দণ্ডভয় না থাকলে সব সমাজেই অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। তাই অপরাধ কমাবার জন্য শাস্তির বিধান সব সমাজেই আছে। তবে দণ্ডভয় সব ক্ষেত্রেই যে কার্যকর হয়, তা-ও আবার নয়। অনেক লোক দণ্ডভয় অবজ্ঞা করে অপরাধ করে থাকে। পৃথিবীর সব দেশেই এখনো জেলখানা আছে। তা সে দেশ যতই সভ্য হোক না কেন। অপরাধবিহীন দেশ এখনো বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। অন্য দিকে, সব সমাজেই অপরাধ ও শাস্তির ধারণা চির দিন এক হয়ে থাকেনি। যেমন বিলাতে একসময় একটা ভেড়া চুরির অপরাধেও মানুষের প্রাণদণ্ড হয়েছে; কিন্তু এখন বিলাতে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে খুন করে ফেললেও তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয় না।
পৃথিবীর বহু দেশেই এখন আর সাধারণ খুনের অপরাধে প্রাণদণ্ড দেয়ার বিধান নেই। এর একটা কারণ মানুষের বিচারে ভুল হতে পারে। কাউকে প্রাণদণ্ড দিলে যদি দেখা যায় বিচারে ভুল ছিল, তবে তার জীবন আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না। এখন বিচারকেরা বলেন, যেহেতু বিচারে ভুল হলে এবং কাউকে প্রাণদণ্ড দিলে সেই ভুল আর শোধরাবার উপায় থাকে না, তাই প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত নয়। ইংল্যান্ডে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড প্রদান করা হয়েছে ভুল বিচারের জন্য। তাই বিলাতে প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে পার্লামেন্টে।
সব সমাজে অপরাধ ও শাস্তির ধারণা চিরকাল এক হয়ে থাকেনি, আর থাকছেও না। আমরা বিলাতের বিচারব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছিলাম। বিলাতের আদালতে একসময় কোনো মেয়েকে ডাইনি বলে সন্দেহ হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যেত। আদালত যদি তাকে ডাইনি বলে সাবস্ত করত, তবে তাকে মারা হতো প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলস্্ থেকে ডাইনি পুড়িয়ে মারার আইন তুলে দেয়া হয় ১৭৩৬ সালে। মানুষ এককালে বিশ্বাস করেছে ডাইনি থাকতে পারে, কিন্তু এখন আর করে না। সেকশপিয়রের ম্যাকবেথ নাটকে ডাইনির কথা আছে। ডাইনির ধারণা বিলাতে একসময় ব্যাপকভাবেই ছিল। ডাইনির ধারণা ছিল সারা ইউরোপেই। কেননা, বাইবেলে আছে ডাইনিকে শাস্তি দেয়ার বিধান। ইসলামে ডাইনির ধারণা নেই। ডাইনি পুড়িয়ে মারার বিধানও নেই। ধর্মবিশ্বাস মানুষের ন্যায়নীতির ধারণাকে নানাভাবেই প্রভাবিত করেছে।
ভারতে এবং বর্তমান বাংলাদেশে একসময় উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল সতীদাহ প্রথা। বাংলাদেশে উচ্চবর্ণের হিন্দু বলতে বোঝাত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য। ১৮১৮ হতে ১৮২৮ সালের মধ্যে কলকাতা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, পাটনা, বেনারস ও বেরিলী এই ছয় বিভাগে বছরে ৬০০ জনেরও বেশি বিধবাকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তদানীন্তন বাংলাদেশে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা সতীদাহ বেশি হতো। লর্ড বেন্টিক ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা দণ্ডনীয় বলে আইন প্রবর্তন করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ না করলে এই ভয়াবহ প্রথা নিষিদ্ধ হতে পারত বলে মনে হয় না। কেননা, বাদশাহ আওরঙ্গজেব এই প্রথা রোহিত করতে গিয়ে সফল হয়েছিলেন না। যদিও কিছুটা সফল হয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব আইন করেছিলেন, যে মায়ের সন্তান মাতৃদুদ্ধ পানে নিরত আছে, সেই মা বিধবা হলে তাকে দাহ করা যাবে না এবং অন্য মায়েদের বিধবা হলে, তাকে দাহ করতে হলে তার সম্মতি লাগবে। সাধারণত আওরঙ্গজেবকে খুবই গোঁড়া মুসলমান হিসেবে চিত্রিত করা হয়; কিন্তু তিনি হিন্দু প্রজাদের সম্পর্কেও যথেষ্ট ভাবিত ছিলেন।
একসময় পৃথিবীর সর্বত্র ক্রীতদাস প্রথা প্রচলিত ছিল। গরু-ভেড়ার মতো মানুষ কেনাবেচা হতো হাটে বাজারে। কিন্তু এখন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই মানুষ কেনাবেচা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে দাসপ্রথা তুলে দিতে গিয়ে বেধেছিল ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫)। এই যুদ্ধে যদি দাসপ্রথার সমর্থকেরা পরাজিত না হতো, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা আরো বহু দিন প্রচলিত থাকত বলেই অনুমান করা চলে। এই দৃষ্টান্তগুলো থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, মানুষের মধ্যে অন্যায়ের ধারণা চিরকাল এক হয়ে থাকেনি। চিরকাল এক হয়ে থাকেনি অপরাধ ও শাস্তির বিধান।
একটি সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে ওঠে রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে। বাংলাদেশের কোনো কবি মুঘল শাসনামলের শেষ দিকে লিখছেন,
টাকাকড়ি লোকে রাখে মাটিতে পুঁতিয়া।
ডাকাত কাড়িয়া লয় গামছা মোড়া দিয়া ॥
ডাকাত দেশের রাজা বাদশাহে না মানে।
উজাড় হইল রাজ্য কাজীর শাসনে ॥
মুঘল রাজত্বের শেষ দিকে কাজীরা হয়ে পড়েছিলেন খুবই দুর্নীতিপরায়ণ। তারা নিচ্ছিলেন বিচারপ্রার্থী ও বিবাদিদের কাছ থেকে উৎকোচ। আমরা আমাদের সময়ে দেখছি রাশিয়াতে রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হয়ে পড়াতে সে দেশে গুণ্ডা-বদমায়েশের আধিপত্য বাড়তে। আজকের মস্কো হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম নিরাপত্তাহীন শহর। কেবল তাই নয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়ে উঠেছেন বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১৭)।
বাংলাদেশ দুর্বল রাষ্ট্র। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে এখানেও ভালো নয়, সেটা আমরা সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই উপলব্ধি করতে পারছি। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ একটি দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সাধন; কিন্তু এই দায়িত্বের কথা যেন বিশেষভাবেই ভুলে যাওয়া হচ্ছে। তবু দেশের যে আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটছে না, তা বলা উচিত হবে না। কিন্তু এই উন্নয়ন হতে পারছে প্রধানত ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে। রাষ্ট্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নয়। কোনো রাজনৈতিক দল এ ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন না।
আমরা আলোচনা করছিলাম, অপরাধ ও শাস্তি নিয়ে। শাস্তি প্রধানত দেয়া হয় তিন কারণে। শাস্তির ভয়ে অনেকে অপরাধকরণে বিরত থাকে। শাস্তি অনেককে সংশোধিত হতে উৎসাহ দেয়। শাস্তি পেতে দেখলে ক্ষতিগ্রস্ত লোক মনে সান্ত¡না পায়, কেননা যে তার ক্ষতি করেছে সে শাস্তি পাচ্ছে। তবে শাস্তি দেয়ার প্রধান যুক্তি হলোÑ অপরাধপ্রবণতাকে সীমিত করতে পারা। যদিও শাস্তি দেয়া কোনো সমাজেই অপরাধকে এখনো একেবারেই নির্মূল করতে পারেনি। মানুষের সমাজ জীবন বহুভাবেই নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক জীবনের ওপর। এর একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত আমরা দেখি ডেনমার্কের ক্ষেত্রে। ডেনমার্ক থেকে ডাকাত গিয়ে একসময় সারা ইউরোপে ডাকাতি করেছে। এসব ডাকাতকে বলা হতো ভাইকিং। কিন্তু ডেনমার্কের লোক এখন আর ডাকাতি করে না। ডেনমার্কের লোক হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ কৃষিজীবী। আর বিশেষভাবেই শান্তিপ্রিয়। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন এলে তার আচরণ অনেক ভিন্ন হয়ে উঠতে পারে। ডেনমার্কে কৃষিজীবনে বিরাট পরিবর্তন আসতে পারার একটা কারণ হলো, সফল সমবায় আন্দোলন; কোনো রক্তক্ষয়ী বিপ্লবী অভ্যুত্থান নয়। ইউরোপের একাধিক দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিভিন্ন প্রকার সমবায় আন্দোলন ফলপ্রসূ হতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রয়োজন হয়নি। রাষ্ট্র সমাজের একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সমাজ জীবনে আসতে পারে অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন।
প্রকাশিত হয় ০৩ নভেম্বর ২০১৭, দৈনিক নয়া দিগন্তে।