পত্রিকার খবর পড়ে জানলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা হয়েছে ইতিহাস বিকৃতির। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মতো অনেকের মনে জাগছে অনেক প্রশ্ন। সব দেশেই ইতিহাস নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। তাদের ইতিহাস গবেষণা ও চর্চার ক্ষেত্রে থাকা উচিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে ধরা উচিত গণতন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশ যদি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে থাকে তবে এই গণতান্ত্রিক অধিকারে হস-ক্ষেপ করতে যাওয়া সমীচীন বলে বিবেচনা পেতে পারে না। একটা দেশের আদালত খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে আদালতকে টেনে আনলে তা সৃষ্টি করতে পারে প্রভূত সমস্যা। সেটা একটা জাতির জীবনে বাঞ্ছিত হতে পারে না।
কয়েক বছর আগের ঘটনা, ভারতে কলকাতা হাইকোর্টে কলকাতার ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট এর জন্য কয়েকজন খ্যাতনামা ঐতিহাসিককে নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেন। এবং তাদের কাছে জানতে চান কলকাতা শহরের ইতিহাস। এসব ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা বলেন, জব চার্নব কলকাতায় কুঠিবাড়ি স্থাপনের আগেই সেখানে ছিল হাটবাজার ও বর্ধিষ্ণু জনপদ। এখানে বাস করত অনেক আর্মানি খ্রিষ্টান ব্যবসায়ী। জব চার্নব তাই কলকাতাকে বেছে নিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপনের জন্য। আর্মানি খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেয়েছিল যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় কুঠি স্থাপন না করলেও এখানে গড়ে উঠতে পারত বিশেষ ব্যবসায় কেন্দ্র। তাই বলা চলে না, জব চার্নব কলকাতা শহরের জনক। যদিও কলকাতা শহর গড়ে ওঠার পেছনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবদান খুবই বিদিত। ইংরেজরা ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দে চেয়েছিল তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপন করতে। কিন্তু নৌযুদ্ধে ইংরেজরা পর্তুগিজদের সাথে সে সময় এঁটে উঠতে পারেনি। চট্টগ্রাম থেকে যায় পর্তুগিজদের অনুকূলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় কুঠি স্থাপন করে ১৬৯০ সালের কাছাকাছি। কলকাতা হাইকোর্ট তাই রায় দেন, কলকাতা শহরের জন্মদিন হিসেবে কোনো বিশেষ দিবস পালন করা যাবে না। তাদের এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা ওঠেনি। কারণ আদালত বিশিষ্ট ঐতিহাসিককে নির্ভর করে প্রদান করেন তাদের রায়।
আমাদের দেশে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে হাইকোর্টে অভিযোগ উঠেছে। আমাদের হাইকোর্ট কিভাবে এর বিচার করবেন সেটা আমরা বলে দিতে পারি না। তবে মনে হয় কলকাতা হাইকোর্টের বিচার এ ক্ষেত্রে কিছুটা নজির হতে পারে। আমাদের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির যেই অভিযোগ উঠেছে সেটা তাদের ইচ্ছাকৃত না প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব সেটা বিচার্য হতে হবে। তারা যা বলেছেন, সেটা তাদের জ্ঞানের অভাবজনিত কারণে ঘটে থাকতে পারে। আসলে ১৯৭১ সালে প্রকৃতই কী ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমরা চেষ্টা করেও তথ্য সংগ্রহ করতে যে পারছি তা নয়। যেসব তথ্য পাচ্ছি তাদের সমন্বয়ে ইতিহাসের একটা সমন্বিত চিত্র এখনো পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক তথ্যই মনে হচ্ছে পরস্পরবিরোধী। যেমন ভারতের তদানীন-ন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬ নভেম্বর ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক শহরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় তিনি বলেন, তিনি যত দূর জানেন, শেখ মুজিব নিজে এখন পর্যন- বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা প্রদান করেননি। শেখ মুজিবকে মুক্ত করে তার সাথে আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি শানি-পূর্ণ সমাধান তাই এখনো অসম্ভব নয়। বলা হচ্ছে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক। যারা এর বিপক্ষে কিছু বলবেন, ধরতে হবে তারা ইতিহাস বিকৃত করছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সত্য হলে বলতে হবে তাদের বক্তব্য ইতিহাস বিকৃতির নিদর্শন নয়। ইন্দিরা গান্ধী সে সময়ের ঘটনা সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত ছিলেন। এই বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী আরো বলেন, শেখ মুজিব মার্কিন-বিরোধী নন। তাই শেখ মুজিবের সাথে সহযোগিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হতে পারে। ইন্দিরা গান্ধীর এই বক্তৃতাটি সঙ্কলিত হয়েছে ‘India Speaks’ নামক বইয়ে। বইটি সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের প্রচার দফতর থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে।
