রাজশাহীর একজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী আমাকে একবার রসিকতা করে সাবধান করে দিয়েছিলেন এই বলে, খবরদার ভুল করে সামাদ সাহেবের সাথে তর্ক করতে যেও না। কারণ, তার ঠোঁটের ওপরে যুক্তি রাখাই থাকে। আমার সেই সময় বয়স কম ছিল, বিদ্যাবুদ্ধি আরো কম থাকার কারণে সেই মন্তব্যের অর্থ বুঝতে পারিনি। কিন্তু তার সদ্য প্রকাশিত ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ বইটি পড়ে এবার সেই সাবধান বাণীর মর্মার্থ কিছুটা বুঝতে পারলাম। এবনে গোলাম সামাদকে আমাদের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর মধ্যে সাধারণ কাতারে ফেলে বিচার করলে ভুল করা হবে। কারণ, কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কোনোকালেও তার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এটা ঠিক তিনি একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষ। সারা জীবন লেখাপড়ার মধ্যেই রাজশাহীর মতো মফস্বল শহরে কাটিয়ে দিলেন। তার অধীত বিদ্যার বহরের সাথে আমাদের কোনো বুদ্ধিজীবীর তুলনা করা চলে না। আমার যত দূর মনে পড়ে, একবার কবি আল্লামা ইকবাল-সংক্রান্ত আলোচনা সভায় এত গভীর আলোচনা করছিলেন, সেটা শুনে তখন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক।
যা হোক, এবার তার সদ্য প্রকাশিত বইটির বিষয়ে আসা যাক। বইটিতে এবনে গোলাম সামাদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাস বিস্মৃতির কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনে বারবার গুরুতর বিপর্যয় নেমে এসেছে। আমরা বরাবরই বিপরীত তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়েছি। কিন্তু এবনে গোলাম সামাদ সাহেব যখন বলেন- ‘অনেক বইতে লেখা হচ্ছে সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কেবল ধর্মছাড়া আর কোনো কিছুরই ঐক্য ছিল না। কিন্তু এ কথা সর্বোতভাবে সত্য নয়। সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আরো একটি দিক থেকে ঐক্য ছিল। সেই ঐক্য হলো ভারতীয় আধিপত্যবাদ ভীতি। জিয়া এটা উপলব্ধি করেই বর্তমান পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন (পৃষ্ঠা-।’
কিংবা ধরা যাক- ‘কেবল গণতন্ত্রের অভাবে বাংলাদেশেই যে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটতে পেরেছে, তা নয়। তবে এক দলের রাজত্ব না গড়লে শেখ মুজিব অতটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন বলে মনে হয় না এবং তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানো হতো যথেষ্ট কঠিন, এ রকমই মনে হয়, বাইরে থেকে দেখে আমাদের অনেকের কাছে (পৃষ্ঠা-১৭৫)।’ এবনে গোলাম সামাদ-এর কয়েকটি মন্তব্য আমাদের ভাবায়। কারণ এ রকম মন্তব্য আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখনোই করেননি। এ রকম চমকপ্রদ বিশ্লেষণ এই গ্রন্থের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। প্রায় ৩৯ পরিচ্ছেদের মাধ্যমে বইটির অবয়ব গড়ে উঠেছে। এর প্রতিটিতে রয়েছে এবনে গোলাম সামাদের অসামান্য জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, যে কেউ এই গ্রন্থ পাঠে নতুন চিন্তায় উদ্দীপ্ত হতে পারবেন। গ্রন্থকার এ দেশের ইতিহাস চর্চার মধ্যে আমাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে চেয়েছেন। বলা বাহুল্য, এ এক কঠিন তপস্যা। লেখক বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে সেই পথেই অগ্রসর হয়ে এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই কারণে কেবল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তৎকালীন অখণ্ড ভারতবর্ষের রাজনীতি ও অবস্থার পর্যালোচনা করেছেন। তবে আনন্দের খবর হলো, এই পরিচ্ছদগুলো পড়তে পড়তে আমার কখনো মনে হয়নি আমি ইতিহাস পড়ছি। এবনে গোলাম সামাদের ঝরঝরে সুবোধ্য গদ্য ক্রমেই টেনে নিয়ে যায়। গ্রন্থকার হিসেবে তিনি আলাদা এই কৃতিত্বের জন্য ধন্যবাদ পাবেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই গ্রন্থে তিনি এমন অনেক মন্তব্য করেছেন, যেগুলো কালের কষ্টিপাথরে সত্য কি না। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এই অভিযোগ প্রতিটি ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ সম্বন্ধেই খাটে। তবে এ কথা সত্য, এই গ্রন্থকারের বয়স বর্তমানে ৮৬ বছর। কারণ গত শতাব্দীর তিন শ্রেণীর শাসনব্যবস্থা তিনি দেখেছেন। তাদের ভালোমন্দের বিচার বিশ্লেষণ করেছেন, তবুও আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমাদের বেশ কিছু সাবধান বাণীও দিয়েছেন। তিনি তার চোখে দেখা ঘটনার সাথে অতীত-বর্তমানকে এক মোহনায় মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।
লেখক গ্রন্থের এক জায়গায় স্বীকার করেছেন- ‘মানুষের চিন্তা চেতনা গড়ে উঠে তার জীবনের অভিজ্ঞতাকে নির্ভর করে।’(সূত্র : লেখক পরিচয়) আবার এটাও ঠিক, এবনে গোলাম সামাদের অনেক মতামতের সাথে পাঠক একমত পোষণ নাও করতে পারেন। কিন্তু তার মন্তব্যের আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করবে। যে আন্তরিকতার পেছনে রয়েছে নির্ভেজাল দেশপ্রেম। আর বইটি লিখেছেন তার অর্জিত জ্ঞানকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই।
আপাতত অল্প পরিসরে এই মূল্যবান বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা গেল না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বইটা পড়ে ইতিহাসের সত্য উদ্ধারে পাঠকের লাভ বৈ তি হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। তিনি ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে সত্যের কাছাকাছি আসার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এই রকম গ্রন্থ তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই প্রত্যাশা আমাদের খানিকটা পূরণ হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।
লিখেছেন খুরশীদ আলম বাবু, লেখাটি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে, দৈনিক নয়া দিগন্তে।