সম্ভবতঃ কয়েক প্রকার এক-কোষী প্রাণী ছাড়া, যৌন-জীবন সবারই আছে। কি অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে জীবন আর যৌন জীবন এত জটিল ব্যাপার নয়। এর কারণ অন্যান্য প্রাণীরা ঠিক মানুষের মত এত সমাজবদ্ধ নয়। তাছাড়া, মানুষের যৌন-জীবন অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক ব্যাপক। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে যৌন মিলনের একটা মরশুম রয়েছে। বছরের বিশেষ সময়ে ওরা অনুভব করে যৌন মিলনের তাগিদ। কিন্তু মানুষ যৌন মিলনের প্রয়োজন অনুভব করে সব সময়ে। অবশ্য এই তফাৎটা যে, মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের এক মৌলিক পার্থক্য ঘোষণা করে, এমন নয়। কারণ বন্য জন্তুদের ক্ষেত্রে যৌন মিলনের কালমাত্রা নির্দিষ্ট থাকলেও গৃহপালিত জীবের ক্ষেত্রে দেখা যায় যৌন মিলনের ব্যাপক স্পৃহা। তাদের আচরণ হয়ে উঠে অনেক পরিমাণে মানুষেরই মত। তাই যৌন আচরণকে বলা চলে বিশেষ ভাবেই আবেষ্টনী-নির্ভর। মানুষ এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের যৌন আচরণের ধারা বদলায়; কারণ, তার জীবনধারা বদলায়। আজকের ইউরোপের যৌন জীবনের যে চেহারা, ঠিক ক’দিন আগেও তা ছিল না। যদিও বা যৌন মিলন মানুষের ক্ষেত্রে চিরদিনের সত্য।
আধুনিক ইউরোপের যৌন-জীবনে যে জিনিসটি বিশেষভাবে চোখে পড়ে তা’হল যৌন আচরণের ক্ষেত্রে মেয়েদের বেপরোয়া ভাব। মেয়েরা আজ পুরুষের মতই হয়ে উঠেছে যৌন জীবনের দাবীদার। যৌন-জীবনটা তাই পশ্চিমী সভ্যতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে হয়ে উঠেছে সপ্রকাশ। ইউরোপে যৌন আচরণের ধারা পাল্টে গিয়েছে, বিশেষ ভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে। এক সময় পশ্চিম ইউরোপের মেয়েরাও ছিল পুরোপুরি স্বামী-নির্ভর। পুরুষ-শাসিত সমাজে মেয়েদের কোন স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে। যৌন জীবনেও ছিল না এর ব্যাতিক্রম। সাধারণভাবে ভাবা হত, বিবাহের আগে মেয়েদের থাকতে হতে অক্ষতযোনি। বিয়ের পর তাকে থাকতে হবে স্বামীর সাথে বিশেষভাবে বাধা। স্বামী ছাড়া জীবনে সে জানবে না আর কোন অন্য পুরুষকে। কিন্তু পুরুষের কথা আলাদা। পুরুষ সাধারণ ভাবেই বহুগামী। তার এ আচরণ অবশ্য প্রশংসার নয়। কিন্তু তবু সহ্য করা চলে। সমাজে একদল মেয়েমানুষের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে আলাদা ভাবে যাদের দেখা হয় সমাজ-জীবনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অমঙ্গল রূপে। গণিকা প্রথা সভ্যতার মতই প্রাচীন।
কিন্তু কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতা ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে গণিকারা পায়নি কোন সামাজিক সম্মান। পুরুষের বাড়তি যৌন দাবীকে সহ্য করেছে সমাজ। কিন্তু মেয়েদের বেলায় এ-ক্ষেত্রে কোন সহনশীলতার পরিচয় দেয়নি সমাজ। পুরুষের ক্ষেত্রে বহুগামীতাকে যতনা হেয় চক্ষে দেখেছে সমাজ, মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখেছে তার চাইতে অনেক বেশী। ফরাসী দেশের আইন ছিল, যদি কারও স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে মিলিত হয়, তবে স্বামী যে কেবল বিবাহ বিচ্ছেদ দাবী করতে পারবেন এমন নয়; বরং তার সন্মানহানির জন্যে তিনি দাবী করতে পারবেন তার ভূতপূর্ব স্ত্রীর তিন মাস থেকে দু বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কিন্তু পুরুষ যদি কোন মেয়েমানুষকে তার যৌন প্রয়োজনের জন্যে রাখে তবে স্ত্রী পারবেন কেবল বিবাহ বিচ্ছেদ ও মাত্র কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবী করতে।
কার্যক্ষেত্রে মেয়েরা এ আইনকেও যে কাজে লাগাতে পারত এমন নয়। কারণ, স্বামীবিহীনভাবে মেয়েদের পক্ষে সেদিন বাঁচা ছিল প্রায় অসম্ভব। মেয়েরা সব সহ্য করত। ক্ষমার মন নিয়ে নয়,স্রেফ বেঁচে থাকবার জন্যে রুটির প্রয়োজনে। এই বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে অনেক কম বয়সের মেয়েকে বিয়ে করতে হ’ত অনেক বেশী বয়সের পুরুষকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ভোগ করতে হত অকাল বৈধব্য। জীবন কাটাতে হ’ত এক করুণ নিঃসংগতায়-এ-জীবনের অনেক খানিই আজ হয়ে পড়েছে অতীতের ঘটনা।
ছেলে-মেয়ের বিয়ের বয়সের ব্যবধান আজ গিয়েছে কমে। দু’জনের আয়ে সংসার চালান সহজ বলে ছেলে-মেয়েরা আজ বিয়ে করছে কম বয়সে। এবং করছে অনেক পছন্দের পর। আর এই পছন্দ কেবল মাত্র মানের নয়, শরীর ও মনের দুই। শারীরিক প্রেম আজ সমাজে মেয়েদের ক্ষেত্রেও হয়ে উঠেছে বিশেষ প্রকাশ্য সত্য। বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাও অবশ্য অনেক বেড়েছে। কিন্তু এই বাড়বার কারণ স্রেফ যৌন-জীবনের ধারার পরিবর্তনের নয়। এই পরিবর্তনের কারণ, মেয়েরা আজ আর কেবলমাত্র স্বামীর রুটি-নির্ভর নয়। শুধু জীবিকার প্রয়োজনে কোন মানুষের সাথে আটকা থাকতে চায় না আজ অধিকাংশ মেয়ে।
অন্যদিকে সাধারণ ভাবেই যৌন-জীবন সম্পর্কে ঘটেছে মানুষের ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন। ফ্রয়েড আজ অনুপ্রবেশ করেছেন সাধারণ ভাবে ইউরোপের জন-চেতনায়। মানুষ আজ ভাবে, যৌনতৃষ্ণা মেটার মধ্যে কোন অকল্যাণ নেই। অকল্যাণ থাকে অবস মনের মধ্যে। এক সময় মেয়েরা শিক্ষা পেত, আসংগ পিপাসা, ভদ্রমেয়ের কাম্য নয়। ফলে একটা বিরাট সংখ্যক মেয়ে শেষ অবধি ভূগত কাম-তুষারত বা ফ্রিজিডিটিতে মেয়েরা এক সময় শিক্ষা পেত ও মেনে নিত যে, কামাতুষারতা সুরুচিবান মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক। দেহের দাবীটা ইতর বা ভালাগার। কিন্তু আজ এ-ধারণা ভেঙ্গেছে। মেয়েরা অস্বীকার করতে রাজি নয় তাদের শারীরিক প্রয়োজন। এ-বিষয় পুরুষের মতই সচেতন হয়ে উঠেছে তারা। দাবী করছে তাদের সমান অধিকার। শারীরিক প্রেমটাকে তারা ছোট, হেয় করে দেখতে চায় না আর। যৌন-জীবন মানুষের চিরকাল ছিল। ছিল যৌন বিলাসের ইচ্ছাও। কিন্তু এটা ছিল প্রধানতঃ পুরুষকে ঘিরে। কিন্তু আজ এ-ব্যাপারে পশ্চিমের দেশগুলোতে মেয়েরাও হয়ে উঠেছে অগ্রণী।
এক সময় গীর্জা মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে ইউরোপে। গীর্জার প্রভাবে যৌন জীবনকে হেয় আর রহস্যময় ভাবতে চাইত লোকে। কিন্তু আজ গীর্জার প্রভাবও কমেছে। মানুষ সেক্সকে গ্রহণ করতে চায় এক সহজ জৈবিক সত্য হিসাবে। কোন লজ্জাজনক বাস্তবতা হিসাবে নয়। যৌন ব্যাধি আজ সারে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ আজ সহজসাধ্য। অতিকায় নগর-কেন্দ্রীক জীবনে মানুষ আজ একে অপরের অচেনা। এই অচেনা জীবনে কুংসার ভয় অল্প। অনেক সহজ এমনিতেই অবাধ জীবন।
অনেকে মনে করেন, এটা ভাল হচ্ছে না। এর ফলে ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হবে বিবাহ ব্যবস্থা। পরিবার বন্ধন। মানব শিশু হবে তার অতি প্রয়োজনীয় মাতা-পিতার সাহায্য ও আশ্রয় থেকে বঞ্চিত। সে বেড়ে উঠবে এক হৃদয়হীন যান্ত্রিক পরিবেশে-পেশাদার শিশু পালকদের হাতে। ফলে, সমাজ জীবনে নেমে আসবে এক সার্বজনীন হৃদয়হীন সুখবাদী মনোভাব। আজো মানুষের জীবনে অতীত বিশ্বাসের প্রভাব অনেকখানি টিকে আছে। আর তাই এখনো সৃষ্টি হচ্ছে না ব্যাপক সামাজিক সঙ্কট। কিন্তু এ সঙ্কট অনিবার্য ভাবে দেখা দেবে আগামীতে।
ঠিক এমনটি ঘটবে কিনা বলা যায় না। অনেক আদিম সমাজে পরিবার প্রথা শিথীল নয়। সন্তান প্রতিপালনে এ-সব সমাজে দেখায় না কোন শৈথিল্য। কিন্তু যৌন জীবনের ক্ষেত্র এ-সব সমাজের মানুষ অনেক আলগা। উৎসবের দিনে এরা যৌন আচরণে হয়ে উঠে বিশেষ ভাবেই মুক্ত। এরা এ-সময় সেক্সকে দেখে নিছক আনন্দের উপকরণ হিসাবে,-বংশ রক্ষার উপায় হিসাবে নয়। মানুষ, পশ্চিমে আবার সেক্স-কে কেবল মাত্র বংশ রক্ষার উপায় হিসাবে না দেখে, উপভোগ করতে চাইছে এর আনন্দ-মূল্যকে। এ যেন এক নব্য আদিমতা।
সিকানদার আবু জাফর (সম্পাদিত), সমকাল, অষ্টম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, আশ্বিন, ১৩৭১ (১৯৬৩ ইং)।