আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও অপরিহার্য কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কবি না ফেরার দেশে চলে যান অসংখ্য পাঠক-ভক্তকুল ছেড়ে। সমগ্র জাতি শোকাহত এই মহান সাহিত্যিককে ঘিরে। বিভিন্ন পর্যায়ের লেখক-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক সব ধরনের গণমাধ্যমে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখে চলেছেন। শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদ ‘কবি আল মাহমুদ’ শিরোনামে ২৩ ফেব্রুয়ারির ‘নয়া দিগন্তে’ এমন একটি কলাম লিখলেন যা পড়ে পাঠক মাত্রই বিস্মিত ও আহত না হয়ে পারে না। নয়া দিগন্তের মত পত্রিকা কীভাবে এমন লেখা ছাপলো সেটাই অবাককরা বিষয়!
কলামটির দুটি অংশ আছে। প্রথমত আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে নেতিবাচক মূল্যায়ন; দ্বিতীয়ত, আল মাহমুদের সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ের কিছু স্মৃতিচারণ। দ্বিতীয় অংশ নিয়ে কোন আপত্তি নেই। কবির সঙ্গে তার জীবনের অনেক স্মৃতিকথা পাঠক জানতে পেরেছেন, সেজন্য কলামিস্টকে ধন্যবাদ। আপত্তি ও প্রতিবাদ হচ্ছে প্রথম অংশ নিয়ে যেখানে আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এবনে গোলাম সামাদের মতো বরেণ্য পন্ডিতের পক্ষ থেকে এমন অযৌক্তিক ও অসত্য মন্তব্য আশা করা যায় না। প্রথম অভিযোগ হলো: আল মাহমুদের কবিতার ‘ভাববস্তু বড় নয়, রূপকল্পনাই বড়’ এবং ‘তার কবিতার সাধনা বাক-প্রতিমা গড়ার সাধনা। কথা হলো কাব্য বিচার করতে হয় কাব্যদৃষ্টিতে, কোনো নৈতিক মানদন্ডে কবিতা বিচার করলে তা অবিচারের পর্যায়ে পড়ে। কোন কবির কবিতা ভাববস্তুর চেয়ে রূপকল্প বড় হলে কবিকে কোন ভাবেই দোষি করা যায় না বা কবিত্বের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তাছাড়া আল মাহমুদ রূপকল্প ও ভাববস্তু উভয়েরই প্রাধান্য দিয়েছেন কবিতায়। যেমন:
দেয়ালের ফ্রেমে রাখা কে দুঃখিনী জলের জলুস
পাথর ফাটানো ধারা সান্ত¡নার শব্দের মতন
তুমি কি জননী সেই, অভাবের আভায় দলিত
বাংলার মানচিত্র এ ঘরের পেরেকে রয়েছো?
[‘ফেরার পিপাসা’, কালের কলস]
এর চেয়ে তীব্র দেশচেতনাসম্পন্ন ভাববস্তু আর কি হতে পারে যেখানে রূপকল্পও দারুণভাবে অঙ্কিত। সমগ্র কবিতা আমলে না নিয়ে যদি বিচ্ছিন্ন একটি/দুটি কবিতা দিয়ে সামগ্রিক বিবেচনা করা হয় তাহলে যে কোন কবির ক্ষেত্রেই অবিচার অনিবার্য। আল মাহমুদের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। এবনে গোলাম সামাদের দ্বিতীয় আপত্তি হলো ‘কবি আল মাহমুদের কাছে নারীর অস্তিত্ব কেবলই কামচর্চার জন্য। নারী এসে সংসার গড়ে জননী হয়, সে উপলদ্ধি যেন ছিল না তার কাছে। তার কবিতা পড়ে মনে হয়, পুরুষ যেন নারীদের প্রভু। অথচ জীবনে সুখি হতে হলে উভয়ের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আল মাহমুদের কাছে মানব জীবনের এই সহজ বাস্তবতা যেন হতে চেয়েছে উপেক্ষিত। আসঙ্গলিপ্সাই যেন পেতে চেয়েছে আগ্রাধিকার।’ এই মন্তব্যের সত্যতা নেই আল মাহমুদের কবিতায়। স্পষ্টত কয়েকটি দিক থেকে তিনি নারীকে দেখেছেন- প্রথমত, গার্হস্থ্য প্রেমিকা; দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির প্রতীকে; তৃতীয়ত, বোনের দৃষ্টিতে; চতুর্থত, স্বর্গচ্যুত হাওয়া বা ঈভের রূপকে; পঞ্চমত, স্নেহ-মততাময়ী জননী ও দেশজননীর সামগ্রিক রূপকল্পে; ষষ্ঠত, শুধুমাত্র নারীরূপে।
