বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায়ই এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে প্রভুর ডাকে সার দিয়েছেন। পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাঝখানে তিনি করোনায় আক্রান্ত হলেও পরে করোনামুক্ত হন। হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের উন্নত চিকিৎসায় বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কাছে দাবি করা হলেও তার কোনো প্রকার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
২.
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তার বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়ে নিলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে। ১৯২৯ সালে তার জন্ম রাজশাহীতে। সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকার তেজগাঁও কৃষি ইনস্টিটিউট থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে প্রথমে বিলাত ও পরে ফ্রান্সে যান উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন, বিদেশে লেখাপড়া করতে গেছেন বৃত্তি নিয়ে। কিন্তু সেখানে থাকেননি, ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে এসে ১৯৬৫ সালে অধ্যাপনায় যোগ দেন রাজশাহী ভার্সিটিতে। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বা উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর। এবনে গোলাম সামাদ উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও বিভিন্ন বিষয়ে বহুমাত্রিক লেখার জন্য বহুল পরিচিতি পান। প্রকাশিত হয়েছে অন্তত ২১টি বই। তিনি এক সময় দৈনিক ইনকিলাবে ও পরে নয়া দিগন্তে যে জ্ঞানগর্ভ লেখা লিখতেন তা আর কারো পক্ষে লেখা সম্ভব কি না জানি না।
প্রতি সপ্তাহে তার লেখা কলাম প্রকাশিত হওয়ার পর বোঝা যেত মানুষ কত আগ্রহভরে ও গুরুত্বের সাথে সেগুলো পড়তেন। আমি উল্লিখিত দুটি দৈনিকের ডেস্কেই কাজ করেছি, ফলে তা জানা সহজ ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় যান এবং প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেন, কাজ করেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায়।
আগেই বলেছি তিনি সাম্প্রতিক কালে নয়া দিগন্তে নিয়মিত কলাম লিখে আসছিলেন। আরো লিখতেন দৈনিকটির সহযোগী মাসিক প্রকাশনা ‘অন্য এক দিগন্তে’। এসব লেখায় অপরিসীম জ্ঞান আর প্রখর বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক ছিল। কোনো কোনো লেখায় আবার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতেও দেখেছি। কিন্তু তাই বলে তিনি আখঠাক করে কথা বলতেন না, যা বলা প্রয়োজন মনে করতেন তাই বলতেন। একটা ঘটনা বলি। হিলারি ও ট্রাম্পের নির্বাচনকালে তিনি অনেক আগেই বলে বসলেন ট্রাম্পই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন, হিলারি জিততে পারবেন না। তিনি এর কারণও বিশ্লেষণ করলেন। আর যায় কোথায়? সবাই ঝেঁকে ধরলেন তাকে আর নয়া দিগন্ত পত্রিকাকে। লেখকের মতামত নিজস্ব, পত্রিকার তাতে দায় নেই একথা বলে এক ধরনের খালাস তো হলো পত্রিকাটি, কিন্তু তিনি দায়ী হয়ে রইলেন। ফোনের পর ফোন, কাগজে লেখা ও ই-মেইলে আসা প্রতিক্রিয়ায় ভরে গেল টেবিল। কারণ সবাই, বিশ্বের প্রায় অনেক দেশ ও দেশনায়ক হিলারির আসন্ন বিজয় দেখতে পেয়ে রীতিমতো অভিনন্দন জানাতে যেন ফুলের তোড়া নিয়ে প্রস্তুত। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের আগ্রহটা ছিল অন্য কারণে, সেটা নাইবা বললাম। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল এবনে গোলাম সামাদই সঠিক। চার বছর ট্রাম্পের নানা পাগলামি বিশ্বকে দেখতে হয়েছে।
৩.
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আমি কলেজ জীবনে বোটানির উপর সুন্দর একটি বই পেয়ে সেটি কিনি। পড়ে খুব মজা পেতাম, কারণ চারপাশের গাছ নিয়ে, এসবের নানা গুণাগুণ নিয়ে লেখা ছিল বইটি। বইটির নাম আজ আর মনে নেই, তবে বইয়ের লেখক ছিলেন এবনে গোলাম সামাদ, এটি মনে আছে। তখন থেকে মাথায় নামটি ঢুকে যায়। দৈনিক ইনকিলাবে কাজ করতে এসে আবার তাকে পেলাম পত্রিকার পাতায়। আমার ছোট মেয়ের রাজশাহী ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে সপ্তাহখানেক সেখানে থাকতে হয়েছিল। থাকতাম শাহ মখদুম হলে ছাত্রদের গেস্ট হিসেবে, মেয়ে থাকত ছাত্রীদের একটি হলে। বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পরীক্ষা, তাই না থেকে উপায় নেই। একদিন বিকেলে গেলাম ইনকিলাবের রাজশাহী ব্যুরো অফিসে। ব্যুরো চিফ রাজশাহীর নামকরা সাংবাদিক রেজাউল করিম রাজু আমাদের পেয়ে খুব খুশি হলেন। দেখলাম সেখানে একজন বৃদ্ধ বসে লিখছেন। পরে জানলাম তিনিই প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ। তাকে বাসা থেকে এনে বিভিন্ন খাবারদাবার দিয়ে বসিয়ে দিতে হয়, তার পর সময় নিয়ে লেখেন। এটাই তার কাছ থেকে লেখা আদায়ের কৌশল, জানালেন রাজু। লেখার ফাকে সালাম দিলাম, তার লেখা বই ও কলামের ভক্ত পাঠক জেনে তিনি খুশি হলেন। মেয়ের কথা জানতে চাইলেন। বললাম। উনি বললেন : তাহলে একটু টেস্ট নেই, কেমন ছাত্রী।
আমার মেয়ে তার নাতনীর বয়সী, দেখলাম আলাপ জমেছে ভালোই। রাজু আগেই কোথায় যেন গেছেন, অফিস সহকারী ছেলেটা আছে। বেশ গোছানো অফিস। আমিও একটু বাইরে বেরুলাম, ওরা নিজেদের মতো করে আলাপ করুক। ফিরে আসতেই স্যার বললেন, আপনার মেয়ে তো বেশ জানে। কোনো প্রশ্নেই আটকাতে পারিনি। আমি বললাম, স্যার, আমাকে তুমি বলুন। শেষে তিনি রাজি হলেন। মেয়ে বলল, স্যারের সাথে ছবি তুলব। সাথে আগেকার দিনের ক্যামেরা ছিল, ফিল্মও লোড করা ছিল। তুললাম ছবি। রাজশাহীর কয়েকটি বিভাগে চান্স পেলেও আমার মেয়ে পড়তে রাজি হয়নি, প্রচণ্ড গরম বলে। তখন এপ্রিল মাস ছিল, নববর্ষ উৎসবও চলছিল। ফলে এই সময়টা রাজশাহী থাকে খুবই উত্তপ্ত। পরে মেয়েটি জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে সেখানেই পড়েছে। কয়েক দিনই কথা বলেছি তার লেখার ফাঁকে। জেনেছি অনেক জ্ঞানগর্ভ বিষয়। তবে খুব বেশি কথা বলতেন না তিনি, একটা গাম্ভির্য ছিল। বলতে গেলে কয়েক দিনে আমাদের সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়েছিল, তাই কথা বলতেন আমাদের সাথে। এই হলো এবনে গোলাম সামাদ স্যারের সাথে আমার স্মৃতি। এর পর আর দেখা হয়নি। নয়া দিগন্তে যোগ দেয়ার পর দেখলাম তিনি সেখানে লেখা শুরু করেছেন। সে সময় তার দেখা পেতাম পত্রিকার পাতায়। কয়েক বছর ধরে লিখেছেন। শেষ দিকে অসুস্থতার কারণে আর পারেননি।
৪.
এবনে গোলাম সামাদ বিরল প্রতিভার অধিকারী একজন অনন্য লেখক ও কলামিস্ট ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। বিজ্ঞান শিখেছেন ও শিখিয়েছেন পদ্ধতিগতভাবে। তার একটি বৈজ্ঞানিক মানস ও স্বকীয় চিন্তারীতি গড়ে উঠেছিল। এই বিষয়ে তার সমৃদ্ধ ইউরোপীয় উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছিল আর সেটাই কাজে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন : ‘আমি ছিলাম, ওই যাকে সাধারণভাবে বলে অভিজ্ঞতাবাদী। সবকিছু যুক্তি দিয়ে প্রমাণিত হয় না। কেউ যদি বলেন, রাজশাহীর বাজারে ১৪০ রকম আম বিক্রি হয়, তবে তার কথাটা সত্য কি না, সেটা জানার জন্য যেতে হবে রাজশাহীর বাজারে। বিশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে এটার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না।’
এখান থেকে স্পষ্ট যে তিনি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণমূলক অভিজ্ঞতাকে সবচাইতে গুরুত্ব দিতেন। আর এখানেই নিহিত রয়েছে তার নৈর্ব্যক্তিক, নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ এবং ব্যবহারিক বৈজ্ঞানিক মানসের উৎস। তার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল যা তার লেখার পরতে পরতে দৃশ্যমান ছিল। সেটি হলো এদেশের গণমাধ্যমে ও বুদ্ধিবৃত্তির বলয়ে বহুল প্রচলিত যেসব ভাষ্য ও বয়ান পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ব করছে তিনি সেগুলো তার নিজস্ব পড়াশুনা, জ্ঞান ও বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে যাচাই বাছাই করে নিতেন। তিনি এমন কোনো দল বা পক্ষ অবলম্বন করেননি, যেখানে তথ্য ও সত্যের চাইতে রঙ মাখানো প্রচার-প্রপাগাণ্ডাই মুখ্য ছিল। এ কারণে তাকে এদেশে বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত বয়ানগুলোর পক্ষাবলম্বন বা সেগুলো পুনর্লিখন করতে দেখা যায়নি। বরং তিনি নিঃস্বার্থভাবে ও নির্মোহভাবে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিটি বিষয়কে দেখতে, বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন, বুঝিয়েছেনও । তার এসব লেখা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। জানি না এসব লেখার সবগুলো বই আকারে বের হয়েছে কি না, না হওয়ারই কথা। প্রকাশকদের কাছে এবং তার গুণমুগ্ধ পাঠকদের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেন বিষয়টি ভেবে দেখেন এবং বই আকারে সেগুলো বের হয়। তার প্রতি রাইল অপরিসীম শ্রদ্ধা।
লেখকঃ আহমদ মতিউর রহমান; প্রকাশিত হয়েছে ‘অন্য এক দিগন্ত’ ম্যাগাজিনে, ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর।