শিল্প-বিচার ও শিল্পবস্তু ক্রয় 

(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘শিল্পকলা’তে, ১৯৮৭ সালের জুন মাসে)

কোন শিল্পকর্ম ভাল আর কোন শিল্পকর্ম তা নয়, তার চূড়ান্ত মানদন্ড নেই। কিন্তু তবু ভালমন্দের একটা বিচার করতে হয়। সমস্যাটা বিশেষভাবে দেখা দেয়, যখন আমরা কোন শিল্পবস্তু ক্রয় করতে চাই। আমাদের তখন স্বাভাবিক ভাবেই জানতে ইচ্ছা হয়, যা কিনছি তা কেনার মত কিনা। আর কি দামেই বা তা কেনা উচিৎ? 

এক সময় শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা-বাদশাহরা। সে সময় রাজা-বাদশাহরা যে শিল্পকর্ম কে মনে করতেন উন্নত মানের বলে। আর কোন বিচারের মানদন্ডের প্রয়োজন হত না। কিন্তু বর্তমানে, আধুনিক রাষ্ট্রে শিল্পকর্মের অন্যতম ক্রেতা হল সরকারী মিউজিয়াম। সরকারী পয়সা হল জনসাধারণের পয়সা। এই পয়সা ব্যয় করবার সময় দেখা দেয় অনেক প্রশ্নঃ কথা ওঠে, জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে কেনা হচ্ছে যেসব শিল্পকর্ম, তা যথার্থই কিনবার যোগ্য কিনা। অথবা যে দামে যে শিল্পকর্ম কেনা হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য ঠিক অতটাই হওয়া উচিৎ কিনা। জনমতের একটা চাপ এসে দেখা দেয় এ-ক্ষেত্রেও।

আগেকার দিনে এই চাপের প্রশ্ন ছিল না। শিল্প বিচারের ক্ষেত্রে জনমতের চাপ হল হাল আমলের ব্যাপার। অন্যদিকে অনেক শিল্পী মনে করেন শিল্পীরা হলেন স্বাধীন। তাদের যেভাবে ইচ্ছা, তাঁরা সেভাবেই রচনা করেন  তাদের শিল্পবস্তু। কিন্তু এরাও চান, সরকারী মিউজিয়ামে স্থান হোক এদের শিল্পকর্মের। যে মিউজিয়াম-এর জন্য বিশেষভাবে ব্যয় হয় সর্বসাধারণের ট্যাক্সের অর্থ। শিল্পকর্ম, জনমত, জনসাধারণের অর্থ ইত্যাদির সমস্যা তাই আজকের দিনে দেখা দেয় যথেষ্ট জটিল রুপে। অনেকে তাই অভিমত দেন, জনমত যাচাই করে শিল্পবস্তু ক্রয় করবার। কিন্তু জনমত যাচাই করা ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। 

জনমত অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রিত হতে চায় একদল শিল্পীর খ্যাতির দ্বারা। শিল্পকর্মময় শিল্পীর খ্যাতিই হয়ে দাঁড়ায় জনসাধারণের বিচার্য বিষয়। কিন্তু শিল্পীর খ্যাতি এক জিনিস আর কোন শিল্পীর বিশেষ শিল্পকর্মের মূল্য-বিচার স্বতন্ত্র পর্যায়ের ব্যাপার। এছাড়া এই প্রচারের যুগে অনেক শিল্পী অচিরেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন কেবলমাত্র প্রচার মাধ্যমের জোরে। অনেকে প্রচার মাধ্যমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাতির থাকার ফলে লাভ করেন সহজ খ্যাতি। নানা কৌশল খাটিয়ে একজন শিল্পী গড়ে তুলতে পারেন তার নিজের একটা বিশেষ ভাবমূর্তি (Image)।

আজকের দিনে শিল্পকর্ম কেনা বেচা হয়ে উঠেছে একটা বিশেষ ব্যবসা। অনেকে নতুন শিল্পীর শিল্পকর্ম কেনেন, বিশেষ ঝুঁকি নেন, ভবিষ্যতে বিক্রি করে লাভবান হতে পারবেন এই আশা নিয়ে। তাঁরা নানাভাবে প্রচার কার্য চালিয়ে চান নিজেদের কৃত শিল্পকর্মের মূল্য বৃদ্ধি করতে। শিল্পকর্মে এ’দের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে আর পাঁচটা। বিক্রয়যোগ্য জিনিসেরই (Commodity) মত। এক্ষেত্রেও সৃষ্টি হতে দেখা যায় বিশেষ ধরণের ফটকাবাজারী-যার হাত থেকে রেহায় পাওয়া শক্ত। কারণ, যারা শিল্পবস্তু কেনা-বেচার বাজার নিয়ন্ত্রিত করে, শিল্পবস্তুর চাইতে শিল্পবস্তুকে বেচে কি করে অধিক আর্থিক লাভ সম্ভব তাই তাদের সম্ভব হয় মূল লক্ষ্য। 

আধুনিক যুগে দুটো বিজ্ঞান হচ্ছে খুব জনপ্রিয়। একটি হলো সমাজবিজ্ঞান আর একটি হল মনোবিজ্ঞান। এ-দুয়ের সাহায্য নিয়ে অনেকে করতে চান শিল্পকর্মের বিচার। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এরা যে খুব কাজে আসে, তা নয়। সমাজ বিজ্ঞান চায় শিল্পকর্মের সমাজ পরিবেশ বিশ্লেষণ করতে। কিন্তু সমাজ পরিবেশ বিশ্লেষণ এক জিনিস আর শিল্পকর্মের মূল্য বিচার এক জিনিস। প্রাচীন চীনা নিসর্গ-চিত্র আজো আমাদের ভাল লাগে। অনেকে চীনা শিল্পের এই দিকটির উদ্ভব বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বলেছেন, এই নিসর্গ চিত্রকলার (Landscape Painting) উদ্ভব হয়েছে সে যুগের চীনের আমলাতন্ত্রের বিশেষ প্রয়োজন পূরণের জন্য। চীনা আমলাতন্ত্র দার্শনিক কনফিউসিয়াস-এর অনুসরণ করতে যেয়ে এমন-ভাবে গড়ে ওঠে যে আতে হাপিয়ে ওঠে সে আমলের আমলাদের জীবন। তাঁরা খুজে পেতে চান প্রকৃতির শান্ত পরিবেশ মুক্তি। কিন্তু তাদের পক্ষে চাকরী ছেড়ে তা করা সম্ভব হত না। আর হত না বলেই তাঁরা তাদের কক্ষে টাঙাতে চাইতেন শিল্পীর আঁকা রোমান্টিক নিসর্গ চিত্র। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এ সময়ের সব নিসর্গ চিত্রকেই কি বলা চলে সমান মূল্য মানের? অন্য দিকে সে সে আমল গত হওয়ার বহু পরেও মানুষ এখনও কেন কদর করে এ-সব নিসর্গ চিত্রের? 

আধুনিক জীবনে যন্ত্র একটা বড় কথা হয়ে উঠেছে। বড়ো কথা হয়ে উঠেছে শহরের আঁকা বাঁকা আলোক ঝিকিমিকি। এ-সবের প্রভাব পড়ছে আধুনিক শিল্পকলার উপরে। সমাজ পরিবেশ নিয়ে বহুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় বর্তমান যুগের বিভিন্ন শিল্প আন্দোলনকে। কিন্তু বিচার করা যায়না বিশেষ শিল্পকর্মকে। অনেকে তাই শিল্পকর্মক বিচারের জন্য নিতে চান মনোবিজ্ঞানের সাহায্য। কারণ ভাল লাগার ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে আমাদের মনেরই উপর। এ পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানের গবেষণা থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি।

মানুষ সাধারণত বিশেষ ধরণের পরিমাপ (Proportion) পছন্দ করে। যেমন যে আয়তক্ষেত্রের প্রস্থ সাধারণ দৈর্ঘ্যের শতকরা ৬২ ভাগ, সাধারণর অধিকাংশ মানুষের তা ভালো লাগে। মানুষ পছন্দ করে প্রতিসাম্য (Symmetry) ও ভারসামাই (balance)। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রতিসাম্য যদি আগে পিছে না হয়ে দ্বিপার্শ্ব (bilateral) হয়, তবেই তা আমাদের পরিতৃপ্ত করতে পারে বেশি। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের এই সব আবিষ্কার নকশাকলার ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সব শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে এই ধরণের বিচাররীতি প্রয়োগ করা চলে না। জটিলতা দেখা দেয় নানা কারণে। 

আমরা জানি সব শিল্পকর্ম সবার ভালো লাগে না। সব শিল্পকর্মের আবেদন সবার ক্ষেত্রে হয় না একই রকম। এই পার্থক্যের ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ভাল লাগাটা নির্ভর করে অনেক পরিমাণে আমাদের স্মৃতির উপর। সব শিল্পকর্ম সবার মনে একই রকম স্মৃতির বা ভাবের অনুষঙ্গ (Association) সৃষ্টি করে না। এ কারণে ; ভাল লাগার সাধারণ সূত্র দেয়া প্রায় অসম্ভব। মনোবিজ্ঞানের গবেষণা থেকে অবশ্য কতগুলি মূল্যবান কথা প্রমাণিত হয়েছে, যা চোখে দেখার শিল্পের (Plastic Art) ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখার কথা প্রমাণিত হয়েছে, যা চোখে দেখার শিল্পের (Plastic Art) ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখার যোগ্য। যেমন মনোবিজ্ঞানের গভেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, নাটক, উপন্যাস, কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর (content) চাইত রূপকলার (form) মূল্যই অধিক। রূপকলার নতুনত্বই এ-ক্ষেত্রে মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে বেশি। 

