[সংগ্রহ ও ভূমিকা : শাহাদাৎ সরকার। এবনে গোলাম সামাদ (১৯২৯-২০২১) রচিত “ফরাসি জীবন, ফরাসি চিন্তা” লেখাটিতে ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের ছবি। ষাটের দশকে এবনে গোলাম সামাদ উচ্চতর গবেষণার জন্য ফ্রান্সে অবস্থান করছিলেন। সেই সময়ের ফ্রান্সের সামাজিক রাজনৈতিক জীবন এবং দার্শনিক জগতের রূপান্তর তুলে ধরেছেন। ফারসি রাষ্ট্র গঠনে দাগোলের ভূমিকা এবং দাগোলের সিদ্ধান্তের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বিশ্লেষণ করেছেন। লেখাটিতে তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। এই লেখাটি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত মাসিক সমকাল পত্রিকার চতুর্থ বর্ষ, দশম সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৮-এ প্রকাশিত হয়।]
এ যুগের কোন নামি দার্শনিক বলেছেন : কোন কিছুকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া মানে অপরিচিতকে পরিচিতের মাধ্যমে ব্যক্ত করা। ইউরোপের একটা দেশকেই আমরা বিশেষ করে চিনি, বিলাত। তাই আর কোন দেশের কথা, বিশেষ করে ফ্রান্সের কথা বলতে গেলে বিলাতের কথা আপনা থেকেই এসে পড়ে।
বিলাতের সাথে ফ্রান্স-এর তফাৎটা অনেকদিকের। অনেকে অনেক ভাবে এই পার্থক্যের ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু বিলাত আর ফ্রান্সের মধ্যেকার পার্থক্যের একটা বড় কারণ ভূগোল, অন্যটি অর্থনৈতিক জীবন। বিলাত আর ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংগঠন এক নয়-এক নয় জীবন। দ্বীপবাসী ইংরেজ বুঝেছে বাণিজ্য, গড়েছে প্রথম কলকারখানা, হয়েছে আধুনিক ইতিহাসের বুকে প্রথম শিল্প-বিপ্লবের দেশ। ভাল কয়লা আর লোহা খুব কাছাকাছি থাকাতে এবং উদ্ভাবনী মানুষের আবির্ভাবে বিলাত হয়ে ওঠে সারা পৃথিবীর কারখানা গৃহ। কিন্তু ফ্রান্সে শিল্প বা কারখানার বিপ্লব আসে অনেক পরে। ফ্রান্সের প্রায় অর্ধেক লোক এখন কৃষিজীবি। আর এই কৃষি-জীবন সবক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়ে থাকা নয়। কারখানার তালে তালে চলেনি ফরাসি জীবন। ফরাসিরা হয়ে ওঠেনি সেভাবে যান্ত্রিক আর ক্ষিপ্র। ইংরাজদের তুলনায় ফরাসিদের অপেক্ষাকৃত শ্লথ জীবনধারার সাথে আমাদের অনেক বেশী মেলে, এর একটা গোড়ার কারণ বোধহয় আমাদের ভূমি-নির্ভরতা।
বিলাতের মানুষ আর ফ্রান্সের মানুষ একভাবে এগোয় নি। বিলাতের ইতিহাস আর ফরাসি ইতিহাস এক পর্যায়ে পড়ে না। যদিও বা ভোলতের আর মঁতেস্কু-র মত প্রথম শ্রেণীর ফরাসি চিন্তানায়করা রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রকারান্তরে বিলাতকেই করতে বলেছেন আদর্শ। ফরাসি জাতির ইতিহাস, একটি আবেগ-প্রবণ জাতির ইতিহাস। দার্শনিক জন লক-এর দেশ বিলাত। বিলাতের মানুষকে বলা যায় বিশেষ অর্থেই এমপেরিক্যাল। অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চিন্তা করেছে ইংরাজ। অন্যদিকে দার্শনিক ডেকার্ত-এর দেশ ফ্রান্সের মানুষ চেয়েছে আদর্শের ভিত্তিতে সবকিছু ভাবতে। আদর্শে আর বাস্তবে মেলেনি। ফলে জেগেছে দ্বন্দ্ব, জেগেছে তীব্র সংঘাত। সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ফরাসি জীবন আর চিন্তা।
সব ক্ষেত্রেই ফরাসিরা চিন্তা করতে চেয়েছে আদর্শঘেষা ভাবে। সব কিছুর মধ্যেই দিতে চেয়েছে একটা আদর্শগত রূপ। বিলাত সাম্রাজ্যকে বলেছে সাম্রাজ্য। কিন্তু ফরাসিরা সাম্রাজকে বলতে চেয়েছে সাগর পারের ফ্রান্স – “ফ্রঁস উৎব-মের” (France’ outre-mer)। প্রচার করেছে, একদিন এসব জায়গার মানুষ মিলে গড়ে উঠবে এক বৃহত্তর ফ্রান্স। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কি করেই বা হবে। ক’দিন আগেও আলজিরীওরা উচ্চ সরকারী চাকরী পেত না। ফরাসিদের চাপে আলজিরিও কৃষকদের সরে যেতে হয়েছে দক্ষিণের দেশে। যেখানে ভূমি অপেক্ষাকৃত অনুর্বর। একজন আলজিরিও কৃষকের বাৎসরিক আয় দাঁড়িয়েছে আলজিরিয়ার একজন ফরাসি কৃষকের বাৎসরিক আয়ের শতকরা তিন ভাগ মাত্র। আজ আলজিরিয়ানরা যখন স্বাধীন হবার মুখে, তখন অনেক ফরাসি অবাক হয় ফ্রান্সের সাথে তার সব রকম সম্পর্কছেদ করে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী শুনে। ভাবে কি অকৃতজ্ঞ আলজিরীয়রা। ফ্রান্সের কাছ থেকে পেল জ্ঞানের আলো, পেল কৃষ্টি, চিনল জগৎকে ; আর আজ সেই কৃষ্টি-ভূমি ফ্রান্সের প্রতি এত বিতৃষ্ণা! অকৃতজ্ঞ আর কাকে বলে! নাপলেয়াঁ আপেক্ষ করেছিলেন, ইউরোপ তাকে ভুল বুঝল বলে। তার আদর্শ ছিল সারা ইউরোপকে একত্র করে এক জাতি, এক প্রাণ গড়া।
ফরাসিদের আদর্শ আর জীবন সমছন্দে গড়ে ওঠেনি। ফরাসিরা ভুগেছে স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র আর ক্যথলিক চার্চের শোষণ ও শাসনে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে এক অদম্য পূর্ণ স্বাধীনতার আকাঙ্খা। সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা পেতে গিয়ে দেখা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি অরাজকতা। চতুর্থ রেপুবলিক ভেঙ্গে আজ জন্ম নিয়েছে পঞ্চম রেপুবলিক। অথচ ফ্রান্সের সমস্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম জটিল। আয়তনে ফ্রান্স গ্রেটবৃটেনের দ্বিগুণ কিন্তু জনসংখ্যায় কম। অথচ লোকের অবস্থা বিলাতের তুলনায় স্বচ্ছল, এমন নয়। ফ্রান্সের জমি খুবই উর্বর, এছাড়া আছে খনিজ ফসফেট। ফ্রান্সে লোহার অভাব নেই। যদিওবা ভাল কয়লার অভাব আছে। কিন্তু জলবিদ্যুতকে কাজে লাগাতে পারা যায় অনেক সহজে। ফ্রান্সে যে বকসাইট আছে তাকে কাজে লাগান যায় অনেক ভাল ভাবে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে ফ্রান্স আজ পড়েছে ইউরোপের অনেক দিক থেকে পিছিয়ে।
যাঁরা মনে করেন আজকের পৃথিবীর অর্থনৈতিক সমস্যার প্রধান কারণ হল জনসংখ্যার চাপ। ফ্রান্স তাদের কথাকে বোধহয় মিথ্যা করে দেয়। ফ্রান্স আমাদের অনেক প্রচলিত ধারণাকেই দেয় বাতিল করে। অনেকে মনে করেন প্রাচ্যের দেশগুলিতে গণতন্ত্র অচল। কারণ, জনশিক্ষার অভাব। কিন্তু ফ্রান্সের ক্ষেত্রে সে-কথা খাটে না। প্রাপ্ত বয়স্ক সবলোক এ দেশে লিখতে পড়তে জানে। কিন্তু তবু আইন সভায় এ দেশেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি হট্টগোল-আজ প্রয়োজন করেছে শক্তিমান নেতা দ্য গোল-এর।
ফরাসিরা জীবন, রাষ্ট্র, সমাজ এসব নিয়ে তর্ক করেছে প্রচুর। কিন্তু বাস্তব জীবনে বারে বারে জড়িয়ে পড়েছে নানা বিরোধের গোলক ধাঁধায়। এর ফলে ফরাসি দেশে দেখা দিয়েছে বুদ্ধিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। এই শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসি দার্শনিক বের্গস ঘোষণা করেন : বুদ্ধি দিয়ে শেষ অবধি বাস্তবতাকে বোঝা যায় না। বুঝতে হয় বোধ দিয়ে। সত্য শেষ অবধি হৃদয় দিয়ে হৃদির ব্যাপার। জীব-বিবর্তন সম্বন্ধে তিনি নূতন মত খাড়া করতে চান। বলেন : জীবন স্বাধীন আদ্য শক্তির বা এলঁ ভিতাল-এর বিভিন্ন ধারায় বিচিত্র প্রকাশ মাত্র। জীবন, প্রাণীজগৎ, আপনার গুণে আপনি বিকশিত। পরিবর্তন এক অপরিহার্য সত্য-তাকে বোঝার জন্যে তর্কের প্রয়োজন হয় না। আজ আর এ-মত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু এ-দর্শনের মধ্যে ফরাসি জীবনের একটা বিশেষ প্রবণতাকে যেন খুঁজে পাওয়া যায়। ভাবনাকে এরা অনেকেই সরিয়ে রাখতে চায় দূরে-ভাবে কি হবে অত ভেবে! জীবন হোক আপনা হতে আপনাতে বিকশিত-তার সহজ ধারা অনুসরণ করে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ফ্রান্সে অস্তিত্ববাদ (Existentialism) প্রাধান্য পায়। অস্তিত্ববাদকে কয়েক কথায় গুছিয়ে বলা যায় না। আসলে এটা কোন গোছাল দর্শন নয়। অস্তিত্ববাদ এই নামটাকে ঘোলাটে মনে হয়। নানা দেশের নানা সময়ের নানা বয়সের দার্শনিককে ফেলবার চেষ্টা হয় এ-দলে। শুধু দার্শনিক নয় দস্তইয়েবস্কি, রিলখ (Rilke), কাফকা-র (Kafka) মত সাহিত্যিককেও ফেলা হয়ে থাকে অনেক সময় এই দলে। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মধ্যে যে ঐক্যটুকুকে সাধারণ ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে বলা যায় এক তীব্র ব্যক্তিবাদ (Individualism)। আর বিশেষ করে সনাতন দর্শনের প্রতি বিতৃষ্ণা। এ-দলের অনেকে আস্তিক। আবার অনেকে নাস্তিক। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের সবার কাছে সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে মানুষ আর তার ব্যক্তি-অস্তিত্ব। তাঁদের মতে মানব-অস্তিত্বের সকল দায়িত্ব মানুষের, ব্যক্তি মানুষের। শেষ অবধি এই বিশ্বে মানুষ শুধু নির্ভর করতে পারে তার ব্যক্তি-শক্তির উপর।
এই ব্যক্তিবাদী দর্শনের জনক বলে সাধারণত যাঁকে ধরা হয়, তিনি হলেন গত শতাব্দীর দিনেমার দার্শনিক কিয়েরকগির (Kierkegaar)। কিয়েরকাগর ছিলেন খৃষ্টধর্মে বিশেষ বিশ্বাসী। তার মতে প্রকৃত খৃষ্টান সেই যে মনে করে তার নিজের জীবনের জন্যে সে নিজেই ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী। যে মানুষকে ভালবাসে আদর্শগত ভাবে নয়Ñ ভালবাসে ব্যক্তি হিসাবে। প্রতিবেশীকে ভালবাসে বলে ক্ষান্ত হয় না-ব্যক্তিগত ভাবে প্রতিবেশীর কাছে এগিয়ে যায় তাকে সাহায্য করবার জন্যে। মানুষ তার জীবনে ব্যর্থতা আর কৃত্রিমতা ডেকে এনেছে কথার ফানুষ তৈরি করে। বড় আদর্শের বুলি সৃষ্টি করে। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে মানুষের কথা ভাবতে যেয়ে। যখন আমরা বলি মানুষকে ভালবাস, তখন আমরা ভুলে যাই আসল মানুষের কথা, ব্যক্তি মানুষের কথা। ফলে ব্যক্তি থেকে যায় অবহেলিত; কিন্তু আদর্শকে মনে হয় খুবই উজ্জ্বল। এ যেন এক আলেয়ার পিছে ছোটা।
প্রতিটি মানুষকে নিতে হবে তার আপন দায়িত্ব। বেছে নিতে হবে পথ। যেমন নিয়েছিলেন খৃষ্ট। পিছু হটেন নি ব্যক্তি হিসাবে; সত্য বলে যা জেনেছিলেন তার জন্যে জীবন দিতে। খৃষ্ট জীবন দিয়েছিলেন ব্যক্তি হিসাবে-সমষ্টির অংশ হিসাবে নয়। তাই খৃষ্ট সত্য; তাই তিনি মহান। আমরা জনকল্যাণের জন্যে সম্পাদকীয় লিখি। কিন্তু যা কিছু লিখি ব্যক্তিগত ভাবে তা পালন করতে যাই খুব কম। আর এর ফলে বাড়ে সুন্দর কথার কলেবর। মানুষের চেয়ে মানুষের কথা হয়ে ওঠে অনেক সুন্দর। মায়ার প্রাচীর। আমরা ভুলে যাই আমাদের অস্তিত্বের রূপ নির্ভর করে আমাদের অর্থাৎ ব্যক্তি হিসাবে আমাদের চেষ্টার উপর। সমষ্টির কথা বলতে গিয়ে আমরা নিই মিথ্যার আশ্রয়। আমাদের ব্যক্তিদায়িত্বকে করি অবহেল। আসল সত্য সমষ্টির মধ্যে নেই, আছে ব্যক্তি হিসাবে প্রতিটি মানুষের মধ্যে। প্রতি ব্যক্তির আপন চেষ্টায় ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তির মধ্যে ব্যক্তি একটা পরম সত্য, মানব অস্তিত্বের প্রথম সত্য। ব্যক্তিকে গ্রহণ করতে হবে সত্য বিচারের একটি প্রাথমিক পরিমাপক বা ‘ক্যাটিগোরি’ (catego) হিসাবে।
মানব জীবনের প্রকৃত সমস্যা পছন্দ করবার সমস্যা। কোন পথে সে ব্যক্তি-হিসাবে চলবে তার সমস্যা। এ সমস্যা শেষ অবধি ব্যক্তির-ব্যক্তিকে নিতে হবে এর সমাধানের ভার। এ কথার অর্থ এই নয় যে, মানুষের দায়িত্ব কেবল মাত্র তার নিজেকে ঘিরে। অন্যের প্রতি তাঁর কর্তব্য অবশ্যই আছে। কিন্তু এ কর্তব্য পালনের দায়িত্বও তার একান্ত ভাবে নিজের।
হেগেল রাষ্ট্রকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সবার উর্ধ্বে। হেগেল বলতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের উন্নতিতেই ব্যক্তির সার্থকতা। কিয়েরকাগর ছিলেন এর বিরোধী। ব্যক্তি রাষ্ট্র বা সমাজের অংশ হিসাবে সত্য নয়Ñসত্য ব্যক্তি হিসাবে। একথা ভুলে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রগতির কথা বলার অর্থ ব্যক্তি মানুষকে অবহেলা করা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন গুটিকয় ব্যক্তির সাথে অন্যদের বলিদান করা। কিয়েরকাগর-এর বিদ্রোহ হেগেলের বিরুদ্ধে। সনাতন দর্শনের বিরুদ্ধে-যা মানব অস্তিত্বের সাথে সম্বন্ধবিহীন সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত। কিয়েরকাগর-এর দর্শনের অন্যান্য কতগুলি বিশেষ দিক সাড়া জাগায় জার্মান দার্শনিক মার্টিন হিডগের (Martin Heidegger) আর জাপার (Jasper)-এর চিন্তায়। কিন্তু অস্তিত্ববাদ বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করে ফরাসি সাহিত্যিক-দার্শনিক জাঁ পল র্সা তর (Jean Paul Sartre)-এর চেষ্টায়।
সারতর-এর মতে, আমরা প্রধাণত দু-ধরনের বাস্তবতার সাক্ষাৎ পাই। এক ধরনের অন্যটিকে তিনি বলেছেন বাস্তবতাকে তিনি অভিহিত করেছেন অঁ-সোয়া (en-soi) বলে। অন্যটিকে তিনি বলেছেন পুর-সোয়া (Pour soi)। অঁ-সোয়া বলতে বোঝায় সেই সব সত্য যা নিজেই সত্য। যেমন একটা টেবিল বা চেয়ারের বাস্তবতা। কিন্তু পুর-সোয়া বলতে বোঝায় যা নিজের চেষ্টায় সত্য। এ জিনিসটি মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। যেমন কোন মানুষকে আমরা জানি সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে। এই সঙ্গীতজ্ঞ রূপ সত্যটি টেবিল চেয়ারের মত সত্য নয়-এটা একটি ব্যক্তি মানুষের চেষ্টাকৃত অর্জন। মানুষের অনেক দিক আছে যা টেবিল চেয়ার কি একটা চার কোণা পাথরের মতই সত্য। যখন বলি একজন মানুষ পাঁচ ফিট লম্বা, তখন এই সত্যের মধ্যে সেই ব্যক্তির কোন কৃতিত্ব নেই। এসত্য অঁ-সোয়া পর্যায়ের। অর্থাৎ মানবিক বিশেষ সত্যগুলো মানুষের ব্যক্তি চেষ্টায় অর্জিত। মানুষ তাই যেভাবে নিজেকে গোড়ে তোলে তার অস্তিত্বের সার্থকতা নির্ভর করে সেই গড়ে তুলতে পারবার উপর। ব্যক্তি-কর্ম দিয়েই ব্যক্তি পরিচয়। তাই ব্যক্তিকেই শেষ পর্যন্ত নিতে হবে তার আপন দায়িত্ব, নৈতিক দায়িত্ব। একে বাদ দিয়ে কোন মানব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে : যখন কেউ কোন পথ বেছে নেয় তখন কেবলমাত্র নিজের জন্যেই যে নেয় এমন নয়। সে যদি সঙ্কটের দিনে তার মানব-দায়িত্বের উপর ভিত্তি করে পথ না বাছে, তবে বুঝতে হবে সে কাপুরুষতার পরিচয় দিচ্ছে মাত্র। ভীরুতার জন্যে সে চেপে রাখছে আপন ইচ্ছাকে। মানবিক সত্য তার মধ্যে থেকে লোপ পাচ্ছেÑসে হয়ে উঠছে টেবিল চেয়ারের মতই সত্য। সারতর-এর মতে বিধাতা নেই। আর নেই বলেই মানুষকে নিতে হবে তার নিজেকে গড়ে তুলবার সমস্ত ভার।
সারতর-এর মতের উপর আছে ফরাসি জীবনের বিশেষ অবস্থার ছাপ। অনেকে তাঁর মতকে বিশ্লেষণ করতে যেয়ে বলেছেন গত মহাযুদ্ধে জার্মান কতৃক অবিষ্কৃৃত ফ্রান্সের অবস্থার কথা। এ সময় সারা ফ্রান্স জুড়ে চলেছে জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন। সারতার যুদ্ধ করেছেন হিটলারের বিরুদ্ধে। বন্দী হয়েছেন, ছাড়া পেয়েছেন। অধিকৃত বিজিত ফ্রান্সের অবস্থা এ সময় ছিল অন্য