কথাটা উঠেছিল এইভাবে : কোন বন্ধু বললেন, নজরুল বড় কবি হতে পারেন নি, কারণ তিনি মননশীল ছিলেন না। আর একজন বললেন, নজরুল মননশীল হতে পারেন নি, কারণ, তাঁর ব্যক্তি জীবন কেটেছে বেজায় বিশৃঙ্খলায়।
নজরুল বড় কবি হলেন না, কারণ, তাঁর মধ্যে ছিল পড়া-শুনা ও মননশীলতার অভাব, এ-রকম মন্তব্য আজকাল হার-হামেশাই কথা প্রসঙ্গে শুনতে পাই, সাহিত্য-রসিক মহলে। কিন্তু কাব্য ও মননশীলতার মধ্যে যোগাযোগ কতটুকু?
নিজে কবি নই। কবিরা কিভাবে কবিতা লেখেন, সে বিষয় কোন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্তু কবিদের জীবনী পরে (পড়ে) আমার মনে হয়েছে, কবিতা ঠিক মননের ব্যাপার নয়। কবিতা কবির এক বিশেষ প্রতিভার দান। কবিতার কাজ কোন কিছু প্রমাণ করা নয়। কবিতার আবেদন মানুষের আবেগের কাছে। কথাটার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশেষভাবে কবিদের জীবনী থেকে। অনেক কবির জীবনেই কার্যত ঘটেনি ভাবনা-চিন্তার অবকাশ। জ্ঞান চর্চ্চার সুযোগ। কিন্তু তবু তারা হয়েছেন কবি, জগত-খ্যাত কবি। বিখ্যাত কবি র্যাবোঁ-র (Remband) কথাই ধরা যাক। র্যাবোঁ ছেলে বেলায় মার সাথে ঝগড়া করে বাড়ী থেকে পালান দু’বার। মাত্র ষোল-সতেরো বছরে লিখতে শুরু করেন কবিতা। র্যাবোঁ বাঁচেন সাইত্রিশ বছর। কিন্তু তিনি তাঁর উনিশ বছর বয়সের পর আর লেখেন নি কোন কবিতা। সাহিত্য ছেড়ে গ্রহণ করেন এক রোমাঞ্চকর ভবঘুরের জীবন। কিন্তু অত অল্প বয়সে র্যাবোঁ। যে সব কবিতা লিখেছেন ফরাসী সাহিত্যে তা অমর হয়ে আছে।
প্রায় কবির জীবনই বড় বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে কাটে। কবিদের জীবন ধ্যানীর জীবন নয়। ফরাসী কবি বদল্যার-এর (Baudelaire) বোহেমিআনা কবিকুলে বিশেষভাবে খ্যাত। এত বিশৃঙ্খল উদ্দাম জীবন খুব কম কবিরই ছিল। যৌবনের প্রারম্ভেই বদল্যার আক্রান্ত হন সিফিলিস রোগে। আর মারাও যান সেই একই রোগে। বদল্যার-এর কবিতা সাহিত্য জগতে স্মরণীয় হয়ে আছে, যেমন হয়ে আছে তাঁর বিশৃঙ্খল জীবনের কথা।
বয়স বাড়বার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ে। জ্ঞান বাড়ে। কিন্তু তা বলে ভাল কবিতা লিখবার ক্ষমতাও যে বাড়ে, এমন নয়। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বেঁচে ছিলেন আশি বছর। কিন্তু তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলি প্রায় সবই লেখা তাঁর তিরিশ বছর বয়সের মধ্যে। কেন এমন হয়?
কাব্য ও মননশীলতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন অনেকেই। এ সম্পর্কে টি, এস, এলিয়ট-এর একটা চমৎকার আলোচনা আছে। এলিয়টের বক্তব্য : কবিদের চিন্তাশীল ও ভাবপ্রবণ, এই দুই ভাগে ভাগ করে বিচার করতে যাওয়া একটা সাধারণ ভুল। কারণ সব কবিতার উৎসই হল কবির আবেগ (emotion) যাদের আমরা মননশীল কবি ব’লে চিহ্নিত করতে চাই তাঁরা আসলে আবেগ শূন্য নন। এঁদের বৈশিষ্ট হল, এঁদের আবেগ কোন বিশিষ্ট চিন্তা অথবা দর্র্শনকে নিয়ে জেগে ওঠা। এই সব কবি যা দান করেছেন তা কোন ধরাবাঁধা চিন্তা নয়, একটি চিন্তার সাথে জড়িত চিন্তার পরিপূরক আবেগ। যাঁরা মনে করেন কবিরা চিন্তা করেন, তাঁরা কবিতা লেখেন না-কবিতা সম্বন্ধে চিন্তা করেন মাত্র। এলিয়ট কটাক্ষ করে বলেছেন :
The people who think that Shakespeare thought, are always people who are not engaged in writing poetry, but who are engaged in thinking, and we all like to think that great men were like ourselves. (1)
কাব্য ও মননশীলতার মধ্যে যদি কোন যোগাযোগ না থাকে, তবে কবিতা, বিচার প্রসঙ্গে মননশীলতার প্রশ্নটি যুক্তিতে টেকে না। কিন্তু নজরুল প্রসঙ্গে মননশীলতার প্রশ্নটিই নানাভাবে অনেকে তুলে ধরতে চান। নজরুলকে বিচার করতে চান এঁরা নজরুলের জ্ঞানের পরিধি, চিন্তার সংগতি ইত্যাদি ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে। নজরুলের কবিতার থেকে নজরুলই স্থান পান এদের আলোচনায় বেশী। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের দান নিয়ে এখনো আলোচনা যথেষ্ট হতে পারেনি তার কারণ নজরুল সম্পর্কে আমাদের বিশেষ উপেক্ষা। নজরুল-সুহৃদদের লেখাও এর জন্য অনেক পরিমাণে দায়ি। তাঁদের অনেক মন্তব্য নজরুল সাহিত্য বুঝতে সাহায্য করে না। শ্রী অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর কল্লোল যুগ বইতে নজরুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন : “এই অস্থির এলোমেলোমি নজরুলের শুধু পোশাকে-আশাকে নয়, তাঁর লেখায়, তাঁর সমস্ত জীবনে ছড়িয়ে ছিল। বন্যার তোড়ের মত সে লিখত, চেয়েও দেখতাম না সেই বেগ-প্রাবল্যে কোথায় সে ভেসে চলেছে।…নিজের মুখে সে কারণে-অকারণে স্নো মাখতো খুব, কিন্তু তার কবিতার এতটুকু প্রসাধন করতে চাইতো না।” নজরুল-এর সাথে শ্রী অচিন্তোর ছিল ব্যক্তিগত পরিচয়। কিন্তু তাঁর বক্তব্যকে তা বলে ঠিক মেনে নেওয়া যায়, এমন নয়। কারণ নজরুল, কবিতার পরিমার্জনার চেষ্টা যে করতেন, তার পরিচয় তাঁর কবিতার পাণ্ডুলিপি থেকে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও মনে রাখবার মত : সব কবিতার প্রসাধন চলে না। সৌখিন কবিতার বেলা, মানে ভঙ্গি-
প্রধান কবিতার বেলায়ই প্রসাধনের প্রশ্ন বিশেষভাবে ওঠে। নজরুল এই ধারার কবি ছিলেন না।
1. T. S. Eliot (1922) : Shakespeare and the Stoicism of Seneca.
সিকান্দার আবু জাফর (সম্পাদিত), সমকাল, জ্যৈষ্ঠ-শ্রাবণ, দ্বাদশ বর্ষ, ১০-১২ সংখ্যা-১৩৭৬।