আত্মদর্শন

অনেক সময় কারো লেখা পড়তে পড়তে পাঠকের মনে লেখকের সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা জাগে । বর্তমান পুস্তকটি পড়তে যেয়েও আমার সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা জাগতে পারে। তাই আমি আমার নিজের সম্বন্ধে দু কথা বলছি।

আজ থেকে প্রায় তিরাশি বছর আগে রাজশাহী শহরে জন্মেছিলাম আমি। আমি লেখাপড়া করেছি রাজশাহীতে স্কুলে ও কলেজে। রাজশাহী শহরের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ আমার মন মানসিকতা গঠন করেছে। রাজশাহী বড় শহর ছিল না। আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখনও এ শহরে বাঘ আসত। এই শহরের কাছে খুব ঘনঘন না হলেও শিরোইল নামক এলাকায় ছিল যথেষ্ট বন। যেখানে ছিল চিতাবাঘ। এই শহরে ছিল প্রচুর সাপ । যাদের অনেকই ছিল বিষধর। শহরের কাছেই একটা এলাকায় অনেক অজগর সাপ ছিল । যারা খরগোশ গিলে খেত। অন্যদিকে রাজশাহী শহরে ছিল একটা প্রথম শ্রেণির কলেজ। আর ছিল বরেন্দ্র মিউজিয়াম। এখানে ছিল একটা শিক্ষার পরিবেশ। যা আমাকে প্রভাবিত করেছে।

আমি বহু বিষয়ে ঘরে পড়াশোনা করে জানতে চেয়েছি। অনেক বিষয়ে ছিল আমার জানবার আগ্রহ। আমি আমার বাল্যকাল থেকেই জানতে আগ্রহি ছিলাম মানুষ সম্বন্ধে। ইচ্ছা ছিল নৃ-তত্ত্ব পড়বার। কিন্তু সেটার সুযোগ ঘটেনি। আমি ঢাকায় যেয়ে তেজগাঁ কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছিলাম কৃষিবিদ্যা । তারপর বিলাতে যাই উদ্ভিদের রোগ-ব্যারাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে । বিলাতের লিড্স শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলাম উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব। বিলাতে ছিলাম মাত্র এক বছর। তবে এই এক বছর আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। আমাকে আমার পিতা তাঁর একটি বাড়ি বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে পাঠান বিলাতে । সেটা ১৯৫৪ সালের কথা। বিলাতে আমার আরো পড়বার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি অর্থের অভাবে। পাকিস্তান সরকার মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটায় । ছাত্র হিসাবে আমি মেধাবী ছিলাম না। মানুষ হিসাবেও ছিলাম না খুব করিতকর্মা। ফিরে আসি দেশে। ঢাকায় পাট গবেষণাগারে একটি চাকরি পায়। সেখানে চাকরি করি প্রায় চার বছর।

ছেলেবেলা থেকে ফরাসী ভাষা শেখার প্রতি আমার একটা আগ্রহ ছিল। নিজের চেষ্টায় কিছু ফরাসী ভাষা শিখেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসী ভাষায় একটা সার্টিফিকেট কোর্স করেছিলাম। আমি ১৯৬০ সালে ফরাসী সরকারের দেওয়া একটা বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যাই আরো পড়াশুনা করতে । সেখানে যেয়ে অর্জন করেছিলাম পোয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবাণুতত্ত্বে ডক্টরেট। ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে চাকরি নিই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে; ১৯৬৪ সালে ১১ সেপ্টেম্বর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটানা অধ্যাপনা করেছি প্রায় বত্রিশ বছর। আমি উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ছাত্রদের পড়িয়েছি উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব । এক পর্যায়ে পড়িয়েছি জীবাণুতত্ত্ব।

বর্তমান বইতে যে বিষয় নিয়ে আমি আলোচনা করেছি তার সঙ্গে আমার অধ্যাপনার বিষয়ের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই । রাজশাহী শহরের কাছে শহর থেকে প্রায় মাইল তিনেক দূরে ছিল সাঁওতালদের গ্রাম। সাঁওতালরা বন থেকে কাঠ কেটে খড়ি করে বেচতে শহরে আসতো। সাঁওতালদের সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা হয়। আমার হাতের কাছে যে সব বই পাই, সেগুলি পড়েফেলি । আমি নৃ-তত্ত্ব বিষয়ে অনেক বই পড়ি । শেষে নৃ-তত্ত্ব নিয়ে লিখে ফেলি একটি ছোট বই। বইটি বাজারে বেশ বিক্রি হয়েছিল। এসব কথা বলছি এই জন্যে যে, আমি যদিও ছিলাম কর্ম জীবনে উদ্ভিদবিদ্যার লোক, কিন্তু বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিলাম নৃ-তত্ত্বের প্রতি আমার অবসর সময় কেটেছে নৃ-তত্ত্ব সম্পর্কে নানা জনের লেখা বই পড়ে। বর্তমান বইতে যা আলোচনা করেছি, তাতে আছে আমার এই অনানুষ্ঠানিক পড়াশুনা করে অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব।

আমি কোন প্রতিভাবান ব্যক্তি নই। কিন্তু অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তির দ্বারা আমি হয়েছি প্রভাবিত। যে সব কালজয়ী প্রতিভাবান ব্যক্তি আমাকে প্রভাবিত করেছেন তাদের মধ্যে একজন কার্ল ফন লিনে (১৭০৭-১৭৭৮)। ইনি ছিলেন সুইডিস। কিন্তু সুইডিস ভাষায় বই না লিখে, তার সময়ের পণ্ডিতদের মত বই লিখেছেন লাতিন ভাষায় লিনে (Linne) নামটা লাতিন ভাষায় হয়েছে Linnaeus| আমরা বাংলাভাষায় নামটিকে ইংরেজি বর্ণে সাধারণত লিখি লিনিয়াস লিনিয়াস চেয়েছেন সব কিছুকে তার বৈশিষ্ট্য অনুসারে শ্রেণীবদ্ধ করে আলোচনা করতে। তিনি গাছপালা ও জীবজন্তুকে শ্রেণীবদ্ধ করে আলোচনা করেছেন । শ্রেণীবদ্ধ করে আলোচনা করেছেন আকরিক বস্তুসমূহকে। আর এর জন্য তিনি হয়ে আছেন বিশেষভাবে খ্যাত।

লিনিয়াস কখনো আসেননি বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের বটগাছের নাম তিনি দিয়েছেন Ficus bengalensis| তাঁর দেওয়া বট বৃক্ষের এই নামটি আজো বিজ্ঞানী সমাজে স্বীকৃত হয়ে আছে। তাঁর দেওয়া লাতিন ভাষায় Ficus মানে ডুমুর। লিনিয়াসের দেওয়া বটগাছের নামের বাংলা করলে দাঁড়ায় বাংলাদেশের ডুমুর গাছ। বটগাছের ফল আর ডুমুরগাছের ফল দেখতে প্রায় একই। যে ডুমুরগাছ দেখেছে কিন্তু বটগাছ দেখেনি, সে ডুমুরগাছের সঙ্গে বটগাছের তুলনা করে মনের মধ্যে বটগাছ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে পারবে। মানুষ সব সময় চায় তার পরিচিত কিছুর সঙ্গে তুলনা করে অপরিচিতকে বুঝতে। লিনিয়াস পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। চিকিৎসক হিসাবে তিনি ছিলেন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু শ্রেণীবদ্ধ করে আলোচনা করবার চেষ্টা করেছেন উদ্ভিদ, প্রাণী ও আকরিক বস্তুদের। আর সে জন্যেই পেতে পেরেছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি।

লিনিয়াস তার বিখ্যাত Systema naturae (1758 ) নামক গ্রন্থে মানুষকে স্থাপন করেছেন প্রাইমেটস (Primates) বর্গে । আর মানুষের নাম রেখেছেন Homo sapiens । লাতিন ভাষায় ‘হোম’ মানে হল মানুষ। আর ‘সেপিয়েন্স’ মানে হলো জ্ঞানী। মানুষ এমন প্রাণী, যে জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা রাখে। জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। মানুষ প্রাণী কিন্তু এদিক থেকে সে হলেন অন্য প্রাণীদের থেকে স্বতন্ত্র । লিনিয়াস মানুষকে চারটি বড় প্রকারে ভাগ করেন প্রধানত গাত্রবর্ণকে নির্ভর করে। এরা হল, ইউরোপের সাদা মানুষ, এশিয়ার পিতাভ মানুষ, আফ্রিকার কৃষ্ণকায় মানুষ আর আমেরিকার লালচে মানুষ। লিনিয়াসকে ধরতে হয় নৃতত্ত্বের জনক। লিনিয়াস কেবল মানব প্রকারের কথা বলেননি, লিনিয়াস লোক-সংস্কৃতি (Folklore) সম্বন্ধে করেছেন প্রথম আলোচনা বিরাট প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন লিনিয়াস। নানা বিষয়ে কৌতূহল ছিল তার।

আমি একজন অতি সাধারণ ব্যক্তি। কিন্তু লিনিয়াসের সম্বন্ধে আমার ছিল নানা বিষয়ে কৌতুহল । সাধারণভাবে জানতে চেয়েছি অনেক কিছু । যা জেনেছি, তা নিয়ে লিখেছি জনপ্রিয় প্রবন্ধ; মূলত অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে। আমাকে কেউ শিক্ষাবিদ বললে আমি খুশি হই। কারণ, আমি চেয়েছি আমার দেশবাসীকে শিক্ষিত হতে সাহায্য করতে, আমার লেখার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে যেয়ে আমি বিভিন্ন বিষয়ের অধ্যাপকদের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পেয়েছি। তাঁদের কাছ থেকে আমি শিখবার সুযোগ পেয়েছি অনেক কিছু। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না করলে সে সুযোগ আমি পেতে পারতাম না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর পেয়েছি ১৯৯৫ সালে। যাদের সঙ্গে জন্মেছিলাম, তাদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। আমি অনেক সময় বাল্য বন্ধুদের আমার লেখা পড়তে দিতাম। জানতে চাইতাম তাদের মতামত। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। কদিন পরে আমিও মিলিয়ে যাব পঞ্চভুতে।

কোন বইতে পড়েছিলাম, Christen J. Darkenbug (1626-1772) নামে ডেনমার্কের একজন ব্যক্তি বেঁচে ছিলেন প্রায় ১৪৬ বছর। বিলাতের Henry gunkins (1501-1670) বেঁচে ছিলেন ১৬৯ বছর। এরকম দীর্ঘায়ু জীবন অতি বিরল ঘটনা। আমার বয়স এখন নব্বইয়ের কোঠায়। অসুস্থ আমি বিছানায় শুয়ে আমার কাটছে দিন। বিলাতের কবি ব্রাউনিং লিখেছেন:

Grow old along with me
The best is yet to be
The last of life
For which the fast was made.

কবি বোঝাতে চেয়েছেন, বৃদ্ধ বয়সেরও আছে একটা বিশেষ অর্থ । যেটাকে খাটো করে দেখা উচিত নয়।

কিন্তু বৃদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকাটা আমার কাছে হয়ে উঠেছে কষ্টচিত। লিনিয়াস মানুষকে চিহ্নিত করেছেন বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে। তবে বুদ্ধি থাকবার জন্যে মানুষ কতটা সুখী হতে পারে তা নিয়ে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে জাগছে প্রচুর সংশয়। মানুষ গড়েছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে হচ্ছে যুদ্ধ। সব জাতি তাদের প্রতিরক্ষা খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যকোন খাতে সে পরিমাণ নয়। অন্য প্রাণী যুদ্ধ করে না কিন্তু মানুষ যুদ্ধ করে। এক গাছে অনেক কাক বাস করে। যদি কোন কাক বৃদ্ধ বয়সে অক্ষম হয়ে পড়ে, বিশেষ করে অন্ধ হয়ে গেলে, সেই গাছের অন্য কাকরা তাকে খাদ্য এনে খাওয়ায়। কাকদের মধ্যে কোন রাষ্ট্র নেই। কিন্তু সহজাতভাবে কাজ করে চলেছে সমাজ কল্যাণের একটা ধারণা।

আমাদের পত্রিকায় এখন প্রতিদিন খবর বের হচ্ছে নারী নির্যাতনের। কিন্তু অন্য প্রাণীদের মধ্যে নারী নির্যাতনের এরকম ঘটনা ঘটে না। মেয়ে মাকড়সারা যৌন মিলনের পর, পুরুষ মাকড়সাকে খেয়ে ফেলে। কিন্তু অধিকাংশ প্রাণীর মধ্যে এরকম ঘটনা ঘটে না। অন্য প্রাণীদের মধ্যে পুরুষ তাদের নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে না। আসলে পাশবিক অত্যাচার কথাটা বলাই ভুল । পশুরা তাদের স্ত্রী জাতির উপর পাশবিক অত্যাচার করবার কোন প্রয়োজন দেখে না। অধিকাংশ প্রাণীর বাচ্চা হয় বছরের বিশেষ সময়। আর তাদের পুরুষদের যৌন উত্তেজনার সূচনা হয় বিশেষ সময়ে সারা বছর তারা থাকে যৌন প্রবণতাবিহীনভাবে । অনেক প্রাণী সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। কিন্তু তাদের সমাজ বন্ধন গড়ে ওঠে তাদের সহজাত প্রবৃত্তিকে নির্ভর করে। আমার মনে হয়, মানুষ পৃথিবীতে বিলুপ্ত হতে পারে কোন প্রাকৃতিক কারণে নয়, তার বুদ্ধির কারণেই। প্রাকৃতিক জগৎ নয়, মানুষের কাছে মানুষই হল সবচেয়ে বড় সমস্যা ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিভাগে চাকরি করেছি। উদ্ভিদজগত প্রাণীজগত থেকে ভিন্ন । বৃক্ষের নেই প্রাণীদের মতো স্নায়ুমণ্ডলী । নেই প্রাণীদের মত কোন আনন্দ ও বেদনার অনুভব৷ লিনিয়াস বলেছেন, আকরিক বস্তুরা কেবলই আছে; তাদের মধ্যে নেই প্রাণের স্পন্দন। উদ্ভিদরা জীবন্ত। কিন্তু তাদের নেই কোন অনুভব ক্ষমতা। যেমন আছে প্রাণীদের । মানুষ হল একমাত্র প্রাণী, যে কেবল অনুভব করে না; যে ভাবনা চিন্তা করে। ভাবনা চিন্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করতে চায় তার জীবনকে। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে আমি হয়ে উঠেছি যথেষ্ট সংশয়বাদী। আমার মনে হয় মানুষের বুদ্ধি, মানুষের কার্যকলাপ মানুষের বিলুপ্তি এনে দিতে পারে ।