রকম। জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে অনেককেই-কোন পথে সে চলবে। ব্যক্তির দায়িত্ব আর পৌরুষ এখানে হয়ে উঠেছে বড় কথা। ব্যক্তি-সিদ্ধান্ত হয়েছে অনেক মূল্যবান। কিন্তু এখন আর আগের পটভূমি নেই। কোন আন্দোলন আর গোপনে করবার নয়। আত্মগোপন করে থাকতে হয় না কাউকে। নিতে হয় না মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়িয়ে কোন সিদ্ধান্ত। সারতর-এর চিন্তাধারা আজ অনেক ভাবেই বদলে গেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন বিশেষ ভাবে বামপন্থীÑশ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থার গোঁড়া সমালোচক। সম্প্রতি তিনি খবরের কাগজে কিউবার উপর একটা লম্বা প্রবন্ধ লিখেছেন। তার বক্তব্য : কাসত্রর পদ্ধতি যাই হোক, কাসত্র হচ্ছেন কিউবার সন্তান। কাসত্রর মনে আছে কিউবার দেশ প্রেম আর কল্যাণ কামনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্ষেত্রে দেবার কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি অভিহিত করেছেন ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদ বলে। কিছু দিন আগে তিনি আলজিরিয়ায় পূর্ণ স্বাধীনতার সমর্থনে বিবৃতি দিয়ে হন কর্তৃপক্ষের বিরাগ ভাজন। সারতরকে মনে করা হয় বর্তমান ফরাসি মানসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।
ক’দিন খুবই চাঞ্চল্যে কাটল। আলজিরিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে আমার মনে জেগেছিল এই চাঞ্চল্য। পারি-র জীবন কিন্তু চলেছিল খুব স্বাভাবিক ভাবে। কোথাও ছিল না বিন্দুমাত্র ভীতিকাতরতার ছাপ। সারা ফ্রান্স সমর্থন জানিয়েছিল প্রেসিডেন্ট-দ্যগোল’কে। ফ্রান্সের একটা বিরাট রাজনৈতিক সঙ্কটের অবসান হ’ল। কিন্তু ফরাসি জীবন থেকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদায় নিল এমন বলা যায় না। ফ্রান্সের বর্তমান পঞ্চম রেপুবলিকের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এখন সংশয় বিহীন ভবিষ্যৎবাণী করা যায় না। পঞ্চম রেপুবলিক দাঁড়িয়ে আছে দ্যগোল-এর ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে। অনেক সমস্যার সমাধান হয়নি-কিন্তু ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ব্যক্তিত্বের আড়ালে। পঞ্চম রেপুবলিকের সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আগে, অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ রেপুবলিকে প্রেসিডেন্টের প্রভাব (influence) ছিল, কিন্তু ক্ষমতা (power) ছিলন। কিন্তু বর্তমানে প্রেসিডেন্টের হাতে আছে জাতীয়সভা (National Assembly) বাতিল করবার ক্ষমতা। বৈদেশিক চুক্তি করবার ক্ষমতা। সামরিক বাহিনীকে হুকুম দেবার ক্ষমতা। কোন কার্য নিয়মতান্ত্রিক হচ্ছে কিনা এটা বিচারের জন্যে সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ কমিটি। এ কমিটিতে তিন ভাগের একভাগ লোক