এবনে গোলাম সামাদ – বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় সন্ধান, নবতর নির্মাণ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির প্রত্যয়ে একজন দূরদর্শী দার্শনিক। স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিনির্মাণ তার চিন্তা-গবেষণার মৌলবিন্দু। পুঁজিবাদী সভ্যতার বহুব্যপ্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা। যৌবনের প্রারম্ভে অর্থনৈতিক সাম্যের প্রত্যয়ে এবনে গোলাম সাম সাম্যবাদের অসারতা অনুমানে সত্যকে সন্ধান করেছেন প্রগাঢ় অনুসন্ধিৎসায়। প্রখর যুক্তিযোগ, নির্মোহ পর্যবেক্ষণ এবং আশ্চর্য বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী এ প্রাচ্য-মনীষা তাঁর পূর্বতন দর্শন ঝেড়ে ফেলে আগ্রহী হয়েছেন দেশ জাতির ও শেকড়মুখী জীবনবোধে। দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, অর্থনীতি, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, কৃষি, সমাজতত্ত্ব, উন্নয়ন রাজনীতি- ইত্যকার বিষয়ে তাঁর নবলব্ধ বোধ-বোধির আলোর বিচ্ছুরণ করেছেন। হাজির করেছেন এসবের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও বিবেচনা। প্রচলিত ধারার বুদ্ধিজীবীতার বিপরীতে মৌল বিশ্বাস, ইতিহাস-সংস্কৃতির আলোকে জাতির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত নির্মাণের দায় এবনে গোলাম সামাদ ধারণ করেছেন স্বেচ্ছায়। তকমা বিক্রি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেননি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এ কলমযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে কলকাতায় কাজ করেছেন আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায়।
সম্প্রতি ৯১ বছর বয়সী জ্ঞানতাপসের সান্নিধ্যে নোঙরের পক্ষ থেকে মুখোমুখি হন কবি ও চিন্তক মাঈন উদ্দিন জাহেদ, সাহিত্যকর্মী আধু সাঈদ হাননান ও ইতিহাসের তরুণ প্রভাষক সামস সাইমুম। দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে ইতিহাস রাজনীতি দর্শন নৃতত্ত্ব সংস্কৃতিসহ বহু বিষয়ের অনুপুংখ বিশ্লেষণ। যার চুম্বকাংশ নোঙর পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হল।
– নোঙর সম্পাদনা পরিষদ (সংক্ষিপ্ত)
নোঙর-স্যার আসসালামু আলাইকুম….
ডঃ সামাদঃ ওয়ালাইকুম সালাম। আমার শরীরটা খুব অসুস্থ। আপনারা কোথেকে এসেছেন?
-চট্টগ্রাম থেকে স্যার।
ডঃ সামাদঃ চট্টগ্রামের কোথায়? বৃহত্তর চট্টগ্রাম তো চিনতে পারি না! আমি থাকতাম আসকার দিঘি। গরীবুল্লাহ শাহর ওখানে আমার বাবার কবর। সবারই। বাবার, মা’র, বড় ভাই, মেঝো ভাই, সেঝো ভাই। আমাকে চাটগাঁর লোকও বলা যায়।
-স্যার চট্টগ্রামে কয় বছর ছিলেন আপনি?
ডঃ সামাদঃ থাকাতো নয়, গিয়েছি আসছি, বাবার চাকুরির সুবাদে। পার্টিশানের সাথে সাথে আমার বড় ভাই ওখানে গেলেন। আব্বা আম্মা কিছুদিন পরে চলে গেলেন ভাইয়ের কাছে। আরো দুই ভাই ওখানে চলে গেলেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের সাথে আমাদের কী যেন একটা সম্পর্ক ছিল।
-আত্মিক সম্পর্ক কি?
ডঃ সামাদঃ আত্মিক সম্পর্ক না হয়তো। এমনি সম্পর্ক বোধ হয় ছিল। আমরা ওইদিক দিয়ে এদিকে এসেছি মনে হয়। ইংরেজরা পর্তুগিজদের হাত থেকে যদি চট্টগ্রাম দখল করতে পারতো, তাহলে তো ওখানে রাজধানী হতো, কলকাতাতো রাজধানী হয় না। প্রথমেতো তারা গেল চট্টগ্রাম দখল করতে।
-মহসিন কলেজের পাহাড়ের উপরে এবং দেয়াং পাহাড়ের ওদিকে পর্তুগিজদের বাতিঘর আছে।
ডঃ সামাদঃ গোটা কোর্ট বিল্ডিংটাইতো পর্তুগিজদের। পর্তুগিজ ভাষায় পোর্তো গ্রন্ড। গ্রন্ড অর্থ হলো বড় আর পোর্তো অর্থ হলো পোর্ট।
-ওর থেকেই কি পতেঙ্গা হয়েছে?
ডঃ সামাদঃ পতেঙ্গা কী জন্য হয়েছে জানি না। গত যুদ্ধের সময় পতেঙ্গার লোকদের বললো চলে যেতে হবে। পতেঙ্গার সব লোকেরাই খুব ধনী ছিল।
-চট্টগ্রাম যাবেন নাকি আবার।
ডঃ সামাদঃ নারে বাবা আমার শরীরে কুলায় না। ওই যারা অনেক খানের লোক হয়, তাদের কোনো খানেই স্থান হয় না। Poly centre means no centre.
-স্যার আপনার সময় কেমন কাটছে?
ডঃ সামাদঃ আমি আসলে খুব চিন্তিত, চারদিকে অসৎ লোকের আনাগোনা। পৃথিবীতে অসফল চোরেরাই জেল খাটে। সফল চোরেরা না। যে দেশে অসফল চোরের চেয়ে সফল চোর বেশি হয়ে যায়, সে দেশের বিপদ ঘনিয়ে ওঠে।
-স্যার আপনার শরীর কেমন যাচ্ছে?
ডঃ সামাদঃ না রে বাবা! আমার নব্বই বছর বয়স হয়েছে। যখন ভেতর থেকেই যন্ত্রপাতি খারাপ হতে থাকে, তখন আর মেরামত করে কিছু হয় না। দুনিয়াদারি আসলেই একটা বোঝা। একদিন ছিলাম না, একদিন থাকবো না। এটাইতো সত্যি। এমপি হলেও থাকবো না, এমপি না হলেও থাকবো না। রাজনীতির ব্যবসাটা বন্ধ হলে গণতন্ত্র নিয়ে অনেকদূর যাওয়া যেত। তবুও ভালো। অন্তত পাঁচবছর পর একবার এসে হলেও আমার কাছে ভোট চাইবে নেতারা। আমি একজনকে জানি, যে একবার এক প্যাকেট বিড়ি নিয়ে ভোট দিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই, তুমি এক প্যাকেট বিড়ি নিয়ে ভোট দিলে, এটা কেমন কথা? সে বলে- আমাকে এই এক প্যাকেটই কে দেয়?
-বাংলাদেশে কি এখন গণতন্ত্র আছে?
ডঃ সামাদঃ কোনো দেশেই গণতন্ত্র নাই। আমেরিকার চার চার জন প্রেসিডেন্ট মারা গেছে ঘাতকের হাতে। কেনেডি হত্যার কোনো বিচারই হলো না।
-ওরা তো স্যার দাবি করে, বিশ্বব্যাপী ওরাই গণতন্ত্রের সোল অ্যাজেন্ট।
ডঃ সামাদঃ কথা হচ্ছে, কিছু গণতন্ত্র থাকলেও সেটা ভালো। পুরোটা পাচ্ছি না বলে অংশটাও নিবো না, তা কি হয়? সেটা খুব একটা ভালো নীতি বলে আমার কাছে মনে হয় না। ইসলামের একটা শিক্ষা হলো: দুইটা মন্দের মধ্যে কম মন্দকে ভালো বলে গ্রহণ করতে হবে। বন্ধুত্ব করতে হবে।
-এখন বন্ধু সিলেক্ট করাটাতো কঠিন ব্যাপার….
ডঃ সামাদঃ কথা হচ্ছে যে, চিরদিনের জন্য বন্ধুতো থাকে না কেউ। অধিকাংশ বন্ধুই হলো প্রয়োজনের আইনস্টাইন কয় ভাগে যেন ভাগ করেছে, আমার মনে নাই। প্রয়োজনের বন্ধু, ভালো বন্ধু আর কী কী জানি, সব বন্ধু কি আর একরকম?
-স্যার, হঠাৎ করে দেশের পরিস্থিতি কেমন যেন উদ্বেগজনক হয়ে গেলো …….
ডঃ সামাদঃ কথা হচ্ছে, যখন থেকে আমরা আদর্শচ্যুত হলাম, তখন থেকে এই কাণ্ড শুরু হতে থাকলো।
-বাঙালী মুসলমান এর সংকট তো দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে।
ডঃ সামাদঃ আপনি যদি পেটাতে পারেন, তাহলে টিকবেন না হলে টিকবেন না। আমরা কি মুরগিকে জবাই করে খাচ্ছি না? চিন্তা করছি মুরগির রাইট সম্পর্কে? কথা হচ্ছে পৃথিবীটা এরকমই। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। এখন এটা কেন হয়েছে, আল্লাহর ফায়সালা নিয়ে তো আর প্রশ্ন করা যাবে না। মশা সৃষ্টি না করলে কী হতো? আমাকে কামড়াচ্ছে শুধু শুধু। এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। পৃথিবীটা যেমন সেরকমভাবে থাকতে হবে।
-সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
ডঃ সামাদঃ এটা কখনোই বুঝাতে পারলাম না।
-আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও তো সন্তোষজনক না।
ডঃ সামাদঃ ওটা কখনোই ছিল না, ওরা সব সময় মাখনভোগী ছিল। আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা নামকরা অধ্যাপক ছিল, তারা হয় ইন্ডিয়ার অ্যাজেন্ট ছিল, তখনতো র্যাড ছিল, র’ ছিল না। র্যাডের অ্যাজেন্ট ছিল না হলে সিআইএ’র অ্যাজেন্ট ছিল।
-এখনও তো সমস্ত বুদ্ধিজীবীগুলো একই রকম।
প্রশ্নঃ এখন কথা হচ্ছে এদেরকে বুদ্ধিজীবীতো আপনারা বানাচ্ছেন। এদেরকে হাততালি তো আপনারা দিচ্ছেন। তো কী করা যায়, নিজেরা কেন অর্গানাইজড হচ্ছেন না, কেন এগিয়ে আসছেন না? কথা হচ্ছে, এক সময় ইউরোপেও তো লোকে দূর্গের মধ্যে থাকতো। ডাকাতের ভয়ে। আপনার মেয়ে এখন এগারটার সময় বাড়ি ফিরবে। এটাতো হতে পারে না। দেশের অবস্থা বুঝেতো তাকে চলতে হবে। এখন তার উপর কিছু হামলা হলে অমুক তমুক বললে তো চলবে না। নিজের নিরাপত্তা নিজেরও রেসপন্সিবিলিটি আছে। এই যে আমাদের গণপরিষদ ভবনটা, এটাতো হলো মধ্যযুগের একটা দূর্গ, যেখানে লোকেরা ভাইকিংদের ভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিত। এটার সাথে আমাদের কোনো ঐতিহ্য নেই। বরঞ্চ কার্জন হলের সাথে আছে। সেটা একটা বেটার আর্কিটেকচার অনেকদিক থেকে।
-ওটাকে তো মডারেট করতে গিয়ে আসলটাই হারাতে বসছে…….
ডঃ সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে, ইংরেজরা চেয়েছিল আমাদের সাথে একটা অ্যাডজাস্টমেন্ট এন্ড কম্প্রোমাইজ। এটা মনে রাখতে হবে, ইংরেজরা আমাদের দেশে আসার আগে তাদের মধ্যে জন্মেছে নিউটন, তাদের মধ্যে জন্মেছে ফ্রান্সিস বেকন, তাদের মধ্যে জন্মেছে শেকসপিয়ার। ইংরেজরা খালি দোকানদারের জাত ছিল এটা যারা বলে তারা ইংরেজ সম্পর্কে কিছুই জানে না। সিরাজদৌলা হেরেছিল বলে তার জন্য ইংরেজরা এদেশে রাজত্ব করতে পারেনি। তারা নেপোলিয়ানকে হারিয়েছে, নেপোলিয়ানকে যদি হারাতে না পারতো ওয়াটার লু’তে, তাহলে অর্ধেক ইন্ডিয়া, কম করে অর্ধেক ইন্ডিয়া ফ্রান্সের হতো। আমরা একটা যুদ্ধেও জিততে পারিনি ইংরেজদের সাথে।
-ঐতিহাসিক ভাবেতো আমরা আসলে খুব বেশি প্রোগ্রেসিভ জাতি না। কিন্তু এই যে হাজার বছরের বাঙালি, হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য…
ডঃ সামাদঃ কিছু না। আমাদের খাওয়া ছিল সোজা। আমরা খেয়েছি, ঘুমিয়েছি, দাবা পাশা খেলেছি। আমাদের জীবনটা ছিল অন্যভাবে অ্যাডজাস্টেড।
-এটারওতো একটা ধরন আছে।
ডঃ সামাদঃ হ্যাঁ, ধরন ছিল। রোমান সাম্রাজ্য টিকেছিল কত? দু’হাজার বছর। বৃটিশ সাম্রাজ্য একশ নব্বই বছরে আমাদের দেশে শেষ হয়ে গেছে। তারা থাকতেতো পারেনি। এত খারাপই বা কী করে হলাম?
-স্যার আমাদের মিডিয়াগুলোতো ঐতিহ্য নিয়ে কোন প্রোপাগ্যান্ডা করছে না।
ডঃ সামাদঃ মিডিয়াতো করবেন না। তিনটা কাগজ চলছে ইহুদিদের টাকায়, তারা সেটাকে ব্যবসা হিসাবে নিচ্ছে। তারা ঠিক যে আমাদের অ্যান্টি করছে তা না, তারা এদেশে টাকা খাটাচ্ছে ব্যবসার কথাও চিন্তা করে। কেন না এদেশে ব্যবসা বুদ্ধির লোক নাই। তারা জেনে গেছে, যদি ইসরায়েল ফেল করে তাহলে তাদেরকে তো কোথাও থাকতে হবে। কে না জানে, র্যালি ব্রাদার্স ইহুদি। তাদের হাতে সম্পূর্ণ পাটের ব্যবসাটা ছিল। মার্শেল, লয়েড ইহুদি। ইংরেজ আমলে ইহুদিরাইতো এদেশে লুটপাট করেছে বেশি। খাঁটি ইংরেজ আর কটা লুটপাট করেছে? তো যাই হোক, ওসব ব্যাপারে আমি আর কী বলবো? আমিতো শিক্ষক ছিলাম, আমিতো এসবের কোনো কিছুর মধ্যে ছিলাম না। সুতরাং আমি যতটুকু পেরেছি, একটু লিখতে শিখেছিলাম। আমাকে কয়েকজন শিখিয়েছিল। একটু লেখেছি। ব্যাস।
-স্যার আপনার লেখালেখিতে প্রথম দিকে কারা আপনার অনুসরণীয় ছিল?
ডঃ সামাদঃ আমার বাবা।
-উনিও লিখতেন?
ডঃ সামাদঃ উনিও লিখতেন। আমাদের সবাই লিখতেন। তো একটু চুপচাপ লিখতাম। আমাদের কেউ চিনে না। লেখাটা ছিল আমাদের কাছে একটা খেলা।
-স্যার আপনার বাবার কয়েকটা বই ছিল।
ডঃ সামাদঃ আরে তাতো থাকতেই পারে। কতজন হোমিওপ্যাথিক কাব্যওতো লিখেছে।
-আপনিও কি লিখেছেন কবিতা?
ডঃ সামাদঃ আমি কবিতা লিখিনি। আমার ও রোগ ছিল না।
-এটাকে রোগ হিসাবে দেখছেন স্যার? আপনার বাবার কোন কয়টা আছে?
ডঃ সামাদঃ কী জানি? তোমাদের মাথার মধ্যে কমিউনিস্ট প্রবৃত্তি ঢুকেছে কেন? কমিউনিস্টরা আল্লাহ মানে না, কিন্তু মানুষকে আল্লাহ করে তৈরি করে, তাকে নিয়ে রাজনীতি করে। এটা অত্যন্ত খারাপ জিনিস। আস্তিকতা মানুষকে যতটা ক্ষতি করে, তার থেকে মানুষ পূজা অনেক বেশি ক্ষতি করে। টি এস ইলিয়ট ঠিকই বলেছে, যে এরা বিধাতায় বিশ্বাস করে না, মানুষকে বিধাতা করে তোলে। এটা হচ্ছে এদের সবচে বড় জঘন্য কাজ।
-সমাজের অনেকগুলো গণ্ডগোলের পেছনে এই কমিউনিস্টরাই দায়ী।
ডঃ সামাদঃ আপনারা ওদের কথা শোনেন কেন? কমিউনিস্টদের বাহুতে কত বল?
-দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে বলে….
ডঃ সামাদঃ শেখ হাসিনা তাও একটা কাজ করেছে, বাপের জীবনীটা ছাপিয়ে ‘টু ন্যাশন থিওরি’কে সাপোর্ট দিয়েছে। ইন্ডিয়ার বিরোধীতা সত্ত্বেও দুইটা চিনা সাবমেরিন গ্রহণ করেছে। খালেদা জিয়া একটাও করেননি। শেখ হাসিনা অন্তত দেবগৌড়ার সাথে চুক্তি করে একটা জিনিস প্রমাণ করেছে যে, গঙ্গা একটা আন্তর্জাতিক নদী, আমরা এখন যদি আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলতে হয় সেটা বলতে পারি। ইন্ডিয়াতো স্বীকার করে নিয়েছে, কতটা পানি পাবো সেটা পরের কথা। কিন্তু এই যে গঙ্গা একটা আন্তর্জাতিক নদী, এটাতো স্বীকার করেছে। সেটাইতো স্বীকার করছিল না। জোয়ান অব আর্ক কোনোদিন যুদ্ধ করেনি। কিন্তু যুদ্ধ করিয়ে ফ্রান্সকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এ wicked government is far better than a weak government. রাজশক্তি বজ্র শক্তি, Kill or they kill, এ ছাড়া কোনো কথা নাই। মানুষের ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস। দুইটা যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কে শান্তি বলে।
তাহলে করণীয় কী?
এমন কাগজ এই যুগান্তর! বানদুলা সম্পর্কে ফিচার ছাপাচ্ছে, যে বানদুলা চেয়েছিল গোটা মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত দখল করতে। এতে আমাদের কী লাভ হতো? ইংরেজ আমলে হয়তো লোকে ব্রিটিশ ছিল বলে বানদুলাকে পাবলিসিটি কিছু দিয়েছে, এরা জানে না যে বানদুলা কী চাচ্ছিল? বানদুলাতো সামনে ছিল, পেছনেতো ছিল পর্তুগিজরা। এরা বাড়ির ধারের ইতিহাসটা পর্যন্ত কখনো পড়ে দেখে না, যে আসলে কী ব্যাপার ঘটেছে।
-এখন স্যার আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দুই বাংলাকে এক করার এক ধরনের প্রোপাগ্যান্ডা চলছে।
ডঃ সামাদঃ কথা হচ্ছে যে, যেরকম ভাবছে জোর দিয়ে হবে, তা হবে না। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত তৈরি হয়ে গেছে। তোমাদের বাড়ি তাদের হাতে বিক্রি হয়ে যাবে না। তারা আর দু’শ বছর আগের কেউ নয়। আমাদের পূর্ব পুরুষ সাতশ বছর এই উপমহাদেশ শাসন করেছে। সেটা ভুলে যেও না।
-আমরা যে আলাদা একটা স্বত্তা, এই জিনিসটা গ্লোরিফাই হচ্ছে না। বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব স্বকীয়তাটা তারা উজ্জ্বল করে তুলছে না।
ডঃ সামাদঃ ভুলবে নাকি জানি না। আমারতো এক পা চলে গেছে কবরে। আর তা ছাড়া আমার বুকের মাফ ছিল পঁচিশ ইঞ্চি। বত্রিশ ইঞ্চি লাগে বোধহয় সৈন্য হতে, সেটা জানি না। তো কথা হচ্ছে, যে এরকম কেন? আল্লাহ আল্লাহ করো বান্দা, নবী করো সার, মাঝে আল্লাহ, আল্লাহ কর মাঝ দরিয়া পার। তা কি হয়? হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজে সাতাশটা যুদ্ধে জেনারেল ছিলেন। কী আর বলব, আপনাদের চট্টগ্রামতো বার আউলিয়ার দেশ। মাইজভাণ্ডারিতো ওখান থেকেই উঠেছে না?
-এখন ঈদে মিলাদুন্নবীতে প্রচুর গরু জবাই হবে।
ডঃ সামাদঃ আরে ঈদে মিলাদুন্নবীতেতো হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে গাড়িতে সাজিয়ে আমার এখান দিয়েই নিয়ে গেল! খাওয়াদাওয়া করতে পারে। কোরআন শরীফে বলেছে যে, সুন্দর ফল আর মিঠাপানি তোমাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং কিছু খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। সবসময় নয়, কিন্তু করতে পারে বলতে তাই বলে এভাবে নাকি?
-একেবারে উৎসব করে।
ডঃ সামাদ; না উৎসব করবে কেন? লা-শারিক আল্লাহ। এভাবে আল্লাহর শরিক বানাচ্ছে কেন? একেবারে আনুষ্ঠানিকতা করে একধরনের পূজার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে বিষয়গুলোকে। গোটা পীরবাদইতো হলো পূজা।
-স্যার পীরবাদটা ইরান থেকে আসছে না?
ডঃ সামাদঃ পীরইজম মেইনলি সেন্ট্রাল এশিয়ার ব্যাপার। পীর শব্দটা হলো ফার্সি। বৃদ্ধ ব্যক্তি তিনি। জ্ঞানী। বৃদ্ধ আর জ্ঞানী একই । একটা প্রবাদ ছিল প্রাচীন যুগে; তিন মাথা যার, বুদ্ধি নেবে তার। হাঁটু দুটো আর মাথা, বসলে যখন মাথা হাঁটুর সাথে লাগতো তখন তাদেরকে বলা হতো তিন মাথা। কেন না খুবই বৃদ্ধ তারা। আর জ্ঞানটা নির্ভর করে অভিজ্ঞতার উপর। বৃদ্ধদের অভিজ্ঞতা বেশি। তখনতো আর বই ছিল না। বৃদ্ধদের যেহেতু অভিজ্ঞতা বেশি, তাই পীর আর জ্ঞানী একই ব্যক্তি ধরা হতো। তো যাই হোক। আমি ছিলাম শিক্ষক মানুষ, সবচেয়ে বেশি পড়েছি কেমিস্ট্রি আর বোটানি। অন্য ব্যাপার আমি জানি না।
-উদ্ভিদ রোগতত্ত্বইতো আপনার মূল বিষয়…
ডঃ সামাদঃ তা যা হোক, সেসব বলতে যাবো না। তবে, আমার বাড়ির কাছে একটা মুদির দোকান ছিল। সেটা আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করেছিল। মুদির দোকানদারকে আমি ভাই ডাকতাম। আমি মাঝে মাঝে যেতাম। তো দেখতাম মুদির দোকানে অনেক জিনিস আছে। একটাতে লোকসান হলে মআরেকটাতে পুষিয়ে নেয়। সেজন্য আমি অনেক বিষয়ে কিছু কিছু পড়ে রেখেছিলাম। যেন, একটাতে লোকসান খেলে আরেকটা দিয়ে করে খাবো।
-আপনার নৃ-তত্ত্বের প্রথম পাঠ বইটা খুব ভালো হয়েছে।
ডঃ সামাদঃ আমি ওটাকে ঠিক করতে চাচ্ছি। বাজারের লোকেরা এটাকে ভুলভাল ছাপিয়ে দিয়েছে।
-বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে একটা ছোট্ট বই ছিল আপনার।
ডঃ সামাদঃ ওটা ইসলামিক ফাউন্ডেশান ছাপাতেই চাচ্ছিল না। ওদের মাথার মধ্যেই আসছিল না যে এই বই আমি কেন লিখলাম! আমিতো ওটা ইসলাম বাঁচাবার জন্য লিখিনি, মুসলমানকে বাঁচাবার জন্য লিখেছি। দুটোতো এক না।
-এদেশের মুসলমানদের অধিকাংশই কনভার্টেড না, এটা নিয়ে আপনার একটা বক্তব্য ছিল।
ডঃ সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে, হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বাপওতো মূর্তি পূজা করতেন। এখন কনভার্টেড বলতে কী বুঝালো! হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর আব্বা দোজখে যাবেন কিনা আমিতো বলতে পারি না, কারণ তারাওতো মূর্তি পূজা করতেন। তো যারা মূর্তি পূজা করে তাদের সবাইকেইতো বলতে হয় মালাউন ।
-কলকাতার একজন বাংলাদেশে মুসলমান এবং তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে একটা বই লিখেছে। সে একটা ডাটা দিলো যে বেশিরভাগ মুসলমান কনভার্টেড।
ডঃ সামাদঃ কথা হচ্ছে বাংলাদেশে হিন্দু ম্যাজরিটি ছিল না প্রথম কথা, আর দ্বিতীয় কথা, বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে ইংরেজ শাসনামলে। তার আগে মুসলমান ম্যাজরিটি ছিল না। সুতরাং ইংরেজ আমলে কনভার্শনের প্রশ্নতো ছিল না। এটাতো ইংরেজ আমলের চর্চা থেকেই দেখা যাচ্ছে।
স্যার, সামাজিক সাম্য নিয়ে আপনার বিবেচনা কী?
ডঃ সামাদঃ আমি সোস্যালিজম পছন্দ করি না। আরেকটা কারণে আমি স্টেইটকে ঘৃণা করি। রাষ্ট্রের মতো লুটপাট আর কেউ করে না জনগণকে। মানুষ যে ভালো জীব নয়, তার একটা প্রমাণ হচ্ছে মানুষের জন্য রাষ্ট্র লাগে। এক গাছে যত কাক থাকে, তাদের মধ্যে কোনো কাক অন্ধ হয়ে গেলে অন্য কাকেরা তাকে খাওয়ায়। তার জন্য ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট করতে হয় না, মানুষের ক্ষেত্রে ওয়েল ফেয়ার করতে বক্তৃতা দিতে হয়।
-তাহলে মানুষের সামাজিক অবস্থান কীভাবে দাঁড়ালো?
