(২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এক অল্প শীতের সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ হয় রাজনীতিবিদ এবং লেখক রুহুল কবির রিজভীর সাথে, তার শ্যামলীর বাসায়। অজস্র বইয়ের বিরাট সমারোহের মাঝে এক টেবিলে তিনি বসে আইরিশ কবি সিমাস হেইনির একটি কবিতার বই পড়ছিলেন। আরো দু-তিনজন তার মুখোমুখি বসা। হাতে একটা ডায়েট কোক, আর আইনের বেশ কিছু কিতাব স্তুপের মত দাঁড়িয়ে আছে তার বামে। বসতেই তিনি হিটারটা বাড়িয়ে দিলেন, বোধ হয় ‘উষ্ণ অভ্যর্থনা’ এমনই। আর একজন এলেন থাই সুপ-অন্থন নিয়ে। আমি এর ফাঁকে আলাপের ট্রেনটা চালু করে দিলাম, যদিও নিয়ন্ত্রণ আর রইলোনা হাতে। বিষয়, এবনে গোলাম সামাদ। চলল… -মিনহাজ আমান। )
প্রশ্নঃ আপনার সাথে এবনে গোলাম সামাদের পরিচয়টা ঠিক কোন সময়টাতে?
রুহুল কবির রিজভীঃ আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৮-৭৯ সেশনে ভর্তি হই। সবেমাত্র কলেজ পাশ করে ভার্সিটিতে ১ম বর্ষে পড়ছি। সেই সময়ে আমি লাইব্রেরি বা জিওগ্রাফির সেমিনার কক্ষ যেখানেই যেতাম না কেন দেখতাম যে একজন শিক্ষক সবসময়ই বই নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি আমি দু’একবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ এর নিজস্ব লাইব্রেরিতে গিয়ে সেখানেও স্যারকে বই নাড়াচাড়া করতে দেখেছি। তখন আমার মনে হলো উনি কে? তখন আমার পরিচিত গুনীজনদের কাছ থেকে স্যারের সম্পর্কে জানতে চাই। সে সময়ে রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজের প্রিন্সিপালের কাছ থেকে একবার জানতে গেলাম। তাকে আমরা ‘রোমিও’ নামে চিনতাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, উনি হলেন ‘রাজশাহীর সক্রেটিস’। এভাবে স্যারের সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। পরবর্তীতে ‘৭৯ এর শেষের দিকে যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠবো, স্যার তখন রাবি’র উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বর্ষের ভর্তি প্রক্রিয়া প্রায় শেষের দিকে। ওয়েটিং লিস্ট থেকে ২-১ জন ভর্তি নিবে এমন অবস্থা। আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। তখন একজন ছাত্রকে ভর্তির ব্যাপারে স্যারের কাছে যাই। স্যারকে বলি, স্যার তাকে ভর্তির সুযোগ দিন। স্যার জিজ্ঞেস করলো, তাকে কী হিসেবে নিব? আমি বলি, স্যার ও খেলাধুলায় বেশ ভালো। স্যার অনেকটা কৌতুক করে বললেন, খেলাধুলা পারে ভালো, কিন্তু সে কি ভবিষ্যতে আবাহনী-মোহামেডানে খেলতে পারবে? স্যার খুব রসিক মানুষ ছিলেন। তার একদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আম-চত্তরের দিকে ছিলাম আমি। স্যারকে দেখলাম ফাইলপত্র হাতে হেটে যাচ্ছেন। স্যার আমাকে দেখে ডাকলেন, এই ছেলে শোনো। তোমার ছেলেটিকে আগামীকাল এসে ভর্তির ফর্ম নিয়ে যেতে বলো। আমি স্যারের কথায় খুশি হলাম। ছেলেটির নাম ছিল ‘ডিউক’। এখান থেকেই স্যারের সাথে পরিচয় শুরু।
প্রশ্নঃ রাজশাহীর সক্রেটিস সেই প্রিন্সিপালের নামকরণ ছিল? আমি জানতাম আপনি দিয়েছিলেন নামটা?
রিজভীঃ হ্যা স্যারকে সেই অধ্যাপকই ‘রাজশাহীর সক্রেটিস’ নাম দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তীতে তা বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করি।
প্রশ্নঃ আপনি কি উনাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন?
রিজভীঃ না। আমি সরাসরি স্যারকে শিক্ষক হিসেবে পাইনি কারণ আমি উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র ছিলাম না। আসলে শিক্ষক তো শুধু ক্লাসের শিক্ষক দিয়েই হয় না। আমি উনার ব্যাপারে যেটা বলি যে, উনি হলেন চারণ শিক্ষক। স্যার একজন ‘প্যাস্টরাল টিচার’ ছিলেন। স্যারের জ্ঞান ছিল অপরিসীম।
স্যারের সাথে মাঝে মাঝে বাধের ধারে হাটার সময় স্যার আমাকে বিভিন্ন গাছের নাম বৈজ্ঞানিক নামসহ বলতেন। তারপর শহরে ডাচদের একটা কুঠি আছে। ঐ এলাকার নামই বড় কুঠি এখন। স্যার সেই ঘটনাও আমাকে বলতেন। অর্থাৎ স্যার ছিলেন একজন চলমান জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। যা জানতে চাইতাম তাই বলতে পারতেন। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর স্যারকে একদিন বললাম, স্যার চলেন আমরা মিষ্টান্ন ভান্ডারে যাই। দোকানটি বেশ বিখ্যাত ছিল। সেখানে গিয়ে আমরা লুচি আর বুন্দিয়া খেলাম। তখন জানতে পারলাম, স্যার লুচি বুন্দিয়া খুব পছন্দ করতেন।
এরপরে বহুদিন দশকের পর দশক আমি স্যারের সান্নিধ্যে কাটাই। বলতে গেলে পুরো ছাত্র জীবনটাই আমি স্যারের সাহচার্যে ছিলাম। যখনই আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়া আসা করতাম বা যতদিন রাজশাহীতে থেকে পড়াশোনা করেছি স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। স্যারের সাথে থাকা এই পুরো সময়টা আমার জন্য এক টুকরো হীরক খন্ডের মত অতি মুল্যবান। স্যারের ভিতর একটি শিশু-সুলভ ব্যাপার ছিল। আমি যখনই স্যারকে নিয়ে কোথাও যেতে অনুরোধ করতাম স্যার যেতে রাজী হতেন। বলতাম স্যার চলেন, মিষ্টান্ন ভান্ডারে যাই বা অন্য কোথাও বসি। স্যার আসতেন। আমি খুবই অভিভূত ছিলাম যে একজন এত বড় পন্ডিত মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্যারিসের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা একজন ব্যক্তি কতটা কোমল ও শিশু-সুলভ মনোভাব রাখতেন। স্যার ফরাসী ভাষায়ও বেশ পারদর্শী ছিলেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল, স্যারের সাথে কাটানো সময়গুলোর মাঝে বা নাস্তা করতে করতে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান নেয়া। ছোট ছোট প্রশ্ন করে জানতে চাওয়া। কোন নির্দিষ্ট বিষয় না বরং খেলাধুলা থেকে শুরু করে মিউজিক, ফিজিক্স, হিস্টোরি, কেমিস্ট্রি, লিটারেচার জ্ঞানের এমন কোন রাজ্য নেই যেখান থেকে প্রশ্ন করলে স্যারের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যেত না। শুধু আমিই নই, আমার অনেক শিক্ষকও তার ছাত্র এবং একই সাথে ভক্ত ছিলেন। যেমন আমার ফিজিক্স এর একজন শিক্ষক ছিলেন ড. আমিরুল ইসলাম, উনি পরবর্তীতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হন। আমরা উনাকে ‘মি. ক্লিন্টন’ বলতাম। উনি অত্যন্ত সুদর্শন ছিলেন। উনাকেও আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ড. এবনে গোলাম সামাদ সম্পর্কে। উনি (আমিরুল ইসলাম) বললেন, রিজভী, তোমরা জানো না, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন পাকিস্তান আমল। স্যার ছিলেন বোটানির শিক্ষক আর আমরা ছিলাম ফিজিক্সের ছাত্র। আমরা কয়েকজন মিলে স্যারকে ক্যাম্পাসের কোনো এক জায়গায় দাড় করিয়ে ফিজিক্স এর থার্মো-ডাইনামিকস সম্পর্কে জানতে চাইলাম। স্যার তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চমৎকারভাবে সব বুঝিয়ে দিলেন। অথচ উনি ছিলেন বোটানির শিক্ষক। তো এখানে বলতে চাচ্ছি, স্যারের যে চমৎকার পান্ডিত্য আর জ্ঞানের পরিধি ছিল তা স্যারের ব্যক্তিত্বকে যে কতটা মহৎ আর সৌন্দর্য-মণ্ডিত করে তুলেছিল, স্যারের সাথে মেলামেশা না করলে তা বুঝা সম্ভব না। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে। আমার খুব আফসোস হয় যে স্যারের সাথে চলাফেরার, আড্ডা দেয়ার, ওঠা-বসার বা একসাথে নানা অনুষ্ঠান করেছি এত দীর্ঘ সময়ের উনার যে কথাবার্তা বা আলোচনাগুলো ছিল সেগুলো যদি আমি কোথাও টুকে রাখতে পারতাম তাহলে একটা বিরাট গ্রন্থ হয়ে যেত। যেমনটি আহমদ ছফা করেছিলেন। যাই হোক, আরো নানা ঘটনা ও বিষয় আছে যা বলতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। তবে আমি শুধু বলব, এবনে গোলাম সামাদ একজন নিরহংকার, শিশুর মতো সরল, সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষ। একজন চারণ পন্ডিত।
অনেক জ্ঞানীগুণী শিক্ষকদেরকে যখনই প্রশ্ন করতাম তারা বলতেন, আমার রুমে আসো বা চেম্বারে আসো, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু স্যারকে প্রশ্ন করলে জায়গায় দাঁড়িয়ে সাথে সাথে উত্তর দিয়ে দিতেন হোক তা ফুটপাত বা ভাঙ্গা মেঠোপথ। স্যারের সাথে হাটছি, ছোট ছোট প্রশ্ন করছি আর স্যার উত্তর দিচ্ছেন। আর উত্তর দেয়ার ভঙ্গিতে কোন পান্ডিত্য জাহির করার চেষ্টা থাকত না তবে উত্তরগুলো অবশ্যই পান্ডিত্যপূর্ণ হতো। অর্থাৎ কঠিন কথাও যে খুব সহজ করে বলা যায় তা স্যারের কাছ থেকে জেনেছি। হোক তা দর্শন শাস্ত্র বা বিজ্ঞানের কোন বিষয় স্যার যত চমৎকারভাবে খুব সহজ করে জটিল বিষয়গুলোকে লিখতে পারতেন তা নিরলসভাবে তার বলার ভঙ্গিতেও লক্ষ্যনীয় ছিল। স্যার জটিল বিষয়গুলো ব্যখ্যা করতে গিয়ে তার গভীর তাৎপর্য না খুজে চমৎকার সহজ ভাষায় ব্যখ্যা করতেন যে বুঝতে কোন সমস্যা হতো না। আর এটিই ছিল স্যারের অন্যতম একটি প্রতিভা। এই ধরণের মানুষ যুগে যুগে তৈরি হয় না।
প্রশ্নঃ আমরা সামাদ সাহেবকে একজন কলামিস্ট বা স্কলার হিসেবে চিনি। কিন্তু উনি কি ক্যাম্পাসে কখনো রাজনীতি বা শিক্ষক সমিতি তে জড়িত ছিলেন? বা আপনারা কি উনাকে কখনো জ্ঞানী পন্ডিত বা শিক্ষক ভূমিকার বাইরে অন্য কোনো ভূমিকায় দেখেছেন?
রিজভীঃ স্যার ছিলেন একজন জ্ঞান পাগল মানুষ। স্যারকে আমরা কখনো কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় পাইনি। যেমন,রাজনীতি করা, বড় পদে যাওয়া, শিক্ষক সমিতি করা বা ভিসি হওয়া এগুলোর ধারে কাছে যেতেন না কখনো। স্যার ছিলেন একজন জ্ঞান পাগল মানুষ। সুতরাং, এগুলোর কোন প্রশ্ন ই আসে না। স্যার এগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত একজন মানুষ ছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে উনি কখনো জড়াননি। কিন্তু স্যার সবসময় রাজনৈতিক ঘটনা গুলোতে সক্রিয় ভুমিকা রেখেছেন। যেমন, ভাষা আন্দোলনের সময় স্যার ঢাকায় এগ্রিকালচার কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেই আন্দোলনে স্যারের একটি গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। একই সাথে স্যার একজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও ভুমিকা রেখেছেন। সবচাইতে মজার ব্যপার হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক’জন শিক্ষক ভারতে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। আরো মজার ব্যাপার হলো তিনি প্রবাসী সরকারের যে মুখপাত্র পত্রিকা ‘জয় বাংলা’, তার প্রথম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও ছিলেন। পরবর্তীতে আব্দুল গাফফার চৌধুরী সেখানে যাওয়ার পর উনি ‘সহকারি সম্পাদক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত উনার যে গৌরবজ্জল ভূমিকা, এর জন্য রাষ্ট্র তাকে কখনো কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তার যে প্রাপ্য স্বীকৃতি, সেটিও তাকে দেয়া হয়নি। অথচ স্বায়ত্তশাসিত সরকারের আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে স্যারের যে এত গৌরবজ্জ্বল সক্রিয় ভূমিকা, তার জন্য রাষ্ট্র তাকে কখনো পুরষ্কৃত করেনি। তিনি না পেয়েছেন একুশে পদক, না পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক না অন্য কোন পদক; কোনো প্রকারের পুরষ্কারই উনাকে দেয়া হয়নি। তবে খেয়াল করলে বুঝা যায় যে এসব পদক পেতে রাজনীতি করতে হয়। কিন্তু কোনো মহান পন্ডিত বা সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষেরা এ ধরণের পদক পায় না। আমি ড. আনিসুজ্জামান এর লেখাও পড়েছি। লেখালেখির বিষয়ে উনার সাথে কিছুটা দ্বিমত তৈরী হয়েছিল। আনিসুজ্জামানও লিখেছিল, উনি প্রবাসী সরকারে ছিলেন। একটি রাষ্ট্র একজন পন্ডিত সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষের কাছ থেকে আর কি চাইতে পারে? অথচ সার্বিক বিবেচনায় আপনি বাংলাদেশের দু’একজন শিক্ষাবিদ এর কথা বললে সেখানে তার নাম আসবে।
প্রশ্নঃ এমনকি উনি তো কখনো এমন এসব বিষয়ে আগ্রহীও ছিলেন না? আমার সাথে আলাপে তাকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি।
রিজভীঃ না, এসবের কোন প্রশ্নই আসে না। উনি এসবের জন্য কখনোই লালায়িত ছিলেন না। অত্যন্ত জ্ঞান পাগল একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রের তো একটা দায়িত্ব ছিল। রাষ্ট্র তার জ্ঞানকে পুজি করতে পারে কিন্তু তার স্বীকৃতি দিতে পারে না সেই রাষ্ট্র তো ফাংশনাল রাষ্ট্র হতে পারে না।
প্রশ্নঃ আপনি আপনার স্মৃতিচারণমূলক বই ‘অবরুদ্ধ দিনলিপি’তে বলেছেন, এবনে গোলাম সামাদের সাথে আলাপে নানা প্যারাডক্স ছিল।
রিজভীঃ এটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার৷ অনেক সময় হতো কি, স্যার একটি বিষয় বিশ্বাস করত। কিন্তু আমরা সে বিষয়ে তার থেকে আরো জ্ঞানগর্ভ তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার জন্য স্যারকে তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম। তখন স্যার তার যুক্তিকে পোক্ত করার জন্য আরো বেশি রেফারেন্স টেনে অনেক তথ্য দিতেন। আর এটিই আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান ছিল। এটাই মুলত আমাদের মধ্যে একটি প্যারাডক্স ছিল। অর্থাৎ একটা বিষয় উনি বিশ্বাস করেন, আমরা ও বিশ্বাস করি। কিন্তু সেটার সম্পর্কে আরো গভীর ভাবে জানার জন্য আমরা তাকে বেশি বেশি প্রশ্ন করতাম বা সেই বিষয়টির নেগেটিভ ইম্পেক্টটা উত্থাপন করতাম। আর তখনই স্যার তার যুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে অনেক তথ্য নিয়ে আসতেন যা আমাদের জন্য একটি মূল্যবান প্রাপ্তি ছিল। প্যারাডক্স বলতে মুলত এটিকেই বুঝাতে চেয়েছি।
প্রশ্নঃ সামাদ সাহেবের চিন্তায় তো নানা সময়ে নানা পরিবর্তন দেখা গেছে। যেমন তিনি একসময় এম এন রায়ের ‘র্যাডিকাল হিউম্যানিজম’ দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
রিজভীঃ আসলে একজন মানু্ষের জীবদ্দশায় চিন্তায় পরিবর্তন ঘটা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। যেমন আমি ছাত্রদল করেছি এবং ছাত্রবিরোধী আন্দোলনও করেছি। আবার যখন এম এন রায়ের লেখা পড়েছি, তখন তার লেখা দ্বারা আমিও প্রভাবিত হয়েছি। কিন্তু আমি কখনো আমার রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে যাইনি। সুতরাং পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক। উত্তরাঞ্চলে শিক্ষিত যে দু একজন তরুণ প্রগতিশীল চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করেছে তার মধ্যে উনি একজন। উনি একসময় বামচিন্তা ধারা ও র্যাডিকেল হিউমেনিজমেরও পক্ষে ছিলেন। তবে উনি এক্টিভিস্ট ছিলেন না। একজন মানুষের চিন্তা জগতে পরিবর্তন হতে পারে৷ যেমন রবীন্দ্রনাথ প্রথমে কবিতা লিখেছেন পরে গান, নাটক, গল্প ইত্যাদিতে কিছুটা সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছিল যেটা আপনি ‘কলকাতা-কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী’ বইটিতে পাবেন। পরে তিনি নোবেল প্রাইজ পেলেন। একসময় জাতীয়তাবাদ নিয়ে কাজ করেছেন কিন্তু পরে যখন দেখলেন, জাতীয়তাবাদ একটি অত্যন্ত ডগম্যাটিক বা সংকীর্ণ ব্যবস্থা যা একজন আন্তর্জাতিক কবির জন্য মানানসই না তখন আবার জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও লিখেছেন। এটি নিয়ে তার একটি সুন্দর প্রবন্ধও রয়েছে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুসোলিনি, হিটলার বা ফ্যাসিজম দেখেছেন তখন আন্তর্জাতিকতা ও মানবিকতার পক্ষেও বলেছেন। সুতরাং একজন মানুষের মানসিক বিবর্তন হতেই পারে। এবনে গোলাম সামাদের সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। তবে স্যারের জীবনের শেষ ৩০-৪০ বছর সময়ে বিশেষ করে স্বাধীনতার পরে তার চিন্তায় পরিবর্তন হয়েছে। তা হলো তিনি মনে করতেন যে এই আঞ্চলিক বা ভৌগলিক স্বাধীনতা একটি সময় বিপন্ন হতে পারে, এটাকে রক্ষা করতে হবে। একই সাথে এই ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে আমাদের যে রিসোর্স আছে তাও সুরক্ষা করতে হবে। আর উনি এই বিষয়ের চর্চা করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। আর এই কারণেই অনেকে তার বিরুদ্ধে নানা অভিমত ব্যক্ত করে যা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমার কাছে স্যারকে তার জায়গায় সঠিকই মনে হয়েছে। তাছাড়া তার মতে, এ রাষ্ট্রে ইসলাম একটি প্রভাবশালী ‘ইনগ্রিডিয়েন্ট’ যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামী সংস্কৃতির সাথে জড়িত এবং এ সংস্কৃতি যে এত বড় জায়গা দখল করে রেখেছে তার প্রভাব সামগ্রিক সংস্কৃতিতে থাকবে না, তা প্রাসঙ্গিক হতে পারে না। এই অবস্থান থেকে স্যারের চিন্তা সঠিক। আমি একজন সেক্যুলার হতে পারি বা ধার্মিক নাও হতে পারি। কিন্তু আমি যখন সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি ধর্মকে বিবেচনা করব তখন সেই ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা যায় না। সেই সমাজে উক্ত সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকবেই। স্যার ঠিক এই বিষয়টিই ভেবেছিলেন যা আমার কাছে সঠিকই মনে হয়েছে। একজন মানুষ অন্য ব্যক্তি বা নানা বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হতেই পারে। তবে সকল বিষয়ে যে আমরা একমত হব ঠিক তা নয়। তবে এর বাইরেও সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে স্যারের যে পান্ডিত্য, তার যে মহান রূপ আর এই জ্ঞানের গভীরতার মাঝে তার যে মহিমান্বিত রূপ তা তো নিঃসন্দেহে অনেক মহান। আর সেই রুপটির সাথে আমরা যখন পরিচিত হই, মিশতে পারি বা কথা বলি তখন আমরা অনেক আনন্দবোধ করি, পুলকিত হই। কারণ তখন আমি অনেক কিছু জানতে পারছি অনেক কিছু শিখছি। আর এতে করে আমার মনের মধ্যেও এক ধরনের আনন্দের খোরাক আসছে। এটিই মুল বিষয়।
প্রশ্নঃ উনি তো প্রায় ৯১ বছর বেচে ছিলেন যার মধ্যে উনি প্রায় ৭৫ বছরই লেখালেখি করেছেন। আপনার কি মনে হয় উনার লেখালেখির কোন প্রাসঙ্গিক প্রভাব রয়েছে সমাজে?
রিজভীঃ আসলে সত্যি বলতে আমি জানি না স্যারের কত তরুণ ভক্ত রয়েছে। যেমন আপনার মত যারা লেখালেখিতে যুক্ত রয়েছেন এমন অনেকেই থাকতে পারে। যেমন সেদিন পিজি হাসপাতালের একজন সিনিয়র ডাক্তারের সাথে শহীদ জিয়ার জন্মবার্ষিকীর একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়। তখন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারেন যে, আমি স্যারের একজন বিশাল ভক্ত, অনুরক্ত। ঠিক উনিও স্যারের খুব ভক্ত ছিলেন। যদিও স্যারের সাথে তার পরিচয় ছিল না। তো সমাজে এরকম কত বিজ্ঞ, বিদ্যান, সাধারণ, নবীন ও প্রবীণরা তার ভক্ত হয়ে আছেন তা তো আমরা জানি না। তবে এখন জানতে পারছি, আপনাদের মত তরুণরা স্যারের লেখার সাথে পরিচিত, স্যারের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত, কথা হয়েছে। এটি আমার জন্য আরো গর্বের বিষয়। আমি ভাবতাম যে মানুষ তাকে পাগল মনে করে অবহেলা করেছে। কিন্তু যারা তার সাথে মিশেছে বা তার অন্যান্য যত ছাত্র যারা স্যারের সাথে মিশেছে তাদের কাছেও স্যারের উচ্চ পর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যেমনটি আগেও বলেছি আমরা স্যারকে ‘সক্রেটিস’ বলতাম।
প্রশ্নঃ তার মানে আপনার মনে হচ্ছে যে আগের থেকে সামাদ সাহেবের জনপ্রিয়তা বা পাঠক সমাজের পরিধি এখন বৃদ্ধি পেয়েছে?
রিজভীঃ আসলে মানুষ দুই রকমের হয়ে থাকে। এক হলো যাদের হৃদয় উন্মুক্ত। তারা জ্ঞান চর্চায় কোন সংকীর্ণতা রাখে না। আরেক হলো যারা জ্ঞান চর্চায় নিজেকে নিয়ে অহংকার রাখে। যারা জ্ঞান নিয়ে অহংকার করে তারা সাধারণত ভুল করে স্যারের মত মানুষ চিনতে। এবনে গোলাম সামাদ স্যারকে ঐ সকল মানুষই চিনতে ভুল করে যারা নিজেদেরকে পন্ডিত মনে করে। আর তারাই স্যারকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে ও ভুলভাবে মূল্যায়ন করে। তবে আমি মনে করি যারা সকল প্রকারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য বিষয়ের বাইরে গিয়ে তাকে বিবেচনা করে এবং নিরপেক্ষভাবে সত্যিকার অর্থে স্যারকে জানতে চায় তাহলে তারা স্যারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে, চিনতে পারবে। অর্থাৎ কেউ যদি কোন ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে স্যারকে বিবেচনায় আনে তাহলে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে না। স্যারকে চিনতে হলে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার হতে হবে। কোন প্রকারের পূর্বচিন্তা দ্বারা বা গন্ডির মধ্যে থেকে স্যারকে বিবেচনা করতে গেলে তা নিরপেক্ষ হবে না। দল ও মতের বাইরে গিয়ে চিন্তা করলে স্যারের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব।
প্রশ্নঃ আপনার কি সেই স্মৃতিটা মনে আছে যখন এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে আপনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে উনি আপনাকে দেখতে গিয়েছিলেন?
রিজভীঃ হ্যা অবশ্যই মনে আছে। স্যার হাসপাতালে এসেছিলেন দেখতে। তবে হাজার স্মৃতির মাঝে এটি একটি স্মৃতি। আমার সবচেয়ে বেশি মনে পরে যে স্মৃতি, সেটা হলো, এরশাদের পতনের সময়ে ৯০ এর দিকে ডাকসু নির্বাচনের ঠিক এক মাস পর রাকসু(রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন হয়। আমি তখন রাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়। আমার প্যানেল থেকে আমি একাই নির্বাচিত হয়েছিলাম। আমার মনে আছে স্যার আমাদের সাথে সেদিন জেগেছিলেন রাত ১২:৩০ টা পর্যন্ত রেজাল্টের অপেক্ষায়। যদিও স্যার রাজনৈতিক কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। আমার মনে আছে, সেদিন রাতে সকল কাজ শেষে ভোটের গণনা চলছে। আমি সোহরাওয়ার্দী হলে এসে শুয়ে আছি। হঠাৎ করে পিওন এসে আমাকে বলল, এবনে গোলাম সামাদ স্যার টেলিফোন করে জানতে চাচ্ছে আপনি জেগে আছেন কি না। স্যার কথা বলতে চাচ্ছেন। আমি কিন্তু তখনো আমার ফলাফল জানি না। তো আমি এসে টেলিফোন ধরে সালাম দিলাম। বললাম, স্যার, আপনি এখনো জেগে আছেন! স্যার আমাকে বললেন, তুমি জিতেছো। প্রায় ২৫০-৩০০ ভোটের ব্যবধানে তুমি জিতেছো। অর্থাৎ আমার প্রথম অভিনন্দনটা স্যারের কাছ থেকেই এসেছে। তো এটি স্যারের সাথে আমার একটি অন্যতম স্মৃতি। আমি এটা নিয়ে বহুদিন ভেবেছি, একটা মানুষের কতটুকু স্নেহ বা ভালবাসা থাকলে আমার ফলাফলের জন্য মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে।
প্রশ্নঃ আপনার সাথে ড. সামাদ সাহেবের মনে রাখবার মত স্মৃতি কোনটি?
রিজভীঃ এটা তো হঠাৎ করে বলতে পারব না। কারণ স্যারের সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি। আমি যখন ৫ বছরের মত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমনে স্যারকে সাথে করে নিয়ে যেতাম। এর একটাই উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই দীর্ঘ পথটাকে একটু আনন্দদায়ক করা। যেমন, একবার পঞ্চগড় গিয়ে ৬-৭ ঘন্টা সময় পেলাম। এই পুরো সময়টা জুড়ে স্যারের সাথেই থাকতাম। এমনই বহু ঘটনা, খন্ড খন্ড স্মৃতি রয়েছে। স্যারকে যখনই সুযোগ পেতাম এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ছোট ছোট প্রশ্ন করতাম। হোক সেটা ভূত থেকে শুরু করে, বিজ্ঞান, বোটানি, জিওলজি, সাহিত্য বিষয়ে আর স্যারও সাথে সাথে উত্তর দিতেন। আমার মনে যে হয়তো দু-এক বার স্যার বলেছিলেন “এত কি আর জানি রে, বাবা।” এটাও স্যারের একটা বিনয়ের প্রকাশ।
প্রশ্নঃ আপনি লিখেছিলেন যে, উনি আপনাকে বিভিন্ন সময়ে ইমেইলে লেখা পাঠিয়ে পড়তে বলতেন। এই ব্যাপারে কিছু বলুন।
রিজভীঃ হ্যা স্যার আমাকে পড়তে বলতেন বিভিন্ন লেখা। স্যার আগে নয়াদিগন্ত, যুগান্তর এ লিখতেন। পরে দীর্ঘ সময় ইনকিলাব এ লিখতেন। পরে কোন একটি বিষয়ে ইনকিলাব এর সাথে দ্বিমত তৈরি হওয়ায় লিখা বন্ধ করে দেন। কারণ স্যার ছিলেন মুক্ত চিন্তার অধিকারী। স্যার নয়াদিগন্তে লিখতেন। নয়া দিগন্তের সম্পাদক (আলমগীর মহিউদ্দিন) আবার স্যারের ছাত্র ছিলেন। তারপর শেষের দিকে তো আর স্যার লিখতে পারতেন না। উনি বলতেন আর অন্য কেউ লিখে দিতেন। অথচ এক সময় স্যার ভারতের ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলত। স্যার একটা কলাম লিখে দিচ্ছেন। তার পালটা যুক্তি দিয়ে আরেকজন আরেকটা কলাম লিখছে।
প্রশ্নঃ আপনি একবার লিখেছিলেন, নিজের একটা অবজেক্টিভ বায়োগ্রাফি লিখতে চান। এটা কতদূর এগুলো?
রিজভীঃ না আসলে আমি তো বাঙালি লোকদের মধ্যে বিখ্যাত কেউ নই। সাধারণত বিখ্যাত লোকদের অটোবায়োগ্রাফি গ্রহণযোগ্য হয়। সেই চিন্তা করে আর লিখিনি। তবে জেল জীবনের উপর একটি লেখা অসমাপ্ত আছে। সেটা সম্পন্ন করার পরিকল্পনা আছে।
প্রশ্নঃ আমরা আপনার কাছ থেকে একটি অটোবায়োগ্রাফি আশা করি।
রিজভীঃ হ্যা বলেছিলাম একবার লিখব। কিন্তু পরবর্তীতে নানা চিন্তা থেকে সেটি বাদ দেই।