আবার বুনবো তা-ই পুণ্যসিক্ত নতুন মাটিতে,
তোমাকে জড়াবো বুকে হে প্রেয়সী, তোমাকে কেবল
রক্তের উত্তাপ দেবো, প্রেম দেবো, গান দেবো বেঁধে,
তোমাকে ফসল দেবো, গৃহ দেবো, তৃপ্তি দেবো নারী।
আপনাকে শান্তি দেবো আর নূহ, শক্তি দেবো আমি।
[‘নূহের প্রার্থনা’, লোক লোকান্তর]
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক
বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।
[‘সোনালি কাবিন: ১৩’]
এইসব পঙ্ক্তি আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবন-সংস্কৃতি, পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনের প্রতি কবির দায়বদ্ধতা প্রমাণ করে। আল মাহমুদের কবিতায় ‘মানব জীবনের এই সহজ বাস্তবতা যেন হতে চেয়েছে উপেক্ষিত। আসঙ্গলিপ্সাই যেন পেতে চেয়েছে আগ্রাধিকার’- এমন মন্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই ধরা পড়ে তাঁর কবিতায়। নারী-পুরুষের যৌথ জীবনে যৌনতা অপরিহার্য বিষয়; একে কবি শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। স্বামী-স্ত্রী কাবিনের মাধ্যমে সংসার জীবন শুরু করেন। বাংলার গ্রামীণ মুসলিম চাষিজীবনের সংসার নিয়ে কবি সম্পূর্ণ একটি কাব্য সিকুয়েন্স সৃষ্টি করেছেন ‘সোনালি কাবিন’ নামে। সেখানে প্রেমকাম, সন্তান-গৃহস্থ, চাষবাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-রাজনীতি সবই আছে- জীবন ও কাব্যিক সত্যে যা বাংলা কাব্যে অদ্বিতীয়। ‘শৃঙ্গার রসের প্রাধান্যের কারণে আল মাহমুদের কবিতা ‘রসবৈচিত্রহীন’হয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন এবনে গোলাম সামাদ সেটা সম্পূর্ণ অসত্য, অন্যায্য ও আরোপিত। কবি আজীবন বাংলার জনজীবন ও প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন এভাবে:
আমার বিষয় তাই, যা গরিব চাষীর বিষয়
চাষীর বিষয় বৃষ্টি, ফলবান মাটি আর কালচে সবুজে ভরা
খানাখন্দহীন সীমাহীন মাঠ।
চাষীর বিষয় নারী উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা
পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।
[‘কবির বিষয়’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না]
এমন চরণগুচ্ছ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল একজন কবির পক্ষেই লেখা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে কোনো কবির সমগ্র কবিতা না পাঠ করে একটি/দুটি কবিতার বিচারে সামগ্রিক গড়পড়তা মন্তব্য করাটা সেই কবির প্রতি অন্যায় করা, বিশেষভাবে কবি যখন বেঁচে নেই। আল মাহমুদের ক্ষেত্রে এবনে গোলাম সামাদের মূল্যায়নও তেমনই হয়েছে।
এ-কথা সবার জানা যে, আল মাহমুদ ‘সোনালি কাবিন’পর্যন্ত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভাবাপন্ন। ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’ কবির সবচেয়ে বড় বাঁকবদল। এরপর থেকে কবি সমাজতন্ত্র ছেড়ে ইসলামী জীবনাদর্শ গ্রহণ করেন। এখানেই তিনি মানবমুক্তির পথ খুঁজে পান। দুই পর্ব মিলেই কবির জীবন ও সাহিত্য। সাহিত্যবিচারে উভয় পর্বই আমলে নিতে হবে। কবি যেমন লিখেছেন ‘পিপাসার মুখ, ‘সোনালি কাবিন; তেমনি লিখেছেন ‘হযরত মোহাম্মদ, ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’বা ‘উড়াল কাব্য’। সব মিলেই আল মাহমুদ। খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখলে সম্পূর্ণ মূল্যায়ন হয় না, অবমূল্যায়ন হয়।
অন্যদিকে কলামিস্ট সংশয় প্রকাশ করেছেন আল মাহমুদের কবিতার কালোত্তীর্ণতা নিয়ে। কারণ কবি গান লিখেননি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল শুধু গানের জন্য বেঁচে আছেন। তাহলে প্রশ্ন বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা কি কেউ পাঠ করেন না? উত্তর অবশ্যই পাঠ করেন। এখনো রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের অসংখ্য কবিতা পাঠক পড়েন-ভাবেন। আর যে সব কবি গান লিখেননি তা কি কালোত্তর হতে পারেনি? শেক্সপিয়র-টিএস এলিয়ট কি গানে টিকে আছেন? মধুসূদন-মানিক-বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন-আহসান হাবীব-সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা কি কাল থেকে কালান্তরে উচ্চারিত নয়? আসলে সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ থাকলে এমন মন্তব্য করাটা কঠিন। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসুর প্রসঙ্গও তিনি তুলেছেন তীর্যকভাবে। মনে রাখতে হবে কবি জীবনের প্রাথমিক পর্বে বদ্ধদেব বসুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, আনুকুল্য পেয়েছেন। কিন্তু পরে তা কাটিয়ে উঠেছেন
‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠোর পরবর্তী সময়ে। কবি লিখেছেন:
হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও আক্রান্তদের মধ্যে থেকে আমি এসেছি
আমি বললাম।
আপনার মুখ হিটাহিটদের প্রাচীর মন্দিরের
পুরোহিতের মতো নিষ্কম্প রইল।
রেখা ভাঙলো না, ঢেউ উঠলো না।
যেন পরাজিত হও, লুটিয়ে পড়ো, সেবা কর- ছাড়া
নৈরাজ্যের গহ্বর থেকে আর কিছুই বেরুবে না।
[‘বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার’, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো]
কবি তিরিশোত্তর কাব্যধারা অতিক্রম করে দেশজ আধুনিকতায় পৌঁছেছেন উত্তর-উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। আল মাহমুদ সমকালীন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন-ফররুখ আহমদের পর সবচেয়ে মৌলিক, শক্তিমান ও বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল কবি। তাঁর কাব্য বৈচিত্র্য, গভীরতা ও শিল্পদক্ষতা নিয়ে পাঠক-সমালোচকের মাঝে কোন সন্দেহ নেই। আল মাহমুদের স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতার শিখরস্পর্শী কাব্যশৈলী অবিসংবাদিত। সাম্রাজ্যবাদী ও গণশত্রুদের বিরুদের কবি ‘উড়াল কাব্যের মতো কবিতা লিখেছেন। এইসব বিষয় নিয়ে এবনে গোলাম সামাদ লিখলে কবির প্রতি সুবিচার করা হতো। কোন এক অজ্ঞাত বিদ্বেষ থেকে তিনি এমন সব মন্তব্য করেছেন বলে মনে হয়েছে। কবির প্রতি অন্যায্য মূল্যায়ন প্রত্যাহার করে আশা করি তিনি সঠিক মূল্যায়ন করবেন আগামীতে।
লেখকঃ ড. ফজলুল হক তুহিন, আল মাহমুদ গবেষক।