ক’দিন ধরে পত্রিকায় পাহাড় ধস নিয়ে অনেক কিছু আলোচান হলো। অনেক বিশেষজ্ঞের মত, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেখানে বাড়িঘর এবং পথঘাট নির্মাণে সেখানকার ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না বলে পাহাড়ে ধস দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে। কারণ, যে কোনো জায়গায় কোনো নির্মাণকর্ম করতে হলে সেখানকার ভূমির গঠন সম্পর্কে জানা আবশ্যক। তা না হলে ভারসাম্য বাজায় থাকা সম্ভব হয় না।
১৯০৪ সালে নির্মিত হয় আসাম-বাংলার রেলপথ। এই রেলপথ নির্মাণের সময় কাটতে হয় অনেক পাহাড়। কিন্তু এই পাহাড় কাটার ফলে দেখা দেয় না পাহাড় ধস। সে সময় দেশে পরিবেশবাদী বলে কোনো জনগোষ্ঠী ছিল না। থাকলে তারা হয়তো আসাম-বাংলার রেলপথ খোলার বিরোধিতা করতেন। হতে পারত না আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভব। আমরা এখন সব ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছি পরিবেশ সংরক্ষণের। কিন্তু মানব সভ্যতার গোড়ার কথা হলো, মানুষের উপযোগী পরিবেশ নির্মাণ। তা না হলে মানুষকে থেকে যেতে হতো সেই আদিম বৃক্ষচারী প্রাণী হিসেবে। আরো অনেক অদ্ভুত কথা বলতে শোনা গেল অনেক বিশেষজ্ঞকে (প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৭)।
একজন বিশেষজ্ঞ বললেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারসের চাষ করা যাবে না। চাষ করা চলবে না রাবারের। কিন্তু আমরা জানি, মালয়েশিয়া রাবার চাষের সাফল্যের ফলে এখন হতে পেরেছে আর্থিক দিক থেকে অনেক সচ্ছল। রাবার এশিয়ার কোনো দেশের গাছ নয়। রাবার গাছ হতো দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে। সেখান থেকে ১৮১৬ সালে উইকহ্যাম নামে জনৈক ইংরেজ ব্যবসায়ী ৭০ হাজার বীজ গোপনে নিয়ে এসে মালয়েশিয়ায় রাবার চাষের সূচনা করেছিলেন। মালয়েশিয়া বর্তমানে বিশ্বের প্রধান রাবার উৎপাদক দেশ। আমাদের দেশে রাবার চাষের সূচনা হয় পাকিস্তান হওয়ার পর। বর্তমানে আমাদের দেশে রাবার উৎপাদন শুরু হয়েছে।
আমাদের রাবার উৎপাদনের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। কিন্তু আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাবার চাষ করলে নাকি ঘটবে পাহাড়ে ধস। কিন্তু আমরা মালয়েশিয়ায় এরকম ধস ঘটতে দেখছি না। আমাদের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, পাহাড়ে সেগুন গাছ রোপণ করা যাবে না। কারণ এর ফলে নাকি বাড়বে ভূমিধস। কিন্তু আমাদের দেশে সেগুন চাষ শুরু হয়েছে সেই ইংরেজ আমল থেকেই, ১৮১৭ সাল থেকেই। সেগুন কাঠ বিশ্বের সবচেয়ে সেরা কাঠ হিসেবে বিবেচিত। সেগুন কাঠে পোকা লাগে না। সেগুন কাঠ ব্যবহার হয় জাহাজ নির্মাণে। বাংলাদেশে এখন জাহাজ নির্মাণ শিল্প আরম্ভ হয়েছে। সেগুন কাঠ তাই আমাদের খুবই প্রয়োজন। অথচ আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেগুন গাছ না লাগাতে। এসব বিশেষজ্ঞের জ্ঞান নিয়ে তাই অনেকের মতো আমার মনে দেখা দিয়েছে বিশেষ সংশয়। এরা পাহাড়ের ধস বন্ধ করার নামে দেশের আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী হয়ে দাঁড়াচ্ছেন প্রচণ্ড বাধা?
১৭৬০ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব মীর কাশিমের কাছে চট্টগ্রাম অঞ্চল ইজারা নেয়। ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক জেলা হিসেবে গঠন করে ১৮৬০ সালে। এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলে কোনো পৃথক জেলার অস্তিত্ব ছিল না। যতগুলো কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করা হয়েছিল, তার মধ্যে একটি কারণ ছিল খ্রিষ্টান মিশনারীদের অনুরোধ। কেননা তারা মনে করেছিলেন, এরকম একটি পৃথক জেলা গঠন করা হলে সেখানে উপজাতিদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করা সহজ হতে পারবে। আইন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে কেবল মাত্র উপজাতিরাই জায়গা কিনতে পারবে। সাবেক পাকিস্তানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা যুক্ত হয় র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে। সাবেক পাকিস্তানে ১৯৬৪ সালে কেবল উপজাতিরাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় জায়গা কিনতে পারবে এই আইন রদ করা হয়। বাংলাদেশ গায়ের জোরে সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা জয় করেনি। বাংলাদেশ চাচ্ছে না সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম আবার ফিরে আসুক। কিন্তু আমাদের অনেক কথিত বিশেষজ্ঞ যেন সেটাই চাচ্ছেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, চাকমারাই সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র উপজাতি নয়। আরো অনেক উপজাতি আছে। যেমন, মারমা। চাকমা এবং মারমাদের মধ্যে বিরাজ করছে না কোনো সদ্ভাব। তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে রক্তক্ষরার সঙ্ঘাত। আসলে চাকমা ও মারমারা কেউই এ অঞ্চলে আদিবাসী নয়। এরা সবাই এসেছেন ইংরেজ আমলে ১৮২৪ সালের কাছাকাছি প্রথম এ্যাংলো-বর্মা যুদ্ধের সময়। কিন্তু আমাদের সংবাদপত্রসেবীরা এমনভাবে লিখছেন যে, তা পড়ে মনে হচ্ছে যেন এরা হলেন এই অঞ্চলের আদিবাসী। যেটা সত্য নয়।
বিএনপির একজন বিবৃতি কৌশলী নেতা ছুটে যাচ্ছিলেন চাকমাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে। কিন্তু তাকে সেটা জানাতে দিল না আওয়ামী লীগের কর্মীরা। তিনি বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। অথচ এই নেতাকে কখনো রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে কোনো দুঃখ প্রকাশ করার কথা আমাদের জানা নেই। রোহিঙ্গারা এই অঞ্চলের জন্য একটা বড় রকমের সমস্যা হয়েই উঠছে। বাংলাদেশের উচিত হবে, এই সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেয়া। চাকমা ও মারমারা সবাই এসেছেন আরাকান অঞ্চল থেকে। তাই আরাকানে উদ্ভূত সমস্যা আর চাকমা মারমাদের সমস্যা হয়ে পড়তে পারে সংশ্লিষ্ট।
পাহাড়ি অঞ্চলে মাটি থাক থাক করে কেটে প্রত্যেক থাকে আবাদ করা হয় (Contour Tillage)। এভাবে আবাদ করলে ভূমিধসের সমস্যা থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে এই পদ্ধতি যথেষ্ট অনুশ্রিত হচ্ছে না। হলে পরে পাহাড় ধসের সমস্যা এখনকার মতো আর থাকবে বলে মনে হয় না। অনেক দেশেই এভাবে আবাদ করে মাটির পহাড় ধসের সমস্যা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে।
১৯৪৭ সালে যখন র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে সাবেক পার্বত্য জেলাকে পাকিস্তানে দেয়া হয়, তখন চাকমারা এটা মানতে রাজি হননি। তারা উড়ান ভারতের পতাকা। যাকে বালুচ রেজিমেন্ট গিয়ে টেনে নামান। কিন্তু এখনো আমাদের দেশে অনেকে আছে, যারা চাকমাদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি সম্পন্ন। যেটাকে সমর্থন করা চলে না। সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন তিনটি জেলায় বিভক্ত। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান। এখানে বাংলাদেশের অন্যত্র থেকে মানুষ গিয়েছেন; যাদের তাড়িয়ে দেয়া যাবে না। কারণ তারা একই বাংলাদেশের নাগরিক। একজন চাকমার যদি ঢাকায় এসে জায়গা কিনে বাড়ি করার অধিকার থাকে, তবে ঢাকা থেকেও একজন সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিকের নিশ্চয় থাকতে হবে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে জায়গা কিনে গৃহ নির্মাণের অধিকার। চাকমাদের মধ্যে বিশেষভাবে বিরাজ করছে হিন্দুত্বের মনোভাব। যে সম্পর্কে সাবধান হওয়া প্রয়োজন।
দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত, ৩০ জুন ২০১৭।