এবনে গোলাম সামাদ একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি স্বতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এ দেশের সুধিমহল কিংবা বিশেষজ্ঞমহলে তাকে চিনে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রচণ্ড ধী, অপরিমেয় মেধা ও তীক্ষ্ম লেখনি শক্তির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবনে গোলাম সামাদ। জীবনের পুরোটা কাটিয়েছেন আত্ম-অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থেকে। তার আত্ম-অনুসন্ধানের প্রকৃতিও ভিন্ন মাত্রার। অনুসন্ধানে তিনি নির্মোহ, নিরপেক্ষ এমনকি অপ্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। তিনি যে কক্ষপথে বিচরণ করে নিজের যথার্থ প্রকাশ প্রয়াসী তা একান্ত আপনার। কারো তির্যক দৃষ্টি, বক্র চাহনি, উপেক্ষা প্রবণতা তাকে দমাতে পারেনি। তাকে সামান্যতম আঁচড়ও দিতে পারেনি। সত্যি বলতে তাকে বিচ্যুতও করতে পারেনি তার চলার পথ থেকে।
এবনে গোলাম সামাদ একজন সাদাসিধে নিরহংকার, নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন। তিনি অতিশয় প্রচার বিমুখও ছিলেন। তার নামই এ কথার প্রমাণবাহী। তিনি দেশের খ্যাতিমান রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের যশস্বী অধ্যাপক, পশ্চিমা দেশে তার উচ্চশিক্ষার সবক এবং আরেক দেশ হতে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু তার দাপ্তরিক কাজের বাইরে কখনও তাকে এসব অভিধা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। সত্যিই এ সারল্য মনের ঔদার্য অভিব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ।
তিনি কখনই নিজের নামকে উচ্চকিত করতেন না। নিজের নামে পরিচিত হোননি কোথাও। নামের অর্থ বলে- তার বাবা গোলাম সামাদ তিনি তার এবন বা পুত্র। এই ছিল তার পরিচয় (অবশ্য তার বাবার প্রকৃত নাম ইয়াছিন।) একজন মানুষের প্রচার বিমুখ হবার জন্য আর কী চাই। অথচ জ্ঞানে, গুণে, শিল্পে সুষমায় তার দ্বিতীয়জন আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন একজন বহুপ্রজ প্রতিভার অধিকারী। অর্থাৎ একের মধ্যে অনেক। প্রযুক্তি কিংবা বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের এই আমলে সকল বিশেষজ্ঞই বিশেষ জ্ঞানে বিশেষায়িত। অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞানকে খ-িত এবং আরো খ-িত অংশের উপরই সবার বিশেষজ্ঞতা অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়েছে। অবশ্য এটি জ্ঞানের সৌন্দর্য বটে। তবে এবনে গোলাম সামাদ এই প্রচলিত ধারার বাইরের একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। কোনো বিশেষায়িত একমাত্র জ্ঞানের গ-িতে আবদ্ধ তিনি ছিলেন না। বরং তিনি একই সাথে অনেকগুলো বিষয়ে তার পা-িত্য ও বিশেষজ্ঞতা ছিল প্রোজ্জ্বল ও দীপ্তমান। এমনকি প্রত্যেকটি বিষয়েই তার জ্ঞানের প্রোজ্জ্বলতা একটি অন্যটির চেয়ে বেশি দীপ্তিময়। এটি যেন আমাদের সেই পূর্বসূরীদের আরেক অঞ্জলি। অর্থাৎ মুসলমানদের গৌরবের দিনে যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অতি মাত্রায় পারদর্শী ছিলেন তারা কেবল ঐ একটি মাত্র শাখা নিয়েই ব্যাপৃত ছিলেন এমনটি নয়। যেমন ইবনে সিনা তার চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনবদ্য উদ্ভাবনের জন্য খ্যাতিমান হলেও তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়েও তার ব্যুৎপত্তি ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো। আর আল-কেমি যাকে রসায়ন শাস্ত্রের জনক বলা হয় তিনিও ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে সর্বকালের কৃতি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একইভাবে প্লেটো, এরিস্টোটল, সক্রেটিস তারা নীতিশাস্ত্র বা দর্শন শাস্ত্রে খ্যাতিমান হলেও জ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় তাদের বিচরণ ও কর্তৃত্ব ছিল বিস্ময়ের। এবনে গোলাম সামাদ তেমনি একজন জ্ঞানবান ও জ্ঞানরাজ এক মহান ব্যক্তিত্ব। একাধিক নয় অসংখ্য মহান গুণাবলি ও জ্ঞানের প্রায় সকল শাখাই ছিল তার আত্মস্থ। এ জন্যই আমরা তাকে বলতে চাই একজন বহুপ্রজ প্রতিভার অধিকারী এবনে গোলাম সামাদ।
এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন একজন শেকড় সন্ধানী ঐতিহাসিক। তিনি ছিলেন ইতিহাসের পোকা। ইতিহাসের দুটো দিক থাকে। একটি প্রকাশ্য অন্যটি প্রচ্ছন্ন। ইতিহাসের বহির্ভাগ তথা প্রকাশ্য দিকের অনুধ্যান অত্যন্ত সহজ হলেও ইতিহাসের অন্তর্নিহিত তথা প্রচ্ছন্ন দিকটি খুবই ভয়াবহ ও জটিল ধরনের হয়ে থাকে। ধী-শক্তির গভীরতা ও উপলব্ধির প্রখরতা ব্যতীত কেউ ইতিহাসের অন্তর বিদীর্ণ করতে চাইলে তার বিপদাশঙ্কা ভয়াবহতর হতে জটিলতর হতে বাধ্য। এ জন্যই চাই ইতিহাসের প্রকৃত জ্ঞান, গভীর জ্ঞান এবং যথামাত্রার উপলব্ধি শক্তি। তাই মোহাবিষ্ট ও অনিরেপক্ষ ঐতিহাসিকদের জাঁতাকলে নিপিষ্ট হতে দেখা যায় ইতিহাসের সাধারণ পাঠক ও শিক্ষানবিশদের। এ নিয়ে চলে রকমারি রাজনীতির উলট-পালট খেলা।
এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন একই সাথে ইতিহাস সচেতন ও রাজনীতি সচেতন। ইতিহাস ও রাজনীতির পথচলা যুগপৎ। তারা একে অন্যের সহগ ও সহোদর। রাজনীতিবিদরা খেলতে চান ইতিহাস নিয়ে আর ইতিহাসবিদরা শুধরাতে প্রয়াসী থাকেন রাজনীতিবিদদের। কেউ কারো স্পর্শের বাইরে যেতে পারে না।
ইতিহাসের সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা শেষে বলা যায়- তিনি ইতিহাসের নির্মোহ পাঠক, নিরপেক্ষ অনুসন্ধানী ও নিখাঁদ গবেষক। তিনি ইতিহাসকে চর্চা করেছেন তার মৌল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। প্রবেশ করেছেন তার অতলান্তে। তাতেই ধরা পড়েছে ইতিহাসের পেছনের ইতিহাস তার হাতে অতি সহজেই। প্রথমেই তিনি মনোনিবেশ করেছেন ইতিহাস ও তার আঙ্গিক নির্বাচনে, এরপর আত্মস্থ করেছেন ইতিহাসের গোড়ার বয়ান। এরপর অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন ইতিহাসের ফলাফল অন্বেষণে। এ কাজে তিনি ছিলেন নিরলস, নিরপেক্ষ ও একাট্টা। তিনি ইতিহাসের সবক নিয়েছেন তার মৌল উৎস ও আকর থেকে। ফলে তিনি পথভ্রান্ত হোননি কখনও। ইতিহাসের পাঠ ও উপলব্ধি থেকে অর্জিত সকল নির্যাস তিনি উপস্থাপন করেছেন দেশ ও জাতির কল্যাণ তরে। কারো দৃষ্টির বক্রতা বা বাক্যের তির্যকতা তাকে লাইনচ্যুত করতে পারেনি।
প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ বাংলাদেশে ইসলাম। তিনি এ বইটি রচনা করেছেন এক স্বতন্ত্র চিন্তা থেকে, যে চিন্তা প্রায়শ আমাদের মধ্যে সক্রিয় ও সচল থাকে না। এ বইটির মূল থিম ছিল- বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবের নেপথ্যে সক্রিয় চেতনা ছিল ইসলামের ধর্ম বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে তার যুক্তিও খুব প্রাসঙ্গিক ও অকাট্য। গোটা বইয়ের আলোচনায় তিনি স্পষ্টরূপে প্রমাণ করতে চেয়েছেন- বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম না থাকলে আর যাই হোক বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হতো না। কারণ বাঙালি হিন্দুরা কোনদিনই চাননি বাঙলা ভাষা ভিত্তিক একটি পৃথক জাতি-রাষ্ট্র গড়তে। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানরা তা চেয়েছেন। গোটা বইতে তিনি এ বিষয়ে নানান যুক্তি, তথ্য, প্রমাণ ও দলিল সন্নিবেশন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন নির্মোহ ঐতিহাসিক সত্যতায়। উক্ত বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন-
“অন্যদিক থেকে বলা যায়, ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয়- ধর্ম হলো জনমতের উৎস। ধর্ম একটা সামাজিক ঘটনা, কেবল ব্যক্তি মনের খামখেয়ালীপনার সৃষ্টি বলে তাকে চিহ্নিত করা যায় না। সমাজ জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার গভীর প্রয়োজন থেকেই উদ্ভব হয়েছে ধর্মের। ধর্মের সমাজতন্ত্র এখন একটা অতি শ্রদ্ধেয় আলোচ্য বিষয়। ধর্ম ও রাজনীতির সম্বন্ধটা তাই দূরের নয়, কাছের। ইতিহাসে দেখা যায় মানুষের ধর্ম বিশ^াস তার রাষ্ট্র চেতনাকে নানাভাবেই নিয়ন্ত্রিত করছে। আধুনিক জাতীয়তাবাদের জন্মভূমি ইউরোপের ইতিহাসও এ থেকে মুক্ত নয়। ১৮৩০ সালে রাষ্ট্র হিসেবে বেলজিয়ামের আবির্ভাব হয় প্রধানত ধর্মীয় কারণেই।”
এভাবেই পুরো বইটিকে তিনি সাজিয়েছেন এক বিশেষ আদলে। বাঙালি মুসলমানদের নৃ-পরিচয়, বাঙালি মুসলিম মানসের রূপরেখা ও রাষ্ট্র চেতনা, সমাজ জীবনে ইসলাম, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মুসলিম উপাদান ইত্যাদি সূচিক্রমে তিনি বাংলাভাষী ও বাংলাদেশী সমাজ বিনির্মাণের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে ইসলামকে দেখিয়েছেন এবং তা যথামাত্রায় সঠিক বলে পাঠকমাত্রই ঠাহর করতে এবং ইতিহাসের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছেন এবনে গোলাম সামাদের ক্ষুরধার যুক্তি ও তাথ্যিক অনবদ্য পরিবেশনায়।
এবনে গোলাম সামাদের ছাত্রজীবনের পাঠ ও কর্মজীবনের অধ্যাপনা উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে হলেও তিনি তার পাঠের চৌহদ্দিকে সীমায়িত করেননি কখনও। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার দক্ষতা ছিল সুবিদিত। তার সমকালে এমন বোদ্ধা-প-িতের খোঁজ মেলা ভার। তবে নৃ-তাত্ত্বিক বিষয়ে নিবিষ্ট পাঠ ও গভীর অধ্যয়ন বাঙলাভাষীকে দিয়েছে এক জগতের ঠিকানা। এ বিষয়ে সমৃদ্ধ পাঠ, ব্যাপক অধ্যয়ন, মনোযোগী গবেষণা সর্বোপরি এসবের সরল উপস্থাপনায় ঋদ্ধ হয়েছে বাঙলা ভাষায় জ্ঞানের এ শাখা। এতদিন এ অঙ্গনে উৎস ও আকর গ্রন্থের যথেষ্ট দৈন্য ছিল। এবনে গোলাম সামাদের এ বিষয়ক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম ও গ্রন্থাদি নৃ-বিজ্ঞানের মৌলিক ও আদি গ্রন্থ হিসেবে সর্বদা স্বীকার্য।
প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ একজন আত্মসচেতন মানুষ। তিনি নিজেকে ভুলে থাকতে পারেননি এক মুহূর্তের জন্যও। তার নিজেকে চেনার প্রয়াস সর্বক্ষণের। তিনি তার জাতি, জাতিসত্তা, পরিচয়ের উৎস ইত্যাদি অন্বেষণে চষে বেড়িয়েছেন ইতিহাসের অলি-গলি-প্রান্তর। তার প্রতিটি পাঠ ছিল নিবিষ্ট ও নির্মোহ। তার পাঠে কোনো ধরণের একরৈখিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। তবে পাঠ-পরিণতি নিঃসৃতিতে ছিল তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টি ও স্বতন্ত্র ভাবনা। এখানেই এবনে গোলাম সামাদের বিশেষত্ব। এবনে গোলাম সামাদ তার ইতিহাস অধ্যয়ন ও নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণার মিশেলে ব্যস্ত পাঠক ও জিজ্ঞাসুজনদের সামগ্রিক প্রয়োজনে রচনা করেছেন তার ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ গ্রন্থখানি। এক অনবদ্য গ্রন্থ বটে।এ বইয়ে তিনি তার আপন পরিচয়ের অনুসন্ধানে নয় বরং আমাদের দেশ ও জাতির প্রকৃত আত্মপরিচয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়েছেন অতিমাত্রায়। তার অধ্যয়ন গন্তব্য স্পর্শ করা অবধি তিনি এ থেকে নিবৃত হোননি। তার আত্মপরিচয়ের সন্ধানে বইটি অন্তত আমাদেরকে সে কথারই জানান দেয়। এ গ্রন্থে জাতিসত্ত্বার স্বরূপ, বিকাশধারা, নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপান্তর, রাষ্ট্রচিন্তা, রাজনীতি-আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাকার বিষয়ে বিদগ্ধ ও প্রাজ্ঞ আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন পণ্ডিতপ্রবর এবনে গোলাম সামাদ। এ গ্রন্থের অধ্যয়নে এ জাতি পেতে পারে নতুন আলোকের সন্ধান, মুক্তি মিলবে অসংখ্য বিভ্রান্তির। জানা যাবে আমাদের জাতি ও জাতীয়তার অমূল্য রত্নভাণ্ডার ও তথ্য খাজাঞ্চী।
অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের কাছে নেই। জানা নেই তার দলবাজির খবরও। তবে তিনি ছিলেন অতি মাত্রায় রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ। প্রায় শতায়ু প্রাপ্ত বহুদর্শী এ প-িত প্রত্যক্ষ করেছেন বাঙলার রাজনীতির দীর্ঘকাল, সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই, নানান টানা পোড়েন, রাজনীতির জোয়ার ভাটা। তাই বাংলাদেশের প্রায় পৌনে এক শতাব্দির রাজনীতি তাকে অধ্যয়ন করে রপ্ত করতে হয়নি। রাজনীতির সমুদয় হালচাল কিংবা চালচিত্র ছিল চাক্ষুষ। তাই তিনি বাংলার ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম কিংবা উপসম্পাদকীয়।
তথ্যের পোক্ততা, তত্ত্বের নির্ভরতা, বাক্যের শক্তিমত্তা, দৃষ্টিভঙ্গির নির্মোহতা, রাজনীতির মোড়লদের অসংগতি, তাদের অসংলগ্ন আচরণ, বিভ্রান্তির মূল জায়গা এবং পরিশোধনে মোলায়েম নির্দেশনার কারণে তার প্রত্যেকটি কলাম বা উপসম্পাদকীয় আজও সমান আবেদনময়ী। সুস্থ চিন্তার রাজনীতিকদের আজও তা প্রেরণার উৎস। রাজনীতিকে সুস্থ ধারাতে ফেরাতে তার কলামসমূহ সাক্ষাত বটিকাতুল্য, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও সফলতার জন্য মাইল ফলক।
তার প্রতিটি রাজনৈতিক কলামেই থাকে স্বতন্ত্র চিন্তার সফেদ প্রলেপ। তার রাজনীতি বিষয়ক কলামসমূহ নির্বাচিত কতেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ সমন্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে রাজনীতি বিষয়ক নির্বাচিত কলাম। এ গ্রন্থটি একই সাথে বাংলাদেশের রাজনীতি ও বাঙলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের তাবৎ সঙ্কট নিয়ে রচনা করেছেন তার নিবন্ধ-প্রবন্ধ কিংবা উপ-সম্পাদকীয়। তাৎক্ষণিক ইস্যুতে লিখিত এসব রাজনতৈক উপসম্পাদকীয় কোনো সহজলভ্য বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের বিপক্ষে বলা, তাদের ভ্রম চিহ্নিত করা, শোধরানোর পরামর্শ দেয়া কিংবা কদাচ চোখে অঙ্গুলি স্থাপন করে দৃষ্টি খুলে দেবার চেষ্টা করা এ যে কতবড় কঠিন কাজ তা বিশ্লেষণ করা নিষ্প্রয়োজন। এই কঠিন কাজটিই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বৌদ্ধিক কৌশলে মসৃণরূপে সম্পন্ন করতে পারতেন প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ। তার লেখা রাজনৈতিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বোদ্ধা মহলে উৎসাহ বা বিরক্তির শেষ নেই। তার লেখা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনার অন্ত নেই। এ সব লেখার জন্য তিনি কখনও নন্দিত আবার কখনও নিন্দিত। কিন্তু সে সবে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের। তার কলাম সংকলনের গ্রন্থটিতে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রায় শতের কাছাকাছি কলাম রয়েছে। এখানে রোহিঙ্গা, রাজনীতির ডান-বাম, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, ১৫ আগস্ট, ৭ নভেম্বর, হরতাল, ধর্মঘট, গণতন্ত্র, বংশতন্ত্র ইত্যাকার বলা না বলা, আলোচিত-অনালোচিত সুপ্ত প্রায় সকল বিষয়কে একীভূত করে দেশ কল্যাণে রচনা করেছেন প্রতিটি নিবন্ধ। তার নিবন্ধের ভাষা কখনও তির্যক, কখনও সরাসরি। আবার কখনও প্রতীকি। কিন্তু সর্বাবস্থায় তা সত্যের উন্মোচক, দেশের কল্যাণ নির্ণায়ক।
তিনি অর্ধশতেরও বেশি রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন আন্তর্জাতিক বিষয়ে। আধুনিক বিশ্বের শক্তিমান দেশসমূহের রাজনীতি, কৌশল, দাম্ভিকতা, বিপর্যয়ের অশনি, দুর্বলদের করণীয়, প্রতিবেশী দেশসমূহের অন্তর্দ্বন্দ্ব, খামখেয়ালীপনা ইত্যাদি ইস্যকে সামনে এনে মানব কল্যাণে রচিত তার সকল প্রবন্ধ-নিবন্ধ। মুসলিম নিধন, দুর্বলদের উপর অবলাদের খড়গ, মোড়লদের একচোখা নীতি, দুই বন্ধু প্রতিম দেশের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করা, মোফত ফায়দা হাসিল, স্থলপথ, জলপথ, আকাশপথকে অনিরাপদ করার কুটকৌশল ইত্যাকার বিষয়ে সুস্পষ্ট উচ্চারণ সন্বলিত বাঙাালি লেখক কেবল তাকেই নজরে পড়ে। এত সমৃদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত লেখা সমকালে আর কারো ঝুড়িতে দেখা যায় না। প্রচণ্ড সাহসি আর বিক্রমী লেখার জন্যই তিনি অনেকদিন বেঁচে থাকবেন- বাংলাদেশিদের হৃদয়ে, বিশ্ববাসীর চেতনায়। যাহোক আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক কিংবা দেশের নানান ইস্যুতে লিখিত ও রচিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধগুলো ছিল আলোক সঞ্চারী। জ্ঞানরাজ্যের নবদ্যুতি। প্রতিটি নিবন্ধের গন্তব্য ছিল লক্ষ্যাভিসারী। এ যেন জ্ঞান সম্রাজ্যের এক একটি ঝকঝকে নুড়ি।
সবার উপরে দেশ সত্য তাহার উপরে নেই। দেশপ্রেমের উচ্চাংগীয় পরাকাষ্ঠার শ্লোগান এটি। প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের জীবনেও এ প্রবাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন মন প্রাণ দিয়ে। বাঙলার সমাজ-সংস্কৃতিকে লালন করতেন হৃদয় দিয়ে। বাংলাদেশ, দেশের কল্যাণ, জাতির মঙ্গল এর বাইরে কোনো চিন্তা করতে পারতেন না এক মুহূর্তের জন্যেও। এই মহৎ চিন্তা ও চেতনার প্রসব বেদনার ফলশ্রুতি প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের ‘বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া’। সত্যিই এ এক অনবদ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থের পাঠ পাঠককে নিশ্চিত করে এবনে গোলাম সামাদের দেশপ্রেম, তাকে প্রভাবিত করে এবনে গোলাম সামাদের উত্তুঙ্গ দেশভাবনা। তার মধ্যে সম্ভাবিত করে নবমাত্রার।
দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে, প্রয়োজনে সকল প্রকার আত্মত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে এ গ্রন্থের প্রতিটি পাঠ, বরং প্রতিটি শব্দ আমাদেরকে সচকিত করে আমি কী করছি? দেশ আমাকে কী দিয়েছে? তার প্রাপ্য কী? আমি কি মূর্চ্ছিত? আমার সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে, খামখেয়ালী মুক্ত হয়ে দেশের কল্যাণে, উন্নয়নে ও পরিবর্তনে সত্বর মনোনিবেশ করতে হবে এখনই।
সমাজ বিনির্মাণের টান, দুনিয়াকে কল্যাণে ভরে দেবার মোহাবিষ্ট আহ্বান তার প্রতি সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ভালোবাসার গোপন রহস্য এখানেই। কারণ তার কল্যাণ ভাবনা ছিল নিরপেক্ষ, তার সুস্থ বিনির্মাণ পরিকল্পনা ছিল নিষ্কণ্টক। তার সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি ছিল নিখাঁদ, বিশ্বাসে টুইটুম্বর।
এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন গত শতাব্দীর শেষার্ধের কীর্তিমান লেখক। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারের খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক। মূলত তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত সব্যসাচী কলামিস্ট। বৈচিত্র্য বিষয়ে নবতর ভাবনায় নির্মোহ কলমের অবিরাম যোদ্ধা হিসেবে অবশ্যই তিনি সম্মানার্হ। তার সমকালে এমন কলমযোদ্ধা দেখা মেলা ভার। এমন দেশপ্রেমিক কলমযোদ্ধা ও জ্ঞান প্রেমিক বোদ্ধা আমাদের কমই নজরে আসে। এবনে গোলাম সামাদ উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও তিনি একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও মর্যাদাবান কলামিস্ট। পৃথিবীতে তার আয়ুষ্কাল কম নয়। তবে পৃথিবী হতে তিনি যা নেবার নিয়েছেন। তবে দিয়েছেন অনেক বেশি। তার অবদানের প্রাচুর্যের কারণেই পৃথিবী তাকে উচ্চকিত করে রাখবে অনন্তকাল। তার চিন্তার বিভিন্নতা ছিল সম্প্রসারিত। বোদ্ধাজনদের মন্তব্য- জ্ঞানের এমন শাখা নেই যেখানে প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের পদচারণার স্পর্শ নেই। তিনি একজন ক্ষণজন্মা মহাজ্ঞানী এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
আমাদের এই বাংলাদেশের মতো দেশের আত্মবিস্মৃত, আত্মভোলা জাতির জীবনে এবনে গোলাম সামাদের মতো সজ্জন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন বড় বেশি। এবনে গোলাম সামাদের সমুন্নত রাজননৈতিক দর্শন, উন্নত সমাজ ভাবনা, বিশ্বাস নির্ভর সাংস্কৃতিক চেতনা, কর্ম নির্ভর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অহিংস ধর্মনীতি, মানবতা ও মানবিকতার প্রেষণা, নিরপেক্ষ সত্য চিন্তনই কেবল পারে একটি ইতিহাসবিস্মৃত সাংস্কৃতিকে ভুলে থাকা নিরীহ অবলা জনগোষ্ঠীর সার্বিক মুক্তির দ্বার উন্মোচন করতে।
আমাদের জন্য প্রয়োজন বেশি বেশি এবনে গোলাম সামাদদের জন্মগ্রহণ, প্রতিপালন ও পৃষ্ঠপোষকতা। তার মতো কীর্তিমান গুণী ব্যক্তিত্বের জন্য নিঃসরিত হোক আমাদের হৃদয় উজাড় করা নির্ভেজাল সমগ্র ভালোবাসা।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বহুপ্রজ এবনে গোলাম সামাদ যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন তার জ্ঞান সাধনার অনন্যতায়। তার বিদগ্ধ মননশীলতা অনন্তকাল টিকে থাকবে তার সৃষ্টির অনবদ্যতায়। প্রচার বিমুখ এবনে গোলাম সামাদ প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠবেন দিনকে দিন তার বিকিরিত জ্ঞানের দীপ্ত শিখায়।
আমাদের এ আলোচনা কোনোভাবেই এবনে গোলাম সামাদকে প্রতিমূর্ত করতে পারবে না। কারণ সূর্যের ছায়া নির্মাণ প্রচেষ্টা যে অসম্ভবকে সম্ভব করারই ব্যর্থ প্রচেষ্টা। এবনে গোলাম সামাদের পূর্ণ চিত্রায়ন প্রচেষ্টা কেবল দুঃসাধ্য নয় এ রীতিমতো স্পর্ধাও বটে। তাই প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের সামগ্রিক উন্মোচন নয় বরং আমরা জ্ঞানের এ সাম্প্রতিক অধীশ্বরকে সাধুবাদ জানাই। তার চিন্তার পরিধির বিশালত্বে বিস্মিত হই। নিবেদন করি- জ্ঞানতাপস, শ্রদ্ধাবর এবনে গোলাম সামাদের জন্য অকৃত্রিম শ্রদ্ধার আন্তরিক অর্ঘ। ওপারের জীবনেও তিনি চির সুখের অধিকারী হউন সে প্রত্যাশা সর্বক্ষণের।
এবনে গোলাম সামাদের চিন্তা অমর হোক। তার দর্শনে পুলকিত হোক প্রাযুক্তিক এ বিশ্ব।
ড. কামরুল হাসান, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ এ প্রকাশিত।