সুখের সন্ধানে আমরা

আমি কিশোর বয়সে আমার প্রৌঢ় পিতাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, ‘সুখের চেয়ে শান্তি ভালো’। সে আমলে এই প্রবচনটা খুব প্রচলিত ছিল। মানুষ সে সময় সুখ আর শান্তিকে এক করে দেখতে চায়নি। কিন্তু এখন আমার কাছে এই বুড়ো বয়সে মনে হয়, শান্তি ছাড়া সুখভোগ সম্ভব নয়। আর সুখ ছাড়া জীবনে শান্তি আসতে পারে না। সুখ আর শান্তি দুটো আলাদা শব্দ। এদের অর্থের মধ্যেও পার্থক্য আছে। কিন্তু বাস্তবে সুখ ও শান্তি চলে যেন একে অপরের হাত ধরে। ‘সুখ’ শব্দটি আমাদের দেহনির্ভর। পক্ষান্তরে ‘শান্তি’ শব্দটি আমাদের মননির্ভর। কিন্তু বাস্তবে শরীরের অস্তিত্বকে বাদ দিয়ে মনের অস্তিত্বের কথা ভাবা কঠিন। আমরা আমাদের শরীর নিয়ে সারা জীবন বাঁচি। মৃত্যুতে আমাদের শরীরের আর প্রয়োজন থাকে না; ফুরায় সুখ-দুঃখের অনুভব।

ইঞ্জিল কেতাবে বলা হয়েছে- মানুষ কেবল খেয়ে বাঁচে না। কথাটা খুবই সত্যি। কিন্তু না খেলে যে মানুষের মৃত্যু ঘটে, সেটাও অবধারিত। আল কুরআনে তাই বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে আহার্য প্রদান করতে (সূরা ৯০ : ১৪)। আল কুরআনে আরো বলা হয়েছে- ভালোভাবে রন্ধন করা সুস্বাদু খাদ্য আহার করতে (সূরা ২ : ১৭২)। ধর্ম হিসেবে তাই ইসলামকে বলতে হবে অনেক বাস্তবধর্মী। কেননা ইসলামে দেহের প্রয়োজনকে খাটো করতে বলা হয়নি। হাদিসে বলা হয়েছে- ফুল কেনার আগে খাদ্য কিনতে হবে। ইসলামের এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) লিখেছিলেন :

যদি জোটে মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনো গো ক্ষুধার লাগি।
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনো হে অনুরাগী।
বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা।
হৃদয় প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা।

যেসব কবি মুসলমান না হয়েও ইসলামি প্রজ্ঞার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ওপরের কবিতার পঙ্ক্তিগুলো একসময় বাংলার মুসলিম মানসকে পেরেছিল যথেষ্ট উদ্দীপ্ত করতে, রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা যা করতে পারেনি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বাংলাভাষী মুসলমানের অনেক কাছের কবি। সুখের সন্ধানে আমরা, বলতে গিয়ে তাই তার কথা বিশেষভাবে মনে এলো। ইসলাম চেয়েছে দেহ ও মনের প্রয়োজন সমভাবে পূরণ করতে। আর এটা করতে পারলে মানুষ পেতে পারে সুখের সন্ধান। এ রকমই আমার এখন এই বুড়ো বয়সে মনে হয়।

একসময় ছাত্রদের উদ্ভিদবিদ্যা পড়াতাম। উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে পার্থক্যটা নানা দিক থেকেই যথেষ্ট বড়। প্রাণীর বেদনাবোধ আছে; কিন্তু উদ্ভিদের বেদনাবোধ আছে বলে মনে হয় না। কেননা, প্রাণীর বেদনাবোধের কারণ হলো স্নায়ুমণ্ডলী থাকা; কিন্তু উদ্ভিদের কোনো স্নায়ুমণ্ডলী নেই। তাই মনে করা চলে যে, উদ্ভিদের নেই বেদনাবোধ। বৌদ্ধরা প্রাণী আহার করে না। তারা প্রাণীদের কষ্ট দেয়ার বিরোধী। তারা মনে করেন, হিংস্রতা সুখের অন্তরায়। প্রাণীদের প্রতি হিংস্র হলে মানুষ তার প্রতিবেশী মানুষের ওপরও হতে চায় হিংস্র। হিংস্রতাকে পরিত্যাগ করতে না পারলে মানুষ পেতে পারে না শান্তি। কেননা, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত দুঃখের বড় কারণ। বৌদ্ধরা প্রাণিদুগ্ধ পান করাকে মনে করেছেন অহিংসার পরিপন্থী নয়। তাই তারা উদ্ভিজ্জ আহার্য ও প্রাণিদুগ্ধ পান করে চেয়েছেন জীবন ধারণ করতে। ভেবেছেন, এভাবে জীবনধারণ হলো শান্তি ও সুখ লাভের প্রকৃষ্ট পন্থা। ইসলামও অহিংসাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান কাবা শরিফ। কাবা শরিফে এবং তার কাছে কোনো প্রাণী হত্যা করা চলে না। এমনকি পিঁপড়াকেও নয়। বৌদ্ধরা সেলাই না করা জামা (চিবর) ধারণ করে বৌদ্ধস্তূপ সাতবার প্রদক্ষিণ করে। তারা মস্তক মুণ্ডিত করে। মুসলমানেরাও কাবাগৃহকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে। এই প্রদক্ষিণের সময় তারা কোনো সেলাই করা জামা পরিধান করে না। আগে কাবাগৃহ প্রদক্ষিণের সময় প্রত্যেককে মস্তক মুণ্ডায়ন করতে হতো; কিন্তু এখন চুল ছোট করে কাটলেও চলে। কাবাগৃহ প্রদক্ষিণের সময় নারী-পুরুষ একত্রে প্রদক্ষিণ করে। এই প্রদক্ষিণের সময় নারী-পুরুষে কোনো পার্থক্য করা হয় না। এ ছাড়া, এ সময় নারীদের মুখমণ্ডল রাখতে হয় অনাবৃত। কেন, কী কারণে বৌদ্ধদের মতো কাবাগৃহে একই রকম আচরণ করা হয়, সেটা এখনো হয়ে আছে গবেষণার বিষয়।

ইসলামে বলা হয়েছে, পশু জবাই করতে হবে এমনভাবে (আড়াই পোঁচে), যাতে আহার্য প্রাণী পায় খুব কম কষ্ট। আহার্য প্রাণীকে খুব কষ্ট দিয়ে বধ করলে সেই গোশত হালাল বলে বিবেচিত হয় না। ইসলামে ন্যায়যুদ্ধ (জিহাদ) করাকে সমর্থন করা হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে বলা হয়েছে, আল্লাহ আক্রমণকারীকে পছন্দ করেন না। বলা হয়েছে, যুদ্ধে মাত্রা ছাড়ানো চলবে না ( সূরা ২ : ১৯০-১৯১)। কুরআন শরীফে মানুষকে বিশেষভাবে বলা হয়েছে মধ্যপন্থী হতে (সূরা ২ : ১৪৩)। ইসলামের অন্যতম মূল শিক্ষাই হলো, এটা। মধ্যপন্থা ঠিক করতে হবে বাস্তব পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে। এর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মধ্যপন্থা বলতে গাণিতিক গড় (Mean) বোঝায় না। যেমন, যারা ভীরু তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। অন্য দিকে যারা হঠকারী তারা বেশি ঝুঁকি নিয়ে বিপদে পড়ে। কিন্তু যারা প্রকৃত সাহসী তারা নেয় যথাযথ পরিমাণে ঝুঁকি। তারাই হলো মধ্যপন্থী। কারণ, তারা ভীরু নয়। আবার তারা হঠকারীও নয়।

বিলাতে জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২) ছিলেন সুখবাদী দার্শনিক। তিনি বলেন, মানুষ চায় ব্যথার অনুভূতিকে (Pain) কমাতে এবং সুখের অনুভূতিকে (Pleaser) বাড়াতে। যা কিছু সুখের অনুভূতিকে বাড়ায়, তাকে গ্রহণ করতে হবে মঙ্গল (Good) হিসেবে। তিনি সুখের এই অনুভুতির সাথে দু’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যোগ করেন। তিনি বলেন, এই সুখের অনুভূতি কেবল ক্ষণিকের জন্য হলে চলবে না। হতে হবে একটি মানুষের সারা জীবনের জন্য। অন্য দিকে এই সুখের অনুভূতি কেবল গুটিকয়েক মানুষের জন্য হলে চলবে না। হতে হবে সর্বাধিকজনের জন্য। অর্থাৎ সুখ হতে হবে সামাজিক, ব্যষ্টিক নয়। বেন্থামের এই মতকে বলা হয় হিতবাদ। হিতবাদ বিলাতে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। বেন্থাম ছিলেন বিলাতের দার্শনিক। কিন্তু তার কাছে আমরাও যথেষ্ট ঋণী। বেন্থামের অনুসারী ছিলেন লর্ড বেন্টিং। তিনি ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন (১৮২৮-১৮৩৫)। বেন্টিং ছিলেন বেন্থামের শিষ্য। তিনি এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে করতে চান গণমুখী। এবং তিনি হিন্দুসমাজে প্রচলিত ভয়াবহ সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করেন। এগুলো তিনি করেছিলেন বেন্থামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। বেন্থাম চেয়েছিলেন এই উপমহাদেশে উদার ভাবধারার প্রবর্তন হোক। সুখবাদ অনেক রকম আছে। এই উপমহাদেশে চারবাক ছিলেন সুখবাদী। আর তার দর্শন যথেষ্ট খ্যাত হয়ে আছে। তিনি বলেছেন :
যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ

অর্থাৎ, যত দিন বাঁচবে, সুখেই বাঁচবে। এ জন্য যদি ঋণ করেও ঘি খেতে হয়, তবে খাবে। কেননা, মরে গেলে ঋণ শোধ করতে হবে না। এই ভোগবাদ হলো দায়িত্বজ্ঞানহীন ভোগবাদ। এর মধ্যে কোনো সামাজিক উপাদান নেই। নেই সর্বাধিকজনের জন্য সর্বাধিক কল্যাণের কথা। বেন্থাম ছিলেন গণতন্ত্রী; কিন্তু চারবাক তা ছিলেন না। বাংলাদেশে এখন বেন্থামের চেয়ে চারবাকের প্রভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশি- যা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে বিশেষ প্রতিবন্ধক।

১৯৫৪ সালে তখনকার একজন খ্যাতনামা মার্কিন অর্থনীতিবিদ ই. স্টালে একটি বই লেখেন The Future of Under Developed Countries নামে। এ বইয়ে তিনি সুখের (Happiness) একটি সমীকরণ প্রদান করেন : সুখ = অধিকৃত সম্পদ/বাসনা। তিনি বলেন, ইউরোপে মানুষ চেয়েছে অধিকৃত সম্পদ (Acquired Wealth) বাড়িয়ে সুখী হতে। তাদের এই ইচ্ছা তাদের করেছে উদ্যোমী; কিন্তু অনুন্নত দেশে মানুষ উদ্যোমী নয়। বরং তারা চায় বাসনাকে (Desire) কমিয়ে সুখী হতে। তাদের এই মনোভাবের পরিবর্তন না ঘটলে অনুন্নত দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত হতে পারবে না। উন্নয়নের সমস্যাটা অনেক পরিমাণে মানসিক। স্টালে বই লেখার পর ৬১ বছর গত হলো। তার সময়ের অনেক অনগ্রসর দেশ এখন আর অনগ্রসর হয়ে নেই। তারা চাচ্ছে তাদের বস্তুগত সম্পদ বাড়াতে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তাদের সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে অন্য দেশের সাথে। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাই মনে হয়, সুখী বিশ্ব গড়তে হলে বাসনার মাত্রাকেও হতে হবে নিয়ন্ত্রিত।

দৈনিক নয়াদিগন্ত/০২ অক্টোবর ২০১৫

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