ডঃ সামাদঃ মানুষ কবিতা লিখতে পারে! কাকতো লিখতে পারে না, তাই নিজেকে বড় করে। না হলে ইলেকট্রিক আর্থে তারের শক খেয়ে একটা কাক মরলে কয়টা কাক আসে? আর আমাদের মাইকে বলতে হয় একটি শোক সংবাদ। তাও লোক হয় না এখন। এত কাক কী করে এসে জোটে?
-এটা কাকের ঐক্য।
ডঃ সামাদঃ পাখিদেরও হার্টে চারটা চেম্বার, মানুষেরও হার্টে চারটা চেম্বার। কিন্তু ওদের হার্ট অনেক ভালো। যাক বিহঙ্গদের বরাবরই আমার ভালো লেগেছে।
-বিহঙ্গদের উপর আপনি কোনো বই লিখেছেন?
ডঃ সামাদঃ হয়তো পারতাম লিখতে। কিন্তু লিখিনি। বিহঙ্গ নিয়া লিখলে বিহঙ্গদের সমাজ জীবন নিয়াই লিখতাম। ঐ কোথাও পানকৌড়ির ছবি ছাপাতাম না।
পানকৌড়ি নামটাইী সুন্দর, পাখিটা বিশ্রি। আল মাহমুদই ওকে গ্লোরিফাই করল।
ডঃ সামাদঃ গল্প আছে না? একোন মরারে অমর করিয়া… ছেলে হচ্ছে, বাবা মা নাম অমর রাখলো। কিন্তু চিরকাল সে বাঁচে না। এ নাম রাখা ঠিক নয়। এরকম অনেক নামতো আছে। ধনপতিও ভিখারি হতে পারে।
-স্যার আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানচর্চা কি আরো বিস্তৃত হওয়া উচিৎ না?
ডঃ সামাদঃ গবেষণা চলছে মোটামুটি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যত বই লিখলো বাংলাদেশের উপরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তো তা লিখেনি।
-ওরাতো প্রকল্প আর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত।
ডঃ সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে, এই ভাগবাটোয়ারায় যারা লিপ্ত তাদের ঘিরে কেন মারছে না লোকেরা? যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজন অ্যাভারেস্ট বিশেষজ্ঞ পড়াতো। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয় কারো ধারে কাছেও কেউ নাই। ব্যাপার হচ্ছে যে, এগুলো বলেতো লাভ নাই।
-এটা কি পরিবেশের কারণে হচ্ছে স্যার?
ডঃ সামাদঃ দেখেন এটা বলা খুব মুশকিল। যে রোমানরা আগে বিশ্ব কাঁপাতো, তারা আজ ইতালির রাস্তায় লোকের পকেট থেকে পাঁচ টাকা চুরি করছে। এখন এরা এরকম হয়ে গেল কেন এটা বলা যাবে। না। কী করে বলবো বলেন? এগুলো বলা যায় না। কত মা’র ছেলে মারা যায়, সব মা তো আর পাগল হয় না। কোনো কোনো মা পাগল হয়, তবে এটাও সত্য যে তার ছেলে মারা না গেলে সে পাগল হতো না। এটা কেন যে হয় তা বলতে পারবো না। এ পৃথিবীতে কেউ দুধ বেচে কলা খাবে, কেউ কলা বেচে দুধ খাবে। এখন আমি কী করতে পারি?
-আমাদের এই যে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে এর পেছনে কারণটা কী?
ডঃ সামাদঃ এখন কথা হচ্ছে যে, এরা টাকার জন্য বুদ্ধিজীবী কি না? টাকাও মানুষকে বুদ্ধিজীবী বানায়।
-টাকার জন্য বুদ্ধিজীবী নাকি টাকার জোরে বুদ্ধিজীবী?
ডঃ সামাদঃ সেরকম কী করে বলবো ভাই? আমি কি অত জানি? আমার এখন যে অবস্থা! টিকি বলে লিখি, লিখি বলে টিকি। এই এরা একটু টাকা এনে দেয়, লেখা টেখার ব্যাপারে, তাই আমি বেঁচে আছি। আপনারা যে এসছেন আমার কাছে, এতেই আমি খুশি। কতদূর থেকে এসছেন!
-আপনাকে দেখতে আসা।
ডঃ সামাদঃ অবশ্যই চট্টগ্রাম আমার কাছে খুবই প্রিয় জায়গা। আমার মেয়ে ক’দিন আগেই গিয়েছে, সেই বান্দরবান, সে নাকি মিয়ানমারেও ঢুকে গিয়েছিল। নাইক্ষংছড়ির ওদিক দিয়ে মনে হয়। হয়তো একদিন বন্দুক নিয়ে ঢুকবে।
-চট্টগ্রাম আপনার কাছে কেন ভালো লাগতো স্যার?
ডঃ সামাদঃ লাগতো নাম আর প্রকৃতির কারণে। তবে নামগুলোতো আধা বর্মি – দিয়ং, পতেঙ্গা, টেকনাফ, হ্নীলা, উঞ্চিপ্রাং, কাঠগড় ইত্যাদি। ব্যাপার হচ্ছে লোকেদের কলকাতায় যেতে দেখেছি, রেঙ্গুন যেতে পারলে কলকাতায় থাকতো না। রেঙ্গুনের সব দর্জি ছিল এদিক থেকে যাওয়া। ওরা চট্টগ্রাম হয়ে যেত। কথা হচ্ছে, এদের সাথে আমাদের এই সম্পর্ক খারাপ তো হতো না।
-হঠাৎ করে কনফ্লিক্টটা কেন দেখা দিলো?
ডঃ সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে যে, আরাকান একটা ছোট জায়গা। আমরাও দল বেঁধে গিয়েছি। যারা আসছে সবাই কিন্তু রোহিঙ্গা নয়। রোহিঙ্গাতো হলো, যারা চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য হয়ে গিয়েছিল (রোহাঙ) যুদ্ধ করার জন্য। আমরাতো আরাকানকে রোসাঙ্গই বলতাম। আমরাতো আরাকানকে আরাকান বলতাম না। তো যাই হোক, ব্যাপার হচ্ছে যে, বার্মার সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ। হবার বহু কারণ আছে। শ্রীকান্ত পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু এই সম্পর্কটা খারাপ করেছে হিন্দু বাঙ্গালী। মুসলমান বাঙ্গালীরা করেনি।
-এটা কখন থেকে শুরু হলো?
ডঃ সামাদঃ কথা হলো; ইংরেজদের পরেই বার্মাতে আমরা গেলাম লুটপাট করতে।
-আমরা বলতে হিন্দু বাঙ্গালী নাকি সব বাঙ্গালী?
ডঃ সামাদঃ মুসলমানে ঠিক লুটপাট করেনি। মুসলমানরা বার্মা গিয়ে নিজের পৌরুষ ত্যাগ করে পালিয়ে আসেনি। অবশ্য হিন্দুরা করেছে।
-অংসান সুচির বাবা, ওই তো মূলত বর্মি জাতীয়তাবাদের মূল।
ডঃ সামাদঃ এটাকে ঠিক বর্মি জাতীয়তাবাদও বলা যায় না। দোবামা আচিয়ঙের ব্যাপারটা আমার এখন অতটা ক্লিয়ার মনে পড়ছে না। তবে ব্যাপার হচ্ছে যে, বার্মার লোকদের আমরা খুব ঠকিয়েছি।
-বর্মি বলতে ওখানকার বার্মিজদের নাকি বাঙালি বার্মিজদের?
ডঃ সামাদঃ না না। খাঁটি বার্মিজদের। বর্মাতে তো কোনো মেয়ের সাথে যদি চারদিন একসাথে ভাত খাওয়া যায় তাহলেই সে স্ত্রী হয়ে যায়। তাদের দেশাচার অনুসারে। প্রথা না, দেশাচার। আসলেই হয়ে যাবে। তবে অনেক বর্মিও এখানে এসেছে। আমাদের ভূতছাড়া থেকে রংপুর পর্যন্ত। ভূতছাড়া থেকে তামাক নিয়ে বর্মি চুরুট বানাতো। নিকোটিনের প্রতি তাদের আসক্তি ছিল বেশি। তাছাড়া রেশমের ব্যাপারে খুব যাতায়াত ছিল। আমরা সম্পর্ক নষ্ট করেছি ওদের সাথে। ওদের এককভাবে দোষ দেব না।
-এবছর একটা উপন্যাস বেরিয়েছে চট্টগ্রাম থেকে, নাম- অগ্নিকোণ। লেখক ওখানে স্টাবলিশ করতে চেয়েছে, বাঙালিরা ওখানে গিয়ে বর্মি মেয়ে বিয়ে করতো। আর বর্মি সমাজটা ছিল নারীবাদী। মাতৃতান্ত্রিক, যেহেতু ওদের মেয়েরা বাঙ্গালী হয়ে যাচ্ছে একারণে ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানে বর্মী জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
ডঃ সামাদঃ না না, ওদেরকে যেভাবে ঠকিয়েছে না! সেগুন কাঠ দেদার বিক্রি করেছে ওখান থেকে এনে। এসবের কী দরকার ছিল? চট করে রোহিঙ্গা মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া? মানে একটা ইমিডিয়েট মারামারির কাজটাতো সেখানেই শুরু হয়েছে। তো কথা হচ্ছে, ওগুলো করার আমাদের কী দরকার পড়েছে?
-ওটাতো পরিকল্পিতভাবে করানো হয়েছে।
ডঃ সামাদঃ এটা কোনো যুক্তি? একজনের বাড়িতে আগুন দিতে বললো, আপনি দিয়ে দিলেন। এটাতো হবে না। You are to take your faults.
-ওদেরকে বছরের পর শিক্ষা দীক্ষা থেকে বঞ্চিত করে বর্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে রেখেছে, যার কারণে তাদের এই পরিণতি। আসলে কি তাই?
ডঃ সামাদঃ আমি নিজে সাকার বাপকে বলতে শুনেছি, যে আমরা আন্দরকিল্লা থেকে পাথরকিল্লায় চলে যাবো। আমাদের কি সে ক্ষমতা ছিল? পাথরকিল্লা ছিল আকিয়াবে। সেখানে খুব গৌড়িয় স্থাপত্য টিকে আছে। ওখানে আর্কিটেকচার সব গৌড়িয়। এই যে ধারণা, যে আমরা আন্দরকিল্লা থেকে পাথরকিল্লায় চলে যাবো, এটাতো ঠিক ছিল না।
-অডাসিয়াস স্পিচ ছিল!
ডঃ সামাদঃ হ্যাঁ তো, ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাতো আমরাই বলেছি। ওরাতো বলেনি প্রথমে। আরাকানের যত পুলিশ, সব ছিল চট্টগ্রামের। সব ভালো চাকুরি করতো চট্টগ্রামের লোকেরা। ইন্ডাস্ট্রির মালিক ছিল চট্টগ্রামের লোকেরা। তাছাড়া প্রচুর ধান হতো সেখানে।
-এখনওতো হয় স্যার।
ডঃ সামাদঃ হ্যাঁ। ধানই ছিল সম্পদ। জাপানীরা দখল করতে করতে মহেশখালি পর্যন্ত এসেছিল। মহেশখালি বোধহয় চার-পাঁচদিন ছিল জাপানিজরা। কথা হচ্ছে যে, কেউ তো আরাকানকে বিজয়ীভাবে নেয়নি। ওরাও তো পায়ে হেঁটে এসেছে, এরাও পায়ে হেঁটে গেছে। আরাকানের সাথে চট্টগ্রামবাসীর কোনো ঝগড়াই ছিল না। ঝগড়া হয়েছে মেইনলি পশ্চিম বাঙলার হিন্দুদের সাথে আর গুজরাটিদের সাথে। দশ লাখ ছিল এরা। সবচে বেশি ছিল গুজরাটিরা।
-গৌরঙ্গী বলা হতো ওদের?
ডঃ সামাদঃ তা আমি ঠিক বলতে পারছি না। হয়তো বলা হতো। তবে গুজরাটের লোক সব থেকে বেশি ছিল।
-চট্টগ্রাম আবার যাবেন?
ডঃ সামাদঃ আমার শরীর কুলাবে না। আমার মেয়ে গেলে যাবে, আরাকানে বন্দুক নিয়ে।
-রোহিঙ্গারাতো বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রের জন্য হুমকি?
ডঃ সামাদঃ আমেরিকা ক্যু করতে পারবে। ইন্ডিয়া পারবে না।
-রোহিঙ্গারা কি আর কখনো ফিরে যাবে?
ডঃ সামাদঃ যদি আমেরিকা পক্ষে থাকে তো রোহিঙ্গা যাবে। আর না হলে না। মাটি বাপের নয়, মাটি দাপের। আমাদের এ অঞ্চলে বলে- মাটি বাপের নয়, মাটি হচ্ছে দাপের। যদি দাপ দেখাতে পারি, মাটি আমার। অকুপেশান ইজ নাইনটি পার্সেন্ট পজেশান। যার জমি দখল হয়ে যায়, তাকেই তো যেতে হয় কোর্টে। যে দখল করছে তাকে তো যেতে হয় না।
-স্যার ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ নামে একটি মাসিকে মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এক লেখক লিখেছেন ওই সময় বাংলাদেশের যারা ছিল, তারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে। এটা কি ঠিক?
ডঃ সামাদঃ বঙ্গভঙ্গইতো হয়নি। হয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভাগ। কিন্তু ওটাইতো একটা মিথ্যা কথা যে বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল। ওটাতো ঠিক কথা নয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভাগ হয়েছে। সেতো আর এক হয়নি। উড়িষ্যা বিহার তো এসে আর আমাদের সাথে এক হয়নি। তাহলে ওটা নিয়ে শোক করে কী লাভ? ওই দার্জিলিং ছিল ভাগলপুরের সাথে, এই।
-স্যার কোনো সময় যদি বাংলা এক হয়। ধরছি হবে না। যদি হয়, তাহলে কি বাঙ্গালিরা সুপার পাওয়ার হয়ে যাবে না?
ডঃ সামাদঃ আমরা দখল করে নেবো। কলকাতায় অনেক বাড়িঘর সত্যি সত্যি আমরা কিনে ফেলেছি এর মধ্যে।
-তো এটা হলে তো ভালো হতো, একটা বৃহৎ বঙ্গের মতো কিছু একটা হতো।
ডঃ সামাদঃ ওটা কিছু না। ওর খারাপ দিক আছে। অনেকগুলো বেটার বউ হলে গালাগালি শুনতে হয়।
-ওখানে তো হিন্দু ম্যাজরিটি।
ড সামাদঃ তা অবশ্য ঠিক। ওসব চিন্তা-ই করার দরকার নেই। যতটুকু আছে ততটুকু রক্ষা করাই হয়ে গেছে অসম্ভব ব্যাপার।
-বৌদ্ধ এবং হিন্দুরা যে এক হয়ে গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করছে।
ডঃ সামাদঃ কোথাও এক হয়নি বৌদ্ধরা। বৌদ্ধরা এক আছে এখানে? মারামারি করছে না সন্তু লারমা আর মারমারা? গোটা মহেশখালিতেইতো সন্তু লারমারা যেতে পারে না। এখানকার সবইতো মারমাদের। সম্পূর্ণ পটুয়াখালি মারমাদের। ওখানেতো বৌদ্ধরা কিছু করছে না। এই বৌদ্ধ কারা? আসলো কোত্থেকে? আক্রমণ হবে দক্ষিণ থেকে, উত্তর-পূর্ব থেকে, আক্রমণ হবে আমাদের উপর নদীর উপর থেকে। এগুলো একটু ভাবার দরকার আছে। আমরাতো আর কিছু করতে পারবো না, সিভিল ডিফেন্স করতে হবে। যাতে করে লোকের কষ্টটা কম হয়। দেখা যাক কী হয়! আমাদের উপর অত্যাচারতো কম হয়নি। গোটা সুন্দরবন হতে মানুষ পালিয়ে গেছে মগদের অত্যাচারে। এখনতো অনেক ভালো আছি। মগের ভয়ে লোকে কী করেছে সেটাতো আমি জানি। আমার পূর্বপুরুষরা মাগুরায় থাকতো। মগদের প্রথম ওখানে শাখা ছিল। হার্মাদরা কি কম কিছু করেছে?
-হার্মাদরাতো পুরো চট্টগ্রাম পর্যন্ত দখল করে ফেলছিল।
ড. সামাদঃ শব্দটা হলো আর্মাদার, তা থেকে হার্মাদ। সুতরাং আমাদের পূর্ব পুরুষরা এত লড়াই করে বাঁচতে পারলে আমরা পারবো না কেন? এই রাজশাহী শহরেই তো বাঘ মেডিকেল কলেজের কাছে আসতে দেখেছি। আমি নিজেইতো কত ফ্যাসাদ দেখেছি। রাজশাহীতে সাপের ভয়ে তো আমরা খাটের উপর থাকতাম। আর মশারি ভালো করে গুঁজে দিতাম শুধু মশার ভয়ে নয়, সাপও যাতে না কামড়ায়। তো কথা হচ্ছে, আগের থেকে জীবন অনেক সহজ হয়েছে। এত কেন আমরা হতাশ হচ্ছি? কথা হচ্ছে যে, ঢাকা যেসব জায়গায় ডুবে যেত সেই জায়গাতে এখন বাড়ি। এখন বর্ষাকালে নিচু জায়গা পানিতে জমে যাচ্ছে বলে বন্যা হচ্ছে। ওসব জায়গা তো আমিও ডুবতে দেখেছি। খুব ভালোর মধ্যে আগেও যে ছিলাম, এমনতো নয়। আগের থেকে আমরা অনেক ভালো আছি।
-রাখাইন সম্প্রদায়ের কথা বলছেন। পটুয়াখালিতো পুরোটা রাখাইন, মহেশখালি রাখাইন।
ড. সামাদঃ আরে এরা আছে এদের সাথে? আর পোপতো এসে মানাই করে গেছে ওদের সাথে থাকতে, হিন্দুদের সাথে। যাই হোক সেসব ভেবে কোনো লাভ নাই। শেখ মুজিবতো খান সেনাদের হাতে মারা যায়নি, তার দেশের লোকরাই তাকে মেরেছে। আমরা জানি না কোন ঝোপঝাড়ের মধ্যে কারা কী করছে? যদি জানাই যাবে তাহলেতো ওরা ওটা করতে পারবে না। তোমরা যারা আছো, ওরা কেউ কিছু করে ফেললে তখন তোমরা কবিতা লিখবে; হা হা।
-স্যার হঠাৎ কবিতার উপর ক্ষেপলেন কেন?
ড. সামাদঃ আসলে যতগুলো কারণে আজকে আমাদের দেশের লোক খেতে পারছে না, তার কারণ হলো রবীন্দ্রনাথ। এইদেশের লোকে ভেবেছিল কবিতা লিখেই সারা পৃথিবী উল্টে ফেলবে। সাম্রাজ্য ঐশ্বর্য কবিতা অমৃত… এইসবতো রবীন্দ্রনাথ লেখে নাই, লিখেছেন চট্টগ্রামের নবীনচন্দ্র।
-রবীন্দ্রনাথ বিশ্লেষণ করেই তো সাহিত্যজীবীরা চলছে।
ড সামাদঃ রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা অবশ্যই ছিল। সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ যা কিছু করেছেন তার একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড আছে। ছবি যে এঁকেছেন তারও একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড আছে। সত্তর বছর বয়সে এসে ছবি আঁকতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথকে এমনিতে খাটো করতে আমি চাই না। কিন্তু কথা হচ্ছে এ রবীন্দ্র পূজা কীসের জন্যে?
-কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এর অ্যাসেন্সটা নিলে দোষ কী?
ড সামাদঃ কথা হচ্ছে তোমরা রবীন্দ্রনাথের ধারে কাছে পৌঁছাতে পারছো?
-বাংলাদেশে কিন্তু যত লেখক আছে তার মধ্যে পঁচাত্তর শতাংশ কবি।
ড সামাদঃ জানি না। পরে লিখবে কাব্য তোমায় দিলাম আজকে ছুটি। জানি না, তোমরা লিখছো লিখো। তুমি মতি আমি দূর, আমি দেখি তুমি দূর, এই কবিতাও তো পড়েছি। তবে কি, কবিতা আমি জানি না। বোধ হয় একটা কি দুইটা লিখেছি। আমি পাঠশালায় পড়তাম। আমার ছাতা হারিয়ে গেছিল। ছাতাটা হারিয়ে আমি কিরকম দুঃখ পেয়েছি, তার উপর লিখেছি। ওই পাঠশালায় পড়েছিলাম। মাস্টাররা বলতেন- আল্লাহর বিনা হুকুমে একটা গাছের পাতাও নড়ে না। কেউ চুরিও করেনা। তার এই দর্শনটা সারাজীবন খুব কাজে দিয়েছে। হরেন পণ্ডিতের বাসায় পড়তাম তখন। তারপর গেলাম তারিনী বাবুর কাছে, তিনি অবশ্য ব্রাহ্মণ ছিলেন।
-তখন কি টোলে পড়তেন?
ড সামাদঃ আমি তো পাঠশালায় পড়া ছেলে। হরেন পণ্ডিতের পাঠশালাটা ছিল তারিনীবাবুর পাঠশালাটার পাশেই। ওইতো এখানে। ওরই কাছে রবীন্দ্রনাথের ঝুলন কবিতাটা। রবীন্দ্রনাথরা আদি ব্রাহ্মণ।
-ছাতা হারিয়েতো কবিতা লিখলেন, গল্প লিখেননি কখনো?
ড সামাদঃ না। আমারতো অত ছাতা হারায়নি। আরে আমি অত বড় লোকের ছেলে ছিলাম না। আগেকার দিনে বলা হতো, A tightly rolled & a never unrolled umbrella is a sign of aristocracy. যাদের ছাতা সবসময় জড়ানো থাকে এবং কখনো খোলা হয় না, তারা হলো ভদ্রলোক।
-অ্যারিস্টোক্রেসি দেখানোর জন্য?
ড সামাদঃ হয়তো। ব্যাপার হচ্ছে ঐ ছাতার অনেক রকম মানে ছিল এবং সেটার দিন চলে গেছে। প্রত্যেক যুগেরই কিছু সৌন্দর্য থাকে, আমাদের সময়েরও ছিল।
-স্যার, আঁকাআঁকির চিন্তাটা কি ছাতা হারানো থেকে?
ড সামাদঃ না না। ছবি আঁকার প্রেরণা আসছে অনেক পরে। আগে আমার কোনো প্রেরণাই ছিল না।
-প্রেরণা থেকেই কি ‘ইসলামী শিল্পকলা’ এর উপর বইটা লিখলেন?
ড সামাদঃ আরে না। রশীদ চৌধুরী আমাকে বললো যে ইসলামী শিল্পকলার উপর একটা বই লিখে দিতে পারবেন? আমিতো পড়াতে পারছি না, অসুবিধা হচ্ছে, তাই ওর জন্যই লিখেছিলাম।
-রশীদ চৌধুরী ওর সাবজেক্ট পড়াতে পারে না, একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর কাছে এটা লিখতে বললেন কেন?
ড সামাদঃ সেটা না, ব্যাপার হচ্ছে বয়রা তো আর সন্দেশ খায় না। সন্দেশ অন্য লোকে খায়। ওরা অন্যের জন্য বানায়। তো ব্যাপার হচ্ছে রশীদ চৌধুরী পড়াবে বলে এটা লিখতে বললো। আরেকজন এসে বললো যে, কেমিস্ট্রির উপর একটা বই লিখে দেন। লিখে দিলাম। তবে এটা ঠিক যে আমি অন্যের লেখা বই পড়ে বুঝে বই কি লেখতে পেরেছি। ওই বোঝা ঠিক ছিল, এবং সে জন্যই বোধহয় শিক্ষকতা করতে পারলাম।
-স্যার অ্যানথ্রোপলজিরটা কেন লিখলেন?
ড সামাদঃ না। অ্যানথ্রোপলজি আমার ছেলেবেলা থেকে ভালো লাগতো। আমি পড়তাম। অ্যানথ্রোপলজি আমার খুব প্রিয় বিষয়।
-মুহাম্মদ আসাদের ছেলে তালাল আসাদ এর একটা বই আছে অ্যানথ্রোপলজির উপর।
ড সামাদঃ উনি একটা থিওরি দিতে চেষ্টা করেছে, উনিতো মার্কসবাদী। কিন্তু ইসলামও একটা অ্যানথ্রোপলজির পার্ট আছে। ব্যাপার হচ্ছে যে, বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের বহু কিছু মিলবে না। সে চেষ্টা করাও ভুল। কারণ দুইটা হচ্ছে আলাদা অ্যাপ্রোচ। তবু আমরা বলছি; সূর্যের টানে পৃথিবী আটকা আছে। এই যে টানের ধারণা, এটাতো হচ্ছে Human concept. Pulling & Pushing. আমরা বিশ্বকে এখনো বোঝার চেষ্টা করি, Human concept দিয়ে।
-তাহলে Devine concept কী হবে? Human concept তো হলো টানাটানির বিষয়টা।
ড সামাদঃ যা মানুষের সাথে মেলে না তা বুঝতে পারি না।
-আমরাতো অভিজ্ঞতার বাইরে চিন্তা করতে পারি না।
ড সামাদঃ আমরাতো বুঝতে পারি না। কিছুটা বুঝাতে চেয়েছেন আইনস্টাইন ফিল্ড থিওরিতে- যে, আমি যদি পাহাড়ের উপর হাঁটি, তাহলে মনে হবে যে, পাহাড় আমাকে টানছে বলে আমি আঁকাবাকা ভাবে হাঁটি। কিন্তু আসলে পাহাড়টাই আঁকাবাঁকা। স্পেসটাই আঁকাবাঁকা। এখন কথা হচ্ছে স্পেসকে কি করে বাঁকা ভাবা যায়? সেটাতো আরো কঠিন এবং গোটা ম্যাগনেটেজিমতো গ্রাভিটেশানের উপর আসছে না। গ্রাভিটির ব্যাপারটাকে তো খালি ফিল্ড থিওরিতে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এগুলো জটিল জিনিস। কথা হচ্ছে: আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না বলেই সেটা সত্যি। নয় এটাতো বলা যাবে না। মানুষের বোঝার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হতে পারে।
-হকিংসের থিওরিটা?
ড সামাদঃ আমি হকিংস বুঝতে পারি না। আমি হকিংস পড়িনি। কারণ সেটা আমার বোঝার ব্যাপারও না। বোঝার চেষ্টাও করি না। সবকিছু কি বোঝা যায়? সব অংক সবাই করতে পারে না। বড় বড় ম্যাথমেটিশিয়ানরাও পারেননি।
-লীলাবতীর অংক সবাই বুঝতে পারে?
ড সামাদঃ তা কী করে বুঝতে পারে? বৈজ্ঞানিকরা বলে সবকিছুর কারণ আছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা সবকিছু সম্পর্কে জানে? সবকিছুর ব্যাপার হচ্ছে, তুমি কি সবকিছু সম্পর্কে জানো? তাহলেতো এটা বলাই ভুল। বিজ্ঞান একটা বিরাট ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত।
-আপনার অধ্যাপনা জীবনে এ ভুলটা কি কখনো ভাঙানোর চেষ্টা করেছেন ?
ড সামাদঃ না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলনা করা যায় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। লোকে বলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় লোককে শেখায় কেন ভাবতে হবে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় শিখায় কীভাবে ভাবতে হবে। আর এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় শেখায় কীভাবে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। আমি তো হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ছাত্রদের শিখিয়েছি কীভাবে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। কী করে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া যায়, কী করে চাকুরি পাওয়া যায়। এত কিছুর মধ্যেতো কী করে নতুন কিছু শেখা যায়, সেটার মধ্যেতো আমি নাই।
-স্যার আপনিতো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতাতে ছিলেন। জয় বাংলা পত্রিকায় কাজ করছেন।
ড সামাদঃ জয় বাংলাতো আওয়ামী লীগের পত্রিকা ছিলো। জয় বাংলাতো সম্পূর্ণটা করেছিল গাজীউল হকের টাকাতে। ও আর মিঠু। তখন বগুড়ায় ছিল স্টেট ব্যাংকের শাখা। সেখান থেকে বত্রিশ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিল ওরা। তবে গাজী শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ার সাথে ছিল না। তারা স্বদেশপন্থী হয়েছিল।
-স্যার ওখানেতো আপনি অনেক কিছু অবলোকন করেছেন।
ড সামাদঃ এই শেখ মুজিবের জীবনী ঠিক করে দিয়েছে ড. সালাউদ্দিন। উনি এবং জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীসহ অনেকেই শেখ মুজিব সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজের মতে ঠিক ছিলেন বদরুদ্দিন উমর। তো ব্যাপার হচ্ছে যে, শেখ মুজিব ইন্ডিয়ার প্লেনে করে দিল্লি থেকে ঢাকায় আসতে চাননি। তার মধ্যে এই ধরনের পরিবর্তন কেন আসলো? এটা নিয়ে আমি অনেক চেষ্টা করেছি বুঝার, কিন্তু বুঝতে পারিনি। শেখ মুজিব ছিলেন ইউসুফ হারুনের লোক। আওয়ামী লীগের লোকেরা বলাকায় আসর জমাতো। ইউসুফ হারুনকে যখন গভর্নর করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানের, তখন তিনি এসে আগরতলা মামলা উঠিয়ে নিলেন এবং শেখ মুজিবকে বললেন যে, তোমাকে প্রাইম মিনিস্টার করবো, যদি তুমি আইয়ুবকে প্রেসিডেন্ট রাখতে রাজি হও। তখনইতো ভুট্টো বড় রকমের শত্রু হয়ে গেলো মুজিবের ।
-অনেক বড় শক্তি পাকিস্তান ডিভাইড চাইলো না, তবুও তো হলো, কেন?
ড সামাদঃ বাংলাদেশ একটা গরীব দেশ। তাকে টাকা দিয়ে কেনা যাবে। পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে গেলে বাংলাদেশকে কেনা অনেক সোজা। উনিশশো চুয়াত্তরে সামান্য খাদ্য আমরা যার কাছ থেকে পেলাম, সেটা আমেরিকার কাছ থেকেই পেয়েছি। এসব বলে তো লাভ নেই। রাশিয়া বক্তৃতা দিয়েছিল। কিন্তু দেবার মতো খাদ্য তার ছিল না। বাকি যারা পোদ্দারি করছে তারাও তো কিছু দিতে পারেনি, নাই-ই তো, দিবে কোত্থেকে। জেডার মাইয়া একটা বিরাট ব্যাপার। এটা চট্টগ্রামের লোকেরা বুঝবে।
-এখনও আছে জায়গাটা।
ড সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে যে, ওখানে একটা বাড়িতে আমি যেতাম, সেটা হলো, সুচরিতদের বাড়ি। সুচরিতের বড় ভাই সুভাশিষ চৌধুরী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তার চেহারা অনেকটা আমার ছোট ভাইয়ের মতো দেখতো। এবং কী করে হলো, এটাও আমি জানি না। ফোক লিটারেচারের উপর সুচরিতের বাপের ভালো কাজ আছে এবং সুচরিত চৌধুরীও নৃত্যকলার উপরও বেশকিছু কাজ করেছে।
-স্যার চিটাগং এ এতবার গেলেন, চিটাগাংয়ের কোনো পরিবারের সাথে আপনার আত্মিক সম্পর্ক হয় নাই?
ড সামাদঃ আরে না। আমি ওসব অত সম্পর্ক করতে চাই না। লোকে আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর কোনোদিন শোধ দেয়নি। আমার খুব ভয় লাগে লোকের সাথে মিশতে।
-স্যার চট্টগ্রাম বার বার যাওয়া কি নৃতাত্ত্বিক বিষয়ের উপর কাজ করার জন্য?
ড সামাদঃ চট্টগ্রামে গিয়ে এক দোকানে চা খেতাম। তো যেখানে আমি চা খেতাম, তাকে আমি সওদাগর। বলতাম। একটা চায়ের দোকানিকে সওদাগর বললে সে যারপরনাই খুশি হতো। এদেশে লোকে জমিদার বললে যা খুশি হয়, চট্টগ্রামে সওদাগর বললে তা খুশি হয়। এজন্য আমার চা-তে একটি দুধ বেশি দিত। চট্টগ্রামে যখন গিয়েছি, তখন চট্টগ্রামের লোক বাংলা ভালো বোঝে না। চট্টগ্রামের ব্যাপার স্যাপার ছিল অন্যরকম। ভ্যালু জাজমেন্ট ছিল আলাদা রকম। চট্টগ্রামের প্রফেসর মনতাজুল ইসলাম আমাদের রাজশাহী এসেছিলেন দুইবার। ওকে চিনতাম। ওর ছেলে কালুরঘাট গিয়ে জিয়াকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। ওর নাম কি ছিল আমি জানি না। বেতারের যন্ত্রটা চলছিল না। ও ইঞ্জিনিয়ার, ও ঠিক করেছিল। ওটা অবশ্য ২৪ মাইল গেছে, কিন্তু ঐটাকে পিকআপ করেছিল একটা আমেরিকান জাহাজ। সে জন্য বাংলাদেশে সবাই শুনতে পেরেছিল। আমেরিকার তখন থিওরি ছিল বাসাম (বাংলা+আসাম) করবে। সেইটার জন্য জিয়াকে বলেছিল, তুমি রিভল্ট করো। এবং চট্টগ্রামে কিছু আমেরিকান সৈন্য এসে যুদ্ধও করেছিল। তারা সবুজ জামা পরতো।
-স্যার আপনার কি মনে হয়েছে চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের অন্য যে কোন অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন?
ড সামাদঃ সেটা হয়েছে অনেক পরে। বাংলা লিটারেচারের আদি পর্বতো অনেকটা চট্টগ্রামের। তা থেকেতো চট্টগ্রামী বংলার কিছু পাচ্ছি না। শাহ্ সগীরের লেখা, আমি জানি না পরে এরা পরিমার্জন করেছে কি না? কিন্তু শাহ্ সগীর এবং আলাদা যাদের আমরা পাচ্ছি, সবচেয়ে পুরানা যে বাংলা বই, যেটা আমরা পাচ্ছি, সেটার বাংলাতো চট্টগ্রামের বাংলা না। সেটার নাম হচ্ছে, শাহ মুহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা। বাংলা সাহিত্যে হালারে উগ্যা এ্যছা দন ফরিব কখনো পাবেন না। আমরাও রাজশাহীতে বলি, কিন্তু ঐভাবে বলি না। হালারে উগ্যা এ্যছা দন ফরিব, এই কথা কোনো দিন বলি না। পাকিস্তানের লোকরা যেমন বলতো; যা বোঝার জিন্না বুঝে নেবেন, আমাদের বুঝার দরকার নাই, এরকম আরকি।
-এটার কি নৃতাত্ত্বিক কোনো ব্যাখ্যা আছে?
ড সামাদঃ বলতে পারি না। যেমন ‘কতি’ শব্দটা। কতি মানে কোথা থেকে এসেছে। কতি শব্দটা কবি কঙ্কনচণ্ডিতে আছে। একসময় সাধু ভাষাতে কতি চলতো। কতি, কণ্ঠি ইত্যাদি। তো ব্যাপার হচ্ছে যে, কোথা থেকে মানুষ! যেমন রাখাইনে বোধিসত্ত্বের মূর্তি পাওয়া গেছে। এখন রাখাইনে ছেরারাজি বৌদ্ধ চলে, তখন মহাজন বৌদ্ধ চলতো। তো যা হোক, আমি নিজে যা লিখেছি, সেই বই পড়লে মনে হয় এই বই আমার লেখা না, এগুলো আমি বুঝতে পারছি না। একশ বছর। কোনো বাড়ির বয়স হয়ে গেলে লর্ড কার্জনের আইন অনুসারে সেটাকে আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট ওন করতে পারে। আমি এখনতো নব্বই, আর দশ বছর বয়স গেলে আমার এক’শ বছর বয়স। হয়ে যাবে। আমি আর্কিওলজির ব্যাপার হয়ে যাবো। প্রত্নতাত্ত্বিক হয়ে যাবো।
-তখন আপনার উপর ডকুমেন্টারি করতে হবে আমাদের।
ড সামাদঃ আমেরিকান অধ্যাপকরা ততদিনই বই লেখে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের উপর অন্য অধ্যাপকরা বই লেখা শুরু না করে।
-তাহলেতো স্যার আপনার এখনো লিখতে হবে। কারণ, আপনার উপর এখনও কেউ লেখে নাই।
ড সামাদঃ আমাকে চিরদিনই লিখতে হবে। কারণ আমার উপর কেউ বই লিখবে না।
-কেউ কেউ তো লিখছে।
ড সামাদঃ সুহৃদ সাক্ষী মাতাল হয়ে কী হবে? চর থেকে শেয়াল এসে বলতো হুক্কা হুয়া, আর সবাই বলতো, কেয়া হুয়া।
-মানে আমাদের তরুণ অধ্যাপকরা প্রাজ্ঞজনের কদর বুঝে না?
ড সামাদঃ ভাইতো বলে লোকে। আমার মাস্টার একদিন আমাকে বলেছিলেন, উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা পেলে সব বানর একদিন মানুষ হতে পারবে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার বানরগুলো মানুষ হচ্ছে না কেন? তখন বলেছিলো, উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা পেলে সব বানরই একদিন মানুষ হতে পারবে। উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না বলেই বানর বানরই থেকে যাচ্ছে, মানুষ হচ্ছে না।
-জাতির পুনর্জাগরণে লেখকের দায় কতটুকু?
ড সামাদঃ এদেরকে আমি জানি না। কারণ, ব্যাপার হচ্ছে যে কালচারটার মধ্যে মানুষ হচ্ছে না এরা, সেটা ঢাকায় বলতো ১৯৩০ এর দশক, ঐ কল্লোল যুগ টুগ ইত্যাদি, এরাতো সেই যুগেরও খুব একটা কিছু হলো না। তাহলে এরা কী হবে তা তো জানি না।
-অপসংস্কৃতির যুগে আমরা………….
ড সামাদঃ নাটোরে একজন এসে জিজ্ঞাসা করেছিল, বনলতা সেনের বাড়ি কোথায়? তো আরেকজন একটা রাস্তা দেখিয়েছিল। সেই রাস্তা ধরে সে গিয়ে নাটোরের বেশ্যাবাড়ি যেটা খুব খারাপ জায়গা, সেখানে গিয়ে পতিত হয়। বুঝতে পারলে? নাটোরে বনলতা সেনের বাড়ি ওরকম কিছু ছিল না।
-এ যুগের যুবকদের লেখাপড়াতো নাই-ই, আছে ফেইসবুক, ইন্টারনেট ইত্যাদি।
ড সামাদঃ কথা হচ্ছে, মানুষ শুধু শব্দ দিয়ে চিন্তা করে না। ছবি দিয়ে চিন্তা করে। যে কারণে ছবির মাধ্যমে বোবাদের শেখানো হয়। কথা হলো; শুধু লেখার মাধ্যমেই যে মানুষ মূল্যায়িত হবে তা তো নয়। কনসেপ্টটা তৈরি হয় মাথায়। এখন শব্দ দিয়ে প্রকাশ সেটা হলো আলাদা ব্যাপার। কথা হচ্ছে, পৃথিবী আগেও ছিল এবং পৃথিবী আরো অনেক দিন থাকবে। এসব নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। ওরে ভীরু তোমার পরে নেই ভুবনের ভার, হাতের কাছে আছে যে জন মাঝি সেই করবে তার পার। আমরা আমাদের সৃষ্টি করি না, এই বিশ্বভুবনের অর্থ আমরা বুঝি না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। তা না হলে এভাবে চলবে কী করে? এত ভাবো কেন? এত ভাবার দরকার নেই।
-স্যার ভার্সিটিগুলো শুধু পাশ করবার কৌশল শেখায়…..
ড সামাদঃ হ্যা, এডিনবার্গ, আমার সময়ের পৃথিবীর যেকোনো চারটা জাহাজের একটা ছিল এডিনবার্গের তৈরি। সেই জায়গা থেকেই অ্যাডাম স্মিথের মতো অর্থনীতিবিদ বেরিয়েছেন। তো যা হোক সেগুলো বলি না। ওগুলো ভেবেও আমার লাভ নেই। বিলাতে পড়েছিলাম এক অ্যাকাডেমিক ইয়ার আর ফ্রান্সে পড়েছিলাম সাড়ে তিন বছর। এই আমার বাইরে পড়া। তবে আমার ভাবতে ভালো লাগে যে, বাইরে পড়ে আমার বেশি শিখতে হয়নি। সুতরাং ঐ বাইরের গর্ব আমি করি না। রাজশাহীতে বসেই অনেককিছু শিখেছিলাম।
-তখনকার পরিবেশটা আপনাদেরকে ওরকম দিয়েছিলো।
ড সামাদঃ মানুষ পরিবেশ খোঁজে না। আমি নিয়েছিলাম, আমার ছেলেমেয়ে খুঁজে নিচ্ছে না। এটা মানুষের উপরেও নির্ভর করে।
-মানসিকতা নেই।
ড সামাদঃ ঐ যে বলেছিলাম, কেউ দুধ বেচে কলা খায়, কেউ কলা বেচে দুধ খায়।
-তার মানে স্যার পরিবেশ ব্যক্তি সৃষ্টি করে না?
ড সামাদঃ এটা বলা খুব মুশকিল। নেহেরু তো আত্মজীবনীতে লিখেছেন, যেরকম ঐশ্বর্যবান বাপের ছেলে হলে লোকে মদ খেয়ে টাকা উড়িয়ে দেয়, আমি যে সেরকম ঐশ্বর্যবান বাপের ছেলে হয়ে মদ। খেয়ে টাকা উড়াইনি, এতে আমার গর্ববোধ হয়। তো ব্যাপার হচ্ছে, কে কী হবে এটা কি বলা। যায়?
-স্যার টিএস এলিয়টের একটা বিখ্যাত প্রবন্ধ আছে না, ট্র্যাডিশন এন্ড দ্যা ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট।। ওখানেতো তিনি বলেছেন, ব্যক্তি মেধাই সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ড সামাদঃ কথা হচ্ছে প্রতিভাবান মানেটা কী? পৃথিবীর প্রতিভাবানরা কি অন্যগ্রহেরও প্রতিভাবান, না তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানেন? এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এই প্রতিভার কীরূপ মূল্য থাকতে পারে? প্রতিভাবানরা কী করেন? অজানাকে জানার চেষ্টা করেন, এই তো? তো, অজানাকে জানার চেষ্টা করা মানে, অজানা না থাকাতো নয়। কলম্বাস আমেরিকাতো কখনও আবিষ্কার করতে পারতেন না, যদি আমেরিকা না থাকতো।
-তার মানে অস্তিত্ব ছিল বলেই কলম্বাস আবিষ্কার করতে পেরেছে।
ড সামাদঃ আবিষ্কার করেছে। তুমি জানতে না সেটা আলাদা কথা, তুমি জানলে সেটার জন্য এত হইচই করার কী হলো? জানতে না বলে জানার চেষ্টা করা হয়েছে। ওসব ভেবে কিছু লাভ নেই। ওসব নিয়ে আমি মাথাও ঘামাই না। ছেলেবেলা একটা কবিতা পড়েছিলাম— চানাচুর চানাচুর, চিবাইলে হায় দাঁতের তলে করে কুড়মুড়, সে যে বাজে অসীম সুর। কবিতাটা আমার ভালো লেগেছে।
-স্যার এরকম মজার মজার কবিতা পড়েছিলেন এবং মনেও রেখেছেন। কিন্তু লেখেন নাই এটার কী কারণ?
ড সামাদঃ কথা হচ্ছে কেউ লেখে কেউ তৈরি করে, কেউ পড়ে। আমিতো দর্জি ছিলাম না, জামা পরেছি।
-স্যার আমরাতো পঞ্চাশ বছরের ভেতরে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হোক কিংবা কাঙ্ক্ষিতভাবে হোক অনেকগুলো সংগ্রাম করে ফেলেছি। এবং বুক ফুলিয়ে বলছি, আমরা ভাষা আন্দোলন করেছি, স্বাধীনতা আন্দোলন করেছি। এখন এই টাইপের আর কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না?
ড সামাদঃ এর থেকে মারাত্মক কিছু হতে পারে। এটা একটা সিরিয়ায় পরিণত হতে পারে। কিছু মারাত্মক ঘটতে পারে বলেই আমেরিকা মহাকাশ বাহিনী তৈরি করছে।
-সেটা কি আমাদের মতো এরকম ক্ষুদ্র থার্ড ওয়ার্ল্ডের কান্ট্রির জন্যও?
ড সামাদঃ চাঁদ থেকে যেকোনো জায়গায় আক্যুরেটলি রকেট ফেলা যাবে।
-উপগ্রহের মাধ্যমে।
ড সামাদঃ উপগ্রহের মাধ্যমে না। ওখান থেকেই তারা ফেলার ব্যবস্থা করবে।
-ডক্যুমেন্টেশান ছাড়া?
ড সামাদঃ চাঁদের টান হচ্ছে পৃথিবীর ওয়ান ফোর্থ। ওখান থেকে ছুঁড়লে সুবিধা।
-আমেরিকা যে চাঁদে গিয়েছিল এটা নাকি মিথ্যা?
ড সামাদঃ এরকম হলে রাশিয়া দারুণভাবে প্রচার করতো। রাশিয়া, ফ্রান্সকে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারার অ্যাপারেটাস আছে, রাশিয়ারতো এগুলো আরো মুখস্ত। কারণ, পড়লে তো তার উপর আগে পড়বে। একবার নয়, ছয়বার চাঁদে গেছে ওরা।
-অনেকে তো প্রচার করে ওটা একটা ফিল্ম ছিল।
ড সামাদঃ তা কি কখনো হয়? এত কোটি টাকা, তাছাড়া এমনিতেইতো রকেট কতদূর যাচ্ছে! ঐ রকেটইতো আমরা বানাতে পারবো না। পাকিস্তানতো অন্যখান থেকে বোমার নকশা চুরি করে বোমা বানাতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিকদের হাতে যদি নকশা দিয়ে দেওয়া যায়, ওরা তো বুঝতেই পারবে না।
-স্যার আরেকটা বিষয় বলছেন যে; ভয়ংকর হবে, এটার কোনো প্রিকশন আছে কি না?
ড সামাদঃ এখন কথা হচ্ছে যে, সোফা চুক্তিটা কি হয়েছে না কি হয়নি? সেটা আমি জানি না। যে কারণে আমেরিকা সরাসরি আসছে রোহিঙ্গাদের জন্য, আর কেউ আসেনি। কারণ, আমেরিকা এখানে আসবে। আমেরিকা এটা ভালো করেই জানে, যে ইংরেজরা পূর্বের থেকে পশ্চিমে গেছে। বাংলাদেশে যেতে পারলে নতুন রুট তৈরি করতে পারবে।
-স্যার এসব কি ধর্মকে কেন্দ্র করে হবে?
ড সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
-স্যার, ফিলিস্তিনের এক ইয়াং ইহুদি প্রফেসর বলছে- ধর্মগুলো আবার ব্যাক করবে। এবং ইহুদি ধর্ম যেহেতু সবচে পুরাতন সেটাই সবার আগে পৃথিবীতে রিভাইব করবে।
ড সামাদঃ জানি না। বিলাতে পুরস্কার ডিক্লার করা হয়েছিল, যিশু খৃস্ট, হযরত মুহাম্মদ (সা:), মোসেস এদের মধ্যে কে বড়, এক ডজন প্রফেটের নাম দেয়া হয়েছিল। তো এক ইহুদি ছেলে লিখলো; যিশু খৃস্টই সবচেয়ে বড় ছিলেন। তো প্রবন্ধটা এতই ভালো হয়েছিল যে তাকে পুরস্কার দেয়া হলো। পুরস্কার দেয়ার সময় কমিটির লোক তাকে চুপিচুপি যে, তুমি তো ইহুদি, তোমারতো বলা উচিৎ ছিল, মোসেস সব থেকে বড়। কিন্তু তুমি হযরত ঈসাকে শ্রেষ্ঠ কেন বললে? ছেলেটি বললো, দেখেন স্যার আমরা ইহুদি। ব্যবসা করে খাই। আসলে মোসেসই বড়, কিন্তু মোসেসকে বড় বললে তো আপনি আমাকে পুরস্কারই দিতেন না। বিজনেস ইজ বিজনেস।
-বিজনেসের সাথে এথিকসের কোনো সম্পর্ক নাই?
ড সামাদঃ ব্যাপার হচ্ছে, বিজনেস ইজ বিজনেস। কোথা থেকে এসে, সেই সিরিয়ার কোন গ্রাম থেকে এসে এক ইহুদি, সিঙ্গাপুর এর চেহারা পরিবর্তন করল, জেলেপল্লী ছিল! সিঙ্গাপুরের মেম্বারশিপ ইউনেস্কোর। ইউনেস্কোকে তখন বললো; আমরা মেম্বারশিপ ছাড়বো, আমাদের চাঁদা দেয়ার পয়সা নাই। বিনা চাঁদাতে যদি রাখতে পারো তাহলে থাকবো।
-যুব সমাজকে আবার পুনরায় উজ্জীবিত করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের কোনো দায়িত্ব আছে কি না?
ড সামাদঃ এত কী খারাপ হয়েছে যুব সমাজ? একটা লোক গাড়িতে চাপা পড়লে পাঁচজন গিয়ে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছে। এত কী খারাপ হয়েছি আমরা? কথা হচ্ছে খারাপটাকে এত বড় করে দেখা হচ্ছে কেন? কটা লোক তার মাকে ভাত দিচ্ছে না?
-এটাতো হাতে গোনা….
ড সামাদঃ তাহলে আমরা এরকম চিন্তা করছি কেন? এখনও আমাদের দেশে একজন ভাবীর কাছে গেলে, ভাবী গজরগজর করলেও খেতে দেয়। তো এত কেন আমরা নিজেদেরকে খারাপ ভাবছি? আমাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন, বন্ধুত্বের বন্ধন যেভাবে কাজ করছে, এটাকে ছোট করে দেখার তো কিছু নেই। আমরা নিজেদের এত খারাপ ভাবছি কেন? ইংরেজ আমলে যত বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছে, এক শেখ মুজিবের আমলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা মনে পড়ে। এখনতো এত দুর্ভিক্ষে ভুগছি না। লোকসংখ্যা কত বেড়েছে! আমরা নিজেদের এত খারাপ ভাবছি কেন?
-তার মানে আশার আলো আছে?
ড সামাদঃ আশার আলো কী? আমরাতো বেঁচে আছি। আমাদেরতো আয়ু বেড়েছে।
-আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাটা?
ড সামাদঃ সামাজিক নিরাপত্তা কতটা কমেছে? সেটা চিন্তা করতে হবে। আমাদের কি চম্বলের মতো ডাকা আছে? কিন্তু কথা হচ্ছে যে, তো আমরা এখনো পরস্পরকে অনেক সাহায্য করে। একজন আরেকজনের বিপদে এগিয়ে যাই। বন্ধুকে বন্ধু হিসেবে সাহায্য করি। এগুলোকে এত ছোট করে দেখার কী কারণ থাকতে পারে? আমাদের সামাজিক ভ্যালুজ এখনো অনেক মূল্যবান। কথা হচ্ছে আমরা নিজেদের এত ছোট করে দেখছি কেন?
-স্যার এসব ম্যাগাজিন, বই বাইর করা, সাহিত্য করাতে কিছু হবে?
ড সামাদঃ অগুলো অবশ্য মানসিক পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ মানুষ হলো মনবান প্রাণী। তার মনের উপর প্রভাব ফেললে সাবজেক্টিভ অ্যাটমোস্ফিয়ারটা চেইঞ্জ হলেও অনেক কিছু হয়।
-তার মানে কবি সাহিত্যিকদেরও কিছুটা প্রয়োজন আছে।
ড সামাদঃ কবি সাহিত্যিকদেরকে দিয়ে তো হবে না। মানুষ ঘটনার উপর বেইজ করে চিন্তা করে। মানুষকে। ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। কী হচ্ছে? যদি নাসাতে সাতটা লোক একসাথে মরে যায়, তাহলে একটাতেও হঠাৎ তারা লোক পাঠাতে পারবে না। মাত্র সাতটা লোককে ওরা লিড করে।
-এই সাতটা লোক তৈরি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
ড সামাদঃ এখন কথা হচ্ছে আমরা কিছু করবো না নিজেরা চুপচাপ করে থেকে আক্ষেপ করবো! কারো
আক্ষেপে ইতিহাস অপেক্ষা করবে না। অহংকার করছি না, আমার কী দরকার ছিল কলকাতা
থেকে ঘুরে এসে এখানে এসব লেখার?
-ফিরলেন কেন স্যার?
ড সামাদঃ আমার ভাই থেকে যেতে বলছিল। কেন না, এখানে বিরোধীতা শুরু হয়ে যাচ্ছিল।
-স্যার, তাইলেতো পদ্মভূষণ আপনি পাইতেন।
ড সামাদঃ পদ্মভূষণ, যারা ইন্ডিয়াতেই আছে তারা কোনোদিন পদ্মভূষণ পেয়েছেন, আমাকে বলেনতো দেখি। ইন্ডিয়ার ক’জন পদ্মভূষণ পায়? বৃটেনে যারা পোয়েট-লরিয়েট হয়েছে তাদের মধ্যে ক’জন কবির বিশ্বজোড়া নাম? শেলি তো পোয়েট-লরিয়েট ছিলেন না, বাইরন তো পোয়েট লরিয়েট ছিলেন না। সোজির নাম ক’জন করে? সেতো পোয়েট লরিয়েট ছিলো। তো, ওসব ভয় পেয়ে কী হবে? কিছুই করছে না এরা, এদের যাদেরকে আমি দেখি। ইন্টেলেকচুয়াল হলো লন্ড্রির জন্য সব। লুঙ্গি ধোয়ার বুদ্ধিজীবী। কথা হচ্ছে, এসব করে তো কিছু হবে না ভাই। কথা হচ্ছে যে, আমার হাতে বন্দুক নাই, কিন্তু প্রস্তুতি কিছু থাকা দরকার, যদি বন্দুক কেউ দেয় তাহলে যেন আমি গুলি ছুঁড়তে পারি। কিচ্ছু করবো না, কিচ্ছু জানবো না। চট্টগ্রাম আমাকে পুরস্কার দিয়েছে, আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি গিয়ে হতাশ, চট্টগ্রামের লোকদের আমি ছেলেবেলায় অনেক সক্রিয় দেখেছি। এখন অন্য চিত্র।
-প্রফেসর আসহার উদ্দিনকে চিনতেন?।
ড সামাদঃ চিনপন্থী ছিলেন বোধহয়। ওখানে গিয়ে প্রফেসরদের মাঝে পরিচয় হয়েছিল ‘ক্রিতদাসের হাসি’র লেখক শওকত ওসমানের সাথে। শুরুতো বামবাম ভাব ছিল। আমিতো বামলোকদের মধ্যে থাকতাম না, আমার ভালো লাগতো না। আমি মনে করতাম যে, পৃথিবীকে বদলে দেয়া যাবে না। মানুষ বিপ্লব করার জন্যে ক্ষমতা দখল করে না। ক্ষমতা দখল করার জন্য বিপ্লবের কথা বলে। তখন আমি এই কথা চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম। এজন্য এদের সাথে উঠাবসা বাদ দিয়ে ফেলেছি। বুঝেছি সব ধাপ্পাবাজ। গরিবির নামে বড়লোক হতে চায়। আমি তার মধ্যে ছিলাম না।
-আপনার মধ্যে যে অ্যান্টি-বাম চিন্তা, এটা কি বিজ্ঞানকেন্দ্রিক চিন্তার কারণে নাকি ওদের ব্যর্থতাগুলো বা হিপোক্রেসি দেখে?
ড সামাদঃ আমার মনে হয় যে, পৃথিবীকে এত তাড়াতাড়ি বদলে দেয়া যাবে না। লোকে আধপেট খাচ্ছে, সেটা বরং ভালো কিছু না খেতে পারার চাইতে। একটা গল্প পড়েছিলাম; আফ্রিকা থেকে কৃতদাস নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকায় বেচতে। তারা বিদ্রোহ করে সাদা লোকগুলোকে মেরে ফেললো। কিন্তু তারা কেউ-ই জাহাজ চালাতে জানতো না। ফলে জাহাজ সমুদ্রে ভাসতে থাকলো, ওরা লোনা পানি খেতে পারলো না। না খেয়ে সব মরে গেলো। সুতরাং পৃথিবীকে চালানোর যোগ্যতা থাকতে হবে। কথা হচ্ছে যে, ওসব করে কী হবে? আর আমি কেন বিপ্লব করতে যাবো? আমিতো পোলেটারিয়েট নই। আমি কেন মরতে যাবো? তাছাড়া আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের ঘাড়ে একটা করে মাথা আছে। এবং আমি কারো চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নই । ঐ লোকটাকেও চিন্তা করতে দেব না কেন? চট্টগ্রামে কত শৌখিন বাম দেখেছিলাম। কল্পনা দত্ত, সূর্যসেনদের সাথে ছিল!
-বিপ্লবী আর সন্ত্রাসীকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড সামাদঃ সন্ত্রাসী মানেটা কী? আমি তা-ই তো বুঝি না। যুদ্ধসন্ত্রাস? কথা হচ্ছে যে, ছুটোবাজি ছুঁড়লে সে হচ্ছে সন্ত্রাসী! আর বোমা ছুঁড়লে তা নয়। আমি বুঝতে পারি না- আটজন প্রফেসরের কাজের উপর নির্ভর করে একটা বোমা তৈরি হয়েছে। ঐ আটজন প্রফেসর গুন্ডা-বদমাশ এর চেয়ে ভালো কী করে হলো? লোককে বাঘের বাচ্চা বললে খুশি হয়, কুত্তার বাচ্চা বললে রেগে যায়। অথচ দুটোই তো স্তন্যপায়ী প্রাণী। এবং কুকুর মানুষের যত উপকার করে বাঘ তা করে না। কী হবে ওসব করে? আমি কোনোদিন আমেরিকার প্রফেসর হবার কথা ভাবি না। এখনও না, কখনোও না। ছাত্র পড়াচ্ছি, পড়িয়েছি। স্কুলের ছাত্রদেরই পড়াতাম। মানুষকে তো কিছু করে খেতে হয়। আমি কিছু করার জন্য পৃথিবীতে জন্মাইনি। চিরকাল নিজেকে ক্ষণিকজন্মা ভেবেছি, ক্ষণজন্মা ভাবিনি। সুতরাং জীবনে সুখি হবার একটা উপায় হচ্ছে নিজেকে বড় না ভাবা।
-চাহিদাকে কমিয়ে আনলে মনের মধ্যে প্রশান্তি থাকে।
ড সামাদঃসেইটাই গৌতম বুদ্ধ বলেছেন। খাওয়া কমাও।
-আমাদের রাসুল (সা:) তো প্রায়ই রোজা রাখতেন।
ড সামাদঃ সেটা আমি বলতে পারবো না। কারণ, আমি ইসলাম সম্পর্কে বা ধর্ম সম্পর্কে অত তো জানি না। তবে আমাকে বলেছিল ধর্মের উপর একটা বই লিখে দিতে, আমি তার জন্য কিছুটা পড়েছিলাম। কথা হচ্ছে একলক্ষ/দুইলক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর এসেছেন মানুষকে ভালো করার জন্য। মানুষকে তো আল্লাহ চাইলেই ভালো করে বানাতে পারতেন। তা না হলে তিনি আছেন কী জন্য? মানুষকে এতরকম বানালেন কেন? হও বললেই যখন হয়ে যায়। আল্লাহ বললেন, আলোর আবির্ভাব হোক, আলোর আবির্ভাব হয়ে গেলো।
-ইকবালও এরকম শিকওয়া করেছেন।
ড সামাদঃ ইকবাল আমি কতটুকুই বা পড়েছি! কথা হচ্ছে, আমার মা-বাবা যদি মুসলমান না হতেন, আমি কি মুসলমান হতাম?
-প্রফেটের দ্বারা কি আমি মুসলমান হয়েছি?
ড সামাদঃ না। প্রফেটের দ্বারাতো আপনি মুসলমান হননি। আপনি বাই বর্ন মুসলমান হয়েছেন। সুতরাং এসব পক্ষে আমার মতামতের কোনো দাম নেই। যদি এ উপমহাদেশে হিন্দু না থাকতো, আমি হিন্দু থাকতাম না। হিন্দু আমার মাথা কাটছে বলে আমি মুসলমান।
-আপনার বৈষয়িক চিন্তা টনটনে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
ড সামাদঃ জ্ঞান থাকা এক জিনিস আর বাস্তবতা অন্য জিনিস। বাস্তবতা ভিন্ন। রিগান ম্যাকাডোর নো-হাউ জানলে হবে না, ডু-হাউ তো জানি না।
-আপনার এত বাস্তব বুদ্ধি, অথচ…
ড সামাদঃ বুদ্ধি ছিল বলেই নব্বই বছর বেঁচে গেলাম ওষুধ না খেয়ে। না হলে আমি কোনকালেই মরে
যেতাম। এমন মানুষ আছে পায়ের ধূলো নিতে এলে রাখিতে হয় দৃষ্টি মেলে জুতো সরায় পাছে। তাই আমি ওসবে যাইনি। মাটির উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাই হয়তো বেঁচে আছি। পাহাড়ে উঠলে হয়তো পড়ে যেতাম। দরকার কী? ওসবের দরকার নেই। ব্যাপার হচ্ছে যে এই জিনিসটাই খারাপ। অন্যকে ছাড়িয়ে যাবো। কেন? অন্যকে ছোট করতে যাবো কেন? খুব ভালো লেগেছে একটা কবিতা। ছেলেবেলায় পড়ি। আমার খুব ভালো লাগে প্রতিবেশিদের সঙ্গে সবুজ গাছের তলায় বসে একসঙ্গে প্রাতঃরাশ খেতে। প্রতিবেশিদের সঙ্গে একসঙ্গে প্রাতঃরাশ খাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। তা আমরা যা-ই খাই না কেন!
-আপনার আত্মতৃপ্তিটা মনে হয় না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম গ্রহণ করবে।
ড সামাদঃ দরকার কী? আমার দাদা কি আমার সম্পর্কে কিছু ভেবেছিলেন কলেরায় মরে যাবার আগে? আমিতো তখন ছিলামই না। ভবিষ্যত প্রজন্ম অনেক ইন্টেলিজেন্ট হতে পারে। আমি যে অঙ্ক করতে পারি না, তারা হয়তো সে অঙ্ক এক মিনিটে করে ফেলবে! কথা হচ্ছে ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতের ছেলেরাই কেন ভাববে না? আমিই তাদের সব ভাবনা করে দিতে পারি সেকি সম্ভব? প্রত্যেক প্রজন্মকে তার নিজের কথা ভাবতে হবে। মানুষের বাঁচবার সমস্যা চিরদিন ছিল এবং থাকবে।
-স্যার ভাববার সুতোটাতো তৈরি করে দিতে হয়।
ড সামাদঃ অতীতের সাথে বর্তমানের, বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের। বন্ডেজ তারাই তৈরি করে নেবে। বন্ডেজ হয়েই যায়। ব্যাকরণ ভাষা তৈরি করে না। ভাষা তৈরি হয় আগে, ব্যাকরণ তৈরি হয় পরে।
-স্যার, আপনার বাবা এই বিল্ডিংটা না দিলে আপনি এখানে থাকতে পারতেন?
ড সামাদঃ আমার জন্মের আগে আমার বাবা মরে গেলে আমার কী অবস্থা হতো? ভাববার কোনো যুক্তি আছে? কী সব আজব বুদ্ধি! তবে আমি কারো সমৃদ্ধি দেখে হিংসা করি না। Jealousy is a thing which has no cure. হিংসা এমন এক জিনিস যেটার কোনো চিকিৎসা নাই। সুতরাং এগুলো ভেবে কিছু লাভ নেই । ওগুলোর মধ্যে আমি থাকি না। নিচের বিছানায় শুয়ে মুড়ি মাখা দিয়ে চা খেতে আমার খুব ভালো লেগেছে। সুখের থেকে শান্তি ভালো। চিরকাল তাই ভাবলাম। এখন তোমরাতো তা হবে না। তোমরাতো গাঙচিল।
-স্যার নারী স্বাধীনতা এবং সমঅধিকারকে কীভাবে দেখেন?
ড সামাদঃ কোনভাবেই দেখি না। অস্কার ওয়াইল্ডের একটা রূপকথায় গল্প আছে না? মেয়েরা যুদ্ধ করতে শুরু করলো ছেলেদের সাথে। একসময় দেখা গেল মেয়েরা জিতে যাচ্ছিল কিন্তু জিতছিল না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল যে, অর্ধেক মেয়ে বাড়িতে মা হতে চলে গিয়েছে বলে ওরা হেরে যাচ্ছে। তো ব্যাপার হচ্ছে যে, এরা কত যুদ্ধ করবে? কী মুশকিলের কথা! মানুষতো ওরা, এ কথা তো আর অস্বীকার করতে পারছে না তারা। ওসবের মধ্যে আমি কখনো ছিলাম না।
-সেজন্য মেয়েদের প্রতি এতো আপনার মুগ্ধতা।
ড সামাদঃ ভালোবাসা আর বোকামির যোগফল।
-স্যার আপনি কি দেশি না বিদেশি সাহিত্য বেশি পড়েছেন, যদিও আপনার সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক বেশি ছিল না।ড সামাদঃ যারা সাহিত্য পড়েছে তাদের সাথে আমি কিছু কিছু ঘুরেছি। ফলে অনেক কথা শিখে গেছি তাদের কাছ থেকে। আমি মূল বইয়ের সাথে নোট বই বেশি পড়েছি। তাতে অনেক শব্দ শিখে গেছি। বড় বড় কথা আছে তার মধ্যে।
-এখনতো স্যার আমাদের বিশ্বমানের সাহিত্যিক তৈরি হয়েছে। ফলে বিদেশি বাংলা সাহিত্যিকরা বুকসেলফে উঠে যাচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন।
ড সামাদঃহতেইতো পারে। কথা হচ্ছে যে, সাহিত্যের ব্যাপার হলো রসের ব্যাপার। সেটা বাদ দিয়েতো হবে না। মুসলমানরা যাতে সবচে কৃতিত্ব দেখায়, সেটা হলো হাতের কাজে। স্থাপত্যে। আরব্য-রজনীর যে কাহিনী, সে কাহিনীতো হচ্ছে ভারতকে নিয়ে। শাহরিয়ার তো ভারতের রাজপুত্র। কথা হচ্ছে, সাহিত্য জগতে কিন্তু নতুন কালচারটা ঐভাবে অগ্রসর না। যতটা স্থাপত্যে এবং যাকে বলা হয় মাইনর আর্ট। থালাবাসন তৈজসপত্র। কথা হচ্ছে আমাদের ট্র্যাডিশানটাতো বুঝতে হবে। ভারতের সাহিত্যের অর্ধেকটাইতো এবং অর্ধেকের বেশিই তো চুরি।
-কীভাবে স্যার?
ড সামাদঃ যেসব গল্পকে আমরা মনে করি ওদের লেখা, সেগুলোতো ওদের লেখা নয়। সেগুলোতো অনুবাদ। কথা হচ্ছে যে, ছোটগল্প লেখা শুরু হলো আমেরিকা থেকে। রিপ ভ্যান উইংকেল, মফাসার উপরও রিপ ভ্যান উইংকেলের প্রভাব আছে। ছোট গল্প এত অরিজিনাল কে লিখতে পেরেছে? এখন নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। রবীন্দ্রনাথের একটা ক্ষমতা ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঠাকুর বাড়ি থেকেই প্রথম আইসিএস বেরুলো। সারা ভারতের। আকরম খা তো সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাই।
-স্যার এখনতো বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ঢাকাকে বেইজ করেই এগুচ্ছে।
ড সামাদঃ হতে পারে। আমার কাছে উন্নতি মানেতো সাহিত্য নয়। আমার কাছে উন্নতি মানে হচ্ছে ভরপেট খেতে পাওয়া। পেট যখন খালি থাকে, মনে হচ্ছে যেন দোযখে আছি। পেট যখন ভর্তি থাকে মনে হচ্ছে যেন বেহেশতে আছি। আমার কাছে বেহেশত দোযখতো খুব দূরে ছিল না। এখনো নয়। খালি পেট মানে দোযখ, ভরপেট মানে বেহেশত। কথা হচ্ছে, যে দেশের অধিকাংশ মানুষ দুই মুঠো দুইবেলা খেতে পায় না, একবেলা খেতে পায় না। সেই দেশে এতসব চিন্তা করা, আমার মনে হয় বেকার, একদম বেকার। গরীবকে নিয়ে তারাই বেশি ভাবে যারা গরীব নয়। এটা মুসলিম প্রধান এলাকা। ওটা হলো একেবারে হিন্দু প্রধান এলাকা। ভাগ হয়ে যাবে এখানে। অনেকে চাননি যে, মুসলমানদের মধ্যে লেখাপড়ার বিস্তার হোক।
-অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরওতো সরাসরি বিরোধীতা করেছিল।
ড সামাদঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে লাভবানতো হিন্দুরাই হয়েছে।
-যারা করেছে, টাকা পয়সা দিয়েছে, তাদেরই ডিপ্রাইভড করা হয়েছে।
ড সামাদঃ এখন কথা হচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আমাদেরকে গ্রাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটা করেছে ইন্ধিরা গান্ধী। রবীন্দ্রনাথ এ জন্য দায়ী নন। পলিটিক্যালি আমরা রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসলে প্রতিভাবান। কেন না উনি যা কিছু করেছেন, উনি যে ছবি এঁকেছেন, ছবির যে কালার। এ কালার তিনি কোথায় পেয়েছেন? এ তো জন্মগত ব্যাপার। অন্যগুলো, কবিতা হয়তো বুঝি না। কিন্তু এই যে কালারস থিম, একটা থিমের পাশে আরেকটা থিমকে সাজানো। এটা জন্মগত শিল্পপ্রতিভা না থাকলে হয় না। তার কেমন করে গান করো হে গুণী? এ প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথই নিজেকে করেছেন। তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি। এ খুবই ভিতরের ব্যাপার। এটাতো স্বীকার করতেই হয়। রবীন্দ্রনাথকে এমনিতে হেয় করতে চেয়ো না। তাতে আমরাই ঠকবো। রবীন্দ্রনাথ অন্য কিছু করে থাকলে সেটা রাজনৈতিক ব্যাপার। উনার শুধু সাহিত্য নয়, সবকিছুতেই উনি যে মৌলিকত্ব এনেছিলেন, কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ যে রবীন্দ্রনাথ সেটাতো মানতেই হবে।
-ভার্সেটাইল প্রতিভা।
ড সামাদঃ তুমি কখনোই রবীন্দ্রনাথকে ডিঙ্গাতে করতে পারো না। তবে আমি রবীন্দ্রনাথ ছাড়াই অন্য কবিতা হয়তো বেশি পড়তাম। জগৎ একটা হেয়ালী, যত না নিয়ম, ততটা অনিয়ম, জীবনটা খামখেয়ালী। আমার ভালো লাগতো। শুধু রবীন্দ্রনাথ পড়েছি, তা নয়। নিজের যখন মাথা খারাপ হয়েছিল পড়াশোনা করতে গিয়ে তখন ওয়ার্ডসওয়াসথ্ পড়েছি। কবিতার একটা কাজ হচ্ছে মানুষের বিপন্নতা থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। দুর্ভাবনার বোঝাটাকে হালকা করা। কিন্তু সেখানে এদের কাউকে আমি ছোট করি না। এদের দ্বারা উপকৃত হয়েছি। বাকিটা রাজনীতির ব্যাপার। নজরুলকে আমি অত বড় বলতে পারি না। আসলে নজরুল পড়ে আমার ভালো লাগেনি। আমি মানি না কোনো আইন, আমি ভীম ভাসমান মাইন। এটা কি কবিতা? কিন্তু যখন, ঊষণে পূর্ণ মেঘ অন্য বেগে ছুটে চলে আসে বাধা বন্ধন হারা! এর মধ্যে নিবিড় ব্যাপার, নজরুলে কি তা পাওয়া যায়? হ্যাঁ, কিছু কিছু জায়গায় নিশ্চয়ই ভালো লাগে। রাহে নারী জল, সেই জল-মাটি মিশে/ ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীর্ষে। এখানে হয়তো আমার অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু সেটাতো খুব বেশি নয়।
-স্যার, নজরুলের গানে অসাধারণ উপমা, উৎপ্রেক্ষা আছে।
ড সামাদঃ কিছু কিছু আছে। সে গানগুলোতো আর চলছে না। ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমে, কোথা তুমি এলে মেঘ বিজলি বরষায়… গানতো এখন কেউ করে না! অথবা শূন্য এই বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়! এ গানও এখন কেউ করে না। অথচ গান হিসেবে এগুলো, আমার অন্তত নিজের হয় গান হিসেবে এগুলোর মূল্য অনেক বেশি। শুকনো পাতার নূপুর পায়ে, গানটার সুরটা অবশ্য বিদেশী। বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস নে আজি দোল, অথবা আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ; এসব গানের ক্ষেত্রে অজয় বাবুই বোধ হয় ছাড়িয়ে গেছে নজরুলকে। দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিরে, হাসবি তোরা বাঁচবি তোরা মরণ নদী আছেই ঘিরে… সেদিক থেকে আবার বলতে হবে নজরুল। সুরকার এবং কথাকার দুদিকেই রবীন্দ্রনাথ কথাকে দিয়েছেন সুর। নজরুল সুরকে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথও সুরকে কথা দিয়েছেন। দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামলো, বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামলো। এই গানটা শুনে তিনি তখনই কথাটা বসিয়েছেন।
-রবীন্দ্রনাথের গানগুলো শুনে কি মনে হয়না গান সম্পর্কে তার দক্ষতা কম ছিল?
ড সামাদঃ কথা হচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথের গান হলো অন্য জিনিস। এটা ভেতর নকশাপ্রধান গান নজরুলের হলো নকশা প্রধান। এখানে ইমপ্রোভাইজ করা যায়। নিজে তৈরি করে সাথে জুড়ে দেয়া যায়। গান করেন গলার দেখাতে পারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানতো তা নয়। এটা হচ্ছে ভেতর থেকে আসা, যেমন একটা মাঝি নৌকা চালাতে চালাতে করছে। এটা হলো রবীন্দ্রনাথ। মাঝির এই গান আসছে ভেতর থেকে, এটা শিক্ষিত ব্যাপার নয়। এটা হচ্ছে তার ভেতরের গান। এখন গানেরতো রূপ আছে। রবীন্দ্রনাথের গানে গলার কাজ দেখাবার নাই।
-স্যার নজরুলের গানে কিন্তু সুরের বৈচিত্র্য আছে… বৈচিত্র্য আছে।
ড সামাদঃ তবে নজরুলের একশ্রেণির গান আছে, যেগুলো আমার রবীন্দ্রসঙ্গীতই মনে হয়।
-স্যার রবীন্দ্রনাথের মাঝির কথা নজরুলের ক্ষেত্রে উদাহরণ দেবেন?
ড সামাদঃ দেখো, নজরুলের দাদা ছিলেন পাটনার তার মাতৃভাষা কিন্তু অঞ্চলে একধরনের গান আছে। যেমন গানটা ধরো, প্রাণেরো রাধারে চলরে গৌরি বসিয়া দুজনে। এই কিন্তু বিহারের গান। এটা কিন্তু বাংলা না। সুরের দিক থেকেও নয়, কথার দিক থেকেও নয়। বুঝতে পারলা? তবে আমিতো গান সম্পর্কে অত না। গান আমি মাঝে মাঝে শুনেছি। আমাদের এখানে গান শিখতেন। আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে, তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে। তো আমার হতো সকাল বেলা কেন এ করছে? এটাতো বিকালের গান। আমার বন্ধু বলেছিল, দেখো গান গেয়ে দুপুর বেলাকে হয় ভোর তবে সে গানই ভালো। কারণ, তোমার সমস্ত পরিবেশটাকেই বদলে দিতে পারছে।
-স্যার আপনি বললেন আপনি গান সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। কিন্তু গানের আপনার একটা বই আছে।
ড সামাদঃ ওটাতো ওরকম। যেমন রশীদ চৌধুরী বললো শিল্পকলার একটা বই লিখে দিতে, দিলাম। ওটা করা যায়। বুঝতে পারলা? যারা প্রফেশনাল শিক্ষক হয় না? তারা অন্যের বই পড়ে অন্যকে পড়ায়। আমরা হলাম ফেরিঅলা, এক হাটের জিনিস কিনে আরেক হাটে বেচি। আমরাতো তৈরি করি না কিছু। তৈরি করা জিনিস বেচি। এক হাটে লও বোঝা শূন্য করে দাও অন্য হাটে, জীবনের ঘাটে ঘাটে।
-আপনি তো কারখানা।
ড সামাদঃ কারাখানা নই আমরা। জিনিসের মূল্য বাড়ে টাইম ফর্ম এন্ড ফ্রি স্পেসের উপর। একখানে একটা জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না, আরেকখানে পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে কিনে ঐ জায়গায় বিক্রি করলাম। ওখান থেকে কম দামে কিনি, এখানে বেশি দামে বিক্রি করি। আমরা অবশ্য পেশাদার শিক্ষক, যা যা জানা আছে তা-ই জানাই। তার বেশি কিছু করি না তো। কোনোদিন করিও নি।
সাক্ষাতকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে, নোঙ্গর পত্রিকার চব্বিশতম সংখ্যায়। অনুলিখন: আবদুস সামাদ রাজু কৃতজ্ঞতাঃ গল্পকার মঈন শেখ ও তরুণ প্রাবন্ধিক শাহাদাৎ সরকার।