আমাদের দেশে এখন আইন করা হচ্ছে উচ্চ আদালতের কোনো বিচারপতি দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে আইনসভার কম করে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি তাকে অপসারণ (ইমপিচ) করতে চান, তবে তিনি তার চাকরি থেকে অপসারিত হবেন। বলা হচ্ছে, এ ধরনের আইন হলে বিচার বিভাগের কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। কিন্তু অনেক দেশেই ইমপিচমেন্টের বিধান আছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথমে উল্লেখ করা যেতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার (কংগ্রেস) ক্ষমতা আছে বিচারক অপসারণের। আইনসভার নিম্নকক্ষ অর্থাৎ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ যদি মনে করে, উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের অপসারণ প্রয়োজন, তবে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ তা প্রস্তাব করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনসভার উচ্চকক্ষ বা সিনেটে কম করে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি প্রস্তাবটি সমর্থন করেন, তবে উচ্চ আদালতের ওই বিচারক অপসারিত হবেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একবার মাত্র কোনো বিচারকের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু সিনেটে সেটা পাস হয়নি। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৮০৫ সালে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট যদি বলেন আইনসভায় পাস হওয়া কোনো আইন সংবিধানসম্মত হয়নি, তবে সেই আইন বাতিল হয়ে যায়। আদালতের ওপর যদি আইনসভার কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে তবে আইনসভার সব আইনই বাতিল হতে পারে। আইনসভা হারাতে পারে তার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাই আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসম্য রাখার জন্য করা হয়েছে এ রকম আইন। না হলে, বিচার বিভাগ হয়ে পড়ত খুবই ক্ষমতাবান।
রাষ্ট্রের হলো তিনটি বিভাগ। আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চেষ্টা করা হয়েছে এদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হলে অথবা সন্ধি করতে হলে তাকে নিতে হয় আইনসভার অনুমোদন। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন খুবই ক্ষমতাসম্পন্ন। এ ছাড়া আইনসভা পাস করে বাজেট। তাই তাদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারের আর দুই বিভাগকে। অর্থাৎ নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য নীতির বাস্তব প্রয়োগ কিছুটা হলেও সম্ভব হতে পেরেছে। গ্রেট ব্রিটেনে রাজা বা রানী যেকোনো বিচারককে পদচ্যুত করতে পারেন। যদি সে দেশের হাউজ অব লর্ডস ও হাউজ অব কমন্স উভয়েই রাজা বা রানীকে সে প্রস্তাব করে। বিলাতে পার্লামেন্ট সার্বভৌম। বিলাতের কোনো আদালত বলতে পারেন না, পার্লামেন্টে প্রণীত কোনো আইনকে বাতিল করার কথা। তবে তারা বলতে পারেন, এই আইনে তাদের পক্ষে বিচার করা হবে কঠিন। কেননা আইনটি স্বচ্ছ নয়। অথবা স্বচ্ছ ভাষায় লিখিত হয়নি। আইন লিখিত হয় ভাষায়। বিচারকদের বিচার করার সময় দিতে হয় আইনের ব্যাখ্যা। আইন জটিল হলে সেটা তারা করতে পারেন না। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া অচল হতে চায়।
বিএনপি বলছে, সে দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চায়। কিন্তু দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট দেশের ব্যয় বাড়াবে; বাস্তবে কোনো কাজে আসবে না। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হ্যারল্ড লাস্কি যথেষ্ট সুন্দর আলোচনা করেছেন। আমার মনে হয়, তার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। কেননা, দ্বিতীয় পরিষদ যদি প্রথম পরিষদকে অনুসরণ করে, তবে তা অনাবশ্যক। অন্য দিকে যদি তা প্রথম পরিষদকে অনুসরণ না করে, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। কেননা, প্রথম পরিষদই হলো জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক পরিষদ।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে প্রেসিডেন্ট অযোগ্যতা এবং অসদাচরণের অপরাধে সে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণ করতে পারেন। কিন্তু বিচারকদের অযোগ্যতা এবং অসদাচরণের অপরাধকে পার্লামেন্টের প্রতি কক্ষের (লোকসভা ও রাজ্যসভা) কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের প্রস্তাবে প্রমাণিত হতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণ আইন অনেক দেশেই আছে। আমাদের দেশে তা হলে তাকে নজিরবিহীন ঘটনা বলা যাবে না। আর এ ধরনের আইনের যে প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা মানতে হবে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার নীতির কারণেই।
সরকারের তিনটি বিভাগের কথা প্রথম বিশেষভাবে বলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪)। এ তিনটি বিভাগ হলো, আইনসভা, শাসন-পরিচালন ও বিচার বিভাগ। লক বলেন, এ তিন বিভাগের কর্তৃত্ব যদি কোনো এক ব্যক্তির হাতে থাকে তবে নাগরিক স্বাধীনতা বিপর্যয়ের মধ্যেই পড়ে। তাই ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ প্রয়োজন। তিনি এটা বলেছিলেন বিলাতের স্টুয়ার্ট রাজাদের স্বৈরশাসন বন্ধ করার লক্ষ্যে। কিন্তু বর্তমানে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র থাকলেও রাজা বা রানীকে মেনে চলতে হয় পার্লামেন্টের নির্র্দেশ। ব্রিটেনে এটা হতে পেরেছে যথেষ্ট নিয়মতান্ত্রিকভাবে।
লকের সময় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চিন্তা এখন হয়ে পড়েছে যথেষ্ট ভিন্ন। লক মনে করতেন, সরকারের বিভাগ হলো তিনটি। কিন্তু এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনেকেই মনে করেন, সরকারের বিভাগ আসলে হলো পাঁচটি। এরা হলো- নির্বাচকমণ্ডলী, আইনসভা, মন্ত্রিপরিষদ, রাষ্ট্রের ধরাবাঁধা কাজ চালানোর জন্য নিযুক্ত কর্মচারীগণ এবং বিচার বিভাগ। এদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। না হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুসামঞ্জস্য আসতে পারে না। একটি রাষ্ট্রে সর্বসাধারণের নাগরিক অধিকার বজায় থাকার শেষ ভিত্তি হলো সচেতন জনমত। জনমতই গণতন্ত্রের অন্তিম ভিত্তি। আমরা এখন আইনের শাসন বা ‘রুল অব ল’ কথাটি খুবই ব্যবহার করি। কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন অ. ঠ. উরপবু, তার বিখ্যাত ১দ্য ল’ অব দ্য কনস্টিটিউশন নামের গ্রন্থে (লন্ডন ১৮৮৫)। তিনি তার এই বইতে বলেন, একটা দেশের আদলতকে সে দেশের জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। তা না হলে তাকে মুখোমুখি হতে হবে গণবিদ্রোহের। আদালতের ক্ষমতার সীমানা আছে। তার ক্ষমতা কখনো অপরিসীম হতে পারে না।
বিচারপতিরা মানুষ। তারা করতে পারেন অসদাচরণ। বিলাতের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত আছে। বিখ্যাত মনীষী ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) এক সময় ছিলেন বিচারপতি। তিনি প্রচুর অর্থ ঘুষ নিয়ে বিচারের রায় অসাধুভাবে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাকে হতে হয়েছিল বিচারের মুখোমুখি। দিতে হয়েছিল প্রচুর আর্থিক জরিমানা। ফ্রান্সিস বেকনের মতো মনীষী খুব বেশি জন্মান না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও ঘটা সম্ভব দুর্ভাগ্যজনক স্খলন।
আমাদের দেশে অনেক রাজনৈতিক দল মনে করছে যে, বিচারপতি অপসারণের বিধান হবে গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে লাভবান হবে বর্তমান ক্ষমতাশীল দল। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাশীল দল চিরদিন যে স্থায়ীভাবে ক্ষমতাসীন থাকবে, এটা ধরে নেয়া ভুল। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট এক কক্ষ বিশিষ্ট। কিন্তু এখানেও বিচারক অপসারণে কম করে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাওয়া সহজ ব্যাপার হবে না। বিএনপি বলছে, সে দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চায়। কিন্তু দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট দেশের ব্যয় বাড়াবে; বাস্তবে কোনো কাজে আসবে না। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হ্যারল্ড লাস্কি যথেষ্ট সুন্দর আলোচনা করেছেন। আমার মনে হয়, তার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। কেননা, দ্বিতীয় পরিষদ যদি প্রথম পরিষদকে অনুসরণ করে, তবে তা অনাবশ্যক। অন্য দিকে যদি তা প্রথম পরিষদকে অনুসরণ না করে, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। কেননা, প্রথম পরিষদই হলো জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক পরিষদ। বিলাতে হাউজ অব লর্ড আছে, কিন্তু কার্যত এখন আর তার কোনো ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় পরিষদ ব্যবস্থা এক অতীত যুগের ধারণার প্রকাশ মাত্র। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কিছু দিন আগে বলেছিলেন, তিনি দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গড়বেন। কিন্তু জানি না কেন! তিনি কি জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাশীল নন? তার দলের একজন নেতা কয়েক দিন আগে বলেছেন, বিচারক অপসারণের আইন হলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ লাভবান হবে। তার এই বক্তব্য আমার কাছে খুব যুক্তিবহ বলে মনে হচ্ছে না।
দৈনিক নয়াদিগিন্ত/১৩ মে ২০১৬