এবনে গোলাম সামাদ দেশের প্রবীণ ও প্রধান বুদ্ধিজীবীদের একজন। গত ১৫ আগস্ট তিনি দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। যেকোনো বিবেচনায় এটি একটি পরিণত মৃত্যু। কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যু কখনো কখনো হিমালয়ের চেয়ে ভারী মনে হয়। ব্যক্তির অভিজ্ঞতা জাতির প্রতি অবদান মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে তোলে। তিনি ছিলেন সেরকম একজন আত্মপরিচয় সন্ধানী মহান পুরুষ। তার লেখালেখির সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘকাল আগে। আমি যখন ষাটের দশকে স্কুলছাত্র তখন। ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একটি রচনা প্রতিযোগিতায় আমি জেলা ভিত্তিতে প্রথম হই। বাংলা একাডেমি পুরস্কার হিসেবে ১৯৬৮ সালে ৭৫ টাকার বইপত্র দেয়। তাতে এবনে গোলাম সামাদ লিখিত একটি বই ছিল। যতদূর মনে পড়ে, বইটি ছিল পাকিস্তানের আদিবাসী বা উপজাতি সম্পর্কে। পরবর্তীকালে তার ‘নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ’ বইটি আমার হাতে আসে। সেই থেকে আমার ধারণা ছিল তিনি বোধ হয় নৃবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত লেখা বা কলাম পড়ে তার গভীর জ্ঞান ও মনীষায় মুগ্ধ হই। বিশেষ করে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত নিয়মিত কলাম ‘আত্মপক্ষ’ আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুবাদে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার বাসায় গিয়ে হাজির হই। তাকে কাছে থেকে দেখা এবং শেখার সুযোগ হয়। আমি অবাক হই এ কথা জেনে যে, তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক। এরকম বহুমাত্রিক পণ্ডিত সমসাময়িক বাংলাদেশে বিরল। পেশায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী হলেও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ। বিশেষত শিল্পকলার মতো ব্যতিক্রমী বিষয়ে তার বিশেষ জ্ঞান আমাকে বিস্মিত করে। এখন বাংলাদেশ জাতির দুঃসময় চলছে। তার সাহসী লেখনী সবসময় আমাদের পথ দেখায়। তার বহুমাত্রিক জ্ঞানের অনেক অংশই আমার জন্য প্রাসঙ্গিক। আমার পড়াশুনার ক্ষেত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এর প্রশাখা পাশ্চাত্য কথিত ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’ বা আত্মপরিচয়ের সঙ্কট আমার একটি আগ্রহের বিষয়। তাই এবনে সামাদের ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধান’ আমার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই গ্রন্থের পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা তার গভীর মনীষার যেমন প্রমাণ পাব তেমনি আমাদের জাতিসত্তার হদিস মিলবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেকোনো অভিধার জন্য আমরা ফিরে যাই গ্রিক নগররাষ্ট্রে। সেই প্রাচীনে। কিন্তু আইডেনটিটি বা আত্মপরিচয় বা জাতিসত্তার পরিচয়ের বিষয়টি এই সেদিনের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে এই অভিধার আবির্ভাব। এরিক এরিকশনকে এর প্রবক্তা পুরুষ মনে করা হয়। ভদ্রলোকের রাষ্ট্রিক পরিচয় জার্মান, ধর্মে ইহুদি আর পরে গ্রহণ করেন মার্কিন নাগরিকত্ব। তিনি ছিলেন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষক। প্রাথমিক অবস্থায় বিষয়টি শুরু হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে। অবশেষে জাতি রাষ্ট্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় এই তত্ত্ব। হিটলারের ইহুদি নির্মূলের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি যে ‘জাতিসত্তার সঙ্কট’ অতিক্রম করছিলেন তাই তাকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এজন্য এই তত্ত্বকে ‘আত্মজৈবনিক উপলব্ধি’সঞ্জাত বলা হয়। পরবর্তীকালে অন্যান্য সমাজতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিষয়টির সাধারণীকরণ ঘটে। পিটার বার্জার তত্ত্বটিকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার ভাষায় “Socially bestowed, socially sustained and socially transformed (Berger : Invitation to Sociology : 1966) ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তত্ত্বটিকে কেন্দ্রীয় বিষয়- রাষ্ট্র, ধর্ম, শ্রেণী, নৃগোষ্ঠী, লিঙ্গ এমনকি ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে এসব বিষয় পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও অবশেষে প্রধান পরিচয়ে স্থিতিস্থাপক। সমাজতত্ত্ববিদ হেনরি টাজদেন এবং জন টার্নার ‘সামাজিক পরিচয় তত্ত্ব’ (Social Identity Theory) কে ‘জাতীয় আত্মপরিচয়’ (National Identity) এর প্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুপার্ট ইমারসন ‘জাতি রাষ্ট্রের পরিচয়’ নির্ধারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এর সার্থক প্রয়োগ করেন। এমারসন বলেন, “A body of people who feel that they are a nation”। কোন জনগোষ্ঠী যদি মনে করে তারা একটি জাতি তবে তারাই একটি জাতি। বিষয়টি অনুভূতি, উপলব্ধি এবং ঐক্যবোধের। এর বাহন হতে পারে নৃগোষ্ঠী, ভাষা, ভৌগোলিক ঐক্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস এবং অনিবার্যভাবে ধর্মীয় অনুভূতি। জাতীয় পরিচয় একটি সম্মিলিত প্রক্রিয়া। সামাজিকীকরণ বা শাসনতান্ত্রিক বা প্রাকৃতিকভাবে একই বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সমচিন্তা, জীবন পদ্ধতি, জাতীয় অর্জন এবং আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটতে পারে একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টিতে। এভাবে গড়ে উঠতে পারে জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি। পাশ্চাত্যের তত্ত্বকথার অবতারণা এজন্য করতে হলো যে, আমাদের বিদ্যায়তনিক বিদ্যার সবকিছুই সেভাবেই বিন্যস্ত। তবে আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে আমাদের দেশজ বা লোকজ আবেদনও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের মরমি সাধকরা বলেন, ‘প্রশ্ন করি নিজের কাছে কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম, কে আমি?’ লালন প্রশ্ন করেন, ‘লালন কী জাত সংসারে?’
‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ নামক গ্রন্থে এবনে গোলাম সামাদ এসব বিষয়াদি পেশ করেছেন বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে। বিষয়টি বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থে, ‘আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ, বিকাশ ধারা নৃগোষ্ঠিক পরিচয়, ভাষা-সাহিত্য, রাষ্ট্রচিন্তা, আন্দোলন-সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক রূপান্তর এবং জাতীয়তাবাদের বিবর্তন সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে।’ গ্রন্থটির লক্ষ্য হিসেবে লেখক বলেছেন, ‘আমরা বুঝে দেখতে চাইব বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয়ের বা স্বাতন্ত্র্যবোধের উদ্ভবের বিভিন্ন কারণসমূহকে।’
গ্রন্থটি ৩৯টি ছোট বড় অনুচ্ছেদে পরিবেশিত হয়েছে। পরিবেশনে অনিবার্য বিষয় ঘনিষ্ঠতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে দূরবর্তী বিষয়-আশয়।
মূল গ্রন্থে প্রবেশ করা যাক। প্রথম পরিচ্ছদ, ‘বাংলাদেশের ঠিকানা’। সঙ্গতভাবেই আত্মজিজ্ঞাসার প্রথম পাঠ। মূলত একটি জাতির সূচনা তার ঠিকানা থেকেই। ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরিচয় হলো প্রথম প্রশ্ন- আপনার ঠিকানা? বিদেশে রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় ঠিকানা। সেখানে ব্যক্তির পরিচয় মুখ্য নয়। জাতিরাষ্ট্রের পরিচয়ই প্রধান। ইতিহাসের এক পর্যায় এই মাটিতে স্লোগান উত্থিত হয়েছে, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। ওই উচ্চারণের প্রতি সতত সমর্থন রয়েছে লেখকের। তাই তিনি প্রথমেই উদ্ধৃত করেছেন, কবি ও গীতিকার আবু জাফর রচিত একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের কয়েকটি চরণ- ‘এই পদ্মা এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে/আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়/এ আমার দেশ এ আমার প্রেম…/কত আনন্দ বেদনা মিলন বিরহ সঙ্কটে।’ এর মধ্যে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের স্বদেশ চেতনার আবেগ অনুভব। এ কথা বলে লেখক আমাদের আহ্বান করেছেন ইতিহাসের গহিনে। বাংলাদেশের ঠিকানা বলতে গিয়ে প্রবীণ পণ্ডিত এবনে গোলাম সামাদ একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো খুঁজে বেরিয়েছেন দেশের নাম ও সীমানা, এর প্রাচীন সূত্রগুলো। সেই পুরনো কথা- অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুস ও পুণ্ড্র নামের ঐতিহাসিক পটভূমির সন্ধান করেছেন তিনি। উৎস সন্ধানে আরো যেসব সূত্রের উল্লেখ আছে নদী, ভাষা ও উপকথার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। অতীতে যাই থাকুক না কেন, ‘সিরত-ই-ফিরোজশাহী’তে সুলতানি আমলে ‘মুলুক বঙ্গলাই’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তাই হয়তো আজকের বাংলাদেশ। মধ্যযুগে বাঙ্গালা আকবর যুগে কথিত হতো বংগাল নামে। আবুল ফজলের মতে সুবে বংগাল ছিল সমৃদ্ধ প্রদেশ। এবনে গোলাম সামাদ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন বংগ বলতে পূর্ব বাংলাকে বুঝিয়েছে, পশ্চিম বাংলাকে (রাঢ়) নয়। তার ঠিকানার কেন্দ্রভূমি বর্তমান জাতিরাষ্ট্র (Nation State) বাংলাদেশ। অন্য কোনো অঞ্চল বা ভাষা বা নৃগোষ্ঠী নয়। আর একটি উপ-অনুচ্ছেদে লেখক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিচয় দিয়েছেন। ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালী’র ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছেন। একটি নতুন তথ্য আছে এখানে। ‘বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিলের ধারে প্রচুর বুনো ধান জন্মায়। উদ্ভিদবিদদের মতে এই বুনো ধান থেকেই উদ্ভব হতে পেরেছে আবাদি ধানের।’ পৃথিবীতে এরকম নদী বিধৌত সমতল ভূমি খুব কমই আছে। দেশের মাটি নামে আরেক উপ-অনুচ্ছেদে এ কথা লিখেছেন লেখক।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের মানব পরিচয়’ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসত্তার সন্ধানের ক্ষেত্রে মানব পরিচয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাষ্ট্র নৈর্ব্যত্তিক সত্তা। তা প্রস্ফুটিত হয় জনসংখ্যায়। জনগণের অতীত, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশ নৃগোষ্ঠিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের সাথে অনিবার্যভাবে জড়িত। মানুষের মধ্যে এসব বাহ্যিক, দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো বংশপরম্পরায় বর্তায়। যা থেকে নির্ণয় করা চলে মানুষের জাতিত্ব। একটি নাতিদীর্ঘ তাত্ত্বিক আলোচনা শেষে এবনে গোলাম সামাদ মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষকেই স্থাপন করা চলে ককেশয়েড বিভাগে।’ তিনি আমাদের বাদামি রঙের বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। আমাদের মাঝারি আকারের মাথার কারণও বিশ্লেষণ করেছেন। ম্যাক্স মুলারের মতো আর্য তথা উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই উপমহাদেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটেছে বলে এবনে সামাদ মনে করেন। মানবধারা ও ভাষার দিক থেকে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করেন তিনি। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের উদ্ভব হতে পেরেছে মূলত বাংলাভাষী মুসলমান আছে বলে। সমগ্র গ্রন্থের মধ্যে এই পরিচ্ছেদটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ মনে হয়েছে। নৃতত্ত্বের জটিল বিষয়ে স্বল্প পরিসরে এরকম সার্থক আলোচনা খুব কমই লক্ষ করেছি।
তৃতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে, ইসলামের অবদান। অর্থাৎ বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ইসলাম কিভাবে কী অবদান রেখেছে তার আলোচনা রয়েছে এখানে। এ পরিচ্ছেদের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘কেবল মানব ধারা ও ভাষার স্বাতন্ত্র্য দিয়েই আজকের রাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যায় না।… তবে আমরা ইসলাম নিয়ে আলোচনা করব ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্মতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।’ তিনি মনে করেন, ধর্ম এখনো হয়ে আছে আমাদের মূল চেতনার উৎস। দীর্ঘ এই প্রচ্ছদে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ইসলামের প্রকাশ বিকাশ ও প্রভাবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। ইসলাম বাংলাদেশে যে তরবারির জোরে নয় বরং মমত্ব, মহত্ত্ব ও উদারতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা প্রমাণ করেছেন এবনে গোলাম সামাদ। মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার উন্নয়নের কথা বলেছেন তিনি। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ও স্থাপত্যে মুসলমানদের অবদানের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছেন। এসবের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের অগ্রসরতা ও প্রভাবের বর্ণনা দিয়েছেন। মুসলমানদের উৎসমূল ছিল এ পরিচ্ছেদের মূল উপজীব্য বিষয়।
ইসলাম ও মুসলিম জাতিত্ব থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পার্থক্য বুঝানোর জন্য চতুর্থ পরিচ্ছেদে হিন্দু সমাজের গড়ন আলোচনা করা হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় বাংলার মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে গিয়ে মোগল ও তুর্কিদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে পঞ্চম পরিচ্ছেদে। সুলতানি ও বাদশাহি আমল ব্যাখ্যাত হয়েছে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে। লেখকের ভাষায় ‘আজকের বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্যকে স্বাধীন সুলতানি আমলের ইতিহাসকে নিতে হবে বিশেষ বিবেচনায়।’ কারণ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য রীতির সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই অনুচ্ছেদের একটি উপ-অনুচ্ছেদ ‘মোগল ও পাঠান’। এখানে লেখক বলেছেন, একসময় বাংলাদেশে মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিজেদের ভেবেছেন পাঠান হিসেবে, মোগল হিসেবে নয়। আমাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে এ কথাটিও মনে রাখতে হয়। একই উপ-অনুচ্ছেদে ষোড়শ শতাব্দীর কবি মুকন্দরাম চক্রবর্তী রচিত ‘মুসলিম পরিচয়’ বাচক কবিতার একটি বিরল উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
পরবর্তী প্রযোজনা ‘রাজা রামমোহন রায় ও বাংলার সংস্কৃতি’। এটি সপ্তম পরিচ্ছেদ। ব্রাহ্মসমাজের একেশ্বরবাদ তথা হিন্দু ধর্মের সংস্কার প্রয়াস সাময়িককালের জন্য হলেও হিন্দু মুসলমান সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছিল। ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। মুসলমান সমাজকে তা প্রভাবিত করেছিল। তাছাড়া বাংলা ভাষার অন্যতম পথকার হিসেবে রাজা রামমোহন রায়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবনে গোলাম সামাদ। বাংলাদেশ জাতির আত্মপরিচয়ের সন্ধানের অনেক বাঁকে এটিও একটি সংযোজন মনে করেন লেখক। বাংলা গদ্যে ইউরোপীয়দের অবদান- পরিচ্ছেদকে দৃশ্যত অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান বিষয়টিকে প্রাসঙ্গিক করেছে। এই জনগোষ্ঠীর আত্মজাগৃতির ইতিহাসে যেসব আন্দোলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে- তন্মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন ও সিপাহি অভ্যুত্থান দুটো অনিবার্য অধ্যায়। নবম ও দশম পরিচ্ছেদে সংক্ষিপ্তভাবে পরিবেশিত হয়েছে সেই ইতিহাস। যেসব ব্যক্তিত্বের আলোকধারায় এই জাতি পেয়েছে পথের দিশা সে রকম তিনজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব স্থান পেয়েছেন পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে। এরা হলেন- নবাব আবদুল লতিফ, নবাব ফয়জুননেসা চৌধুরানী ও স্যার সৈয়দ আমীর আলী। চতুর্দশ পরিচ্ছেদে ভিন্নতর অথচ একটি যৌক্তিক বিষয়ের উল্লেখ করেছেন লেখক। সে বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত বিবর্তিত হয়েছে উপমহাদেশের ভাগ্য তাহলো- ব্রিটিশ সাম্ররাজ্যবাদ। সঙ্গতভাবেই ব্রিটিশ সাম্ররাজ্যবাদের আদি অন্ত খতিয়ান তুলে ধরেছেন প্রবীণ এই পণ্ডিত। অতীত ও বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্য নির্ধারণে ‘হিন্দুত্ববাদ’ পালন করছে মূল ভূমিকা। তাই যৌক্তিকভাবেই পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে বিষয়টি। এরপর ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলেছেন লেখক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশ আলোচিত হয়েছে ষোড়শ পরিচ্ছেদে। সে সময়ের বর্ণাঢ্য ইতিহাস বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণিত হয়েছে। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ কি করে উপমহাদেশে ‘মথইটেন পাকিস্তান’ সৃষ্টি করেছিল তার উল্লেখ রয়েছে এক উপশিরোনামে। ইতিহাস থেমে থাকেনি। পাকিস্তান হওয়ার পরে কখন কিভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মোহমুক্তি ঘটে। তার বর্ণনা অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে রয়েছে।
ঘটনাক্রম এগিয়ে চলেছে- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর প্রাদেশিক নির্বাচন, আইয়ুবের শাসনকাল, শেখ সাহেবের ৬ দফা ইত্যাদি ঘটনাক্রম আলোচনা করতে করতে লেখক পৌঁছেছেন দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদে। আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চাকরি সম্পর্কে নতুন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধুর সংশ্লিষ্টতাও পরিবেশিত হয়েছে পৃথকভাবে। আকস্মিকভাবেই জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে একটি পরিচ্ছেদ সংযোজিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার নেতিবাচক ভূমিকা এবং তার জীবনের করুণ পরিণতি উল্লিখিত হয়েছে। ইয়াহিয়ার আইন কাঠামোর আদেশও বাদ যায়নি। ষড়বিংশ পরিচ্ছেদে ‘কলকাতার স্মৃতি’ ভিন্নতর স্বাদের সন্ধান দেয়। মুক্তিযুদ্ধ তথা আত্মপরিচয়ের শেষপর্ব কলকাতায় যা দেখেছেন এবং যা শুনেছেন অনায়াসে তা লিখেছেন। অন্নদা শংকর রায়ের কয়েকটি ছড়া এই পরিচ্ছেদে একটি বাড়তি সংযোজন। এভাবে লেখকের উত্তরণ ঘটেছে ‘পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ’ এ।
বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পরেও। উল্লিখিত হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা, শেখ মুজিবের চাওয়া-পাওয়া, বাকশাল গঠন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ও জেনারেল জিয়া এবং সিরাজুল আলম খান ইত্যাদি বিষয়ক সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল আলোচনা। বাংলাদেশের মতাদর্শগত সঙ্ঘাত বুঝতে ত্রিংশ পরিচ্ছেদে স্থান পেয়েছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। একত্রিংশ পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এখানে ইসলাম ও গণতন্ত্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে স্বীয় মতামত দিয়েছেন লেখক ভারত ও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত শিরোনামে। বাড়তি সংযোজন তাজউদ্দীন কন্যার স্মৃতিচারণ। হাজার বছরের বাঙালি সংযোজিত হয়েছে গ্রন্থটির শেষের দিকে। সাবেক পাকিস্তানের চব্বিশ বছর নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দিনগুলো সালতামামি ঘটেছে। এবনে গোলাম সামাদ আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিবেশীদের সম্পর্কেও মূল্যায়ন করেছেন। সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদে চীন-ভারত-বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে। জাতিসত্তার একটি অনিবার্য বিষয় আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে মতামত এসেছে অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদে। জাতিসত্তার সংগ্রামে বিহারি সম্প্রদায় একটি আলোচ্য বিষয়। তাদের বিচিত্র ও বিরল অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে সর্বশেষ পরিচ্ছেদে।
উপসংহারে লেখক আত্মপরিচয়ের শেষ কথা বলতে চেয়েছেন। দীর্ঘ আলোচনা ও অনেক বিষয়ের অবতারণা করে লেখক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ‘ভাষা আমাদের জাতিসত্তার মূল্যবান উপকরণ। কিন্তু একমাত্র উপকরণ নয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে উপলব্ধি করতে হলে এই মুসলিম উপাদানকে বিবেচনায় নিতে হবে।’ পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সৃষ্ট ‘জাত্যাভিমান’ জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশ জাতিসত্তার। জাতীয়তাবাদের বহমানতার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন এসেছে জাতিসত্তায়। ভৌগোলিক সীমা, বাংলাদেশ ও ইসলামের স্বাতন্ত্র্য- এই তিন সত্তা নিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। লেখক এভাবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এসেছেন আত্মপরিচয়ের সন্ধান অবশেষে। কবিগুরুর ভাষায় বলা যায় লেখকের অনুমিত আবেদন, ‘আর কিছু নয় এই হোক শেষ পরিচয়।’ দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী গোলাম সামাদ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি যে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দিয়েছেন তা আমাদের দিয়েছে নতুন অনুভব, নতুন প্রেরণা এবং আসল ঠিকানা। তার উদ্ভাসিত এই স্বাতন্ত্র্যবোধ আমাদের জাতিসত্তাকে পৌঁছে দেবে অভীষ্ট লক্ষ্যে।
লিখেছেন ড. আব্দুল লতিফ মাসুম, অধ্যাপক এবং উপাচার্য পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্তে, ১৮ আগস্ট ২০২১।