আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি আসাম থেকে চলে আসেন পূর্ববঙ্গে। কেননা, মূল আসাম পাকিস্তানে আসে না। যেমন আসবে বলে তিনি মনে করেছিলেন। আসাম থেকে আসে কেবল গণভোটের মাধ্যমে একটি থানা বাদ দিয়ে বাদবাকি সিলেট জেলা, যা এখন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ।
সিলেট নামটি ইংরেজির। সিলেটের বাংলা নাম ছিল শ্রীহট্ট। একটা সময় সিলেটের উত্তরাংশকে বলা হতো গৌড়। মোগল আমলে শ্রীহট্ট ছিল সুবে বাংলার অংশ। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৪ সালে সিলেটকে যোগ করা হয়েছিল আসামের সাথে। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে গঠিত হয় একটি ভিন্ন প্রদেশ, যার রাজধানী হয় ঢাকা। কিন্তু ১৯১২ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ বিলুপ্ত হয়। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ একত্র হয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ। আসাম একটা স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে আবার প্রতিষ্ঠা পায়, কিন্তু আসাম স্বতন্ত্র প্রদেশ হলেও এর কোনো হাইকোর্ট ছিল না।
আসাম ছিল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারিক নিয়ন্ত্রণে। আসামের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আসামের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক। আসামের কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। কলকাতা ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই রফতানি হতো তার বিখ্যাত চা। আসামের কাছার জেলার ভাষা বাংলা। ধুবরি ও গোয়ালপাড়ার ভাষা হলো বাংলা। আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাবা গিয়েছিল আসাম পুরোটাই আসবে পাকিস্তানে; কিন্তু তা হয় না। ভাসানী হন বিফল মনোরথ। তিনি একসময় সিরাজগঞ্জ থেকে গিয়েছিলেন আসামে। আসামে তিনি হন একজন বিরাট নেতা। কিন্তু সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে ফিরে আসেন পূর্ব বাংলায়।
ভাসানীর কথা বিশেষভাবে বলতে হচ্ছে, কারণ তিনি গঠন করেন ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি বলেন, মুসলিম লীগ হয়ে পড়েছে একটা বড়লোকের দল। তা দেখছে না গরিবের স্বার্থ। তাই তিনি গড়ছেন গরিবের স্বার্থ রক্ষার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ। উল্লেখ্য, ‘আওম’ শব্দটা আরবি। শব্দগত অর্থে হলো ‘জনগণ’ বা ‘সর্বসাধারণ’। ভাসানী প্রথম ব্যক্তি, যিনি এ দেশের রাজনীতিতে টেনে আনেন ধনী-গরিবের দ্বন্দ্বমূলক রাজনৈতিক দর্শন। এই ধনী-গরিবের দ্বন্দে¦র দর্শন তিনি লাভ করেছিলেন কমিউনিস্টদের কাছ থেকে। আওয়ামী লীগ গঠনের নেপথ্যে ছিল এ দেশের সে সময়ের কিছু কমিউনিস্টের ভূমিকা, যারা আওয়ামী মুসলিম লীগকে সামনে রেখে তার মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন তাদের অনুসৃত রাজনীতি।
১৯৫১ সালের ২৪ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গঠন করেন পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কোনো দিনই আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেননি। তিনি করেছেন একটি স্বতন্ত্র দল, যাতে ভাসানীর কোনো ভূমিকা ছিল না। কিন্তু পূর্ব বাংলায় তার ভাবশিষ্যরা, যেমন খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগে। ১৯৫৫ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। যাতে করে অমুসলমানেরাও এই দলে যোগ দিতে পারে। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন সোহরাওয়ার্দী।
ভাসানীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয় পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। সোহরাওয়ার্দী চান পাকিস্তান থাকবে মার্কিন ব্লকে। কিন্তু ভাসানী সেটি চাননি। আওয়ামী লীগে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ সদস্যই সমর্থন করেন সোহরাওয়ার্দীর নীতিকে। ফলে ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি ১৯৫৭ সালের ২৭ জুলাই গড়েন এক নতুন দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে যেয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের সঙ্গে এক যুক্ত ইশতেহারে বলেন, স্বাধীন বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিক কমিউনিজম একটি ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে উঠেছে।
১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ হয়। ১৯৫৮ সালে সেনাপতি মোহাম্মদ আইয়ুব খান গ্রহণ করেন পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা। তিনি দেশে চালু করেন মৌলিক গণতন্ত্র। ঘটান পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইন্তেকাল করেন। জিন্নাহ আওয়ামী লীগ বলে কোনো দল আর থাকে না। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন। আওয়ামী লীগ যদিও ছিল জিন্নাহ আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা একটি দল, কিন্তু ভাসানীর পদত্যাগের পর তা কার্যত পরিচালিত হচ্ছিল সোহরাওয়ার্দীরই পরামর্শে।
এসব কথা আমি বলছি, কারণ আওয়ামী লীগ ৭০ বছর বয়সে পদার্পণ করল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে ঠিক একটা দল ছিল, তা-ও আবার নয়। এতে চলেছিল সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর দ্বৈত নেতৃত্ব। ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে ছিল না কোনো চিন্তা-চেতনার ঐক্য। আজকের আওয়ামী লীগ আর অতীতের আওয়ামী লীগকে তাই ঠিক এক করে দেখা যায় না।
আওয়ামী লীগের ইতিহাসে বহু ঘটনাকেই ব্যাখ্যা করা যথেষ্ট কঠিন। ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ইউসুফ হারুন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেন তার আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শাখা। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে করেন এই শাখার ব্যবস্থাপক। ইউসুফ হারুন এই সময় হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের প্রতি একজন খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি। জনরব, ইউসুফ হারুনের অনুদানে চলেছিল এ সময় পুরো আওয়ামী লীগ। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইউসুফ হারুনকে করেন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর। ইউসুফ হারুন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে নাকি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রস্তাব করেন, তিনি যদি আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেন, তবে আইয়ুব খান পাকিস্তানে আবার পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের প্রবর্তন করবেন। আর শেখ মুজিবুর রহমানকে করবেন তার প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু এটা হতে পারে না। কেননা, সেনাবাহিনীতে এ সময় ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিশেষ প্রভাব। তারা এটা হতে দেয় না। এসব কথা জানা যায় ভারতের স্বতন্ত্র পার্টির নেতা পিলু মোদির লিখিত Zulfi My Friend নামক বই থেকে। আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিষয়টির কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তার এই বইতে। শেখ মুজিব তার ছয় দফায় বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের কথা। কিন্তু যখন তিনি ছয় দফা রচনা করছিলেন, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি বহন করছিলেন আওয়ামী লীগের ব্যয়ভার।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর ঠিক কী চেয়েছিলেন, তা থেকে গিয়েছে এখনো যথেষ্ট রহস্যময়। কেননা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ৬ নভেম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বক্তৃতা দেন, তাতে তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান একজন মার্কিনবিরোধী ব্যক্তি নন। তাকে একসময় অনেকে বলতেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল (American Stooge)। তিনি তার এই বক্তৃতায় আরো বলেন, তিনি যদ্দূর জানেন, তাতে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যাননি। তার নামে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ভিন্ন ব্যক্তিরা। তাই শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের সমস্যার সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়নি (INDIA SPEAKS. Indira Gandhi, Government of India Publications, December 1971)।
আমার কাছে যা ব্যাখ্যা করা সবচেয়ে কঠিন মনে হয়, তা হলো শেখ মুজিবুর রহমানের সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি ল. ই ব্রেজনেভের পরামর্শে বাকশাল গঠন। একসময় বলা হতো এটা করা হয়েছিল গরিবের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এই গরিবের গণতন্ত্র কথাটা ছিল যে কত অসার, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর এখন তা কমবেশি সবাই অনুভব করতে পারছেন। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-চারজন খ্যাতিমান এমেরিটাস অধ্যাপক ছাড়া। আওয়ামী লীগের ইতিহাস জড়িয়ে পড়েছে বর্তমান বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের সাথে। বাংলাদেশের উদ্ভব বৃত্তান্তকে আওয়ামী লীগের ইতিহাস ছাড়া জানার উপায় নেই। তাই এর ইতিহাস সম্পর্কে হওয়া উচিত বিষয়গত আলোচনা।