আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ। সম্প্রতি তিনি ইন্তিকাল করেছেন-ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এই প্রবাদ পুরুষের ইন্তিকালে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে; তিরোধান ঘঠেছে এক নক্ষত্রের। আমরা জাতির একজন অবিভাবককে হারিয়েছি। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা সহজেই পূরুণীয় নয়। জাতির এই কর্মধারকে আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
যা হোক আমি মরহুম এবনে গোলাম সামাদ লেখার একজন গুণমুক্ত পাঠক। তার কোন লেখা সামনে পেলেই তা আমি পড়ে নিতে বিলম্ব করতাম না। সঙ্গত কারণই দীর্ঘদিন থেকেই এই দার্শনিকের সাথে স্বাক্ষাতের ইচ্ছা কাজ করছিল আমার মধ্যে। কিন্তু কোন ভাবেই তা হয়ে ওঠেনি। ফলে আমার মধ্যে একটা অতৃপ্তিই কাজ করছিল দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু সেই সুযোগটা এসে গিয়েছিল ২০১৬ সালের শেষ দিকে অনেকটা অযাচিতভাবেই। এক শীতের রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহী ছুটে গিয়েছিলাম এই কিংবদন্তীতুল্য দার্শনিক লেখকের সাথে দেখা করতে। তার সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি দেখভাল করেছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রসেফর ড. মাহফুজুর রহমান আকন্দ। তিনি এ বিষয়ে আমাকে বেশ সহযোগিতা করেছিলেন। যেহেতু রাজশাহী শহর আমার কাছে খুব পরিচিত ছিল না তাই তিনি আমার জন্য একজন গাইডের ব্যবস্থাও করেছিলেন। তিনি আমাকে এ কাজে খুবই আন্তরিকতার সাথে সাহায্য করেছিলেন। ফলে আমার রাজশাহী সফর বেশ প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছিল।
স্যারের সাথে সাক্ষাতের সময় হয়েছিল পড়ন্ত বিকেলে। ঠিক আসর নামাজের আগ মহুর্তে আমি ও আমার গাইড তার বাসায় পৌঁছেছিলাম। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর সেখানে আমরা আসরের নামাজ আদায় করেছি। এরপর তার সাথে আমার শুরু হয়েছিল দীর্ঘ কথোপকথন; প্রাণবন্ত আলোচনা। আলোচনা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তার মেধা, মনন ও মনীষার সম্যক পরিচয়। সেখানে স্থান পেয়েছিল বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী। গণমাধ্যম, সাংবাদিকতার সমস্যা, সম্ভবনা ও সঙ্কট নিয়ে আলোচনা হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়েও তিনি তার পান্ডিত্যপূর্ণ মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। আমাদের মূল্যবোধের চর্চা ও অবক্ষয় নিয়ে তাকে বেশ চিন্তিত মনে হয়েছে। তাকে বেশ ইতিহাস সচেতনও মনে হয়েছে আমার কাছে।
দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার বিভিন্ন দিক ওঠে এসেছে তার আলোচনায়। যা এসব বিষয়াদি সম্পর্কে আমার ভুল ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে সহায়ক হয়েছিল। তিনি চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আমাকে সম্যক ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা, সমকালীন রাজনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, নীতিশাস্ত্র, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ধর্ম ও ধর্মতত্ত¡, ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার সাথে দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে তিনি তার জ্ঞানের ভান্ডার থেকে অবলীলায় দ্যোতি ছড়াচ্ছিলেন। আমি তার কাছে একজন বিমুগ্ধ শ্রোতা। তিনি তার প্রত্যেকটি কথায় দার্শনিক যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন। যা আমাকে বিমোহিত করেছিল। তার দর্শন আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিতও করেছে।
ইতোমধ্যেই অনেক সময় পেড়িয়ে গেছে। রাজশাহী মহানগরীর চারদিক থেকে তখন মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভাসতে শুরু করেছে। কিন্তু তার সাথে কথা শেষ করতে মন কোন ভাবেই সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতেই হলো। সেখানেই মাগরিবের নামাজ আদায় করে বিদায়ের সময় এই তার কাছে সবিনয়ে জানতে চাইলাম, ‘স্যার ! আমিও লেখালেখির চেষ্টা করি। এ বিষয়ে আমাকে কিছু পরমর্শ দিন’। তিনি সপ্রতিভভাবেই জবাব দিয়ে বললেন, ‘যে বিষয়ে লিখতে চান, আগে নিজেই জানুন সে বিষয়ে আপনি কী জানেন বা আরও কি কি জানা দরকার’। তার এই তাৎক্ষণিক ও পান্ডিত্যপূর্ণ জবাবের কোন উত্তর না দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি যে কত উচ্চমানের দার্শনিক তার এই কথায় তার যথার্থ প্রমাণ।
মূলত, মানুষ মাত্রই কম-বেশী ভাবুক বা চিন্তাশীল। মানুষ চিন্তা করতে পারে বলেই প্রকৃতির লীলাখেলায় সংশয় ও বিস্ময় প্রকাশ করে। যা মানুষের স্বভাবজাত। মানুষ কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় গোটা প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতির মাঝে লুকায়িত রহস্য ও চরম সত্যকে। এই সামগ্রিক সত্যকে জানার আগ্রহ বা প্রচেষ্টা হলো দর্শন। আর এ সত্যকে জানার কাজে যিনি ব্যাপৃত থকেন তিনি দার্শনিক। জগত ও জীবনকে জানতে গিয়ে এবং জগত ও জীবনের আড়ালের রহস্যকে উদঘাটন করতে যেয়ে দর্শন জ্ঞানের তত্ত¡গত অনুসন্ধান চালায়। মূলত দর্শন হলো জ্ঞানের তত্ত¡গত অনুসন্ধান যাকে সত্যের অনুসন্ধানও বলা যায়। আর একজন দার্শনিকের যা যা গুণ থাকা দরকার এবনে গোলাম সামাদের মধ্যেই সবকিছুই আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
দর্শন বলতে যা বোঝায় তার পথচলা শুরু হয়েছে সুপ্রাচীনকালে গ্রীক নগর রাষ্ট্র এথেন্সে। স্বাধীন ও যুক্তিযুক্ত জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী কিছু ব্যক্তি যখন গ্রীক নগর রাষ্ট্রের প্রচলিত পৌরাণিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিযুক্ত কথা বলতে শুরু করেন তখন তারা স্বাধীন ও যুক্তিযুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীকে নতুন পথের সন্ধান দেন। এক্ষেত্রে যুগশ্রষ্টা হিসাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জনক মহামতি সক্রেটিসের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি তৎকালীন পৌরাণিক বিশ্বাসকে মেনে না নিয়ে, স্বাধীন চিন্তার দ্বারা নতুন সত্যে উপনীত হন এবং তা যুব স¤প্রদায়ের মধ্যে প্রচার করতে শুরু করেন। ফলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। তিনি জীবন দিয়ে নিজ উপলব্ধি জাত সত্যকে রক্ষা করে দর্শন তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথচলার শুভ সূচনা করেন। যুক্তিযুক্ত সত্যের প্রতি তার আমৃত্যু আস্থা পরবর্তী জ্ঞানপিপাসুদের যুক্তি ও সত্যের পথ অনুসন্ধানে প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি যে সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন তার প্রিয় শিষ্য প্লেটো সেগুলোকে প্রচার করেন।
পরবর্তিতে প্লেটোর অন্যতম শিষ্য এরিস্টটলের হাতে পড়ে সেগুলি আরও বিকশিত হয়ে সমৃদ্ধ দর্শনের রূপ লাভ করে। পরবর্তীকালে অসংখ্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের নতুন নতুন চিন্তা বা মতবাদ দর্শন প্রবাহে যুক্ত হয়ে মানুষের সত্যানুসন্ধানের অদম্য কৌতূহল পূরণে সচেষ্ট থেকেছে। কখনো-কখনো কোন দার্শনিক মত যেমন কোন রাষ্ট্র বা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তেমন যুগের পরিবর্তনে অনেক প্রতিষ্ঠিত মতও নতুন মতের কাছে হার মেনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আমার মনে হয় এবনে গোলাম সামাদও নিজেকে একজন কালজয়ী দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার দর্শন মুক্তচিন্তার মানুষগুলোকে আন্দোলিত ও সমকালীন জীবনধারাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য তিনিও মহল বিশেষের বিরাগ হয়েছেন। হয়তো তাকে সক্রেটিসের মত জীবন দিতে হয়নি। কিন্তু তিনি যেভাবে মূল্যায়িত হবার কথা সেভাবে মূল্যায়িতও হননি। আর এ ব্যর্থতা তার নয় বরং এটি একটি জাতীয় ব্যর্থতা।
আমি যখন মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র তখন থেকেই ‘এবনে গোলাম সামাদ’ নামের সাথে পরিচিত হই। তিনি তখন একটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখতেন। তার লেখার একজন সমঝদার পাঠক হিসেবে আমি তার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। এই বিদগ্ধ পন্ডিতের লেখার মর্ম উপলব্ধি করার মত যোগ্যতা না থাকলেও লেখাগুলো পড়তাম খুব মনোযোগ দিয়ে; বেশ যতœ সহকারে। হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। কিন্তু যতটুকু বুঝতাম তা-ই আমাকে তার লেখা পড়বার জন্য প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরতো। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করার অনুসঙ্গও থাকতো। কিন্তু এই মনিষীর পান্ডিত্য, সততা, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, দেশাত্ব ও জাতীয়তাবোধ এবং গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে সেই দৈনিকে তার লেখার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকেনি। কেন থাকেনি তা আমার কাছে অজানায় রয়ে গেছে। বিষয়টি আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছে। কারণ, আমি বঞ্চিত হয়েছি তার ক্ষুরধার লেখনীর কল্যাণ থেকে।
যাহোক দীর্ঘ বিরতির পর তাকে আবারও একটি জাতীয় দৈনিকে নিয়োমিত কলাম লেখক হিসেবে পেয়ে যাই। ততদিনে আমিও লেখালেখিতে হাঁটিহাঁটি পা পা করে পথচলা শুরু করেছি। তাও আবার একই পত্রিকায়। সৌভাগ্যক্রমে প্রতি শনিবার ছিল আমাদের লেখার সিডিউল। এই মহীরূহের সাথে একই দিনে লেখা প্রকাশ হওয়ায় আমি শুধু পুলকিতই হয়নি বরং লাভবানও হয়েছি। যেহেতু তিনি পাঠক প্রিয় লেখক এবং তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বিমুগ্ধ পাঠকরা প্রতি শনিবারের জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষা করতেন, তাই একই দিনে সিডিউল থাকায় অন্তত আমার নামের পরিচিতিতে তা অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। এই প্রাপ্তিকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই বরং এটিকে বড় পাওয়াই মনে করি আমি।
লেখালেখিতে আমি এখনও শিক্ষানবীশ। কিন্তু আমার পথচলায় যেসব গুণী লেখকদেরকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করে এসেছি এবনে গোলাম সামাদ তার অন্যতম। কারণ, তার পান্ডিত্য ও ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর তিনি তার লেখনির মাধ্যমে ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা। আমি তার সকল লেখায় বেশ মনোযোগ সহকারে এবং খুব গুরুত্বে দিয়ে পড়তাম; এখনও পড়ি। যতই পড়তাম ততই আমার অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পেত। মোহাবিষ্ট করতো আমাকে। তার ক্ষুরধার ও পান্ডিত্যপূর্ণ লেখনীতে থাকতো বিশাল তথ্যভান্ডার। এবনে গোলাম সামাদের মেধা, মনন, মনীষা, চিন্তা-চেতনা, দর্শন, প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্য আমার জীবনকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছে। যা আমার চলার পথে পাথেয় হিসেবে অনেকটাই সহায়ক হয়েছে। আমার লেখক স্বত্ত¡ার গতিপথকেও পরিবর্তন করে দিয়েছে। যা কখনো বিস্মৃত হওয়া যায় না; হবার নয়।
এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতায় এই প্রবাদপ্রতীম মনিষী আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার অগণিত সৃজনশীল সৃষ্টি কর্ম। যা জাতি হিসাবে আমাদের প্রেরণার উৎস। আল্লাহ তায়লা মরহুমকে উত্তম পুরুস্কারের পুরস্কৃত করুন-আমীন!
এবনে গোলাম সামাদ সংক্রান্ত এই স্মৃতিচারণটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, একটি অনলাইন পোর্টালে। লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা।