টমাস ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪) ছিলেন বিলাতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যায়ের অর্থনীতির ছাত্র। এখানে ছাত্র থাকার সময় তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন (১৭৯৮)। প্রবন্ধটির নাম, Essay on the Principle of Population As It Affects the Future Improvement of society। এতে তিনি দেখান, মানুষের খাদ্য উৎপাদন বাড়ে পাটিগাণিতিক হারে। অর্থাৎ, ১+২+৩+৪+… হারে। কিন্তু মানুষের জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। অর্থাৎ, ১+২+৪+৮+… হারে। ম্যালথাসের মতে, মানুষ খেতে না পাবার তথা দুর্ভিক্ষ হবার কারণ হলো খাদ্য উৎপাদন যে হারে বাড়ে জনসংখ্যা বাড়ে তার চেয়ে অধিক হারে। এ জন্য সৃষ্টি হয় খাদ্যাভাব। খাদ্যাভাব রোধ করতে হলে করতে হবে জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ম্যালথাস উপদেশ দেন জন্মনিয়ন্ত্রণের।
চীনের কমিউনিস্টরা মনে করেন, চীনের খাদ্য সমস্যা, আবাসন সমস্যা কমাতে হলে অবলম্বন করতে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। কেননা, তাহলে খাদ্য উৎপাদন, অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদন করা চলবে মানুষ বাড়ার সাথে সঙ্গতি রেখে। চীন এ জন্য গ্রহণ করে পরিবারপিছু এক সন্তান নীতি। অর্থাৎ কোনো পরিবার এক সন্তানের বেশি নিতে পারবে না। মায়েরা সন্তানবতী হলে করতে হবে তাদের গর্ভমোচন।
যাতে করে পরিবারপ্রতি এক সন্তানের বেশি সন্তান না থাকে। কিন্তু এর ফলে চীনে সৃষ্টি হতে পেরেছে বিরাট আর্থ-সামাজিক সমস্যা। কারণ, মানুষ কেবল একটি পাকস্থলী নিয়ে জন্মায় না, কাজের জন্য এক জোড়া হাত নিয়ে জন্মায়। চীনে এখন কাজের লোকের বিশেষ অভাব দেখা দিয়েছে। চীন হয়ে উঠেছে বিশেষ অর্থেই বৃদ্ধলোকের দেশ। এই বৃদ্ধ ব্যক্তিরা কাজ করতে আর সক্ষম নন। তারা হয়ে উঠেছেন সমাজ জীবনের বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা। অন্য দিকে কঠোর এক সন্তান নীতি চীনা পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করে প্রধানত পুত্রসন্তান গ্রহণে। বর্তমানে চীনে ছেলেদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মেয়েদের চেয়ে বেশি।
সরকারি হিসাব অনুসারে প্রায় তিন কোটি চীনা যুবক বিবাহের জন্য কোনো চীনা কন্যা পেতে পারবে না। চীনা সরকারকে তাই চিন্তা করতে হচ্ছে সে দেশে বিদেশ থেকে কন্যা আমদানি করার কথা। চীন সরকার ২০১৫ সালে এক সন্তান নীতি পরিত্যাগ করে পরিবারপ্রতি দুই সন্তান নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর ফলে চীনে যে বিরাট আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান আসতে পারবে বলে মনে হয় না।
ভারত চেয়েছিল কঠোর জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করতে; কিন্তু ভারতে গণতন্ত্র থাকায় উঠতে পারে এর বিরুদ্ধে সমালোচনা। ফলে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি ভ্যাসেকটমির মাধ্যমে ভারতে কঠোর জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি অবলম্বন।আর তাই ভারতে এখন দেখা দেয়নি চীনের মতো আর্থ-সামাজিক সমস্যা।
আমরা এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ বলছে, আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্রের অভাবে একটা দেশে কী ধরনের জটিল আর্থ-সামাজিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, চীন তার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত।
বিরাট দেশ মহাচীন। পূর্ব থেকে পশ্চিমে চীনের দৈর্ঘ্য হলো ৫৫০০ কিলোমিটার এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে চীনের প্রস্থ ৫২০০ কিলোমিটার। যখন উত্তর চীনে ঘটে চলে তুষারপাত; তখন দক্ষিণ চীনে হলো বসন্তকাল। যখন পূর্ব চীনে ওঠে সূর্য, তখন পশ্চিম চীনে থাকে রাতের অন্ধকার।
চীন ঠিক একটি জাতির দেশ নয়। চীনের প্রধান জাতি হলো হাংচিনা, এর পরে হলো মানচু-রা। মানচু রাজারা মানুরিয়া অঞ্চল থেকে এসে হাংচিনদের দেশ জয় করেন। মানচু এবং হাংরা এখন প্রায় এক জাতিতে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু চীনে হাং এবং মানচু ছাড়া আছে আরো ৫৩টি জাতি। অবশ্য জনসংখ্যার দিক থেকে এরা বড় জনগোষ্ঠী নয়।
জন্মনিয়ন্ত্রণ মূলত কার্যকর হতে পেরেছে হাংচিনাদের মধ্যে। এ ছাড়াও শহরে জন্মনিয়ন্ত্রণ যেভাবে কার্যকর হয়েছে, গ্রামে তা হয়নি। তা না হলে বর্তমান চীনে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আরো বিপর্যয়কর রূপ নিতে পারত। কেনো চীনারা ম্যালথাসের ধারণাকে এভাবে গ্রহণ করল তা বোঝা যায় না। কেননা, কার্ল মার্কস করেছেন ম্যালথাসের মতবাদের তীব্র সমালোচনা। একটি দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য দুর্ভিক্ষ হয় না। কারণ, হঠাৎ করেই জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে না। তা ছাড়া অতীতে অনেক বড় বড় দুর্ভিক্ষ ঘটেছে পৃথিবীর নানা দেশে, যখন তাদের জনসংখ্যা ছিল আজকের তুলনায় অনেক কম।
আইয়ুব খান তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে যদি জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হয় তবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যে, ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ মানুষকে ধরে খেতে চাইবে। সে সময় থেকে বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু মানুষ মানুষকে ধরে খেতে চাচ্ছে না। আর খাদ্য ফসলের উৎপাদন এতটাই বেড়েছে যে, তা পূরণ করতে পারছে মানুষের খাদ্য সমস্যার।
কোলডস্টোরেজের গোল আলু জমা থাকছে, হচ্ছে না বিক্রি। তা সৃষ্টি করছে আরেক রকমের অর্থনৈতিক সমস্যা। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে হয়েছিল এক বিরাট দুর্ভিক্ষ। একটি হিসাব অনুসারে এ দুর্ভিক্ষে মারা যায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের কাছাকাছি। এই দুর্ভিক্ষ হঠাৎ করেই জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য ঘটেছিল, তা নয়।
ভারত ১৯৭১-১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সমস্যার মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রায় ৭০০ কোটি ভারতীয় রুপি ঘাটতি দেয়। অর্থাৎ ভারত এই টাকার ব্যাংক নোট ছাপিয়ে তা ব্যয় করেছিল। এর ফলে ভারতে দেখা দিয়েছিল বিরাট মুদ্রাস্ফীতি। এর ফলে সে দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম খুবই বাড়তে থাকে। ভারত এই সমস্যাকে সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে চালু করে ভারতীয় টাকায় মুক্তভাবে ধানচাল কেনা। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিপুল খাদ্যদ্রব্য চলে যায় ভারতে। আর বাংলাদেশে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, আর হচ্ছে। কিন্তু ভারতের নীতির কারণে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল, তা নিয়ে এখন আর কোনো আলোচনা হতে দেখা যায় না।
মানুষের খাদ্য সমস্যা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। সব দেশের মানুষের মাথাপিছু খাদ্যের প্রয়োজন যে এক, তা নয়। অনেক দেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে অনেক কম আহার্য গ্রহণ করেও বেঁচে থাকতে পারছেন। যেসব দেশের মানুষ কম খেয়ে বেঁচে আছেন, তারা আকারে, বিশেষ করে উচ্চতায় হয়ে থাকেন খাটো। পক্ষান্তরে যেসব দেশের মানুষ বেশি খেতে পায় তারা আকৃতিতে বিশেষ করে উচ্চতায় হতে চান বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপ থেকে যাওয়া মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসতি করার পর কয়েক পুরুষ যেতেই তারা হতে থাকে গড়পড়তা ইউরোপীয়দের থেকে লম্বা। অর্থাৎ মানুষ কম খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। যদিও আকারে হতে থাকে ছোট।
কিন্তু ম্যালথাসের সময় এ ঘটনার কথা জানা ছিল না। একজন মার্কিন গবেষক ধাড়ি ইঁদুর (Rattus rattus) নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, একটা ঘরে সীমাবদ্ধ পরিবেশে যদি ইঁদুরদের বংশবিস্তার করতে দেয়া হয়, তবে প্রথমে তাদের বংশবৃদ্ধির হার যা থাকে, পরে তাদের বংশবৃদ্ধির হার তা আর থাকে না। তারা তাদের আগের আসঙ্গলিপ্সা হারায় ও সন্তান উৎপাদন করে কম, ঘরে স্থানের অভাবজনিত কারণে। অর্থাৎ প্রাণীদের সংখ্যা সীমাহীনভাবে বাড়তে পারে না। তাদের নিজেদের মধ্যেই প্রাকৃতিক নিয়মে দেখা যায় প্রজননে অবসাদ।
মানুষের খাদ্যাভাস চিরকাল যে একই রকম থাকে, তা নয়। যেমন আমরা বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিমাণ গোল আলু খাচ্ছি, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে সে পরিমাণে খাইনি। জাপানিরা নানা রকম সামুদ্রিক শেওলা সবজি হিসেবে গ্রহণ করেন। আমরা হয়তো বঙ্গোপসাগরের শেওলা আহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠব। যাতে আমাদের খাদ্য সমস্যা বেশ কিছুটা লাঘব হতে পারবে।
২০১৯ সালে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত।