এবনে গোলাম সামাদের সৃজনশীলতা নানা ধারায় বিচ্ছুরিত হয়েছে। একই বিষয়বস্তুর মধ্যে কখনো তার অধ্যয়ন সীমাবদ্ধ রাখেননি। হয়তো এটাই খুব মেধাবী ছাত্র না হওয়ার পেছনে কাজ করেছে। কখনো বিজ্ঞান, কখনো শিল্পকলা আবার এসব পেরিয়ে হয়ে ওঠেন ঐতিহাসিক গ্রন্থের রচয়িতা।
এ বছরের শেষাশেষিতে এসে প্রাজ্ঞ কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ এবনে গোলাম সামাদ ৯৩ বছরে পদার্পণ করবেন। নীরবে-নিভৃতে দেশ ও দশের জন্য যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেন কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করে, সেই ত্যাগী দেশপ্রেমিক মানুষদের চমৎকার দৃষ্টান্ত তিনি। বরেণ্য শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবনে গোলাম সামাদের জন্ম রাজশাহী শহরে। তার জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে। আমাদের রাজশাহীতে যারা গল্প, উপন্যাস ও কবিতা সৃজনের সাথে জড়িত; সেই লেখক গোষ্ঠী তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে কতটুকু বলতে পারছি না। কারণ, রাজনৈতিক দলের সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। প্রায় ২০ বছর ধরে তাকে দেখে আসছি। তিনি নিজের জীবনের সফলতা নিয়ে যত না ভাবনাচিন্তা করেন, তার চেয়ে বেশি ভাবেন এ দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। জীবনের প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন বাম চেতনাতাড়িত ব্যক্তি, তবে তার চিন্তাধারার মধ্যে ছিল দীপ্র দেশ ও জাতির প্রভাব। আর এখানেই তিনি ছিলেন আলাদা ব্যক্তিত্ব। সুলতানা কামালের আত্মজীবনীতে তার এ প্রসঙ্গটির কথা উল্লেখ পাচ্ছি। প্রায় বছর দেড়েক আগে তার একটি গ্রন্থের (আত্ম-পরিচয়ের সন্ধানে) বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম।
বহুলপ্রচারিত নয়া দিগন্তের মুক্তকলামে ছাপা হবার পর একজন তাকে সেটি পড়ে শোনালে তিনি শুধু মুচকি হেসেছিলেন। তবে আমার প্রত্যাশা ছিল ভালো-মন্দ কিছু একটা বলবেন। মুচকি হাসির মানে কী, বুঝতে বাকি ছিল না। তার স্বাক্ষরযুক্ত একটি বই কবি ও কথাশিল্পী মঈন শেখের মধ্যমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বইটি এতটাই চমকপ্রদ যে, উপন্যাসের মতো বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। এই গ্রন্থের সুবোধ্য গদ্য কিভাবে আয়ত্ত করলেন এর সন্ধান করতে গিয়ে এক সময় সেটাও পেয়ে গেলাম। এবনে গোলাম সামাদকে আন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী ‘পথে প্রবাসে’ দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এক সময় তার রচনাশৈলীকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। আমি পাঠকদের অনুরোধ করব বইটি পড়ে দেখার জন্য।
লক্ষ করেছি, তিনি যে অনুষ্ঠানে যান সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে যান। তিনি খুব জোরাল কণ্ঠে বক্তব্য দেন না, তবে তার বক্তব্যের মধ্যে এতটাই প্রজ্ঞার স্বাক্ষর থাকে যে, ইচ্ছা করে, আরো শুনি। তার বক্তব্য শোনার জন্য আমি ও গল্পকার নাজিব ওয়াদুদসহ বেশ কয়েকজন প্রায় সময়ে তার কাছে যেতাম। আমরা জানতাম, এবনে গোলাম সামাদ দেশের চলমান সমস্যা নিয়ে ভিন্নধারায় ভাবনা চিন্তা করছেন। তার সব মতামতের সাথে একমত হয়েছি তা নয়, অজ্ঞের মত তর্কও জুড়েছি। তবে তিনি মোটেও রাগ করেননি। তার সহনশীলতাও অসাধারণ। মনে আছে, আমি তখন সবেমাত্র আইন পেশায় সনদ পেয়েছি। মামলা-মোকদ্দমা পাওয়া দুষ্কর। সেই সময় এক কলেজের বাংলার অধ্যাপকের মামলা পরিচালনা করেছিলাম। মামলা চলাকালে আমাকে তিনি একদিন জানালেন, এবনে গোলাম সামাদ একসময় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’- এ প্যারিস বিষয়ে লিখতেন। তার কাছে দুই তিনটি পুরনো ‘সমকাল’ এখনো রয়েছে। তাকে অনুরোধ করলাম পত্রিকাগুলো আনার জন্য।
আমার সৌভাগ্য, তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। সেই সাময়িকীতেই পড়েছিলাম চার্লস দ্যগলের ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মনোহর ইতিবৃত্ত। তার একটি মন্তব্য আমার এখনো মনে আছে। সেটি হলো- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু না হলে চার্লস দ্যগল কস্মিনকালেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। আজকাল বারবার এই মন্তব্য মরহুম প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে ইচ্ছে করে। আমি এই বিষয়ে অনেক পরে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, শুধু এই লেখা নয়, জাফর ভাই (সিকান্দার আবু জাফরকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। এর অনুরোধে নামে বেনামে তাকে অনেক লেখাই দিতে হয়েছে। তখন তো লেখকের খুব অভাব ছিল। এবনে গোলাম সামাদের শৈশব-কৈশর কেটেছে পটুয়া হবার স্বপ্ন নিয়ে। ইচ্ছে ছিল, বড় শিল্পী হবেন। রং-তুলিও হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। তবে শিল্পকলার প্রতি আকর্ষণ থেকে গেছে আজীবন। তার লেখালেখির শুরু শিল্পকলার আলোচনা দিয়ে। ক্যানভাসে নিজেকে বিকশিত করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু শিল্পকলার ইতিহাস চর্চার মধ্যে কাটিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়। শিল্পকলার ওপর তার রচিত একাধিক গ্রন্থ এর প্রমাণ। সিকান্দার আবু জাফর সম্ভবত তার প্রথম বই ‘শিল্পকলার ইতিকথা’ সমকাল প্রকাশনী থেকে বের করেছিলেন। এর পরবর্তী সময়ে তার বহুল প্রচারিত ও প্রশংসিত গ্রন্থ ‘ইসলামী শিল্পকলা’ বাংলা একাডেমী ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেছিল। উল্লেখ্য, ইসলামী শিল্পকলা বিষয়ে এটি আমাদের দেশে বাংলা ভাষায় প্রথম বই। এ ছাড়া ‘মানুষ ও তার শিল্পকলা’ নামক গ্রন্থও তার একটি চমৎকার রচনা।
এবনে গোলাম সামাদ ১৯৭১ সালে কলকাতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদনা কর্মে যুক্ত ছিলেন। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তার জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই সংগ্রামের নানা ঘটনার সাক্ষী তিনি। এ বিষয়ে তার মতামত পাওয়া যাবে সম্ভবত ১৯৯৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বন্ধু গল্পকার নাজিব ওয়াদুদ। ছাপা হয়েছিল অধুনালুপ্ত মাসিক ‘অঙ্গীকার’ পত্রিকায়। আর সেটিই ছিল তার জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকার। নাজিব ওয়াদুদকে তিনি খুব ভালোবাসেন। এবনে গোলাম সামাদের সৃজনশীলতা নানাভাবে বিভক্ত। অবশ্য তিনি নিজেকে সৃজনশীল লেখক বা সাহিত্যিক ভাবেন না। তবে, তিনি খুব ছোট বেলা থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। খুব কম বয়সেই তার লেখা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায়। এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে এবনে গোলাম সামাদ খুব নম্র ভাষায় তার সেই কৃতিত্বকে এড়িয়ে যান।
আজকে হয়তো তাকে অনেকে একজন কলামিস্ট হিসেবে চিনেন। এমনকি, ঐতিহাসিক মর্যাদা দিতে কেউ দ্বিধা করবেন না। ‘রাজশাহীর ইতিবৃত্ত’ (প্রকাশকাল ১৯৯৯, প্রীতি প্রকাশনী, ঢাকা এই বইটি পড়লে বোঝা যায়- তিনি কথিত ইতিহাসবিদ নন। রসিকের দৃষ্টি দিয়েই রাজশাহীর অতীত-বর্তমান খোঁজার চেষ্টা করেছেন, যার অনেক কিছুই ছিল আমাদের জানার অগোচরে। আপাতত, আজকে তার তিনটি গ্রন্থের ওপর সংক্ষিপ্ত করে আলোকপাত করছি। এগুলো হলো- ১. আত্মপরিচয়ের সন্ধানে (২০২০, পরিলেখ প্রকাশনী) ২. বাংলাদেশের আদিবাসী : জাতি ও উপজাতি (একুশে বইমেলা ২০১৬, দ্বিতীয় সংস্করণ, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী), ৩. বায়ান্ন থেকে একাত্তর (একুশে বইমেলা ২০১৭, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী) ৪. বাংলাদেশে ইসলাম (২০১৯, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী) ৫. বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া (২০১৯, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী) ৬. আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং আরাকান সংকট (২০১৯, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী) ৭. আমাদের স্বদেশ ভাবনা (২০২০, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী) ৮. বাংলাদেশ কথা (২০২১, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী) এবং ৯. এবনে গোলাম সামাদ রচনাবলি (২০২১, পরিলেখ প্রকাশনী, রাজশাহী)।
