অন্য প্রাণীরা যেখানে চলে প্রাকৃতিক নিয়মকে (Instinct) অনুসরণ করে, মানুষ সেখানে চলতে চেয়েছে নিজের তৈরী আইন অনুসারে। পাখিরা বছরে নির্দিষ্ট সময়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার আগে বাসা বানায়। পাখিরা কী করে বোঝে ডিম পাড়ার আগে বাসা বানাতে হবে, আমরা তা জানি না। আমরা এটাকে বলি, ওদের সহজাত ধর্ম বা প্রবৃত্তি। কিন্তু মানুষকে গৃহনির্মাণ করা শিখতে হয়। সে এটাকে জন্মসূত্রে লাভ করে না। একেক পাখি একেকভাবে বাসা বানায়। কাক যেভাবে বানায়, বাবুই সেভাবে বানায় না। এই বাসা বানানোর রকম ওদের মধ্যে বর্তায় বংশগতভাবে। কিন্তু মানুষ এভাবে বংশগত সূত্রে গৃহনির্মাণবিদ্যা লাভ করে না। সেটা তাকে শিখে নিতে হয়। মানুষ যা কিছু জন্মসূত্রে লাভ করে না, যা তাকে শিখে নিতে হয়, নৃতত্ত্বে ব্যাপক অর্থে তাকে অভিহিত করা হয় সংস্কৃতি হিসেবে। যেমন, রিরংসা প্রাকৃতিক, কিন্তু বিবাহব্যবস্থা হলো মানুষের সংস্কৃতির পরিচায়ক।
আইনব্যবস্থা মানুষের সংস্কৃতিরই অংশ। চিরকাল কোনো সমাজের আইন যে একই রকম থেকেছে, তা নয়। তাতে এসেছে পরিবর্তন। নারী জাগরণ শব্দটি বলতে বোঝায়, নারীদের তাদের নিজেদের স্বার্থের উপযোগী করে আইন প্রণয়নের চেষ্টাকে। কবি সুফিয়া কামালকে বলা হয়, এ দেশের নারী জাগরণের অন্যতম নেত্রী। কিন্তু তিনি মেয়েদের স্বার্থের অনুকূলে আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বরং এ দেশের ইতিহাস বলে, নারীরা নয়, পুরুষেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন নারীদের স্বার্থের অনুকূলে আইন রচনার ক্ষেত্রে। যেমনÑ আগে বাংলাদেশের মুসলমান মেয়েরা স্বামীকে তালাক দিতে পারতেন না এখনকার মতো। ব্রিটিশ শাসনামলে তখনকার বাংলাদেশের আইনসভায় ১৯৩৯ সালে প্রণীত হয় মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন। যাতে করে মুসলমান মেয়েরা অত্যাচারী স্বামীকে পায় তালাক দেয়ার অধিকার। আগে মুসলমান সমাজে পুরুষেরা একসাথে চারজন মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। সাবেক পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আইন করে এই প্রথা রদ করেন। আইনটি এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতিতে পুরুষের বহুবিবাহ হতে পারে অনুমোদিত। কিন্তু সব অবস্থায় নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিলাতে ছেলেদের চাইতে মেয়েদের সংখ্যা দাঁড়িPRܧছিল বিশ লাখ বেশি। বিলাতে বহুবিবাহের নিয়ম ছিল না। এখনো নেই। ফলে এই মেয়েদের পড়তে হয়েছিল যথেষ্ট কষ্টের মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে প্রতি ১২টি মেয়েতে দাঁড়িয়েছিল একটি ছেলে। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বিশেষ সমস্যার। অনেকক্ষেত্রে মেয়েরা কোনো ছেলের সাথে চুক্তি করত যে, সে পরপর অনেক মেয়েকে বিয়ে করবে। যদিও একসাথে নয়। যুদ্ধবিগ্রহের ফলে এক সময় মুসলমান সমাজে ছেলেদের চাইতে মেয়েদের সংখ্যা হতো বেশি। কেননা ছেলেরা মারা যেত যুদ্ধে। এ অবস্থায় পুরুষের বহুবিবাহকে অনুমোদন প্রদান ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সব অবস্থায় নয়। মানুষকে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হয় নতুন আইন রচনার। ইসলামে নতুন আইন রচনার বিধান আছে।
পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। তারা কেউই গোঁড়া ধর্মান্ধ ব্যক্তি ছিলেন না। পাকিস্তানে তাই মেয়েদের শিাব্যবস্থা হতে পারে বিশেষভাবে সম্প্রসারিত। তারা পেতে থাকেন নানা কর্মে নিয়োগ। কমে যায় সাবেক পর্দা প্রথার কড়াকড়ি। এর জন্য মেয়েদের কোনো বিশেষ আন্দোলন করতে হয়নি। তাই এখন যেমন বলা হচ্ছে, নারীদের মুক্তির জন্য পৃথকভাবে তাদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সেটাকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে গ্রহণ করা চলে না। কবি সুফিয়া কামাল আটটি কবিতা লিখেছেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে, যার একটিকে নিচে উদ্ধৃত করছি। কবিতাটির নাম ‘হে মশালধারী’। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে ‘মাহে-নও’ নামক মাসিক পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় :
কালের প্রবাহে ভেসে গত হয়ে গেছে সেই দিন,
তিথি, মাস, বৎসরান্ত, যুগ যুগ হইবে বিলীন
কিন্তু তব জয়
উজলি’কালের ব রহিবে অয়।
সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, দীপ্ত নত্রের সম
রহিবে তোমার দান। নাশ করি’ তমঃ
নির্জীব জাতির প্রাণ জীবন-চাঞ্চল্যে ওঠে জেগে
তড়িৎ-প্রবাহ সম বেগে।
ব্যাপ্ত করি’ উদয়-অচলে, অস্তাচলে
উদ্দীপ্ত প্রাণের দলে দলে
আত্ম-উপলব্ধি জাগে। পথের দিশারী
তুমি সেই অন্ধ রাত্রে, হে মশালধারী!
পথের সন্ধান দানি বজ্র-কণ্ঠে দানিলে নির্দেশ
আমরা আজাদ জাতি; আজাদ করিব মোরা দেশ।
হৃদয়ে হৃদয়ে জাগে সাড়া,
ভেঙে যায় ভীতির পাহারা,
শঙ্কাহীন ল প্রাণ সাড়া দিলো তোমার আহ্বানে,
মুক্তকণ্ঠে আজাদীর গানে।
সাহসে দুর্জয় ব, আজো তারা তোমার সে বাণী
শোনে যেন অন্তরী।ে শ্রদ্ধানত শিরে লয় মানি
জাতির পতাকাতলে একত্রিত সকলে তোমারে
স্মরণ করিছে বারে বারে,
তোমার আসন আজো সকলের হৃদয়ের মাঝে
তোমারে লইয়া ভরে আছে।
যুগে যুগে তুমি তব দানের প্রভায়
চিরঞ্জীব হয়ে রবে আপনারি দিব্য মহিমায়।
কায়েদে আজম। তব দান
মহাকাল-ব ভারি’ রহিবে অম্লান।
ওপরের কবিতাটি পড়ে কি মনে হয় না যে, পাকিস্তান হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে নারী জাগরণ এসেছিল, সুফিয়া কামাল সেটাকে স্বীকার করতেন না। তিনি তার জীবনের একপর্যায়ে দ্বিজাতিতত্ত্বে আস্থাবান ছিলেন। তাই তার পক্ষে স্বীকার করতে বাধেনি যে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলেন মুক্তির পথের মশালধারী। সুফিয়া কামাল এর আগে নারী জাগরণ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু খুব বেশি যে লিখেছেন, তা নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে তার লেখা ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতাটি নিচে উদ্ধৃত করছি।
মৌসুমি ফুলের গান মোর কণ্ঠে জাগে নাকো আর
চার দিকে শুনি হাহাকার।
ফুলের ফসল নেই, নেই কারো কণ্ঠে আর গান
ুধার্ত ভয়ার্ত দৃষ্টি প্রাণহীন সব মুখ ম্লান।
মাটি অরণ্যের প্রাণে চায়
সেখানে রিছে স্নেহ পল্লবের নিবিড় ছায়ায়।
জাগো তবে অরণ্য কন্যারা। জাগো আজি,
মর্মরে মর্মরে ওঠে বাজি
বৃরে বরে বহ্নিজ্বালা
মেলি লেলিহান শিখা তোমরা জাগিয়া ওঠো বলো।
কঙ্কনে তুলিয়া ছন্দ তান
জাগাও মুমূর্ষু ধরা-প্রাণ
ফুলের ফসল আনো, খাদ্য আনো ুধার্তের লাগি
আত্মার আনন্দ আনো, আনো যারা রহিয়াছে জাগি
তিমির প্রহর ভরি অতন্দ্রনয়ন, তার তরে
ছড়াও প্রভাত আলো তোমাদের মুঠি ভরে ভরে।
তার এই লেখা পড়ে বাংলাদেশের মুসলিম নারীসমাজে যে বিরাট জাগরণ আসতে পেরেছিল, তা মনে হয় না। কেননা, কবিতাটি উদ্দীপনামূলক ভাষা ও ছন্দে রচিত নয়। যথেষ্ট পরিশীলিত মন না হলে এই কবিতার আবেদন কারো কাছে পৌঁছতে পারে না। এ কবিতা পড়ে যাদের ভালো লাগার কথা, তাদের মন-মানসিকতা হতে হবে সুফিয়া কামালের মতো নারীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। সুফিয়া কামালের মতো নারী বাংলার মুসলমান সমাজে ছিল বিরল।
কবি সুফিয়া কামালের চিন্তা-চেতনা চিরকাল এক হয়ে থাকেনি। এক সময় তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বারা। তিনি ভাবতে থাকেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন হলো একটি আদর্শ রিপাবলিক। যেখানে নারীরা লাভ করতে পেরেছেন আদর্শ মুক্তজীবন। যা হওয়া উচিত অন্য দেশের নারীদেরও কাম্য। সুফিয়া কামাল পেতে পারেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে ১৯৭০ সালে লেনিন পুরস্কার। সুফিয়া কামাল খ্যাত হয়ে ওঠেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের কাছে। কিন্তু আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। আমরা জানছি, সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীরা ছিলেন বিশেষভাবে নির্যাতিত। তাদের করতে হয়েছে খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। যেমন শীতকালে রাস্তা থেকে সরাতে হয়েছে বরফের স্তূপ। সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল না কোনো সাম্যবাদ। গড়ে উঠেছিল বৈষম্যের বিরাট প্রাচীর। সৃষ্টি হয়েছিল জটিল আমলাতন্ত্র এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা পরিণত হয়েছিল বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণীতে। প্রচলিত হতে পেরেছিল যাকে বলে রাষ্ট্র-দাসত্ব। সুফিয়া কামাল নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করতে পেরেছেন ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়াকে। সম্ভবত তিনি এতে পেয়েছিলেন যথেষ্ট দুঃখ। তিনি আর ভাবতে পারেননি তার প্রিয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে নিজ দেশে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারার কথা।
সুফিয়া কামালের সাথে আমার পরিচয় হয় মাসিক সমকাল পত্রিকার অফিসে। সমকাল পত্রিকা প্রকাশিত হতো কবি সিকান্দার আবু জাফরের সম্পাদনায়। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল মার্কিন আর্থিক সহায়তায়। কিন্তু ওই পত্রিকার অফিসে সুফিয়া কামাল প্রায়ই যেতেন। কেননা, কবি সিকান্দার আবু জাফরের সাথে ছিল তার অন্তরঙ্গতা। এই অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান হওয়ার আগে; তারা দু’জন কলকাতায় থাকতেই সাহিত্যচর্চার সূত্র ধরে। সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) ছিলেন সিকান্দার আবু জাফরের (১৯১৯-১৯৭৫) চাইতে কিছু বড়। কিন্তু বয়সের এই সামান্য ব্যবধান তাদের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠেনি। সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন মার্কিন-ঘেঁষা, অন্য দিকে সুফিয়া কামাল ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু এই মতবাদী ব্যবধানও তাদের মধ্যে সহৃদয় সম্পর্কে চিড় ধরাতে পরেনি। ১৯৭১ সালে সিকান্দার আবু জাফরকে চলে যেতে হয় ঢাকা ছেড়ে কলকাতায়। কলকাতায় যাওয়ার পর তিনি প্রকাশ করেন ‘অভিযান’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য তাকে অর্থ প্রদান করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
যদ্দূর জানি, সুফিয়া কামালকে ঢাকা ছাড়তে হয়নি। তিনি ঢাকাতেই ছিলেন যথেষ্ট নিরাপদ। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাকে ভাবেনি পাকিস্তানের দুশমন হিসেবে। কিন্তু এখন বিশেষভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, সুফিয়া কামাল নাকি নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ। ভারতে যারা জাননি, যারা এ দেশেই ছিলেন, তারাও অনেকে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। হয়েছিলেন শহীদ জননী। কিন্তু সুফিয়া কামাল সম্পর্কে আমার এ রকম কিছু জানা নেই।
কবিদের কবিতা সম্পর্কে কিছু-না-কিছু ভাবনাচিন্তা থাকে। কবি সুফিয়া কামালেরও ছিল। তিনি এটা ব্যক্ত করেছেন তার ‘সাঁঝের মায়া’ নামক কবিতার শেষ স্তবকে :
কখনো ডাকিয়া তারে তোমার এ শেষের সভায়!
সাঙ্গ হলে সব কর্ম, কোলাহল হলো অবসান,
দীপ-নাহি-জ্বালা গৃহে এমনই সন্ধ্যায় যেন তোমার আহ্বান
গোধূলি-লিপিতে আসে। নিঃশব্দ নীরব গানে গানে,
পূরবীর সুরে সুরে, অনুভবি তারে প্রাণে প্রাণে
মুক্তি লবে বন্দী আত্মা-সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজনে,
নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প-বিকাশের প্রয়োজনে।
২০ নভেম্বর ছিল সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী। এবার তার মৃত্যুবার্ষিকী যথেষ্ট ঘটা করে পালন করা হলো। কিন্তু কবি সুফিয়া কামালের কবিকৃতী নিয়ে বিশেষ কিছু আলোচনা হতে দেখা গেল না। তাই বর্তমান আলোচনাটুকু করা। কবি সুফিয়া কামালের জীবনী পড়লে আমরা দেখি, তিনি বিয়ে করেছিলেন দুইবার। প্রথম বিয়ে করেছিলেন ১২ বছর বয়সে। তার এই বিয়ে হয়েছিল আপন মামাতো ভাইয়ের সাথে। যার নাম ছিল সৈয়দ নেহাল হোসেন। তার এই স্বামী তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন লেখাপড়া শিখতে এবং কবিতা লিখতে। তিনি তার প্রথম কবিতা ছাপান সুফিয়া এন হোসেন নামে। এ সময় তার প্রথম স্বামী জীবিত ছিলেন। তার প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ১৯৩৯ সালে। তার দ্বিতীয় স্বামীর নাম ছিল কামাল উদ্দিন খান। এরপর থেকে তিনি লিখতে থাকেন সুফিয়া কামাল নামে। আর সে নামেই তিনি এখন সবার কাছে পরিচিত। তার প্রথম স্বামী, যিনি তাকে সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন, তার কথা বাদ পড়ে গেছে সুফিয়া কামাল নারী আন্দোলনের অগ্রগতি সাধন করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, কিন্তু সুফিয়া কামালের জীবনে তার প্রথম স্বামীর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি সুফিয়া কামালের সাহিত্যিক জীবন গড়ে দিয়ে গেছেন।
এখন যেমন বলা হচ্ছে, পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা হচ্ছে পীড়িত। সেটাই একমাত্র সত্য নয়। স্বামী বহু েেত্রই চান তার নিজের মতো করে তার স্ত্রীকে গড়ে তুলতে। স্ত্রীর গড়ে ওঠবার পেছনে ছিল এবং থাকছে স্বামীদের দান। পুরুষ বনাম নারী, এভাবে সমাজ জীবনের ব্যাখ্যা করা নিতান্তই ভুল।
অনেক কিছুই ঘটতে দেখছি সমকালীন সময়ে, যার কথা আগে ভাবতে পারা যায়নি। নারীবাদীরা এক সময় বলতেন, পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা হচ্ছেন অবহেলিত। পুরুষ শাসনের অবসান চাই নারীমুক্তির জন্য। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নারীরাই যেন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন নারীদের কাল, যার সাথে পুরুষ আধিপত্যের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, সে দেশের নারীরা তাদের গর্ভে কন্যাসন্তান এলে ঘটাচ্ছেন গর্ভমোচন। চাচ্ছেন না কন্যাসন্তানের জননী হতে। শোনা যাচ্ছে, ভারতের বেশ ক’টি প্রদেশে বিবাহযোগ্য নারীর অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। মহাচীনে গৃহীত হয়েছিল এক সন্তান নীতি। চীনা নারীরা কন্যাসন্তান চাননি। চেয়েছেন পুত্রসন্তান। শোনা যাচ্ছে, চীনে নাকি নারীসংখ্যার হ্রাস এতই ঘটেছে যে, দেশটি নাকি চাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে সে দেশে বিবাহযোগ্য নারী আমদানি করতে। জানি না, বাংলাদেশের নারী জাগরণ চীন বা ভারতের অনুরূপ হতে যাবে কি না! বাংলাদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের সমালোচনা করতে ব্যস্ত। প্রাচীন যুগে আরবে বিশেষ করে মক্কায় সম্ভ্রান্ত পরিবারে কন্যাসন্তান জন্মকে মনে করা হতো অবমাননাকর। ইসলাম এই প্রথার অবসান ঘটায়। আল কুরআনে বলা হয়েছে, কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান সমতুল্য। কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তানে কোনো পার্থক্য না করতে (সূরা ৮১ : ৮-৯)। ইসলামের মর্মবাণী নারীবিদ্বেষী নয়।
এসব কথা বলতে হচ্ছে, কেননা, ইসলাম নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে নানা বিভ্রান্তি। বেগম সুফিয়া কামাল ঢাকায় মেয়েদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়েছিলেন ‘ছায়ানট’ নামে। ছায়ানট একটি রাগিণীর নাম। হিন্দু সঙ্গীতশাস্ত্রে মূল সুর-লহরী বা রাগ হলো ছয়টি। প্রতিটি রাগের কল্পনা করা হয়েছে ছয়টি করে স্ত্রী সুর-লহরী। ছায়ানট হলো এ রকম একটি সুর-লহরী। ছায়ানট সংগঠনটি এখনো আছে। তবে আগের মতো সক্রিয়তা নিয়ে নয়। বাম ঘরানার আরেকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হচ্ছে ‘উদীচী’ বা উত্তর দিক। উদীচী বলতে বোঝায় উত্তর ভারতকে। আর এক কথায়, হিন্দুস্তানি সঙ্গীত ও সংস্কৃতির ধারাকে; যার সাথে বাংলাদেশের সঙ্গীতের কোনো যোগাযোগ নেই। কেন বাংলাদেশের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম উদীচী হতে পারল, সেটা নিয়ে তোলা যায় প্রশ্ন। এরা কি চান উত্তর ভারতের সংস্কৃতিকে বাংলার সংস্কৃতি বলে চালাতে? পরলোকগত অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মনে করতেন, বাংলাদেশের সঙ্গীতকে গড়তে হবে উত্তর ভারতের অনুরূপ। এখন উদীচীর কর্মকাণ্ড ছাড়িয়ে গেছে ছায়ানটকে। বাংলাদেশের এই দুই সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়া গড়ে উঠেছে আরো সংগঠন। সুফিয়া কামালের সময়ের থেকে আজকের ঢাকা হয়ে উঠেছে অনেক আলাদা। নানা দেশের সঙ্গীত-সুর প্রভাবিত করছে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগৎকে।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/০৫ ডিসেম্বর ২০১৫