লিনিয়াসের মত মেধার অধিকারী আমি নই। কিন্তু তাঁর দ্বারা প্রভুতভাবে ছাত্রজীবনে হয়েছি প্রভাবিত। আমার মনমানসিকতা গঠনে থেকেছে তাঁর প্রভাব। আমি বই লিখেছি চারুকলার ইতিহাস নিয়ে বই লিখেছি নৃতত্ত্ব নিয়ে বই লিখেছি গাছপালার ব্যাধি, জীবাণুতত্ত্ব ও উদ্ভিদ-রসায়ন নিয়ে আমি চারুকলার ইতিহাস নিয়ে বই লিখেছি কারণ, ছেলেবেলায় আমার ইচ্ছা ছিল চিত্রকর হবার। কিন্তু পরে উপলদ্ধি করি, আমি এর ওপর নির্ভর করে জীবন-যাপনে সক্ষম হব না। তাই ত্যাগ করি চিত্রকর হবার বাসনা । কিন্তু চারুকলার ওপর একটা আসক্তি থেকে যায়। বই লিখি চারুকলার ইতিহাস নিয়ে। মানুষ তার চারুতার সাধনায় ফুল, লতাপাতা দিয়ে নকশা রচনা করেছে। উদ্ভিদজগত মানুষের চিত্রকলায় জুড়েছে অনেক স্থান । হতে পারে এটাও আমাকে অনেক পরিমাণে উদ্ভিদজগতের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। মানুষকে স্থাপন করা হয় প্রাইমেটস বর্গে। এই বর্গের প্রাণীরা এখনও অধিকাংশই হলো বৃক্ষচারী, যারা হাত-পা দিয়ে জড়িয়ে গাছে উঠতে পারে ।

অনেককিছু ঘটতে দেখলাম আমার এক জীবনে বিরাট বৃটিশ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়লো। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো পাকিস্তান হবার সময় একটা হিসাব অনুসারে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা করে মারা যায় তিন লক্ষ মানুষ। আর কয়েক মাসের মধ্যে গৃহহীন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ । ১৯৭১ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাব অনুসারে ভারত তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে ভারত যায় প্রায় নব্বই লক্ষ মানুষ। এদের মধ্যে ৭০ লক্ষ ছিল বাংলাভাষী হিন্দু, আর ২০ লক্ষ ছিল বাংলাভাষী মুসলমান। এ সময় কত লোক মারা যায়, তা নিয়ে চলেছে বিতর্ক। আমি তার মধ্যে যেতে চাই না এখানে। আমি আমার আত্মপরিচয় দিতে যেয়ে এসব কথা বলছি। কারণ, এসব ঘটনা আমাকে প্রভাবিত করেছে বিপুলভাবে আর আমার মনে এগুলো সৃষ্টি করেছে গভীর প্রতিক্রিয়া; যা আমি লিখে ব্যক্ত করবার চেষ্টা করেছি পত্র-পত্রিকায়। কারণ আমি চাই না এরকম ভয়াবহ ঘটনার পৌনঃপুনিকতা ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ হয় না নরওয়ে ও সুইডেনের মধ্যে। নরওয়ে এক সময় ছিল ডেনমার্কের সঙ্গে যুক্ত। পরে সে যুক্ত হয় সুইডেনের সঙ্গে । নরওয়ে সুইডেন থেকে পৃথক হয়েছে ১৯০৫ সালে । কিন্তু নরওয়ে ও সুইডেনে কোন বিবাদ ঘটছে না। নরওয়ে আগে ছিল ডেনিস ভাষাভাষি কিন্তু পরে গড়েছে একটি পৃথক জাতীয় ভাষা, নিজেদের পৃথক করে তুলবারই লক্ষ্যে। ভৌগলিক এলাকা (Territory), জনসমাজ (Population), সরকার (Government) এই তিনে মিলে হল রাষ্ট্রের বাস্তবতা। যে কোন রাষ্ট্রের বিশেষতাকে বুঝতে হলে জানতে হয় তার উদ্ভবের ইতিহাস। উপলদ্ধি করতে হয় রাষ্ট্রের অন্তর্গত মানুষের মনোভাবকে আমি সেটা চেষ্টা করেছি বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আমার মনন 1 কাঠামো অন্যের কাজে আসবে কি না, আম তা জানি না। তবে আমার ধারণা সকলের না হলেও, অনেকের তা কাজে লাগবে। আমি রাজনীতির লোক নই। কিন্তু আমি জন্মেছি একটা বিশেষ জনসমষ্টির মধ্যে যাদের জাতিসত্তার সরূপ নিয়ে ভাবাটায় প্রাসঙ্গিক। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত থেকেছে আমার নিজের আত্মপরিচয়েরও প্রশ্ন। নিজেকে জানতে আমার ইচ্ছা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি না ভেবে পারিনি ।

১৯৭১ সালে আমি কলকাতা ছিলাম কিন্তু কেবলমাত্র কলকাতার মধ্যেই আমার গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল না। আমি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জেও কিছু ঘুরেছিলাম। মিশেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানদের সঙ্গে। উপলদ্ধি করেছিলাম তাদের মন মানসিকতাকে। অনেকে এই উপমহাদেশের হিন্দু মুসলীম বিরোধকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে। কিন্তু বিষয়টা অত সহজ নয়। হিন্দুরা ধনী ৷ মুসলমানরা গরীব। তাই সৃষ্টি হতে পেরেছে হিন্দু-মুসলমান সংঘাত, এরকম সিদ্ধান্তে আসা আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই সরল বুদ্ধিবাদীতা। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের একজন খ্যাতনামা নৃ-তাত্ত্বিক লিখেছেন- ‘এমন অনেক গ্রাম পশ্চিমবঙ্গে আজও আছে, সেখানকার বসতি বিন্যাসের মধ্যে বর্ণ প্রাধান্য স্পষ্টরূপে দেখা যায় । কিন্তু শ্রেণী প্রধান্য (যা শহরে দেখা যয়) বিশেষ দেখা যায় না। অস্তত শহরের মতো বসতি বিন্যাসের মধ্যে তা প্রতিফলিত নয়। একই বর্ণের ও জাতি-উপজাতির ধনী মধ্যবিত্ত-দরিদ্রের বাস এক অঞ্চলে। পরিস্কার বোঝা যায়, জাতি বর্ণ ও সম্প্রদায়ের (হিন্দু-মুসলমান) সামাজিক দূরত্ব আধুনিক শ্রেণী দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি দুস্তর…….. ।’ (বিনয় ঘোষ; বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব। পৃষ্ঠা-৭১। বইটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে ১৯৭৯ খৃস্টাব্দে।)

বিনয় ঘোষ তাঁর বইতে পশ্চিমবাংলার পটুয়া ও পটশিল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন। পটুয়াদের জীবিকার উপায় হল, পট আঁকা ও মানুষকে তা দেখিয়ে গান করে কাহিনী বলা । পটের ছবির সাথে তাদের গান ও কাহীনির থাকে যোগসূত্র। পটুয়ারা এক অদ্ভুত সম্প্রদায়। এরা নামাজ পড়ে আবার বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর পূজাও করে। এরা মৃত দেহ কবর দেয়। কিন্তু কবর দেবার আগে আবার তাদের মুখাগ্নীও করে। অর্থাৎ মুখে দেয় আগুনের ছোয়া । এরা পৃথক গ্রাম গড়ে বাস করে। এবং এদের ছেলে মেয়ের বিয়ে হয় কেবল নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে। বিনয় ঘোষ লিখেছেন- পটুয়ারা এখন হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি বাদ দিয়ে হতে চাচ্ছে খাটি মুসলমান। তিনি অনুসন্ধান করে জেনেছেন, পটুয়াদের এই মনোভাব পরিবর্তনের কারণ হল ইসলামী রীতিনীতি অনুসরণ করবার ফলে তারা প্রবিবেশী অন্য মুসলিম সমাজের কাছে থেকে পেতে পারে অনেক সদয় ব্যবহার। পটুয়ারা তাদের বলেছে হিন্দু হলে, তাদের বিবেচনা করা হয় অতি নিম্নবর্ণের হিন্দু হিসাবে। তাদের ধরা হয় অস্পৃশ্য। তারা হিন্দুদের কাছ থেকে পায় না কোন ‘মানুষের মত ব্যবহার। পক্ষান্তরে মুসলমান হলে তাদের মুসলমান সমাজে অচ্ছুত ভাবা হয় না। তারা পেতে পারে অনেক মানবিক ব্যবহার (দ্রষ্টব্য: বিনয় ঘোষের বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব, পৃষ্ঠা-১১৮)। আমি পটুয়াদের কথা বিশেষভাবে বলছি, কারণ বাংলাদেশের শিল্পী কামরুল হাসান এদেশের চিত্রশিল্পীদের উপদেশ দিয়েছিলেন, পটুয়া হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে। তার মতে শিল্পীদের পটুয়া পরিচয় হবে অনেক বেশি বাঙালি। বাংলাদেশে এখন আর পটুয়া সম্প্রদায় নেই। কিন্তু এক সময় নিশ্চয় ছিল । ঢাকার পটুয়াটুলী এলাকা যার স্মৃতি বহন করছে। বাংলাভাষায় ‘টুলি’ শব্দটা এসেছে হিন্দি টোলি শব্দ থেকে । হিন্দিতে টোলি শব্দের অর্থ হল পল্লী। পটুয়াটলী মানে হল, পটুয়াদের পল্লী । পটুয়ারা এক সময় সারা বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলেই ছিল ছড়িয়ে ছিটিছে। বিনয় ঘোষের মতে পটুয়াদের চিত্রকলায় আছে মুসলিম ক্যালিওগ্রাফীর দৃঢ় ও বলবান তুলির রেখা বিস্তারের প্রভাব।

কথায় কথায় অনেক কথা এসে পড়ছে। কামরুল হাসান সাহেব কেবল একজন শিল্পীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন, আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের একজন গোড়া ভক্ত । তিনি ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এঁকেছিলেন একটি কার্টুন । যা এখনো যথেষ্ট খ্যাত হয়ে আছে। আমি কামরুল হাসান সাহেবকে যথেষ্ট ভালভাবে চিনতাম। তার সঙ্গে আমার ছিল ঘনিষ্ঠ পরিচয়। ঐ কার্টুনটিকে কার্টুন হিসাবে আমার কাছে খুব উন্নতমানের মনে হয়নি। তিনি চারুকলার চাইতে কারুকলার ক্ষেত্রে দিয়েছেন অনেক বেশি কৃতির পরিচয় । আমি তার দৃষ্টিতে ইয়াহিয়াকে বিচার করতে চাইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তানের সৃষ্ট সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান । তিনি সাবেক পাকিস্তানে চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা । তাই তিনি করতে সক্ষম হয়েছিলেন ১৯৭০ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন ।

আমি ঢাকা ছেড়েছি অনেকদিন। ঢাকার বুদ্ধিজীবী সমাজের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই । আমি পত্র-পত্রিকায় লিখি একজন ফ্রিল্যান্স (Free-lance) হিসাবে। কিন্তু ঢাকার একটি প্রকাশনী সংস্থা ‘বুকমাস্টার’ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার বর্তমান বইটি ছাপিয়ে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। এদের সে আমার কোন পরিচয় ছিল না। আর এখনও যে আছে, তা নয়। এরা যে আমার মত একজন অপরিচিত ব্যক্তির বইটি ছাপাচ্ছেন, সে জন্যে আমি এদের জানায় আন্তরিক ধন্যবাদ । ভাল প্রকাশকরা বই প্রকাশ করে লেখকদের প্রকাশিত করেন । ভাল প্রকাশকরা সমৃদ্ধ করে তোলেন একটা দেশের লেখার জগতকে।

(লেখাটি  ‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’ নামক বই থেকে নেয়া যা পরিলেখ প্রকাশনী থেকে ২০১৩ সালে ছাপা হয়। পরবর্তীতে লেখাটি একটি নোটসহ ছাপা হয় বাছবিচার নামক ওয়েবজিনে। )

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