প্রথম গ্রন্থটিতে এবনে গোলাম সামাদ আমাদের জাতিস্বত্বার আসল ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন। এখানে তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল বিষয়ের ওপর গভীর দৃষ্টি দিয়েছেন। তার দৃষ্টি নবাব স্যার সলিমুল্লাহ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত প্রসারিত। ক্ষেত্র বিশেষে মনোযোগের বিষয় জাসদের রাজনীতি ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাদ যাননি পাকিস্তানের রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টোও। তার ক্ষেত্রে আলোচনাকালে পিলু মোদীর ‘গু ঋৎরবহফ ঔঁষভর’ গ্রন্থটিকে এগিয়ে রেখেছেন। দ্বিতীয় বইটিও (বাংলাদেশের আদিবাসী: জাতি ও উপজাতি) আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। পার্বত্য চট্টগ্রামে কথিত শান্তি বাহিনীর সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর করার পর উপজাতি- আদিবাসী বির্তক আবার তুঙ্গে ওঠে। কারণ এক শ্রেণীর বামধারার এনজিও বলার চেষ্টা করে থাকে- বাংলাদেশে উপজাতিরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এবনে গোলাম সামাদ তার এই গ্রন্থে বুঝিয়ে দিয়েছেন, একমাত্র চাকমা উপজাতি বাংলাদেশে বসবাস করে না। আরো অনেক উপজাতি বাংলাদেশে রয়েছে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার আগেই তিনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর দ্বিতীয় সংস্করণও শেষ হওয়ার পথে। শেষ বইটিও বেশ চমকপ্রদ। এখানে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক তথ্য নতুনভাবে বিশ্লেষিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বিশেষত শহীদ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তার মতামত আমাদের ভাবায়।
এখানে গোলাম সামাদ বয়সের কারণে প্রায় সময় বিছানায় শুয়ে বসে কাটান। তবুও তার সৃষ্টিশীলতার বিরাম নেই। এরই মধ্যে চলছে লেখাপড়া ও কলাম লেখা। এখনও তার স্মরণশক্তিরও কোনো কমতি ঘটেনি।
একসময় আমরা অনুযোগ করেছিলাম- তিনি কেন আাত্মজীবনী লিখছেন না? তিনি এই অনুযোগ একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছিলেন এই বলে, তিনি এমন কোনো নামকরা ব্যক্তি নন যে, আত্মজীবনী লিখতে হবে। তবে তার ভক্ত পাঠক লক্ষ করবেন- কলাম ও অন্যান্য লেখাগুলোর ভেতর একধরনের আত্মজীবনীর ছোঁয়াই দেখা যায়।
এবনে গোলাম সামাদের সৃজনশীলতা নানা ধারায় বিচ্ছুরিত হয়েছে। একই বিষয়বস্তুর মধ্যে কখনো তার অধ্যয়ন সীমাবদ্ধ রাখেননি। হয়তো এটাই খুব মেধাবী ছাত্র না হওয়ার পিছনে কাজ করেছে। কখনো বিজ্ঞান, কখনো শিল্পকলা, আবার এইসব পেরিয়ে হয়ে ওঠেন ঐতিহাসিক গ্রন্থের রচয়িতা। আর কলাম তো রয়েছেই। তার এই সৃজনশীলতা সংরক্ষণ করা আমাদের এখন জরুরি কর্তব্য। কারণ আমরা জাতি হিসেবে এতটাই বিস্মরণ প্রবণ যে, প্রিয় ব্যক্তি চোখের আড়াল হলে তাকে আমাদের ভুলতে দেরী হয় না। এবনে গোলাম সামাদের বেলায় সেটা যেন না ঘটে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তার ঊননব্বই বছরে পদার্পণে রইল আমাদের হৃদয়ের অফুরান শ্রদ্ধাঞ্জলি। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তাকে জাতির প্রয়োজনে দীর্ঘজীবন দান করুন। তার সৃজনশীলতা প্রবহমান থাকুক- এই আমাদের আজকের প্রার্থনা।
লিখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক, আইনজীবী খুরশীদ আলম বাবু , ২৩ এপ্রিল ২০২১ এ প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামে।