ইতালীতে ফ্রাকাস্ত্রো নামে একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ১৫৪৬ সালে প্রথম কোয়ারান্টিন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ষষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে কালো প্লেগের মড়ক বহুবার ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়ায়। এ থেকে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইতালী ও তারপর অন্যান্য দেশে ৪০ দিনব্যাপী কোয়ারান্টিন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
কোয়ারান্টিন ব্যবস্থা অর্থাৎ প্লেগ আক্রান্ত দেশ থেকে জাহাজ এলে সে জাহাজকে আলাদা করে ৪০ দিনের জন্য আটক রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। বিখ্যাত ইতালীয় চিকিৎসক ফ্রাকাস্ত্রো সর্বপ্রথম দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলেন যে, সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি রোগ-জীবাণু থেকে ১৫৪৬ সালে প্রকাশিত ‘De contagione et contagiosis morbis Curatione’ নামক পুস্তকে তিনি সংক্রামক রোগের সঙ্গে পচন্ত ফলের তুলনা করে বলেন যে, পচে যাওয়া ফলের মতোই মানুষের দেহেও রোগ-জীবাণু জন্মায়, যারা বংশবৃদ্ধি করে মানুষের দেহে ব্যাধির সৃষ্টি করে।
এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner, 1749-1823) গো-বসন্তের ভাইরাস থেকে মানুষের গুটি বসন্তের টীকা আবিষ্কার করেন। যা গুটি বসন্ত নিয়ন্ত্রণে বিরাট অবদান রাখে। শোনা যাচ্ছে, কতকটা একইরকমভাবে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে টীকা আবিষ্কার হতে যাচ্ছে। ফরাসি দেশে বিখ্যাত জীবাণুবিদ লুই পাস্তুর (Louis Pasteur, 1822-1895) তাঁর গবেষণার মাধ্যমে রোগ-জীবাণুতত্ত্ব অর্থাৎ জীবাণু দ্বারা যে আমাদের দেহে অনেক রোগ সৃষ্টি হয়, তা প্রমাণ করতে পারেন। আরম্ভ হয় মানব দেহে রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে রোগ নিরাময় প্রথা।
রোগ-জীবাণুরা খুব ছোট। দেখবার জন্য প্রয়োজন হয় মাইক্রোসকোপের। ভাইরাসরা খুবই ছোট হয়। একমাত্র গুটি বসন্তের ভাইরাস ছাড়া আর কোন ভাইরাসকে সাধারণ মাইক্রোসকোপের সাহায্যে দেখা যায় না। ভাইরাসদের দেখতে হলে প্রয়োজন হয় ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপের। যা জার্মানিতে আবিষ্কার করেন ১৯৪০ সালে E. Ruska এবং H. Mahl। ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপের সাহায্যে ফটো তুলে বিভিন্ন ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কথা জ্ঞাত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বিষয়টি আর আগের মতো রহস্য ঘেরা হয়ে নেই।
প্রত্যেকটি সংক্রামক ব্যাধির শুধু যে বিশেষ বিশেষ উপসর্গ আছে, তাই নয়। তাদের রোগ বিস্তারের পদ্ধতিও বিভিন্ন। আর রোগ বিস্তারের পদ্ধতি হিসেবে মানুষের সংক্রামক ব্যাধিগুলোকে চারভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে, যে সমস্ত রোগ সংক্রমিত হয় মলের সাহায্যে ও আক্রমণ করে মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদান্ত্রে, সেগুলো। রোগীর মলের সাথে বেরিয়ে এসে জীবাণুগুলো মাটি ও পানি দূষিত করে। তারপর অপরিষ্কার হাত ও মাছির সাহায্যে দূষিত হয় খাদ্য। সেই দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে বা অপরিষ্কার হাতের সাহায্যে মুখ-গহ্বরের মাধ্যমে রোগের জীবাণু মানুষের অন্ত্রে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। যেমন- আমাশয় (অ্র্যামিবিক, ব্যাক্টেরিয়াল ও ভাইরাল), টাইফয়েড, কলেরা, পলিও এপিডেমিক হেপাটাইটিস প্রভৃতি।
কতগুলো রোগ বায়ুর সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি, কাশি ও কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস নালীর আবরণী থেকে নির্গত হয় অসংখ্য জীবাণুবাহী শ্লেষ্মারেণু। এই রোগের জীবাণুবাহী শ্লেষ্মারেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের দেহে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। যেমন হতে পারছে করোনা ভাইরাস। যার আক্রমণে ঘটছে বিশেষ ধরণের নিউমোনিয়া। যেহেতু এই রোগের জীবাণু প্রধাণত মানব দেহে প্রবিষ্ট হচ্ছে নাসিকা পথে, তাই আমাদের উচিত হবে নাসিকায় খাঁটি সরিষার তেল গ্রহণ করা। সরিষার তেলে থাকে ইউরাসিক এসিড। এই এসিড অনেক ভাইরাসকেই দূর্বল করে। যেমন সর্দি-কাশির সাধারণ ভাইরাসকে দূর করে এই এসিড। আমাদের সাধারণ সর্দি-কাশি হয় যেসব ভাইরাসের আক্রমণে, করোনা ভাইরাস তাদের সমগোত্রেই পড়ে।
তৃতীয় বিভাগে পড়ে সেই সমস্ত রোগ, যেগুলো সংক্রমিত হয় মানুষের দেহের বাইরের আবরণী চামড়া ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর মধ্য দিয়ে। চামড়া ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর উপর বংশবৃদ্ধি করে রোগের জীবাণুগুলো রোগের সৃষ্টি করে। যেমন- চোখ ওঠা, ট্রাকোমা, গণোরিয়া, সিফিলিস ইত্যাদি।
চতুর্থ বিভাগে পড়ে যেসব রোগ জীবন্ত রক্তশোষক গ্রন্থিপদীদের সাহায্যে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়, সেগুলো। এই রোগের জীবাণুগুলো মানুষের দেহ থেকে কখনও আপনাআপনি নির্গত হয় না। তারা প্রবাহিত হতে থাকে মানুষের রক্ত ও লিম্ফপ্রবাহে। তারপর মানুষের দেহ থেকে শোষিত রক্তের মাধ্যমে তারা প্রবেশ করে কীট বা এঁটুলির দেহে। সেখানে তারা বংশবৃদ্ধি করে ও সেই কীট বা এঁটুলি রোগের বাহকে পরিণত হয়। যেমন- প্লেগের ব্যাকটেরিয়া, পীতজ্বরের ভাইরাস প্রভৃতি।
লেখাটি প্রকাশিত হয় বিডিভিউজে, ২০২০ সালে।