ধর্মের ইতিহাস লেখকরা আলোচনার সুবিধার জন্য সাধারণত ধর্মকে তিন ভাগে ভাগ করেন। এক সময় মানুষ বহু দেবদেবীর পূজা করত। বহু দেবদেবীর পূজা করাকে বলা হয় পলিথেইজম (Polytheism) বা বহুদেবতাবাদ। এর পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায় অনেক দেবদেবীর পূজার সাথে সব চাইতে বড় দেবতায় বা সর্বময় শক্তিতে বিশ্বাস। ধর্মের এই অবস্থাকে বলা হয় হেনথেইজম (Henotheism) বা একেশ্বর ও বহু-দেবতাবাদ। ধর্মের শেষ পর্যায়কে বলা হয় মনোথেইজম (Monotheism) বা একেশ্বরবাদ। আরবরা ছিল কার্যত হেনথেইট (Henotheist)। এরা সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বিশ্বাস করত আবার অনেক দেবদেবীতেও আস্থা রাখত। যেমন মক্কার লোকে মনে করত আল্লাহর আছে তিন কন্যা : আল-লাত, আল-উজ্জা ও আল-মানত। আল-মানতকে ভাবা হতো আল্লাহর সব চাইতে প্রিয় কন্যা ও বহু শক্তির অধিকারিণী। তাকে নিয়ে অনেক প্রাচীন আরবি কবিতা লেখা হয়েছে। ভাগ্যদেবী মানতের নামে আরবরা অনেক কিছু মানত করতে। এ ছাড়া আরবদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ছিল আরও নানান দেবতা। পৃথক পৃথক দেবদেবীর মাহাত্ম্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আরবগোষ্ঠীর মধ্যে চলত সতত কলহ। তবে মক্কার কাবা মন্দিরের ওপর সকলেরই শ্রদ্ধা ছিল। এখানে তারা বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে বছরে একবার করে তীর্থ করতে আসত। কাবা মন্দিরে রক্ষিত কাল পাথরকে (হাজারে আসওয়াদ) ভক্তি করত সকলেই।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরবদের মধ্যে একেশ্বরবাদ প্রচার করেন। এই একেশ্বরবাদের ফলে বহু দেবতার ধারণা বাদ পড়ে। অনেক দেবতার জায়গায় একেশ্বরবাদের নামে আরবরা পায় বিশেষ ঐক্যপ্রেরণা। এই একতার বলে বলিয়ান হয়ে ও নতুন ধর্মের আশাবাদে উদীপ্ত হয়ে, আরবরা পরিণত হয় একটি শক্তিশালী সামরিক জাতিতে। তারা তাদের আবাসভূমি আরব উপদ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রেরণা পায় দিগ-বিজয়ের নেশায়। হজরত মুহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর (৬৩২ খ্রি.) পঁচিশ বছরের মধ্যে আরবরা সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া (ইরাক), মিশর ও পারস্য (ইরান) জয় করে। একশ বছরের মধ্যে আরবরা সমস্ত উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, আরমানিয়া, মধ্য-এশিয়া ও সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চল জয় করে বিরাট আরব-মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। আরবরা কোনো বিরাট সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী ছিল না। কিন্তু এই সমস্ত অঞ্চল জয়ের মধ্যে দিয়ে তারা প্রাচীন ঐশ্বর্যময় সভ্যতাসমূহের সংস্পর্শে আসে। আরবরা এসব সভ্যতার দানগুলোকে স্বীকার করেনিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনায় সুউন্নত হয়ে ওঠে।
আরবরা যেখানেই গিয়েছে, তাদের ধর্মের সাথে তাদের ভাষা ও আরবি অক্ষর সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। ফলে মুসলিম-আরব সাম্রাজ্যের একটা বিরাট অংশ হয়ে উঠে প্রায়-আরব। এ ছাড়া যেহেতু বহুবিবাহ ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, তাই নানা জাতির মেয়েকে বিবাহ করেছে আরবরা একসাথে। ফলে আরবের ধর্মের সাথে সাথে প্রসার ঘটেছে আরব রক্তের। তাই ইরাক থেকে আরম্ভ করে মরক্কো পর্যন্ত লোকে এখন নিজেদের আরব বলে মনে করে। এটা সম্ভব হয়েছে ইসলাম ধর্ম, আরবি ভাষা ও রক্তের বিস্তারের ফলে। পারসিক আর তুর্কিরা যদিও এভাবে আরব বনে যায়নি, তবু তাদের ওপর পড়ে আরবি ভাষা ও অক্ষরের বিরাট প্রভাব। আরবদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষয়ের সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতা এসেছে তুর্কিদের হাতে। অটোমান তুর্কিরা প্রায় গোটা আরব অঞ্চলকেই তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পেরেছে। এই রাজনৈতিক ইতিহাসের ঐক্য ইসলামী শিল্পকলার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো গড়ে উঠবার ব্যাপারে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
আরব যাযাবরদের মধ্যে দলপতির মৃত্যু হলে তার জায়গায় যোগ্যতম ব্যক্তিকে সকলের স্বীকৃতি অনুসারে নেতা নির্বাচন করবার প্রথা প্রচলিত ছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.) চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর মুসলমানদের নেতা হবেন তিনি, যাঁকে সকলে নির্বাচিত করবে, যাকে সকলে মানতে চাইবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা বাস্তবে কার্যকরী হতে পারেনি। খলিফা বা নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন কার্যত বংশগত। খলিফার ছেলে অথবা ভ্রাতৃষ্পুত্র হয়েছেন খলিফা। শেষে দেখা দিয়েছে রাজতন্ত্র। পরে খলিফাদের ক্ষমতা গিয়েছে বিশেষভাবে কমে। শাসনক্ষমতা চলে গিয়েছে বিভিন্ন শাসনকর্তার হাতে। দেখা দিয়েছে একাধিক রাজতন্ত্র। যারা খলিফার ক্ষমতাকে স্বীকার করেছে নামে মাত্র। যাকে আমরা ইসলামী শিল্পকলা বলি, তা গড়ে উঠেছে প্রধানত খলিফা, সুলতান, আমীর প্রভৃতি শাসককুলের পৃষ্ঠপোষকতায়।
হজরত মুহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর পর আবুবকর (রা.) খলিফা হন। আবুবকর-এর পরে খলিফা নির্বাচিত হন হজরত উমর (রা.)। উমর (রা.)-কে খুন করা হয়। উমরের পর খলিফা নির্বাচিত হন হজরত ওসমান (রা.)। তাকেও খুন করা হয়। হজরত ওসমানের পর খলিফা হন হজরত আলী (রা.) এবং তিনিও নিহত হন।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দু’টি বড় বিভাগ আছে: সুন্নি ও শিয়া। হজরত ওসমানকে খলিফা নির্বাচনের সময় অনেকেরই এই নির্বাচন মনঃপূত হয় না। অনেকেই চেয়েছিলেন হজরত আলী খলিফা হন। আলী ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের পুত্র। দাদার মৃত্যুর পর নবী এই চাচার কাছে প্রতিপালিত হন। হজরত আলী ছিলেন নবীর খুবই প্রিয়। পরে আলীর সাথে নবী তাঁর প্রিয় কন্যা ফাতেমার বিবাহ দেন। অনেকেই মনে করতেন আলী ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যত ভালো জানেন অন্য আর কেউ তা জানেন না। সব কথা, সব জ্ঞান ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আলী ছিলেন হজরত মুহাম্মদের (সা.) নিকট-সান্নিধ্যে তাই নবীর কাছ থেকে তিনি জেনেছেন ধর্মের গুঢ় তত্ত্ব, মর্মজ্ঞান। আলীর কাছ থেকে এই মর্মজ্ঞান পাওয়া সম্ভব তার সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের। তাই আলী ও তার বংশধরদের মধ্যে থেকেই একমাত্র হওয়া উচিত খলিফা।
মুয়াবিয়া ছিলেন সিরিয়া প্রদেশের শাসনকর্তা। খলিফা ওসমান (রা.) তাঁকে এই পদ দান করেন। মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন একজন বিচক্ষণ শাসনকর্তা। মুয়াবিয়া সম্পর্কে হতেন খলিফা ওসমানের (রা.) ভাগিনেয়। তিনি ওসমান হত্যায় খুবই ক্ষুব্ধ হন। হজরত আলীর পর মুয়াবিয়া কৌশলে যুদ্ধে জয়লাভ করে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন খলিফা পদে। খেলাফত এরপর থেকে হয়ে ওঠে বংশগত। মুয়াবিয়া যে খলিফা বংশ প্রতিষ্ঠা করেন তাকে বলা হয় উমাইয়া। মুয়াবিয়া ও তাঁর বংশধররা ছিলেন ঘোরতর আরববাদী। আরব ছাড়া অন্য মুসলমানদের তারা বলতেন মাওয়ালী। (মাওয়ালী শব্দের মানে, মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস)। আরব মুসলমানদের হাতে অনারব মুসলমান বা মাওয়ালীদের নানা লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো। মাওয়ালীরা আরবদের সামনে ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারত না। আরবদের সামনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারত না। মাওয়ালীরা আরব মেয়েদের বিয়ে করতে পারত না। এ ছাড়া মাওয়ালীদের দিতে হতো নানা অতিরিক্ত কর। জমির খাজনা তাদের দিতে হতো আরবদের চাইতে অনেক বেশি। পারসিকদের (ইরানিদের) আরবরা মাওয়ালী বলে খুবই ঘৃণা করত। এ ছাড়া সব আরব আবার সমান ছিল না। উত্তরের আরবরা দক্ষিণ দেশের আরবদের অনেক ছোট ও হেয় জ্ঞান করতে। পারসিক ও দক্ষিণের আরবদের এক অংশ তাই উমাইয়া খেলাফত-এর ওপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পারস্যের মুসলমানরা তাদের উমাইয়া বিদ্বেষের কারণে অধিকাংশই গ্রহণ করে শিয়া মতবাদ। শিয়া মতবাদ প্রথমে আরবদের মধ্যে দেখা দিলেও তা বিশেষভাবে ইরানিদের প্রিয় হয়ে ওঠে। শিয়া মতবাদকে কেন্দ্র করে ইসলামে সৃষ্টি হয়েছে মরমীবাদ, গুহ্যতত্ত্বের সাধনা। এই মরমীবাদের প্রভাব পড়েছে শিল্পকলায়।
উমাইয়াদের পর খেলাফত লাভ করেন আব্বাসীরা। আব্বাসীরা ছিলেন হজরত মুহাম্মদের (সা.) আর এক চাচা আল আব্বাসের বংশধর। আব্বাসী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবু আব্বাস আস-সাফাহ্ ক্ষমতা লাভ করেন প্রধানত শিয়াদের সহায়তায়। আব্বাসী খলিফাদের আমলে তাই দরবারে পারসিকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষভাবে বেড়ে যায়। ইসলামী শিল্পকলার ইতিহাস বুঝবার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের ইতিহাস জানা বিশেষ আবশ্যক।
উমাইয়াদের সময় আরব-মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সিরিয়ার দামস্ক (দামেস) শহর। উমাইয়া আমলের শিল্পকলার ওপর পড়েছে এই অঞ্চলের ও নিকটবর্তী অঞ্চলের প্রাচীন শিল্পকলার প্রভাব। এই আমলের শিল্পকলাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে রোমান, বাইজানটাইন ও কপটিক শিল্পকলা।
আব্বাসী খেলাফতের সময় আরব-মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ইরাকের (মেসপটেমিয়া-র) বাগদাদ শহরে। এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন খলিফা আল-মনসুর। বাগদাদ আগে ছিল প্রাচীন পারস্যের সাসানীয় (Sassnian) সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। এখানে তাই ছিল সাসানীয় আমলের শিল্পকলার প্রভাব। এ ছাড়া আব্বাসী আমলে পারসিকদের (ইরানিদের) ক্ষমতা রাজনৈতিক দিক থেকে বেড়ে যাওয়ায় প্রাচীন পারস্য শিল্পের প্রভাব আরও বেশিভাবে পড়ে বাগদাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পের ওপর। ইরাকের ভাবধারা ও শিল্পকলার দ্বারা সমগ্র মুসলিম-বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। উমাইয়া রাজত্ব চলত প্রধানত সামরিক কায়দায়। আরব সেনা ছিল এই রাজত্বের প্রধান ভিত্তি। কিন্তু আব্বাসী রাজত্বে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা বেড়ে যায়। এই আমলাতন্ত্র ছিল অনেক শিক্ষিত। এদের আমলে তাই কেবল শিল্পকলা নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চারও বিশেষ প্রসার হয়েছে। আব্বাসী আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য বাগদাদে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থকে আরবি ভাষায় অনুবাদের জন্য গড়ে ওঠে বিশেষ সরকারি অনুবাদ বিভাগ।
ইসলামী শিল্পকলার ইতিহাসে উমাইয়া খলিফাদের সময়কে সাধারণত উল্লেখ করা হয় প্রারম্ভ-পর্ব হিসেবে। দামেস্ক শহরকে কেন্দ্র করে ঘটে প্রথম ইসলামী স্থাপত্যের উদ্ভব। বাগদাদকে কেন্দ্র করে প্রথম রূপলাভ করে ইসলামী মণ্ডনকলা (Decorative Art)। ইসলামী শিল্প-ইতিহাসের কথা সাধারণত আলোচনা শুরু করা হয় উমাইয়া খলিফাদের আমল থেকে।
ইসলাম ধর্মের জন্ম হয়েছে আরবে। কিন্তু ইসলামী শিল্পকলার নিদর্শন বলতে যা বুঝান হয়, তার উদ্ভব খাস আরবে হয়নি। এর কারণ, প্রথম চার খলিফার পর থেকে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রাণকেন্দ্র ছিল না খাস আরবে। খাস আরবের লোক অন্যদের মতো অতটা পরিমার্জিত ও সভ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সেখানে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয়নি বিরাট নগরকেন্দ্রিক জীবন।