সাংবাদিক Anthony Mascarenhas তাঁর বহুল পঠিত Bangladesh: A Legacy of Blood নামক বইতে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে লন্ডনে বলেন যে, তিনি পাকিস্তান এর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাচ্ছেন না। চাচ্ছেন একটা বিশেষ ধরণের সম্বন্ধ (link) বজায় রাখতে। তবে এ বিষয়ে তিনি বিশদভাবে কিছু বলতে চাচ্ছেন না।
শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন না। তিনি ও ডক্টর কামাল হোসেন পাকিস্তান থেকে পিআই এর একটি বিশেষ বিমানে করে পাকিস্তান থেকে যান লন্ডনে। সেখানে গিয়ে দেখা করেন বিলাতের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এর সঙ্গে। লন্ডন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ও ডক্টর কামাল হোসেন বিলাতের রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গ্রেট বৃটেন তখনও বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল না। ভারত শেখ মুজিবুর রহমান এর এইভাবে বিলাতের রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিমানে করে ঢাকায় আসবার আপত্তি ওঠায়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সেটা গ্রাহ্য করেন না। কেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ডক্টর কামাল হোসেন ভারতের বিমানে করে ঢাকায় আসতে চান না, সে বিষয় এখন কিছু জানা যায়নি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁর আত্মজীবনী My Truth (বাংলা অনুবাদ: আমার সত্যকথন, ভাষান্তর: স্কোয়াড্রন লীডার (অব.) মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম) বইতে শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে লিখেছেন, “তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, উষ্ণ হৃদয়ের লোক, যিনি একজন আইন প্রণেতার চেয়ে পিতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের বেশি অধিকারী ছিলেন। উপরন্ত তিনি সংগ্রামের বেশির ভাগ সময় দূরে অবস্থান করেছিলেন। আমি বলতে চাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় তার চিন্তাধারা, জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ছিল, যারা এসব বিষয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আমি মনে করি না যে তিনি তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাঁর প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। তাই তাঁরা যা কিছু করেছিলেন, তাঁর (মুজিব) নামে ও তাঁর জন্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি এ সকল লোকদের গুরুত্ব দেননি বরঞ্চ তাদের গুরুত্ব দিয়েছিলেন যারা তাঁর বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। এতে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী ছিল।” (পৃ. ১৬২)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানাভাবেই ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ঋণী। জানিনা, তিনি তাঁর পিতার (শেখ মুজিবের) সম্পর্কে এই মন্তব্য সম্বন্ধে কি বলেন। আমার মনে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান শেষ পর্যন্ত দ্বি-জাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। ইন্দিরা গান্ধী কখনও তাঁকে বিশ্বাস করেননি। খন্দকার মুশতাক আহাম্মদ ক্ষমতায় আসেন ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সাল। ভারত সরকার মুশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে ২৭ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে। আর চীন সরকার খন্দকার মুশতাক আহাম্মদ এর সরকারকে কূতনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ৩১ আগষ্ট। অর্থাৎ ভারতের পরে।
ইতিহাসের অনেক কিছুই আমাদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এর দেশে ফেরার ঘটনাকে যত সহজ যেভাবে ঘটতে পেরেছিল বলে বলছেন, ঘটনাটি কিন্তু ঠিক সেভাবে ঘটেছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান ও ডক্টর কামাল হোসেন ভারতের কোন বিমানে চড়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন না। এসেছিলেন বিলাতের রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে। যে গ্রেট বৃটেন তখনও বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল না। গ্রেট বৃটেন বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা থেকে ঐতিহ্য নামক প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ কর্তৃক লিখিত “তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা” নামক গ্রন্থ। এতে শারমিন আহমদ দাবী করেছেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আত্মগোপন করতে বলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তা করতে রাজি হন না।
এতে শারমিন আহমদের এই বক্তব্য কতটা নির্ভরযোগ্য, সেটা নিয়ে সন্দেহ তোলা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শারমিন আহমেদের কথার কোন প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়নি। যদিও করা যেতে পারে। কলকাতায় তাজউদ্দীন আহমদ যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন শারমিন আহমেদের বয়স সাত বছর মাত্র। শারমিন তাঁর মাতার কাছ থেকে শুনে অনেক কিছু লিখেছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান এর কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাগ হয়ে যায়। তাজউদ্দীন যোগ দেন মস্কোপন্থীদের সঙ্গে। তাজউদ্দীন যদিও আওয়ামী লীগে ছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট। ১৯৭১ সালের পর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ এর মধ্যে সৃষ্টি হয় গুরুতর রাজনৈতিক মতবিরোধ।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর আমি দেশে ছিলাম না। পাক বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর কতটা অত্যাচার কিভাবে করেছিল, আমি তা প্রত্যক্ষভাবে অবগত নই। রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আচরণকে প্রশংসা করেছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদ এঁদের সকলকে চাকুরিচ্যুত করেছিলেন এবং অনেককে পাঠান জেলে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়ে এঁদের সকলকেই বহাল করেন চাকুরীতে। বিষয়টি আমার কাছে সুযুক্তিপূর্ণ হল বলেই মনে হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান এর দেশে ফেরার ঘটনাকে এখন যেভাবে তুলে ধরবার চেষ্টা করা হচ্ছে, আসলে পরিস্থিতি যে সেরকম ছিল, তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি বাংলাদেশে ভারতের নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হোক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাই বঙ্গোপসাগরে পাঠান সপ্তম নৌবহর। বলেন, বাংলাদেশকে ভারত দখল করে রাখতে পারবে না। তাকে মেনে নিতে হবে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে। সেটা ছিল প্রচন্ডভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি আর তখনকার মতো বজায় নাই। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া আর চীনের মধ্যে বিশ্ব-নেতৃত্বের ক্ষেত্রে চলেছে বলতে গেলে প্রচ্ছন্ন লড়াই। আর ভারতও চাচ্ছে একটা পরাশক্তি হতে।
প্রথম প্রকাশিত হয় বিডিভিউজে, ২০২০ সালে।