বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষের রাজনৈতিক চেতনা যে স্তরে আছে, তাতে কি সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? রাজনৈতিক চেতনা যদি গণতন্ত্রের অনুকূল না হয়, তবে কেবল আইনের মাধ্যমে আদর্শ গণতন্ত্র আদৌ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বিখ্যাত ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪) লিখেছিলেন : ‘For forms of government let fools contest : Whate’er is best administered is best.’
রাষ্ট্রের কাঠামো কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক করুক স্বল্পবুদ্ধিরা। আসলে যা বাস্তবতা, তা হলো সুশাসিত রাষ্ট্রই কাম্য। আলেকজান্ডার পোপের এই উক্তি এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। বিএনপি চাচ্ছে দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট বা আইন সভা। কিন্তু যে ইংল্যান্ড বা বিলাতের কাছ থেকে আমরা আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ধারণা লাভ করেছি, তার ইতিহাসে দেখি হাউজ অব লর্ডসের ক্ষমতা ক্রমেই কমতে; আর হাউজ অব কমন্সের ক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে। ১৯১১ সালের পার্লামেন্ট অ্যাক্ট প্রণীত হওয়ার পর বিলাতে হাউজ অব লর্ডস শক্তিহীন হয় পড়েছে। এটা টিকে আছে ‘অতীতের নিদর্শন’ হিসেবে।
বিলাতের গত শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাসকি অভিমত দিয়েছিলেন, আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন এক পরিষদই আইনসভা হিসেবে হলো উপযুক্ত।
কারণ, এর মাধ্যমে স্বীকৃতি পায় মানব সমতা এবং ভাবা হয় না একদল মানুষকে অধিক মেধাসম্পন্ন হিসেবে। মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডিমক (Dimock) -এর মতে, ‘দ্বিপরিষদ ব্যবস্থা অতীত যুগের ঐতিহ্যবাহী। যখন মানুষ ভেবেছে, রাষ্ট্র ও সরকার হলো প্রয়োজনীয় মন্দ (a necessary evil)। তাই এর ক্ষমতাকে যত দূর সম্ভব নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।’ কিন্তু মানুষ এখন আর তা ভাবছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যয়ভার বাড়াবে। রাষ্ট্র শাসনে এটা খুব একটা কাজে আসবে না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের দাবিকে তাই আদর্শ পার্লামেন্ট গঠনের অনুকূল বলে মনে হচ্ছে না। রাষ্ট্র ধারণা হিসেবে এটি যথেষ্ট বিমূর্ত। রাষ্ট্র শাসিত হয় রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের দিয়ে। তারা সৎ ও দক্ষ না হলে রাষ্ট্র পরিচালনা কখনো সুষ্ঠু হয় না।
বিখ্যাত মার্কিন দার্শনিক জন ডিউই (John Dewey)-এর মতে, ‘The state is as is its officials are.’ সরকারি কর্মচারীদের প্রকৃতি রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। কাজেই সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, শিক্ষা প্রদান, পদোন্নতি, কাজের শর্তাবলি প্রভৃতি সম্পর্কে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা প্রশাসনকে করতে হয়; যাতে বিভিন্ন পদে যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মচারী নিযুক্ত হতে পারেন।
আমরা ভাবছি- সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। কিন্তু সেটা অংশত সত্য। তাই কেবল ভোটের মাধ্যমে একটা দেশে সুশাসন যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এমন ধারণা সঠিক নয়। তথাপি বলতে হয়, বিএনপির প্রদত্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট (Positive)। এগুলো কেবলই মুক্তিযুদ্ধের আবেগসর্বস্ব নয়। বিএনপি বলছে, তারা গণভোট প্রথার পুনঃপ্রবর্তন করবেন। বিলাতের গণতন্ত্রে গণভোট যদিও আইনি হয়ে ওঠেনি, তবুও তা এখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত। যেমন : ব্রিটেনে গণভোট হয়েছে, দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে নাকি থাকবে না, সেটা নিয়ে। ব্রিটিশ জনমত রায় দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে না থাকার পক্ষে। এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, গণভোটের রায়কে শ্রদ্ধা দেখিয়ে। বাংলাদেশে গণভোট প্রথা এর গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে মজবুত করবে বলেই মনে হয়। বিএনপি গ্রহণ করতে চাচ্ছে ওমবাডসম্যান (Ombudsman) প্রথা।
এই প্রথা প্রচলিত আছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেনে। ব্রিটেন বা বিলাতে এই প্রথা গ্রহণ করা হয় ১৯৬৭ সালের ১ এপ্রিল। বিলাতে ওমবাডসম্যানকে বলা হয় পার্লামেন্টারি কমিশনার ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। তার কাজ হলো, কোনো বিচারপতি যদি কারো ওপর অবিচার করে থাকেন, সে বিষয়ে পার্লামেন্টকে অবহিত করা, যাতে করে এ রকম ঘটনা আর না ঘটে। যেকোনো ব্যক্তি তার ওপর অবিচার হয়ে থাকলে জানাতে পারেন কমিশনারের কাছে। কমিশনার সেটা তদন্ত করে পার্লামেন্টকে জানিয়ে দেন। এর জন্য কাউকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় না। কমিশনার কেবল বিচারকদের ব্যাপারে নয়, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের সম্পর্কে অভিযোগ তদন্ত করে পার্লামেন্টকে এর ফলাফল জানাতে পারেন। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি বিএনপি এবং বিএনপি-নির্ভর জোটকে সমর্থন করতে চাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেবলই বলে চলেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা; বলছে জয় বাংলা, জিতবে এবার নৌকা। ‘জয় বাংলা’ আওয়াজটা উনিশ শ’ সত্তরের নির্বাচনে সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে যথেষ্ট আবেদনবহ ছিল। তখন ‘বাংলাদেশ’ বলে কোনো স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু এখন আছে। অথচ আওয়ামী লীগ ‘জয় বাংলাদেশ’ না বলে আজো জয় বাংলা বলছে। এই ‘বাংলা’ কোন বাংলা? তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
উনিশ শ’ সত্তরে অনেকেই ভেবেছেন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এখন যা বড় হয়ে আমাদের কাছে দেখা দিচ্ছে তা হলো, বাংলাদেশকে রক্ষা করার প্রশ্ন। তাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন আর নেই। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যে রাজনীতি করছে, সেটা বর্তমান প্রয়োজনের সাথে সংযুক্ত নয়। আওয়ামী লীগের প্রচার অভিযানে ফুটে উঠতে চাচ্ছে ভারতের প্রতি একটি বিশেষ দুর্বলতা। কিন্তু এ দুর্বলতা আজো কি থাকার কোনো যুক্তি আছে?
ভারত এখন চাচ্ছে তার আসাম প্রদেশ থেকে কম করে হলেও ১৩ লাখ বাংলাভাষী মুসলমানকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিতে। এটা করলে বাংলাদেশে দেখা দেবে বিরাট মানবিক বিপর্যয়। আজ যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন অনেক ঘটনা আমার মনে পড়ে, যা ভারতপ্রীতির অনুকূল নয়।
বাংলাদেশ সরকার তার প্রথম কারেন্সি নোট ছাপিয়েছিল ভারতের নাসিক মহারাষ্ট্রের টাঁকশাল থেকে। অভিযোগ আছে, ভারত সরকার এই নোট ছাপিয়ে ছিল ডাবল করে। অর্থাৎ একই নম্বরের নোট দু’টি করে। একটি সে রেখেছিল নিজের কাছে। অপরটি দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারকে। উনিশ শ’ চুয়াত্তর সালে ভারত সরকার তার কাছে রেখে দেয়া নোটের সাহায্যে কিনতে চায় বাংলাদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য। ফলে সৃষ্টি হতে পারে, চুয়াত্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশ থেকে খাদ্যশস্য ভারতে চলে যাওয়াসহ একাধিক কারণে এই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল কম করেও চুয়ান্ন হাজার ব্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সাথে এ কথাও মনে পড়ে আমাদের মতো বয়োজীর্ণ ব্যক্তিদের।
বাংলাদেশকে সে সময় খাদ্যের জন্য হাত পাততে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সাহায্য দিতে বিলম্ব করলেও শেষ পর্যন্ত দিয়েছিল। বাস্তবতা হলো, এই সাহায্য না দিলে দুর্ভিক্ষ নিতে পারত আরো ভয়াবহ রূপ। বাংলাদেশ সরকার টের পেয়েছিল ভারতের কৌশল সম্পর্কে। তাই ভারতের ছাপানো জাল নোট বাজার থেকে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বন্ধ করা হলো সীমান্তে মুক্তবাণিজ্য। বিশেষ করে বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হয় দশ টাকা, পাঁচ টাকার নোট। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এই ইতিহাস জানে না। তাই এই ইতিহাস উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
আওয়ামী লীগ ১০ বছর ধরে অনেক ভুল ইতিহাস পড়িয়েছে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের নামে। দলটি ক্ষমতায় থাকলে চলবে এই ভুল ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। এটা হতে দেয়া যায় না।
ভারতের পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দল ‘পাকিস্তানের পঞ্চম বাহিনী’। কিন্তু এর পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারছে না। আমরা জানি, উনিশ শ’ একচল্লিশ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দল পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেনি। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯) বলেছেন যে, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে অর্ধেকের বেশি মুসলমান থেকে যেতে বাধ্য হবেন ভারতে। সে দেশের এই মুসলমানেরা পড়বেন ভীষণ বিপদে। কিন্তু পাকিস্তান না হলে এই উপমহাদেশের মুসলমানেরা থাকবেন ঐক্যবদ্ধ। আর তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে পারবেন নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে।’ মুসলিম লীগ একটি ইসলামপন্থী দল ছিল না। পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, মুসলিম উম্মাহ চেতনার ভিত্তিতে নয়।
কিন্তু এই উপমহাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে মুসলিম উম্মাহর চেতনাও ছিল সংশ্লিষ্ট। দেওবন্দী আলেমরা সবাই ছিলেন কংগ্রেসের সাথে সংশ্লিষ্ট। তারা মুসলিম লীগকে সমর্থন করতেন না। এর একটা কারণ হলো, আগা খান এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উভয়েই ছিলেন বিশেষ মাজহাবভুক্ত, তথা সম্প্রদায়ের লোক। মুসলিম লীগের জন্ম হয় ঢাকায় ১৯০৬ সালে। নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে। ১৯৪০ সালে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন এ কে ফজলুল হক, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত নেতা। কিন্তু আজ প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্ভব হতে পেরেছিল পাকিস্তান আন্দোলনের; যেটা সত্য নয়। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এতে তিনি বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল সঠিক।
তিনি নিজেই ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন সক্রিয়ভাবে। কিন্তু সব ইতিহাসকেই এখন চেষ্টা চলেছে এলোমেলো করে দেয়ার। প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে, শেখ মুজিব ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। অথচ তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, বাংলাভাষী মুসলমানদের জাতীয় চেতনার মধ্যে আছে দু’টি বাস্তবতা। বাংলা ভাষার দিক থেকে তারা বাঙালি। কিন্তু সেই সাথে জড়িয়ে আছে একটি মুসলিম স্বাতন্ত্র্য বোধ। সেটি আজকের আওয়ামী লীগ একেবারেই স্বীকার করতে নারাজ। অথচ শেখ মুজিব এই মুসলিম স্বাতন্ত্র্য বোধকে বজায় রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি না করে, নজরুলকে করেছেন জাতীয় কবি। তার রচিত ও সুর দেয়া গানকে করেন বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। যত বর্তমানে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে গীত হচ্ছে বিএনপি কর্মীদের দিয়ে; আওয়ামী লীগের কর্মীদের দিয়ে নয়। অর্থাৎ নজরুলকে সযত্নে পরিহার করতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এটা বিশেষভাবে হয়ে উঠেছে লক্ষণীয়। বিএনপির সংস্কৃতি চেতনা রাবীন্দ্রিক নয়, যেমন রাবীন্দ্রিক হলো আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি চেতনা।
আওয়ামী লীগ নিন্দা করে চলেছে পাকিস্তানের। আমরা এখন আর বর্তমান পাকিস্তানের সাথে নেই। বর্তমান পাকিস্তান স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নৌপথে পাকিস্তান প্রায় ৪০০০ কিলোমিটারের পথ। বর্তমান পাকিস্তান আর আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য কোনো হুমকি হতে পারে না। কারণ, দেশটি যদি আমাদের আক্রমণ করতে আসে, তবে তাকে তা করতে হবে ভারত ডিঙিয়ে। এটা সে করতে সক্ষম নয়। তাই পাকিস্তানকে শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে প্রচার না হয়ে উঠেছে অর্থহীন, যদিও আওয়ামী লীগ সেটা করছে।
অন্য দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয়, পাকিস্তান আর আগের অবস্থায় নেই। তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণে। ভারত তার পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটায় ১৯৯৮ সালের ১৮ মে, রাজস্থানের মরুভূমিতে। ১৯ মে ভারতের এই পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণে নিন্দা জানান বিএনপির ১০৯ জন সংসদ সদস্য। পাকিস্তান তার পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটায় ২৮ মে, বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে। পাকিস্তান এখন নিজে বানাতে পারছে তার পারমাণবিক অস্ত্র বহন করে ভারতের যেকোনো স্থানে আঘাত করার মতো ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট। অনেকের মতে, ভারত যে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারছে না তার একটি কারণ হলো পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি।
‘বাংলাদেশ টিকে আছে আসলে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের ছত্রছায়ায়’- এই মতটা কত দূর সত্য তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু মতটা বহু দূর প্রচলিত। আর যেহেতু পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র এখন হয়ে উঠেছে ভারতের চেয়ে অনেক উন্নত, তাই ভারত এখন পাকিস্তানকে আগের মতো ধমকের সুরে কথা বলছে না। পাকিস্তান বিজ্ঞানের নানা শাখায় এগিয়ে চলেছে, কেবল সমর বিজ্ঞানে নয়। ১৯৯০ সালে পাকিস্তান তার নিজের নির্মিত কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে স্থাপন করেছে তার নিজের তৈরি রকেটের সাহায্যে। এটা এখনো আমরা ভাবতে পারছি না। পাকিস্তান এন্টার্কটিকায় গড়েছে তার সামরিক ঘাঁটি এবং ‘আবহাওয়া মন্দির’। কেন সে পাকিস্তান থেকে এত দূরে এন্টার্কটিকায় এটা করা প্রয়োজন মনে করছে, আমরা তা জানি না। তবে এ রকম ঘাঁটি স্থাপন করেছে ভারতও। পাকিস্তান ভারতের তুলনায় স্বল্প জনসংখ্যার দেশ।
যদি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয় তবে পাকিস্তান যেভাবে তার জনসমষ্টিকে মরুময় অঞ্চলের মধ্যে এবং পার্বত্য অঞ্চলে সরিয়ে নিতে পারবে, ভারত তা পারবে না। তাই ভারতের জনগণ পারমাণবিক যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। বলা যায়, আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানকে সামরিক দিক থেকে যতটা হেয় মনে করছেন বাস্তবে পাকিস্তান তা নয়। এটাও বলতে হয়, পাকিস্তানের শিক্ষার মান আমাদের চেয়ে হয়ে উঠেছে অনেক উন্নত, আগে যা ঠিক ছিল না। পাকিস্তানের বর্তমান উন্নতিকে বলা চলে না, হতে পারছে ‘আমাদের শোষণ করে’। মানতে হয় তাদের নিজের কৃতিত্বের কথা। বর্তমান শাসনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষার মান উন্নত না হয়ে অবনত হওয়া।
আমরা অনেকেই খোঁজ রাখি না যে, বর্তমান পাকিস্তানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখের কাছাকাছি। বাংলাদেশ থেকে সে দেশে যাওয়া লোকজন পাঞ্জাবে করছেন ক্ষেতখামার। তারা সেখানে সরকারি চাকরি করছেন না। প্রধানত নোয়াখালী অঞ্চল থেকে যাওয়া বহু লোক হয়েছেন মসজিদের ইমাম। তাদের পাকিস্তান ভাবছে না বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়ার কথা। জানি না, আমরা কেন চাচ্ছি বিশেষ করে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার চালিয়ে বাংলাদেশে ভোটযুদ্ধ করতে।
ভোট হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। অনেকে আশঙ্কা করছেন ভোটের পর বাংলাদেশে দেখা দিতে পারে প্রচণ্ড গোলযোগ। খ্যাতনামা অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ্ লিখেছেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলেও সব ভোটার ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কি না, পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে পারবে কি না, নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে কি না এবং প্রদত্ত ভোট সঠিকভাবে গণনা হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কার মেঘ ভারী হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে হতে যাচ্ছে আসন্ন সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলে জনগণ যদি তাদের মতামতের সঠিক প্রতিফলন দেখতে না পায়, তাহলে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। এমনিতেই দেশটি খাড়াখাড়িভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই পারে বিভক্তির এই ভেদরেখাকে হালকা করে দিতে। জীবনসায়াহ্নে কী যে দেখে যাবো, বলতে পারি না। শুধু কি অসহায়ের মতো অশ্রুপাত করব?’ (যুগান্তর, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮)।
আমি ড. মাহবুব উল্লাহ্র মতো এতটা হতাশাবাদী নই। মনে করছি না, নির্বাচনের দিনে এতটা গোলযোগ হবে। কারণ, সেনাবাহিনী থাকবে পাহারায়। তারা পাহারায় না থাকলে হতে পারত গোলযোগ; কিন্তু যেহেতু তারা পাহারায় থাকবে, তাই নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণভাবে। আমাদের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তি রক্ষা করতে পারছে। আমি মনে করি, দেশেও তারা সেটি করতে পারবেন। ইতিহাসে দেখি গণতন্ত্র চরম অবস্থায় টিকতে পারে না। গণতন্ত্রের স্বার্থেই দেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা উচিত হবে না, যাতে করে গণতন্ত্র বিফল হয়।
প্রকাশঃ নয়া দিগন্ত, ২০১৯।