তবে সেটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থান পেতে পারছে না। ইউরোপের মধ্য যুগ আর এশিয়ার মধ্য যুগ সমার্থক নয়; কিন্তু অনেক বুদ্ধিজীবী চাচ্ছেন এদেরকে এক করে তুলতে। আল-কুরআনের সূরা সাদে বলা হয়েছে, স্রষ্টা আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন কাদামাটি দিয়ে। তারপর তিনি তার মধ্যে প্রবিষ্ট করে দেন তার নিজের নিঃশ্বাস। অর্থাৎ আল-কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে আছে আল্লাহর সৃজনীশক্তির অংশ। যাকে কাজে লাগিয়ে গড়তে হবে তার জীবন। ইসলাম একটি নিষ্ক্রিয় জগৎবিমুখ ধর্মে বিশ্বাসী নয়।

ইসলামে বলা হয়েছে, মানুষকে তার অপার সমস্যার সমাধান করে জীবনধারণ করতে। ইসলামের এই মূল দর্শনকে ভুলে গেলে ভুল করা হবে। আমি এ কথা বলছি আমাদের অনেক চিন্তক ব্যক্তি এখন ইসলামকে নিয়ে অশিষ্ট ভাষায় অনেক কিছু বলছেন। তারা এটা বলতে পারছেন তাদের অজ্ঞতার কারণে। অথবা সঙ্ঘাত সৃষ্টির বিশেষ অভিপ্রায় নিয়ে, যে সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকার প্রয়োজনীয়তা আজ বিশেষ মনোযোগের বিষয় হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষককে ইসলামে সম্মান করার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু কখনোই পূজা করার কথা বলা হয়নি। এমনকি নবীপূজাও ইসলামে স্বীকৃত নয়। ইসলামে নবী বলেছেন, আমি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। আমি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি (আল-কুরআন, সূরা তিন, আয়াত ১৪৪)।

আজ বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে হাজারও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অস্বীকারের চেষ্টা করা হচ্ছে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে। হিন্দুরা অনেক দেবদেবীর পূজা করেন, তাদের মূর্তি গড়ে; কিন্তু হিন্দুরা ভগবানের কোনো মূর্তি গড়ে পূজা করে না। হতে পারে, এটা তাদের ওপর ইসলামেরই প্রভাব। ইংরেজরা এ দেশের শাসক না হলে হয়তো ইসলামের প্রভাব তাদের ওপর আরো প্রবলভাবে পড়তে পারত।

দৈনিক নয়াদিগন্ত/২৯ মে ২০১৬

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