শেখ মুজিব ব্যক্তিগতভাবে কী চেয়েছিলেন সেটা অনুমান করা যথেষ্ট কঠিন। শেখ মুজিব পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে যান। পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সরাসরি বাংলাদেশে আসেননি। তিনি কেন লন্ডনে গিয়েছিলেন সেটা যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। লন্ডনে তিনি বিলাতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি কেন এই সাক্ষাৎকারকে প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন আমরা তা জানি না। সাংবাদিক অ্যানথোনি ম্যাসকারেনহ্যাস তার বহুল পঠিত Bangladesh, A Legacy of Blood বইয়ে বলেছেন- শেখ মুজিব তাকে লন্ডনে বলেন, তিনি (শেখ মুজিব) পাকিস্তানের সাথে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছেন না। তিনি পাকিস্তানের সাথে বিশেষ ধরনের সম্পর্ক (Some link) রাখার পক্ষে। এই বিশেষ ধরনের সম্পর্ক কী হবে সেটা তিনি ঠিক করবেন বাংলাদেশে যাওয়ার পর। তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করবেন তার দলের আর সব নেতার সাথে। তারপর তিনি এই বিষয়ে গ্রহণ করবেন সিদ্ধান-। ম্যাসকারেনহ্যাস সত্যি হলে বলতে হবে শেখ মুজিব চাননি পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে। বরং চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সাথে একটা বিশেষ রকমের সম্পর্ক বজায় রাখতে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের সাথে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন সব সম্পর্কের বিচ্ছেদ। মার্কিন পত্রপত্রিকায় এ সময় খবর বেরিয়েছিল যে, বাংলাদেশ চাচ্ছে পাকিস্তানের সাথে একটা বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখতে। শেখ মুজিব দেশে ফেরার পর তার সাথে নানা বিষয়ে তাজউদ্দীনের গুরুতর মতপার্থক্য হতে দেখা যায়। তাজউদ্দীনের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে অভিযোগ ওঠে যে, তিনি (তাজউদ্দীন) হলেন ভারতের চর। তিনি ভারতের সাথে এমন সব গোপন চুক্তি করেছেন, যা বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী। শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে বাদ দেন তার মন্ত্রিসভা থেকে। তাজউদ্দীন ভারতে গিয়ে গড়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। এতে শেখ মুজিবের কত দূর সম্মতি ছিল তা বলা যায় না। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়ে আছে যথেষ্ট কষ্টসাপেক্ষ। এ বিষয়ে ইতিহাস লিখতে গিয়ে অনেকেই করতে পারেন ভুল। কিন্তু এই ভুলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় না। ধরতে হয়, না জানার কারণেই এই ভুল ঘটতে পারছে।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান মোশতাকের পর ক্ষমতায় আসেন। জিয়াউর রহমান যখন দিল্লি সফরে যান তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজি দেশাই। ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিলম সঞ্জীব রেড্ডি। ভারতের প্রেসিডেন্ট রেড্ডি দিল্লি বিমানবন্দরে জিয়াউর রহমানকে স্বাগত জানান। তিনি তার স্বাগত ভাষণে জিয়াউর রহমানকে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশর স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। ভারতের প্রেসিডেন্টের এই উক্তিকে সত্যি বলে ধরলে জিয়াকে বলতে হয় স্বাধীনতার ঘোষক। আমাদের কোনো ঐতিহাসিক যদি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে চান, তাকে বলা যাবে না অপরাধী। কারণ ভারতের প্রেসিডেন্ট একজন খুবই নির্ভরজনক ব্যক্তি। অবশ্য তার বক্তব্যেও ভুল থাকা সম্ভব। ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে আমাদের অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তার বিচার করতে হলে ইন্দিরা গান্ধীর এবং ভারতের প্রেসিডেন্টের দেয়া ভাষণকে বিবেচনায় নিতে হবে। আদালত কী রায় দেবেন আমরা সে বিষয়ে কোনো অনুমান করতে চাই না। কিন’ বাইরে রাজপথে অনেক কিছুই ঘটছে।
আমরা ১২ মার্চ দেখলাম খালেদা জিয়ার ডাকে বিপুল জনসমাগম ঘটতে। বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসতে পারে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে সেই সরকার নিঃসন্দেহে জিয়াকে আবার ঘোষণা করবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তখন আর বজায় থাকবে না। এটা সহজেই অনুমান করা চলে। ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে যে মামলা উঠেছে সেটা না ওঠা ছিল ভালো। এতে দেশবাসীর মনে সৃষ্টি হতে পারছে নানা বিভ্রান্তি।
এই লেখাটি শেষ হওয়ার পর জানতে পারলাম অধ্যাপকদের বিপক্ষে যে মামলাটি করা হয়েছিল সেটি খারিজ করে দেয়া হয়েছে। খবরটি জেনে খুব খুশি হলাম। একসময় আমিও অধ্যাপক ছিলাম আর তাই অধ্যাপকদের এভাবে বিচার করা আমার কাছে মনে হচ্ছিল খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। সর্বোপরি এসব অধ্যাপক এমন কিছু লেখেননি যা ইতিহাসের খুবই বরখেলাপ। আমি আমার লেখায় যা প্রমাণ করতে চেয়েছি, তাই হয়তো এই লেখাটির এখনো কিছু মূল্য আছে।