প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রদর্শন

Photo: ISLAMIC ARTS MUSEUM MALAYSIA

এই উপমহাদেশের উত্তর ভাগে যারা রাজা-রাজত্ব ও রাজ্য শাসন নিয়ে প্রাচীন যুগে চিন্তা করেছেন, তাদের মধ্যে কৌটিল্য হলেন যথেষ্ট প্রসিদ্ধ। কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থে বলেছেন, ‘প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম। নাত্মপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়ং হিতম্॥’ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এখানে যে শ্লোকটি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তার টানা বাংলা করলে দাঁড়াবে- প্রজার সুখে রাজার সুখ, প্রজার হিতেই রাজার হিত, রাজার নিজের প্রিয় জিনিস বা কার্য হিত নয়, প্রজার প্রিয়ই হিত। এ কথা ভেবেই চালাতে হবে রাজাকে তার রাজ্য।

কৌটিল্য ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর লোক। তবে কৌটিল্য যা বলেছেন, মনে করা যায় রাজ্য শাসনের এই ধারণা, তার অনেক আগে থেকেই এই উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। কৌটিল্য একটি প্রচলিত প্রাচীন ধারণাকেই বিবৃত করেন নতুন করে। অনেকের ধারণা, প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকেরাই রাষ্ট্র বা রাজ্যের স্বরূপ নিয়ে ভেবেছেন। কিন্তু তা বোধ হয় নয়।

অনেক দেশেই, অনেক রাজ্যেই চিন্তক ব্যক্তিরা রাজ্য ও রাজ্য শাসন সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। আমরা ভুলে যাই আলেক্সান্ডার (ইসকান্দার শাহ) পারস্য জয় করার অনেক আগেই পারস্যের প্রাচীন রাজা জয় করেছিলেন গ্রিস অঞ্চল। আর আলেক্সান্ডারকে ঠিক বলা যায় না গ্রিক সভ্যতার পতাকাবাহী। কেননা তিনি ছিলেন ম্যাসেডোনিয়ার রাজা। আলেক্সান্ডারের পারস্য জয়ের অনেক আগেই পারস্য থেকে রাজ্য ও রাজ্য শাসনসংক্রান্ত ধারণা গিয়ে পৌঁছেছিল প্রাচীন গ্রিসে। পারস্য ও ভারতের চিন্তাচেতনার মধ্যে প্রাচীন যুগে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সে কথাও মনে রাখতে হয়। এমনিতেও ইতিহাসে আমরা দেখি, এশিয়ার গ্রিকরা ইউরোপের গ্রিকদের আগে হয়ে উঠেছিল সুসভ্য। এশিয়ার এই গ্রিক অঞ্চলকে বলা হতো ইউনান (আইওনিয়া)।

‘রাজা’ শব্দটি সংস্কৃত। রাজা শব্দের একটি অর্থ ছিল শ্রেষ্ঠ। একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে একটি অঞ্চলের লোকে রাজা বা শাসক নির্বাচিত করতেন। প্রথমে রাজারা ছিলেন বিভিন্ন অঞ্চল বা রাজ্যের জনসম্মতির মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তি। রাজার ছেলেই যে কেবল রাজা হতেন এমন নয়। রাজার ছেলে রাজা হওয়ার প্রথা অনেক নৃতাত্ত্বিকের মতে, উদ্ভূত হয়েছে অনেক পরে। অর্থাৎ প্রথমে শুরু হয়েছে প্রজাতন্ত্র, আর তারপর এসেছে যাকে আমরা এখন বলি রাজতন্ত্র। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, গৌতম বুদ্ধের পিতার কথা। গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন্মেছিলেন বর্তমান নেপাল রাষ্ট্রের লুম্বিনিতে। গৌতম বুদ্ধের পিতাকে বলা হয়েছে লুম্বিনির রাজা। তিনি ছিলেন জননির্বাচিত। লুম্বিনি ছিল একটা গণরাজ্য। গণ বলতে বোঝায় যা গণনা করা যায়। মানুষের ভোট গণনা করা যায়।

একইভাবে বর্তমান দক্ষিণ বিহারের বৈশালি নগর ছিল একটি গণরাজ্য। গ্রিক নগর রাজ্য বা রাষ্ট্রকে বলা হতো পলি। যা থেকে উৎপন্ন হয়েছে ইংরেজি Politics শব্দটি। Politics শব্দের আমরা এখন বাংলা করি রাজনীতি। অর্থাৎ রাজ কর্তৃক অনুসৃত নীতি। কিন্তু অতীতে কেবল রাজার ছেলে রাজা হয়নি, রাজা হয়েছেন জনসম্মতির মাধ্যমে। উত্তর ভারতের অনেক ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও দুটো শব্দ প্রচলিত আছে, একটি শব্দ হলো- ‘সভা’ আর একটি হলো ‘সমিতি’। মানুষ সভা করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। সমিতিকে বলা যায় এমন সংগঠন, যা সভার সিদ্ধান্তকে দিয়েছে রাষ্ট্রিক আইনি রূপ। অর্থাৎ গণতন্ত্রের ধারণাকে একেবারেই আধুনিক ধারণা বলে মনে করার কারণ নেই। এর একটি জন্মমূল নিহিত আছে সুদূর অতীতের মধ্যে।

মহাভারত একটি কাব্যগ্রন্থ, কিন্তু এর মধ্যে বিপিত হয়েছে নানা রাষ্ট্রিক ধ্যানধারণাও। যেমন- মহাভারতে বলা হয়েছে, রাজা কংস ছিলেন একজন অত্যাচারী রাজা। তিনি অত্যাচারী ছিলেন বলে তার রাজ্য শাসন টেকেনি। শ্রীকৃষ্ণ তাকে হত্যা করেছিলেন। অত্যাচারী রাজাকে বিধাতা অবতাররূপে অবতীর্ণ হয়ে যুগে যুগে হত্যা করেন, এ রকম ধারণা এ দেশে প্রচলিত ছিল। তবে বিধাতাই যে অবতাররূপে এসে অত্যাচারী রাজাকে হত্যা করেন, এমন ধারণা সব সময় মানুষ বিশ্বাস করেনি। প্রজারাও অনেক সময় তাই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে করেছেন অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মহাভারতে ভীষ্ম বলেছেন, ‘যিনি প্রজা রক্ষার আশ্বাস দিয়ে রক্ষা করেন না, সেই রাজাকে ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত।’ আমাদের ইতিহাসে দেখি প্রজারা অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন।

এর একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো : দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বের সময় সংঘটিত প্রজা-বিদ্রোহ। কেননা রাজা দ্বিতীয় মহীপাল হয়ে উঠেছিলেন অত্যাচারী। এই বিদ্রোহ ঘটেছিল প্রায় হাজার বছর আগে। এই স্মৃতি ধারণ করে আছে বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাট জেলার ধীবরদীঘি নামক বিরাট এক দীঘির মধ্যে স্থাপিত কৈবর্ত স্তম্ভ। স্তম্ভটি গ্রানাইট পাথরের; যার উচ্চতা ১২ মিটার (৪১ ফুট) প্রায়। আর যার ব্যাস ছিল ১০ ফুট বা ৩ মিটার। এর উপরি ভাগ পুষ্পস্তবকের নকশা শোভিত। স্তম্ভটি হয়ে আছে এখনো একটি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন। বাংলাদেশের মানুষ অত্যাচারের কাছে মাথা নত করতে চায়নি। করেছে বিদ্রোহ। জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চেতনা গণমানুষের মধ্যে ছিল, আর সম্ভবত তা এখনো আছে। অতীতে বিদ্রোহ রেখেছে স্বৈরশাসনকে যথেষ্ট সীমিত করে। বিদ্রোহ অনেকের কাছে এখন মনে হচ্ছে সন্ত্রাস। কিন্তু ‘অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পবিত্র অধিকার সর্বসাধারণের আছে’- এটাই হলো ফরাসি বিপ্লবের সময় ঘোষিত বিখ্যাত মানবাধিকারের অন্যতম ধারা। যেটাকে বলা চলে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বারা সমর্থিত।

রাজনীতির অন্যতম গোড়ার কথা হলো, কে আমাকে শাসন করবে? আর আমি কেন তার শাসন মেনে চলব? মানুষ ততক্ষণই কোনো শাসনকে মানতে চায় যতক্ষণ সে সেই শাসন দ্বারা হতে পারে উপকৃত। আর সে তখনই বিদ্রোহ করে, যখন কোনো শাসন তার জন্য হয়ে ওঠে অত্যাচারের নামান্তর। অবশ্য শাসন ও স্বাধীনতার মধ্যে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে মানুষের কতটা শাসন, কতটা স্বাধীনতা তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। আর এখনো আছে; থাকবেও। বিলাত এখন একটা আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু বিলাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একসময় রাজার মাথা কাটতে হয়েছিল। বিনা রক্তপাতেই সে দেশে যে গণতন্ত্র স্থাপিত হতে পেরেছে, এ রকম দাবি করা যায় না। লর্ড প্রটেক্টর কমনওয়েলথের অভ্যুত্থান বিলাতের গণতন্ত্র স্থাপনে অবদান রেখেছে। এটি কেবলই সন্ত্রাস বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছিল যুদ্ধের মাধ্যমে। যদিও এই যুদ্ধকে একদিন বেআইনি বলেছিল গ্রেট ব্রিটেন।

অতীতে অনেক আদর্শ রাজাও ছিলেন। এ দেশে যাদের আদর্শ রাজা বলে মনে করা হয়, তাদের মধ্যে একজন হলেন রাজা হর্ষবর্ধন। তিনি রাজা হয়ে প্রজাদের ওপর করের বোঝা কমিয়েছিলেন। ভালো রাজারা অতীতে প্রজাদের ওপর যদ্দূর সম্ভব কম কর অরোপ করেছেন। সাধারণত এ দেশের রাজারা কৃষক প্রজার কাছ থেকে তাদের জমিতে উৎপাদিত ফসলের চার ভাগের এক ভাগ রাজস্ব হিসেবে গ্রহণ করতেন। কিন্তু রাজা হর্ষবর্ধন গ্রহণ করেছেন উৎপাদিত ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। হর্ষবর্ধনকে এ দিক থেকে তাই বলা চলে একজন ভালো রাজা। হর্ষবর্ধন তার রাজ্যে পথঘাটের উন্নতি ঘটান। স্থাপন করেন পথিকদের জন্য ধর্মশালা। এই ধর্মশালাগুলোতে পথিকেরা বিনামূল্যে খেতে ও থাকতে পেতেন। অসুস্থ হলে পেতে পারতেন চিকিৎসাসেবা। হর্ষবর্ধন নিজে তার রাজ্যের নানা স্থানে ঘুরে দেখতেন রাজকর্মচারীরা কিভাবে প্রজা শাসন করছেন।

রাজকর্মচারী দ্বারা প্রজারা অত্যাচারিত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই সতর্ক। তিনি দেশে শিক্ষা প্রচারের জন্য ব্রাহ্মণদের স্থাপিত টোল ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের স্থাপিত সঙ্ঘকে দিয়েছেন আর্থিক অনুদান। হর্ষবর্ধন যদিও প্রথম জীবনে ছিলেন হিন্দু, কিন্তু পরবর্তী জীবনে হয়ে উঠেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত। তিনি পশু নিধন ও মৎস্য ভক্ষণ করেছিলেন নিষিদ্ধ। তিনি কেবল একজন রাজাই ছিলেন না, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক। তিনি সংস্কৃত ভাষায় তিনটি নাটক রচনা করেন। যার নমুনা এখনো পাওয়া যায়। এ হলো অতীতের একজন আদর্শ রাজার চিত্র, যাকে বর্তমান যুগের শাসকেরাও করতে পারেন অনুসরণ। আমরা অতীত ইতিহাসের কথা এখানে বলছি, কারণ আমাদের দেশে অনেক চিন্তক ব্যক্তি রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে অনেক কথা বলছেন। তবে তারা তা বলছেন কেবলই ইউরোপের ইতিহাসের সূত্র ধরে। নিজের দেশের প্রাচীন ইতিহাসের সূত্র ধরে নয়।

দৈনিক নয়াদিগন্ত এ প্রকাশিত, ২০১৮ সালে।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