অনেকে শিল্পকর্মের মূল্যমান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিতে বলেন ইতিহাসের সাহায্য। ইতিহাস বলতে অবশ্য তারা বোঝাতে চান বিশুদ্ধভাবে শিল্পকলা ইতিহাসকেই। এ’দের মতে সেই শিল্পকর্মকেই বেছে নিতে হবে, যার মধ্যে আছে নতুনত্ব। যদি দেখা যায় আগের শিল্পীরা যা করেননি, কোন নতুন শিল্পী তা করেছেন এবং তা আমাদের কাছে আবেদন রাখতে পারছে, তবে তাকে দিতে হবে স্বীকৃতি। নতুন শিল্পীর কাজকে গ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করবার এর চাইতে কোন যুক্তিযুক্ত উপায় সম্ভব নয়। শিল্পকলার ইতিহাসের মানদন্ডেই হতে হবে শিল্পকলার বিচার। এই বিচার করবার সময়, একটী শিল্পকর্মে তূলনা করে দেখতে হবে নানা দেশের নানা সময়ের শিল্পকলার সঙ্গে। ঐ এক কথাতে একে আমরা বলতে পারি ঐতিহাসিক তূলনামূলক পদ্ধতি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফারাসী লেখক ও দার্শনিক ভলতের (Voltaire) একটা কথা আছেঃ “Tous les genres sont bons, excepte le genre ennuyeux”. অর্থাৎ “সব শিল্পরীতিই ভাল, কেবল একঘেয়ে না হলেই হল।’ এক ঘেয়েমীকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাই হল সর্বক্ষেত্রে সৃজনশীল শিল্পীর সাধনা আর তার স্বাধনার সাফল্যকে ঠিক সময়ে স্বীকৃতি দিতে পারাতেই রয়েছে, শিল্প-সমজদারীর প্রকৃত স্বার্থকতা। শিল্পবস্তু ক্রয়ের সময় কেবল মান বিচার নয়, আর একধরণের সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। যাকে বলতে হয় করণ উপাদানের (Medium) সমস্যা। শিল্পবস্তু ক্রয়ের সময় সবসময়েই ভেবে দেখতে হয়, যা কিনছি, তা টিকবে কতদিন। এমন ছবি যদি আমরা কিনি, যার রঙ ঝরে পড়বে কদিনের মধ্যে, তবে সে ছবির নন্দনগত মূল্য (Aesthetic value) যাইহোক-ক্রয় মূল্য বেশি হতে পারেনা। এ-কারণে শিল্প-বিচার আর শিল্প-বস্তুর ক্রয় ঠিক একই ধরণে লোকের আয়ত্ত্বে নাও আসতে পারে। শিল্পবস্তু ক্রয়ের সময় আমাদের থাকা উচিৎ করণ মাধ্যম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান। 

আমরা নতুন শিল্পীর কাজ কিনবার সমস্যা নিয়েই আলোচনা করছি এতক্ষণ। কিন্তু পুরান শিল্পীর কাজকে বেছে কিনবার সময়ও সৃষ্টি হতে পারে নানা সমস্যার। বিভিন্ন দেশের বড় বড় মিউজিয়ামগুলির ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, কত নকল জিনিসকে কেনা হয়েছে আসল জিনিস বলে। বৃটিশ মিউজিয়ামে একটা জুলিয়াস সিজারের মূর্তি ছিল যাকে একসময় মনে করা হত্ খুবই প্রাচীন বলে। কিন্তু এখন প্রমাণিত হয়েছে মূর্তিটি জাল। তার বয়স কয়েকশ বছরের বেশি নয়। ভানগগের অনেক জাল ছবি ভুল করে কিনেছে অনেক নাম করা মিউজিয়াম। একবার প্যারিসে, পিকাশো জীবিত থাকাকালীন সময়েই ধরা পড়েন এক ব্যক্তি* তিনি ঠিক পিকাশোর অনুকরণে ছবি একে পিকাশোর নাম করে তা বিক্রি করতেন বাজারে। সমজদাররাও এ-সব জাল ছবি অনেক সময় আসল বলেই ভুল করতেন। এখন শিল্পবস্তু জাল ধরবার অনেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও ঠকতে হয় অনেক সময়। এ থেকেই অনুমান চলে যে মানুষের শীল্প বিচারের ভিত্তি ঠুনকো। অনেকে অবশ্য বলবেন, জাল শিল্পকর্ম যদি আসলেরই মত আমাদের মনে রসের যোগান দিতে সক্ষম হয়, তবে জালকেইবা বেশি টাকা দিয়ে কিনতে দোষ কি?

*লেখক এ সময় প্যারিসে ছাত্র ছিলেন। ঘটনাটি তার কাছে খুবই কৌতুকবহ মনে হয়েছিল। বিরাট শিল্পীর খ্যাতি মানুষকে কিভাবে আছন্ন করতে পারে এই জালিয়াতির ব্যবসা একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। – লেখক

___________________

Waley, A., An Introduction to the study of Chinese painting (1923). 

Woodworth, R. S. & D. G Marquis, Psychology P-343. Mathuen & Co. Ltd. London. 1949

Eysenck, H. J., Sense and Nonsense in Psychology. P=332 Pelican Bock. Middle sex. 1957. 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