আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে আলোচনায় প্রমাণের চেষ্টা চলেছে যে, পাকিস্তান একঘরে হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্ববাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বলছে, ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় যে ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ সম্পন্ন হয়েছে, সেটাকে মেনে চলতে হবে। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ১২ মার্চ ১৯৬৩ সালে সম্পাদিত হয়েছে কাশ্মির নিয়ে বিশেষ চুক্তি। ভারত যেটাকে মেনে নেয়নি। কিন্তু ভারত যদি কাশ্মির নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তবে চীনের সাথে ভারতের ১৯৬২ সালের সীমান্ত সঙ্ঘাতের মতো সঙ্ঘাত দেখা দিতে পারে।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন আগের তুলনায় হয়ে উঠেছে অনেক গভীর। পাকিস্তান তাই গোয়াদরে চীনকে দিয়েছে বন্দর ও নৌঘাঁটি গড়ার বিশেষ অধিকার। পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ বাধলে চীনের সাথেও ভারতের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশ ভারতের পে থাকবে (প্রথম আলো : ৫ অক্টোবর ২০১৬)। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের পে থাকলে চীন-বাংলাদেশ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে। চীনের চুম্বি উপত্যকা থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত খুব কাছে। চীন চুম্বি উপত্যকা থেকে বাংলাদেশে পাঠাতে পারে সৈন্য। বাংলাদেশ কি চীনের সাথে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে? বাংলাদেশ কেন ভারতের স্বার্থে চীনকে শত্রু করে তুলবে? আমাদের মন্ত্রী মহোদয় ভূগোল সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন জ্ঞান রাখেন বলে অনুমিত হচ্ছে না।
সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যজনক ঘটনা, তা হলো, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন কেবল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কথা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমাদের দেশে পররাষ্ট্রবিষয়ক ব্যাপারে কথা বলছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যেটা তার দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। এর আগে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী পাকিস্তানের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি এটা করেছিলেন ভারতে গিয়ে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় তাই মনে হচ্ছে কিছু মন্ত্রী বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছেন ভারতপন্থী। কিন্তু এরা ভুলে যাচ্ছেন যে, কাশ্মিরে শেখ আবদুল্লাহ ও বকসি গোলাম মুহাম্মদের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল। ভারতকে বন্ধু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ পরিণত হতে পারে দ্বিতীয় কাশ্মিরে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৬৯ নম্বর ধারার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারত ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্র বিদেশী রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে কোনো রাষ্ট্রকে বিদেশী রাষ্ট্র নয় বলে ঘোষণা করতে পারেন। ভারতের সংবিধানের এই অংশ মোটেও স্বচ্ছ নয়। ভারত যেকোনো রাষ্ট্র দখল করে তাকে ভারতের অংশ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। যেমন সে করেছে কাশ্মিরের ক্ষেত্রে। কথা ছিল কাশ্মির ভারতের মধ্যে থাকলেও থাকবে তার বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। কাশ্মিরের থাকবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রপতি (সর্দার-ই-রিয়াসাৎ)। যিনি হবেন কেবল কাশ্মিরের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত। কিন্তু এখন কাশ্মিরকে করে নেয়া হয়েছে ভারতের একটি প্রদেশ। আমাদের অনেক মন্ত্রী ভারতকে ভাবছেন বিশেষ বন্ধু। কিন্তু মনে হয় তারা ভারতের সংবিধান সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নন। ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিল সপ্তম নৌবহর, যা ভারতকে বাধ্য করেছিল সংযত হতে। ল করলে দেখা যায়, পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক আতাউল গণি ওসমানীর কাছে নয়। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ার পর তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল পৃথক পৃথকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সেনাপতিদের কাছে। কিন্তু ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল কেবল ভারতের সেনাপতির কাছে। আর পাকিস্তানের বন্দী সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে না রেখে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতে। তারপর সিমলা চুক্তি অনুসারে এদের সবাইকে দেয়া হয়েছিল ছেড়ে। সিমলার সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। ১৯৭১-এর লড়াইকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ না বলে সিমলা চুক্তিতে বলা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
আমাদের মন্ত্রীরা চলেছেন এসব ইতিহাসকে এড়িয়ে। ১৯৬৫ সালে কাশ্মির নিয়ে যে যুদ্ধ বাধে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সমর্থন করেছিল ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে। এখনো বাংলাদেশের জনমত সমর্থন করছে কাশ্মিরবাসীকে। তাই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশের জনমত ভারতকে সমর্থন করবে, এ রকম ভাবতে পারা যায় না। যদিও আমাদের ভারতপ্রেমিক মন্ত্রীরা বলছেন, বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে থাকবে ভারতের পক্ষে।
পাকিস্তানে সব রাজনৈতিক দল কাশ্মিরের ব্যাপারে এসে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের প।ে এমনকি পাকিস্তান পিপলস পার্টি, দল হিসেবে যারা নওয়াজ শরিফের সরকারের পতন চায়, তারাও কাশ্মিরের ব্যাপারে সমর্থন করছে নওয়াজ শরিফকে। কাশ্মিরের ব্যাপারে তাই পাকিস্তানে কোনো মতবিরোধ থাকতে দেখা যাচ্ছে না। পাকিস্তান আক্রান্ত হলে সেটা হয়ে উঠবে পাকিস্তানের জন্য একটি সামগ্রিক যুদ্ধ। কেবলই সেনাবাহিনীর যুদ্ধ নয়। জনগণ ও সেনাবাহিনী একীভূত হবে এই সমরে। কিন্তু ভারতে সব দল এগিয়ে আসছে না তাদের প্রধানমন্ত্রীর নীতির সমর্থনে। ভারতে থাকতে দেখা যাচ্ছে কাশ্মির নিয়ে মতবাদিক অনৈক্য।
কাশ্মিরের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট অবগত নই। কাশ্মির বলতে একসময় বোঝাত কেবল ঝিলাম নদীর উপত্যকাকে। যার আয়তন ছিল লম্বায় ৮০ থেকে ৮৫ মাইল এবং চওড়ায় ছিল ২০ থেকে ২৫ মাইল। এই অঞ্চল প্রথমে যে মুসলমান দখল করেন, তিনি যান সোয়াদ থেকে। এর নাম শাহ মির্জা। সংক্ষেপে মীর। তিনি প্রথমে কাশ্মিরের তদানীন্তন হিন্দু রাজার মন্ত্রী হন। পরে রাজাকে খুন করে নিজেই হন সুলতান। কেবল তাই নয়, হিন্দু রাজার বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন। তার এই স্ত্রীর গর্ভের পুত্রসন্তান হন কাশ্মিরের সুলতান। কাশ্মিরে সুলতান শামস-উদ-দীন ১৩৪৬ সালে সিংহাসন আরোহণ করেন। তারপর সুলতান হন সেকেন্দার শাহ। যিনি খ্যাত হয়ে আছেন মূর্তিভঙ্গকারী হিসেবে। ইনি রাজত্ব করেন ১৩৯৩ থেকে ১৪১৬ সাল পর্যন্ত। এ সময় কেবল কাশ্মিরের ব্রাহ্মণ ছাড়া আর সবাই গ্রহণ করেন ইসলাম। কাশ্মিরের ব্রাহ্মণদের বলা হয় পণ্ডিত। এর পরে সুলতান হন জয়নুল আবেদিন। যিনি রাজত্ব করেন ১৪২০ থেকে ১৪৬৭ সাল পর্যন্ত। এরপর বাদশা হুমায়ুনের আত্মীয় মির্জা হায়দার কাশ্মির দখল করে রাজত্ব করেন ১৫৪১ থেকে ১৫৫১ সাল পর্যন্ত। কাশ্মির সম্রাট আকবরের অধীনে আসে ১৫৮৬ সালে।
অর্থাৎ কাশ্মিরের ইতিহাস কাটাকাটাভাবে আমরা যতটুকু জানতে পারি, তাতে কাশ্মিরকে বলতে হয় একটি মুসলিম ভাবধারাসম্পন্ন জনসমষ্টির দেশ। এই কাশ্মিরিদের রয়েছে একটি নিজস্ব ভাষা। এই ভাষা প্রথমে লেখা হতো সারদালিপিতে। কিন্তু মুসলমানেরা এখন এই ভাষা লেখেন মূলত আরবি অরে। কাশ্মিরের সাথে লাগোয়া জেলা জম্মু। জম্মু হিন্দু অধ্যুষিত। এখানকার ভাষা কিন্তু কাশ্মিরি নয়। জম্মুর অধিবাসীদের বলা হয় ডোগরা। ডোগরারা যে ভাষায় কথা বলেন, তা হলো পাঞ্জাবি ভাষার একটি উপভাষা। এর লিখিত সাহিত্য নেই। রঞ্জিৎসিংয়ের সময় তার অন্যতম সেনাপতি গোলাব সিং পান কাশ্মির ও জম্মুর কর্তৃত্ব। যার বংশধরেরা পরিগণিত হন কাশ্মিরের রাজা হিসেবে। এরা রাজা হলেও হন ব্রিটেনের করদমিত্র রাজা। ১৯৩১ সালে শেখ আবদুল্লাহ ও তার দল মুসলিম কনফারেন্স বিদ্রোহ করেন কাশ্মিরে প্রচলিত রাজতন্ত্রের বিপ।ে কিন্তু তারা সাফল্যলাভ করতে পারেননি। পরে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু বলেন, তিনি কাশ্মিরকে স্বায়ত্তশাসন দেবেন। এভাবে তিনি লাভ করেন শেখ আবদুল্লাহর সমর্থন। কিন্তু ১৯৪৭-এ পাকিস্তান হওয়ার পর কাশ্মিরের রাজা যোগ দেন ভারতে। ফলে কাশ্মিরে বাধে গৃহযুদ্ধ। পাকিস্তান সমর্থন করে মুসলিম লীগপন্থী জনসমষ্টিকে। যারা যোগ দিতে চান পাকিস্তানে।
এভাবে সৃষ্টি হয় আজকের জটিল কাশ্মির সমস্যার। কাশ্মিরের এক রাজা দখল করেন আকসাই চীন ও লাদাখ। ১৯৬২ সালে চীন এই অঞ্চল দখল করে। অর্থাৎ বর্তমানে সাবেক কাশ্মির রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়েছে পাকিস্তান-ভারত ও চীনের মধ্যে। সমস্যাটা কেবল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত নেই। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ভাবছেন কাশ্মির সমস্যা হলো কেবল পাক-ভারত সমস্যা। যেটা আসলে বাস্তবতা নয়। কাশ্মির নিয়ে কোনো যুদ্ধ বাধলে সেটা কেবল পাক-ভারত যুদ্ধ হয়ে থাকবে না; হয়ে উঠবে পাকিস্তান চীন বনাম ভারত যুদ্ধ। যেহেতু নেপাল চীন এখন ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাই নেপালও এগিয়ে আসতে পারে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। আমাদের আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা বিষয়টিকে যত সরল করে দেখছেন, সেটা বিশেষভাবেই ভ্রমাত্মক। এ ব্যাপারে তাই হালকাভাবে কোনো উক্তি করা ঠিক হচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন চীনের কাছ থেকে আশা করছে, বিশাল বিনিয়োগ। যে রকম বিনিয়োগ ভারতের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিল একটি খুবই সামান্য ব্যাপার। কিন্তু এখন পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে সেটা সামান্য ব্যাপার হয়ে থাকবে না। ১৯৭১ সালে যত লোক মারা গিয়েছিল তার থেকে বহু বেশি লোক মারা যাবে, বাড়িঘর নষ্ট হবে; পাক-ভারত যদি যুদ্ধ বাধে তা হলে। কেননা, দু’টি দেশই এখন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। যেটা ১৯৭১ সালে তারা ছিল না। আমরা পাক-ভারত যুদ্ধ হোক, সেটা চাই না। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা যে ধরনের বিচার বিশ্লেষণ করছেন, সেটাকে আমরা মনে করি, হতে পারে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় রকমের ক্ষতির কারণ।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে ঠিক কী চেয়েছিলেন সেটা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বলেন, তিনি পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। তিনি কখনোই বলেননি, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নেতা। তিনি গোটা পাকিস্তানের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো প্রার্থী দেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেবল পূর্ব পাকিস্তান থেকে নয়, তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ থেকেও নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছিলেন। যদিও তারা কেউ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ কোনো সময়ই দাবি করেনি, সে হলো কেবল পূর্ব পাকিস্তানের একটি দল। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সেটাই যেন প্রমাণ করতে চাচ্ছে। আর সেই সাথে প্রমাণ করতে চাচ্ছে বর্তমান পাকিস্তান হলো বাংলাদেশের শত্রু। কিন্তু পাকিস্তানকে শত্রু ভাবার কোনো কারণ আজ আর নেই।
শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচবার উপায় নাই। তিনি আরো বলেছেনÑ আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি। শেখ মুজিবের এই বিশ্লেষণ যথাযথ হলে, বাংলাভাষী মুসলমান কাশ্মির প্রশ্নে ভারতের পে না যেতেও পারে। তারা তাদের বাঙালি মনোভাবের চেয়ে মুসলিম মনোভাবের প্রতি দিতে পারে এই বিশেষক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে ঠিক কী চেয়েছিলেন সেটা এখনো যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। কেননা, তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে না গিয়ে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে বলেন, তিনি পাকিস্তানের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছেদ করতে চাচ্ছেন না। রাখতে চাচ্ছেন বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। তবে তিনি এ বিষয়ে বিশদ হতে চান না। ক’দিন আগে আমরা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শুনলাম, পাকিস্তানের সঙ্গে জগড়াঝাটি চলবে কিন্তু তা বলে ছিন্ন হবে না বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক । অর্থাৎ তার বক্তব্য থেকে মনে হয়, তিনি তার পিতার মতোই পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করার পক্ষে নন। তিনি ভারত থেকে সাবমেরিন না কিনে, কিনছেন চীন থেকে। চাচ্ছেন চীন বিপুলভাবে বাংলাদেশে করুক বিনিয়োগ।
ভারত-পাকিস্তান কাশ্মির সীমান্তে গুলিগোলা ছুড়ছে। কিন্তু তা বলেই যে, যুদ্ধ বেধে যাবে এমন ভাবা যায় না। কিন্তু ভারত যদি ১৯৬০ সালের পানিচুক্তি ভঙ্গ করে, তবে পাক-ভারত যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে এবং এই যুদ্ধ যে কেবল পাক-ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। মোদি যদি এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তবে তিনি আন্তর্জাতিক সমাজের কোনো সমর্থন পাবেন বলে মনে হয় না। এ ছাড়া জওয়াহেরলাল নেহরু কাশ্মির সমস্যার সমাধানের জন্য তা নিয়ে যান জাতিসঙ্ঘে। জাতিসঙ্ঘ এই সমস্যা সমাধানের জন্য কাশ্মিরবাসীর গণ-অভিমত (Plebiscite) গ্রহণ করতে। বিশ্ব জনসমাজ চাইবে এভাবেই কাশ্মির সমস্যার সমাধান করা হোক। তারা সরে যেতে চাইবে না জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকৃত প্রস্তাব থেকে। নরেন্দ্র মোদি বলছেন, ভারত প্রথমে কাউকে কখনো আক্রমণ করেনি। কিন্তু জুনাগড় ও মানভাদারের নবাব পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু এই দুই স্থানের বেশির ভাগ অধিবাসী হলেন হিন্দু, তাই ভারত জোর করে এই দুই অঞ্চল দখল করে নেয়।
গোয়া ৫০০ বছর ধরে ছিল পর্তুগালের নিয়ন্ত্রণে। গোয়ার বেশির ভাগ অধিবাসীই হলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। তারা চাচ্ছিলেন পর্তুগালের সাথেই থাকতে। কিন্তু ভারত সৈন্য পাঠিয়ে গোয়া দখল করে। ভারত হায়দরাবাদ দখল করে সৈন্য পাঠিয়ে। কিন্তু সাবেক হায়দরাবাদের মানুষ এখন থাকতে চাচ্ছে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে। তাই দেখা গেল, তেলেঙ্গানার মানুষ অন্ধ্র থেকে পৃথক হয়ে যেতে। যদিও অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানার মানুষ কথা বলেন একই তেলেগু ভাষায়। ভারতে জাতিসত্তার সমস্যা এখনো মেটেনি। শিখরা চাচ্ছেন পৃথক রাষ্ট্র খালিস্তান গড়তে। যদি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, তবে শিখরা গ্রহণ করতে পারেন পাকিস্তানেরই প। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জগজিৎ সিং অররা ছিলেন খালিস্তানপন্থী। তাই তার নাম এখন আর বিশেষ করছে না ভারত। যদিও ১৯৭১-এ ভারতের পূর্ব রণাঙ্গনে প্রধান সেনাপতি ছিলেন তিনি। অর্থাৎ এ দিক থেকে দেখলেও বলতে হবে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে ভারতের পে একটা জটিল ব্যাপার। আপাতত তাই মনে হচ্ছে কাশ্মির নিয়ন্ত্রণ রেখায় গুলিগোলা যতই চলুক, একটা বড় রকমের যুদ্ধ বেধে উঠতে যাচ্ছে না। কেননা, ভারত এ রকম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে ভারত ভুল করতেও পারে। সেটার সম্ভাবনাও থাকছে।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/০৮ অক্টোবর ২০১৬