প্রকাশের কৈফিয়তঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭২ সালের ১9-২১ আগষ্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে সেখানকার শেরে বাংলা ফজলুল হক মিলনায়তনে তিনদিন ব্যাপী একটি সভার আয়োজন করা হয়। সভাতে সনতকুমার সাহা, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, গোলাম মুরশিদ, সালাহউদ্দিন আহমদ, খান সরওয়ার মুরশিদ, আলি আনোয়ারসহ অনেকের সাথে বক্তব্য রাখেন এবনে গোলাম সামাদ। তখনও বাংলাদেশের সংবিধান মুসাবিদা করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা না থাকা নিয়েই এই বিতর্কের আয়োজন করা হয়, পরে সেটি কিতাব হিসেবে প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি, ১৯৭৩ সালে। পরে আবার বইটি পুনরায় ছাপে বিডিনিউজ২৪ এর প্রকাশনা সংস্থা বিপিএল থেকে। উক্ত আলোচনা সভায় এবনে গোলাম সামাদ একটি বক্তৃতা ও এবং একটি সম্পূরক মন্তব্য করেন। বক্তৃতাটি এখানে উঠিয়ে দেয়া হল।
[ভূমিকাঃ আমি যে বিষয় বেছে নিয়েছিলাম সে হচ্ছে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তার আগে একটা কথা বলে নিতে চাই। যারা একটা ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে ঐ ভিত্তিতে বৈবাহিক সম্পর্ক ও অন্যান্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে, নৃবিজ্ঞানের ভাষায় endogamous unit তৈরী হয়। যেখানেই এই জাতীয় অন্তর্বিবাহমূলক একক গড়ে ওঠে সেখানেই দেখা যায় ধর্ম নিয়ে কলহ হচ্ছে। এটা কিন্তু শুধু ধর্মীয় কলহ নয়, এটা হচ্ছে দুটো সমাজের দু’রকম প্যাটার্ন। এটা মনে না রাখলে ধর্ম-নিরপেক্ষতার প্রকৃত তাৎপর্যটা আমরা বুঝতে পারবো না। আমাদের বুঝতে হবে কেন আকাশবাণী থেকে এখনও শ্যামা সংগীত শুনতে পাই যদিও ভারত ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতের পক্ষে এটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবপর নয়, কারণ, তার জনসাধারণের একটা অংশ শ্যামা সংগীত শুনতে অভ্যস্ত এবং সেটা ভারতের সংস্কৃতির অঙ্গ। তেমনি আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জন মুসলমান, তাঁরা একটা বিশেষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে বিশ্বাস করেন। তাই আমরা যদি রাতারাতি তুড়ি মেরে বলি যে ‘খোদা হাফেজ’ বলা বা কোরান পাঠ থাকবে না, তবে সে দৃষ্টিভঙ্গী আর যাই হোক ঐতিহাসিক হবে না।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ রাজনীতিক ব্যাপার। ভারত আমাদের সাহায্য করেছে এবং আমরা ভারত থেকে সাহায্য নিয়েছি- সেটাকে রাজনীতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এবং এটাও সত্য যে ভারতের সাথে আমাদের একটা ঐতিহাসিক যোগাযোগ আছে এবং সম্প্রীতি আছে- সেটাকেও আমরা অস্বীকার করব না। তবে সবকিছু নিয়ে মাতামাতি করতে হবে এটা নয়। শেখ সাহেবের অসুস্থতায় আমরা তার জন্য প্রার্থনা করেছি। তার ছবি নিয়ে আমি ডিবেট করছি না, কারো কারো খারাপ লাগতে পারে কিন্তু কিছু দিন আগে ‘যুগান্তরে’ দেখলাম চব্বিশ পরগণা জেলার বহু মুসলমান বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছেন। কথা হচ্ছে, আমরা যে সংস্কৃতির মধ্যে মানুষ হয়েছি এত সহজে যে তাকে কাটিয়ে উঠতে পারব এমন নয়। সম্প্রদায় আছে বলেই সাম্প্রদায়িকতা আছে। এই সম্প্রদায়ের পেছনেও দীর্ঘ ইতিহাস আছে আমি যে সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মেছি তাকে বাঁচিয়ে রাখবার আমার একটা দায়িত্ব আছ। আমাকে এটুকু বলে নিতে হল।]
বিষয় আভাষঃ আমাকে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সংসদ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে কিছু লিখতে অনুরোধ করা হয়, আমি কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিতি দেশের ইতিহাস পড়তে আরম্ভ করি। আমার উদ্দেশ্য ছিল এসব দেশের ইতিহাসকে বুঝে দেখতে চেষ্টা করা এবং এদের সাথে তূলনামূলকভাবে বাঙলাদেশের কথা বিচার করে দেখা। বাঙলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আরো আছে। তাই যারা আগে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়েছে তাদের আলোচনা থেকে আমাদের অনেক প্রশ্নের বাস্তব উত্তর লাভ সহজ। সব ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবার মত জ্ঞান আমার নাই। আমি এই প্রবন্ধে আমেরিকা, ফ্রান্স, তুর্কী ও ভারতের কথা আলোচনা করবো ও তারপর কিছু মন্তব্য করবো বাঙলাদেশ সম্পর্কে। আমি প্রসঙ্গটি বিচার করে দেখতে চাইব, প্রধানত বাস্তব ইতিহাসের পক্ষ থেকে- বিশেষ অধিবিদ্যার (Metaphysics) দৃষ্টিকোন থেকে নয়। বাঙলা ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষ কথাটা গ্রহণ করা হয়েছে সেকিউল্যারিজম- এর প্রতিশব্দ হিসাবে। ১৮৫৬ সালের পর থেকে ইংরাজি ভাষায় সেকিউল্যারিজম বলতে অনেক সময় বোঝান হয়ে থাকে জর্জ জ্যাকব হোলিওক (George Jacob Holyowke) – এর মতবাদকে। হোলিওক ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) তিনি মনে করতেন, বিধাতা থাকতেও পারেন, নাও পারেন, পরকাল থাকতেও পারে, নাও পারে। এসব তর্ক করা যায়। কিন্তু মাটির পৃথিবী আর বুকে মানুষের প্রাণ যাত্রা প্রত্যক্ষ সত্য। তার যথার্থতা সম্পর্কে কোন তর্ক তোলার অবকাশ থাকেনা। তার অস্তিত্ব প্রাত্যহিক বাস্তব সত্য। তাই আমাদের সকল কর্মের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এই পার্থিব জীবনের কল্যাণ। মানুষের উচিৎ ঐহিক জীবনে সুখী হবার চেষ্টা করা ও অন্যকে সুখী হতে সাহায্য করা। যদি পরকাল বলে কিছু থাকে তবে মানুষ তার ইহকাল ভাল কাজ করবার জন্য পরকালে পুরষ্কৃত হবে। আর পরকাল বলে যদি কোন কিছু না থাকে তবে তাতেও ক্ষতি হবে না। কারণ মানুষ যদি এই জীবনে সুখী হয়, তবে তাই হবে তার পক্ষে এক পরম লাভ। পরকালের প্রতি তাকিয়ে থাকবার জন্য তাকে ইহ জগতের সুখ থেকে বঞ্চিত হতে হবে না। হোলিওক মনে করতেন, মানুষ যত কারণে অসুখী হয়, তার মধ্যে দারিদ্র্য প্রধান। মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক কর্মের তাই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এমন গড়তে সাহায্য করা যেখানে মানুষ তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে না। কেউ গরীব হতে পারবে না। আমি ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদ বলতে হোলিওকের বিশেষ মতবাদকে বুঝছি না। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে আমি বুঝেছি এমন সব রাষ্ট্রের কথা যাদের ক্ষেত্রে সরকারী ধর্ম বলতে কিছু নেই। আত্মা, পরকাল, ইশ্বর ইত্যাদি প্রসঙ্গে আমি কোন আলোচনার অবতীর্ণ হব না। কারণ, আমার বক্তব্যকে তুলে ধরবার জন্য এসব বিষয়কে টেনে আনবার প্রয়োজন হবে না।
১। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আমেরিকাঃ
আমেরিকার সংবিধানে কোন ধর্মকে সরকারী ধর্ম বলে ঘোষনা করা হয় না। বরং বলা হয় ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে থাকতে হবে নিরপেক্ষ। কারণ এই পথেই সম্ভব বিভিন্ন প্রকার খৃষ্টীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ এড়িয়ে যাওয়া। আমেরিকানদের মনে ছিল ইউরোপের ধর্মীয় বিবাদের স্মৃতি। তারা চেয়েছিল, আমেরিকার নতুন মাটিতে এই ধরণের কলহকে টেনে না আনতে। তা ছাড়া আমেরিকা হলো প্রজাতন্ত্র। কোন রাজা থাকলো না। থাকল না সামন্তবাদী সমাজ কাঠামো। রাজারা চিরকালই বলেছেন, রাজ্য শাসনের ক্ষমতা তাঁরা পেয়্যেছেন কোন না কোন প্রকার দৈব শক্তির কাছ থেকে। জনসাধারণকে শাসন করবার তাঁদের আছে পবিত্র অধিকার। কিন্তু আমেরিকায় এই অধিকারের দাবী তুলবার কোন কারণ থাকলো না। ঠিক হল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিধাতা কর্তৃক নির্বাচিত হবেন না, বা কোন পবিত্র অধিকার বলে দেশকে পরিচালিত করবেন না। তিনি হবেন গণনির্বাচিত আর জনগণের সম্মতিই হবে তাঁর শক্তির উৎস।
আমেরিকার সংবিধানে সকল ধর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই স্বাধীনতা কোন চূড়ান্ত অর্থে স্বাধীনতা নয়। আমেরিকার সংবিধানে বলে হয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে কিন্তু ধর্মে জননিরাপত্তার ও সাধারন চেতনার পরিপন্থী হওয়া চলবে না। আমেরিকার আইন অনুসারে “Any religious practice that is contrary to public peace or morality may be outlawed, such as snake handling or polygamy”* অর্থাৎ আমেরিকায় ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে যা খুশী তাই করা চলে না।
আমেরিকার বিভিন্ন মতালম্বী খৃষ্টানরা ইউরোপ থেকে নিগে বসতি করে ছিল। কিন্তু ১৮৩০ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি আমেরিকায় উদ্ভব ঘটে এক নতুন খৃষ্টীয় সম্প্রদায়ের। এরা নিজেদের বলে মরমন (Mormon)। মরমনরা বলে, যেহেতু একমাত্র হজরত ইসা ছাড়া আর সব নবী একসাথে একাধিক বিবাহ করেছেন, তাই বহু বিবাহ অন্যায় নয়। বহু বিবাহ সম্পর্কে মরমনদের মতের জন্য আমেরিকায় কথা ওঠে মরমন সম্প্রদায়কে বেআইনী করবার। মরমনরা শেষে তাঁদের বহু বিবাহ সম্পর্কে মতবাদকে পরিত্যাগ করেন। মরমন-রা বলেন বলেন বহুবিবাহ তাঁদের একমাত্র বক্তব্য নয়, লক্ষ্যও নয়।
আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে একাধিক মামলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্র করে। আমেরিকার সংবিধানের ছয় ধারার (Article VI) বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় চাকুরীর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য কার কাছ থেকে ধর্মীয় ব্যাপারে কোন প্রশ্নের উত্তর চাওয়া চলবে না: “No religion test shall ever be required as qualification to any office or public trust under United States” ১৯৬১ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলা আসে। মামলাকারী অভিযোগ করেন যে, আমেরিকার মেরিল্যান্ড রাষ্ট্রে সরকারী চাকুরিতে যোগ দেবার সময় বিধাতার নামে শপথ নিতে হয়। এর ফলে যাঁরা কোন ধর্ম মতে বিশ্বাস করেন না এবং মনে করেন, মানুষের নৈতিক জীবনের জন্য ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োজন নাই তাঁদের বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করা হয়। এই প্রথা মার্কিন যুক্তরাষত্রের সংবিধানের পরিপন্থী। আদালত মামলাকারীর পক্ষে রায় দেন। ফলে এ ধরণের শপথ নেওয়ার প্রথার অবসান ঘটে।
আমেরিকার অনেক সরকারী স্কুলে আগে ক্লাশ আরম্ভ হবার আগে প্রার্থনা করা হত। ১৯৬২ সালে একজন সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন যে, এ ধরণের প্রার্থনা ও বাইবেল পাঠ মার্কিন সংবিধানের পরিপন্থী। তিনি মামলায় জয়লাভ করেন। ফলে সরকারী স্কুলগুলোতে প্রার্থনা করা ও বাইবেল পাঠ উঠিয়ে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ আমেরিকার আদালতের রায় অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ দাঁড়িয়েছে ব্যাপক, ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ কেবল ধর্ম বিশ্বাসীদের স্বাধীনতা নয়, ধর্মে অবিশ্বাসীদেরও স্বাধীনতা। যদি না, এই স্বাধীনতা জননিরাপত্তার ও সাধারণ নৈতিক বিধির পরিপন্থী হয়।
২। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ফ্রান্সঃ
ফরাসী বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে গীর্জায় সমস্ত সম্পত্তিকে রাষ্ট্রয়াত্ত করে নেওয়া হয় এবং যাজকদের মাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় রাষ্ট্র থেকে। এর ফলে ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চ হয়ে পড়ে ফরাসী রাষ্ট্রের অধীন, পোপের ক্ষমতা লোপ পায়। কিন্তু রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের যোগ ঘুচে যায় না। ক্যাথলিকবাদ ফ্রান্সের সরকারী ধর্ম হয়েই থাকে। ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯০৫ সালে। ফ্রান্সের র্যাডিকাল দল এ সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলে। এ সময়ে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মরিস রুভিয়ে (Morice Rouvier)| ফরাসী র্যাডিক্যালরা ছিলেন ভয়ঙ্করভাবে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করবার পেছনে তাঁদের যুক্তি ছিলঃ রাষ্ট্রের টাকা ধর্মের পেছনে ব্যয় না করে জনহিতকর কাজে ব্যয় করা উচিত। রাষ্ট্র কর্তৃক কোন বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের লোককে সমর্থন করার অর্থ অন্যদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন থেকে বঞ্চিত করা। তাঁদের আপন মত প্রচারের সমান সুযোগ না দেওয়া। অর্থাৎ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা। ফরাসী দেশের রাষ্ট্রীক দর্শনের মূলনীতি হচ্ছে তিনটিঃ সমতা, সখ্যতা ও স্বাধীনতা। এই নীতিকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হলে রাষ্ট্র কোন একটা বিশেষ ধর্মমতকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারেনা, কোন একটি বিশেষ ধর্মমতকে সরকারী ধর্মমত হিসাবে গ্রহণ করতে পারে না।
ফ্রান্স এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু ক্যাথলিকবাদ ফরাসী জীবনে এখনও গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। তা তাঁর সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে নানাভাবে। অবশ্য বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি পারিবারিক ব্যাপারে রাষ্ট্রিক আইনই এখন কার্যকর, ধর্মীয় আইন নয়।
৩। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র তুর্কীঃ
তুর্কী একসময় ছিল বিশেষভাবেই ধর্মীয় রাষ্ট্র। তুর্কীত সুলতান নিজেকে দাবী করতেন, সারা মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে। ইসলামের রক্ষক হিসাবে। কামাল আতাতুর্ক ১৯২১ সালে ক্ষমতায় আসবার পর তুর্কীকে পরিণত করেন একটি প্রজাতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে। তুর্কীকে যদি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হয় তবে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না। আধুনিক জীবনের উপযোগী আইন কানুন রচনা করতে হবে। তাই রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের আইনকে হতে হবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে – সনাতন ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োজনে নয়। কামাল তাঁর এ- সময়কার একটি বক্তৃতায় বলেনঃ ‘যা মরে গেছে, তাকে সুন্দর সিল্কের চাদর জড়িয়ে লাভ নেই- জীবন মানে এগিয়ে চলা।; কামালের নীতি সারা মুসলীম বিশ্বের উপর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। সর্বত্র মুসলিম বিশ্বে আধুনিক-মনা অংশ কামালকে স্বাগত করন, কিন্তু সনাতনপন্থীরা করেন তাঁর নিন্দা। বাঙালী মুসলিম সমাজেও এর প্রতিক্রিয়া হয়ে ছিল। তুর্কীতে বিবাহ, সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার আইন, মেয়েদের স্বাধীনতা ইত্যাদি ব্যাপারে আইন প্রণয়ন সম্ভব হয়েছে, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করতে পারবার ফলে।
অবশ্য তুর্কীর দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ করে গ্রাম্য জীবনে মোল্লা ও ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব বিশেষভাবেই থেকে গিয়েছে। কামালের পর তুরষ্কের ক্ষমতা লাভ করেন কামালের সহযোগী ইউমানু। এর পর ক্ষমতা লাভ করেন আদনান মেন্দারেস। মেন্দারেস জনসাধারণের ধর্মীয় চেতনাকে নিজের পক্ষে এনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চান। কিন্তু মেন্দারের শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। তুরষ্কের আধুনিকমনা সংস্কৃতিবান সম্প্রদায় তাঁর উপর হয়ে উঠেন বিরূপ।
৪। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতঃ
ভারতের ইতিহাস আমাদের সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা শেষ হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর। এই সংবিধানে জনসাধারণকে অনেকগুলি মৌলিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি। এবং বলা হয়েছে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত হবে ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকারের কথা বলা হয়েছে, এই স্বাধীনতা জননিরাপত্তা, জনসাস্থ্য ও নৈতিক চেতনার পরিপন্থী হতে পারবে না। আমেরিকার সাথে ভারতের সংবিধানের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ভারতের পার্লামেন্টের উপর কোন প্রাধান্য নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ভারতের সুপ্রীম কোর্ট আইন সভাকৃত প্রণীত কোন আইনকে বাতিল করতে পারে না। তাই যে কোন বিষয় ভারতের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের আইনগত মূল্যকে খুব বেশি বলা যায় না। স্বাধীনতা লাভের পর গত পঁচিশ বছরে ভারত কি পরিমাণ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পেরেছে, আমি সে বিষয় বিস্তারিত আলোচনার মধ্যে যাব না। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করবার মত। ভারতের রাষ্ট্রীক আইন ধর্মীয় কারণ এখনও সব নাগরিকের জন্য একরকম হতে পারছে না। উদাহরণ, ভারতের উত্তরাধিকার আইন (Succession Act) প্রণয়নে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসৃত হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমানের জন্য এক আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া বিবাহ ও পরিবার প্রথা সম্পর্কেও এক আইন প্রণয়ন করা যায়নি। ভারতে হিন্দুরা এখন আর বহুবিবাহ করতে পারেন না। কিন্তু মুসলমানরা পারেন।
৫ । ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে বাঙলাদেশঃ
বাঙলাদেশকে, বর্তমান সরকার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এই রাষ্ট্রের সংবিধান এখনও রচিত হয়নি। কিছু দিনের মধ্যেই হবে। সংবিধানের কাঠামো ঠিক কি হবে, সে সম্পর্কে আমি কোন জল্পনা করতে পারি না। আমি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নই।
তবে একটা কথা আমার মনে হয়, আমাদের দেশেও সকল ধর্মের স্বাধীনতা কথাটিকে মেনে নেওয়া হবে কতগুলি বিশেষ শর্তে। এ ক্ষেত্রেও থাকবে বিধিনিষেধ। যেমন আছে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে। বাঙলাদেশে সরকারী ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। ধর্মের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু সেই স্বাধীন জননিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও দেশের সাধারন নীতিচেতনার পরিপন্থী হতে পারবে না।
মানুষকে নিয়েই রাষ্ট্র। মানুষের মনোভাবের প্রতিফলনই রাষ্ট্রিক আইনের মধ্যে। নীতিচেতনা মানুষের চিরকাল এক থাকেনি। মানুষের এ ব্যাপারে ধারনা বদলেছে। নতুন আইন হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষও তাঁর আপন আশা আকাঙ্ক্ষা ও নীতিচেতনাকে কেন্দ্র করেই চলবে। বাঙলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ হলে নীতিবিহীন হবে, এমন নয়। যেমন হয়নি অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পর্যালোচনা করে আমি এই স্বীদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি।