আমরা আমাদের বর্তমান গণতন্ত্রের ধারণা লাভ করেছি বিলাতের কাছ থেকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়েই হতে পেরেছিল এর সূচনা। ১৮৭৬ সালে স্থাপিত হয় রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটি (তখনকার নাম রামপুর-বোয়ালিয়া মিউনিসিপ্যালিটি)। শহরের মাঝখান দিয়ে তখন প্রবাহিত হতো পদ্মার একটি শাখা নদী, যার নাম ছিল বারাহি। বারাহি নদী গিয়ে মিশেছিল নওহাটার কাছে বারনই নদীর সাথে। বর্তমান রাজশাহী শহরের যে অংশ পূর্বভাগে অবস্থিত, তাকে বলা হতো বোয়ালিয়া। আর যে অংশ অবস্থিত ছিল বারাহি নদীর পশ্চিম ভাগে, তার নাম ছিল রামপুর। রামপুর-সংলগ্ন একটি ছোট এলাকাকে আবার বলা হতো শ্রীরামপুর। যেখানে বর্তমান রাজশাহী কোর্ট অবস্থিত। লর্ড রিপনের শাসনামলে (১৮৮০-১৮৮৪) ১৮৮৪ সালে প্রবর্তিত হয় বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট।
এই অ্যাক্ট অনুসারে রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটিতে অর্থাৎ রামপুর-বোয়ালিয়া মিউনিসিপ্যালিটিতে ২১ জন কমিশনার (সদস্য) নিযুক্তি পান, যার মধ্যে ১৪ জন ছিলেন শহরের করদাতাদের মাধ্যমে নির্বাচিত। পাঁচজন ছিলেন সরকার মনোনীত। আর দু’জন ছিলেন তাদের পদাধিকার বলে (Ex-Officio)। যে ১৪ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা সবাই নির্বাচিত হয়েছিলেন গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। এভাবেই প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে গোপন ব্যালটে ভোট দেয়ার প্রথা প্রবর্তিত হয়। রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটিতে প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন হরগোবিন্দ সেন। লর্ড রিপনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠান তখনকার বিলাতের প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন, যিনি ছিলেন বিলাতের লিবারেল পার্টির একজন নেতা।
লিবারেল পার্টি মনে করত, এই উপমহাদেশ শাসন করতে হলে এই উপমহাদেশের মানুষের হাতে কিছু শাসনভার ন্যস্ত করতে হবে। না হলে আবার ঘটতে পারে ১৮৫৭ সালের মতো সিপাহিদের অভ্যুত্থান। লর্ড রিপন যা করেছিলেন, সেটা তিনি করেছিলেন তখনকার বিলাতের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোনের নির্দেশে। আমি এই পুরনো কথা টানছি, কেননা, অনেকে বলছেন গণতন্ত্র এ দেশের জন্য উপযোগী নয়। কিন্তু এ দেশের মানুষের মনে ভোটের ধারণা মনে হয় বিশেষভাবেই প্রবিষ্ট হতে পেরেছে। তারা চায় না ভোটের রাজনীতি পরিত্যাগ করতে। যতগুলো কারণে আওয়ামী লীগের বাকশাল নীতি এ দেশের মানুষ মেনে নিতে চায়নি, তার একটি কারণ হলো, বিলাতের উদার গণতন্ত্রের ধ্যানধারণার প্রভাব।
ব্রিটিশ শাসনামলে রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচনের একটি ঘটনা বিশেষ খ্যাত হয়ে আছে। সেটা হলো, মুসলমান কসাই শেখ ব্যাঙ্গার কমিশনার নির্বাচিত হওয়া। হিন্দু কমিশনাররা বলেন, শেখ ব্যাঙ্গা হলো অচ্ছুত। তাই তার সঙ্গে তারা এক টেবিলে বসতে পারবেন না; কিন্তু সেটা ছিল ইংরেজ আমল। শেখ ব্যাঙ্গা ছিলেন নির্বাচিত কমিশনার। হিন্দু কমিশনাররা শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে সভা করতে বাধ্য হন। তাদের আপত্তি আইনত গ্রাহ্য হতে পারে না। সে আমল আর এ আমলের চেয়ারম্যান নির্বাচনের মধ্যে আছে পার্থক্য। এখন চেয়ারম্যান অথবা মেয়ররা নির্বাচিত হচ্ছেন ভোটারদের সবার ভোটে; কিন্তু তখন স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত হতেন কমিশনারদের ভোটে। কমিশনাররা ইচ্ছা করলে চেয়ারম্যানের বিপক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারতেন। ফলে চেয়ারম্যানকে শুনে চলতে হতো কমিশনারদের কথা। কিন্তু এখন যেহেতু মেয়ররা হচ্ছেন সর্বসাধারণের ভোটে, তাই তাদের ওপর এখন আর এই নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা তাই পারছেন আগের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতার অপব্যবহার করতে। তাদের ওপর থাকছে না আর আগের মতো জনমতের চাপ। এই পরিবর্তন সাধন করা কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে, আমি তা বলতে পারি না।
