বাংলাদেশের বরেণ্য জ্ঞানতাপস, ভাষাবিদ-বুদ্ধিজীবী ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না’। তবে একজন গুণী-জ্ঞানী-শিক্ষাবিদ হিসেবে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এদেশে যথেষ্ট কদর পেয়েছিলেন। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের আগেই ১৯৬৯ সালে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ইহলোক ত্যাগ করলেও এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এখনো তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তবায়নের নেপথ্যে যেমন এ দেশের লাখো মুক্তিযোদ্ধা ও কোটি কোটি সাধারণ মানুষের নি:স্বার্থ অবদান রয়েছে, তেমনি সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি দেশের লেখক-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিক ও দেশে-বিদেশে অবস্থানরত অ্যাকাডেমিসিয়ান, শিল্পীদেরও অনন্য সাধারণ ভূমিকা রয়েছে। একটি জাতির মননে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুননের প্রথম কারিগর নাকি মাটির ভূমিপুত্র কবি, দার্শনিকরা। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব আঙ্গিকে দল গঠন করেন এবং ভবিষ্যতের কাক্সিক্ষত স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। সেখানে জাতির হাজার বছরের বিবর্তনের ইতিহাসের ধারাক্রম ও ভবিষ্যতের রাষ্ট্র ও নিরাপত্তার প্রত্যাশিত চেতনাজাত ঐক্য বিনির্মানে যারা নেতৃত্ব দেন তারাই জাতির পথ-প্রদশর্ক, বাতিঘর।
কাজি নজরুল ইসলাম খন্ডিত জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের কথা না বললেও তিনিই প্রথম বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। এর আগে ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলনসহ অন্তত তিনশ’ বছরের ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাসই নজরুলের চেতনায় জাগ্রত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নবজাগরণে নেতৃত্ব দিয়ে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার পরিপুষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। এক সময়ের হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, জহুর হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ, আখতারুল আলম, আবু জাফর শামসুদ্দিনের মত কলামিস্ট এবং সৈয়দ আলী আহসান, দার্শনিক দেওয়ান আজরফ, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এবং রাজ্জাকের সুযোগ্য শিষ্য আহমদ ছফাসহ একদল প্রজ্ঞাবান- সৃষ্টিশীল শিক্ষাবিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের এসব রথি-মহারথিদের মধ্যে সবর্শেষ ভার্সেটাইল ব্যক্তি ছিলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সদ্য মরহুম ড. এবনে গোলাম সামাদ।
এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী পালন করছি। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন রক্ত ঝরাতে হয়, স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য দেশের মানুষকে ঘাম ঝরাতে হয় এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে ভবিষ্যতের লক্ষ্য ঠিক করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্মান ও সুপ্রসস্থ করতে হয়। সেখানে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ব্যর্থতা বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যম ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির স্বাধীন চর্চার ক্ষেত্র উন্মুক্ত থাকলে স্বাধীনতার সার্বজনীন স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রলম্বিত হলেও তা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়না। তবে এখনকার কর্পোরেট পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বৈদেশিক স্বার্থের কুশীলবরাও গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে বিভ্রান্ত করার এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর থাকতে পারে। দেশে দেশে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।
গত ১৫ আগস্ট জাতিয় শোক দিবস, আমাদের স্বাধীনতার মূল স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম মৃত্যু বার্ষিকীর দিনে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেলেন দেশের অন্যতম প্রবীণ বুদ্ধিজীবী, প্রাজ্ঞ কলামিস্ট, লেখক, উদ্ভিদ ও অণুজীব বিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ- ইতিহাস, ভাষা ও শিল্পকলা গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড.এবনে গোলাম সামাদ। এমনিতে রাজনৈতিক কারণে এ দেশের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী ও অ্যাকাডেমিসিয়ানদের মধ্যেও এক ধরণের কৃত্রিম রাজনৈতিক বিভাজন তৈরী হয়েছে। এবনে গোলাম সামাদ কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হলের দেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা পালনকারি মুক্তিযোদ্ধা। তবে লেখালেখির মাধ্যমে তিনি যে রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত মতামত পোষণ করতেন, তাতে এক শ্রেণীর মানুষের বিরাগভাজন হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁর মতো তিন কালের সাক্ষী প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবীর মৃত্যুতে দেশের সরকার বা সরকারি দলপন্থীদের নীরবতা দুঃখজনক। অ্যাকাডেমিক নথিপত্র অনুসারে, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণকারী এবনে গোলাম সামাদ ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট রবিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯২ বছর বয়েসে ইন্তেকাল করেছেন।
দেশের সরকারের মন্ত্রী-আমলা, মূল ধারার গণমাধ্যম বা একচেটিয়া রাজনৈতিক তৎপরতায় সাত দশক ধরে শিক্ষা ও গবেষণায় নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা কলমসৈনিকের মৃত্যুতেও কোনো প্রতিক্রিয়া, শোকবার্তা বা শ্রদ্ধা নিবেদনের আগ্রহ দেখায়নি। এর আগে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে দুই বাংলার সেরা কবি আল মাহমুদের মৃত্যুর পরও দেশের ক্ষমতাসীন জাতীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে কোনো শোকবাণী দেখা যায়নি। কবি আল মাহমুদও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রথম যৌবনে ঢাকায় পর্দাপণের পর থেকে সারাজীবন তিনি এই শহরেই বাস করে গেছেন, ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় আল মাহমুদের মৃত্যুর পর তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করার অনুমোদন দেয়া হয়নি। রাজশাহীতে জন্মগ্রহণকারি এবনে গোলাম সামাদ ১৯৪৮ সালে রাজশাহীর বিষ্ণুপুর শিক্ষাসংঘ থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৪৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ঢাকার তেজগাও কৃষি ইনস্টিটিউট থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর কৃষিবিদ্যা ও উদ্ভিদের রোগতত্ত্বে (প্লান্ট ভাইরাস) উপর বৃটেন ও ফ্রান্সে ৪ বছর উচ্চতর গবেষণায় যোগ দেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে দেশে ফিরে এসে তিনি ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। তবে তাঁর শিক্ষা, গবেষণা ও কর্মের ক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির গন্ডীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জাতির স্বাধীনতা এবং অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নিজের অবস্থান থেকে স্বচ্ছতার সাথে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। উদ্ভিদের রোগতত্ত¡ ও ভাইরাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও পাঠদানের পাশাপাশি একজন সব্যসাচী কলাম লেখক হিসেবে গত অর্ধশত বছর ধরে অবিরাম লিখে গেছেন অসংখ্য লেখা। রাজশাহীতে বাস করেও তিনি ঢাকার জাতীয় দৈনিকগুলোর নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবে পাঠকের মনোযোগ ও জনপ্রিয়তা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে জাতির এক চরম ক্রান্তিকালে ঢাকায় দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার যাত্রা নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়ন সঞ্চার করেছিল। ইনকিলাবে প্রকাশিত এবনে গোলাম সামাদের কলামগুলো অনেক মানুষের প্রত্যাশা ও অনুপ্রেরণার অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছিল। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তাঁর গবেষণা ও লেখার বিষয়-বৈচিত্র্য। বিশেষত: আমাদের জাতির রাজনৈতিক ও নৃতাত্তি¡ক ইতিহাস, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা ও প্রত্যাশার আলোকে নতুন পথের অনুসন্ধান দিতে তিনি আজীবন আপোসহীন কলমসৈনিকের ভূমিকা পালন করে গেছেন।
এবনে গোলাম সামাদের মৃত্যুর পর মূল ধারার জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁর অসংখ্য ছাত্র-গুনগ্রাহী যারা এখন রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, গণমাধ্যমে কাজ করছেন, সংবাদপত্রে লেখালেখি করছেন তাদের মধ্যে অনেকেই প্রিয় শিক্ষক, লেখক-কলামিস্ট, শেকড়সন্ধানী প্রাজ্ঞ গবেষকের মৃত্যুতে শোকার্ত-মর্মাহত হয়েছেন। সুদীর্ঘ জীবনে এবনে গোলাম সামাদের জ্ঞানসাধনা এবং শাসক শ্রেণীর ভ্রুকটি ও রক্ত-চক্ষুর বিপরীতে আপোসহীন ভূমিকার কারণে কেউ কেউ তাঁকে সক্রেটিস অব দি ইস্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। গ্রীসের দার্শনিক সক্রেটিসের কোনো রচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তার সুযোগ্য শিষ্য প্লেটোসহ পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক-অ্যাকাডেমিসিয়ানরা সক্রেটিসের অবদানের কথা স্মরণীয় করে গেছেন। কোনো কোনো মানুষের কর্মের চেয়ে তার ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের দৃষ্টান্ত চিরায়ত মানুৃষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। সত্য প্রতিষ্ঠায় সক্রেটিস নিজের জীবনতে তুচ্ছ করে হেমলক বিষে আত্মোৎসর্গের বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। জাতির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের পরিচয়, আত্মঅনুসন্ধান, আত্মপক্ষ ও সীমাপরিসীমা, পরিচর্যা ও নিরাপত্তার দিক নির্দেশার রূপরেখার জন্য কেউ কেউ এবনে গোলাম সামাদকে ইবনে খালদুনের সাথেও তুলনা করেছেন। এ দেশের গর্বিত মুসলমান হিসেবে হাজার বছরের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের পরম্পরা নিয়ে আমাদের দেশে খুব একটা কাজ হয়নি।
ইউরোপে উচ্চতর গবেষণা করে ডিগ্রী প্রাপ্ত উদ্ভিদের অণুজীব বিজ্ঞানী এবনে গোলাম সামাদ জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি ও রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চেতনাকে শাণিত করতে যে কাজ করে গেছেন তা বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টাদের মনে প্রত্যাশিত আলোকসঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষের চেতনাজগতকে বাংলার সীমা ছাড়িয়ে হাজার বছরে বিশ্বমুসলিমের খ্যাতিমান সূফি-দার্শনিক, জ্ঞানসাধক, বিজ্ঞান গবেষক ও দিগি¦জয়ী বীরদের কর্মের সাথে ঐক্যসুত্রে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এ দেশের যে ক’জন লেখক-সাহিত্যিক, গবেষক ইসলামি চেতনা ও জাতীয়তাবোধের আলোকে জাতীয় চেতনাকে শাণিত করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করেছেন এবনে গোলাম সামাদ নি:সন্দেহে তাদের অন্যতম। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলোর দিকে চোখ বুলালেই বুঝা যায়, তিনি জাতিসত্তার বিকাশের প্রথম পাঠ থেকেই তার কর্মতৎপরতা শুরু করেছিলেন। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, আত্মপক্ষ, আমার স্বদেশ ভাবনা, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, বাংলাদেশের আদিবাসি এবং জাতি ও উপজাতি, বাংলাদেশে ইসলাম, বাংলাদেশ সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আরাকান সংকট এসব জাতিগত ও রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও নিজের অ্যাকাডেমিক বিজ্ঞান বিষয়সহ প্রকাশিত প্রায় ২৫ গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে তার ভার্সেটাইল জ্ঞান, চিন্তা ও গবেষণার পরিধি।
‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ গ্রন্থ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেখক এবনে গোলাম সামাদ বলেছিলেন, ‘আমি বইটির নাম রাখছি ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’। কারণ, বইটিতে চেষ্টা করা হবে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় খুঁজে পেতে। গ্রন্থের ৩৯টি পরিচ্ছেদে ধাপে ধাপে তিনি এই বাংলার মুসলমানদের জাতিসত্তার সন্ধান করেছেন। যেখানে বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব থেকে শুরু করে লেখক আলোচনা করেছেন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী অভ্যুদয় পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা। কোনো জাতিরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবেলা করে টিকে থাকা এবং মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে সব বিষয়গুলোতে জনগণের ঐক্য সমুন্নোত থাকা প্রয়োজন, এবনে গোলাম সামাদ সে সব বিষয় নিয়েই তার কলমকে সর্বদা শাণিত রেখেছেন। জাতির ভূমিপত্রদের অনৈক্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আগ্রাসি শক্তির পথ সহজ করে দেয়। আরাকান সংকট, ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ এবং মিয়ানমারের জান্তা রিজিমকে ঘিরে সাম্প্রতিক যে বাস্তবতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সে প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বিচার-বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন এবনে গোলাম সামাদ ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আরাকান সংকট’ গ্রন্থে। যেখানে বাংলাদেশের নমনীয় মনোভাব ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা, জাতিসংঘের আহŸান সত্তে¡ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না, তখন তিনি শক্তি প্রয়োগের পথেই সমাধানের পথ খুঁজেছেন। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ মিয়ানমারের প্রতি চীন-ভারতের সমর্থন এবং পশ্চিমাদের নিস্ক্রীয়তার কথা বলে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে নতজানু নীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
অবশেষে জাতিসংঘও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বদলে রোহিঙ্গাদের মেনে নিতে বাংলাদেশকে সুপারিশ করছে! এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশের নমনীয়তা, উদারতা কোনো মূল্য পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউই আমাদের বন্ধু নয়। এর মানে হচ্ছে, আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের লিগ্যাসি বা হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয়-কূটনৈতিকভাবে আমাদের কোনো হোমওয়ার্ক নেই। শত শত বছর ধরে অবস্থানরত আরাকানের মুসলমানরা যদি বাঙ্গালি হয়, তবে সেই ভ’খন্ডটি বাংলাদেশেরই অংশ। আরাকানের মুসলমানদের যদি মিয়ানমারের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব না হয়, তবে রাখাইনের মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি তুলতেই পারে। যেহেতু এই সংকট সরাসরি বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে, এ কারণে আরাকানের স্বাধীনতাকামিদের পক্ষে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা নিয়ে পাশে থাকা বাংলাদেশের স্বার্থের জন্যই জরুরি। রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সমঝোতা ও কূটনৈতিক উদ্যোগ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের কমিটমেন্ট ব্যর্থ হলে বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশকে এখনি জোর প্রস্তুতি নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে এবনে গোলাম সামাদ যে যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধানের পথ বাৎলেছেন, তা মোটেও অবাস্তব নয়। বিশ্বের এক নম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের ট্রিলিয়ন ডলারের ওয়ার থিয়েটারকে ব্যর্থ করে দিয়ে আফগান মুজাহিদরা আবারো কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। বিশ বছর যুদ্ধ করেও আফগান তালেবানদের দুর্বল করা যায়নি। এর পেছনে রয়েছে পশতুন জাতির হাজার বছরের ঐক্য ও স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। মহান আফগান কবি খোশহালখান খাটক দিল্লীর মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরবর্তিতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধেও তাদের বিজয় এনে দিয়েছিল। বর্তমান বিশ্বের প্রধান দুই পরাশক্তি সোভিয়েত রাশিয় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করার ইতিহাস তো মাত্র তিন দশকের মধ্যেই ঘটেছে। এবনে গোলাম সামাদ আমাদেরকে তেমন একটি ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। নানা জাতিগোষ্ঠির বিচ্ছিন্নতাবাদি লড়াইয়ে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশ সব দিক থেকেই শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। চীনের রোড অ্যন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে যুক্ত বাংলাদেশ বরাবরই মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্ব ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছে। বাংলাদেশের এই সরল ও যৌক্তিক প্রত্যাশার অবমূল্যায়ণ করা হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই বিকল্প পথ বেছে নিতেই হবে। এবনে গোলাম সামাদ তার সর্বশেষ গ্রন্থে এ কথাই বলতে চেয়েছেন।
লেখাটি ২০২১ সালের ১৮ আগষ্ট দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছে, লিখেছেন জামাল বারী।