আমার মনে হয়, আগের আইনই ছিল গণতন্ত্রের অনেক অনুকূল। রাজশাহী মিউনিসিপ্যালিটিকে করপোরেশনে উন্নীত করেন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৯ সালে রাজশাহী পৌর করপোরেশনের নামকরণ করা হয় রাজশাহী সিটি করপোরেশন। কিন্তু ১৯৯৪ সালের আগে রাজশাহী সিটি করপোরেশনে কোনো প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত হতে থাকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
এখন বাংলাদেশে আছে ১১টি সিটি করপোরেশন। এগুলো হলো : ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, রংপুর, বরিশাল, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা। এগুলো আগে পৌরসভা নামে পরিচিত ছিল। মহিলাদের জন্য সব পৌরসভায় কিছু আসন সংরক্ষিত আছে, যার নির্বাচন প্রত্যক্ষ ভোটে হয় না।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৩০ জুলাই ২০১৮। রাজশাহী শহর মুখরিত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী প্রচার ও প্রচারণায়। পাঁচজন দাঁড়িয়েছেন মেয়র হওয়ার জন্য, যাদের মধ্যে দু’জনের প্রচারণা হলো সবচেয়ে বেশি। একজন হলেন এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং অপরজন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। লিটন হলেন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারের। লিটনের প্রপিতামহ লাল মোহাম্মদ হাজী ছিলেন বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (MLC= Member of the Legislative Council)। লিটনের পিতামহ আবদুল হামিদ ছিলেন রাজশাহীর মুসলিম লীগের একজন নাম করা নেতা। তিনি ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের আইনসভার সদস্য হন (MLA)। লিটনের পিতা এ এইচ এম কামারুজ্জামান (আবুল হাসনাত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান) ছিলেন আওয়ামী লীগের বিরাট নেতা। ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৭৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সারির আর তিনজন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে ঢাকা জেলে বন্দী অবস্থায় নিহত হন। লিটনের আছে বিরাট পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য। বুলবুলের তা নেই। বুলবুল রাজনীতিতে এসেছেন তার আপন ব্যক্তিত্বের জোরে। তিনি তার নিজের জনপ্রিতার বলেই লিটনকে মেয়র নির্বাচনে ২০১৩ সালে পরাজিত করেন। এবারের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু আন্দাজ করতে চাই না। বুলবুল বিএনপির প্রার্থী বলে নয়, বুলবুলের আছে একটা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, যা তাকে রাজনীতিতে শক্তি প্রদান করছে।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো ভুগছে অর্থের অনটনে। রাজশাহী করপোরেশনও একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সচ্ছল প্রতিষ্ঠান নয়। রাজশাহী করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স যা ওঠে, শুনেছি তার প্রায় সবটাই চলে যায় করপোরেশনের কর্মচারীদের বেতন দিতে। করপোরেশন চলেছে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অনুদানে। কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল নয়। তাকে করতে হয় ব্যাংক নোট ছাপিয়ে অর্থের সংস্থান। আর এক কথায় যাকে বলে ঘাটতি ব্যয় (Deficit Financing)। কিন্তু ঘাটতি ব্যয় সৃষ্টি করে সারা দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যাতে বিশেষভাবে কষ্ট পায় স্বল্প আয়ের লোকেরাই। রাজশাহীতে লিটন ও বুলবুল বলছেন নগর উন্নয়নের কথা। কিন্তু তারা বলছেন না এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হবে কী করে। মেয়র লিটনের আমলে বিদেশী সরকারের আর্থিক অনুদানে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি চওড়া সড়ক; কিন্তু এই সড়ক নির্মাণের জন্য শহরের আর্থিক আয় বৃদ্ধি ঘটতে পেরেছে এমন নয়, বরং প্রতি বছর এই সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় করতে হবে প্রচুর। কেবল আমাদের দেশে নয়, অনেক অনগ্রসর দেশেই বিদেশের অনুদানে তৈরি পথঘাট, বাড়িঘর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ করতে হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু এটা করতে হচ্ছে ঘাটতি ব্যয় করে। ঘাটতি ব্যয় একটা দেশকে করে ফেলতে পারে দেউলিয়া।