নিয়োগের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের। যে কোন বিষয় গণভোটে দেবার অধিকারও আছে প্রেসিডেন্টের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গণভোটের নীতি গ্রহণ করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটির সদস্য, বিশেষ প্রতিনিধি ও স্থানীয় কর্মচারীদের। অন্যদিকে সরকার থেকে গেছে পার্লামেন্টারি। জাতীয় সভায় যিনি সংখ্যা গুরু হবেন, তিনি নেবেন মন্ত্রি সভা গঠনের ভার। প্রধান মন্ত্রি চালাবেন রাষ্ট্র। অন্যদিকে সিনেটও আছে। তবে সিনেটের ক্ষমতা আগের মত নেই। সিনেটের আইন জাতীয় সভায় পাস হলে তবেই হবে আইনে পরিণত। জাতীয় সভার রায় এ বিষয়ে হবে সবার উপর গ্রাহ্য। অর্থাৎ ক্ষমতা হয়ে গেছে দু’ভাগে বিভক্ত। জাতীয় সভা আর প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে দ্যগোলের কথায় সব হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে সৃষ্টি হতে পারে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সৃষ্টি হতে পারে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। আসতে পারে ক্ষমতাপরায়ণ প্রেসিডেন্টের স্বেচ্ছাচার। কিন্তু এখন আপাতত সব কিছুই চলেছে ভাল ভাবে।
জার্মান সমাজতাত্বিক ভেবের (Weber)-এর মতে একধরনের নেতা আছেন যাঁদের বলা যায় “বিমুগ্ধকারী” বা ক্যারিজমাটিক (Charismatic)। এসব নেতাদের মধ্যে থাকে এমন এক ক্ষমতা যা বহু মানুষকে সহজেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে। এসব নেতা এমন সব সঙ্কটে জনসমর্থনে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন যা অন্যের পক্ষে কখন সম্ভব হয় না। কিন্তু এমনি নেতৃত্বকে সাধারণ ভাবে স্থায়ী বলা যায় না। সময়ের স্রোতে এই মুগ্ধকারী ক্ষমতা বা ক্যারিজমা (Charisma) ক্ষয় প্রাপ্ত হতে থাকে। কিন্তু যদি এই ক্ষমতা অটুট থাকে, তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুর পর তাঁর স্থান কে পূরণ করবে। ক্যারিজমাটিক (Charismatic) নেতৃত্ব তাই কোন রাষ্ট্রকে স্থায়ী নিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দিতে পারে না। স্থায়ী নিশ্চয়তা আসা সম্ভব কেবল মাত্র প্রতিষ্ঠান-মূলক (institutional) গণতন্ত্রের মারফত। ভেবের (Weber)-এর মতে ক্যারিজমাটিক নেতৃত্ব থেকে প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক গণতন্ত্র গড়ে ওঠা কঠিন নয়। যদি ক্যারিজমাটিক তাঁর শাসনে জনমত প্রকাশের এবং মুক্ত নির্বাচন (free election) বাধা না দেন। তিনি নিজেই যদি জনসাধারণকে সুযোগ দিয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সাহায্য করেন তবে অনেক সহজে একটা জাতির জীবনে সত্যিকার প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক গণতন্ত্র সহজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অনেকে দ্যগোল-এর নেতৃত্বে আশাপ্রদ ভবিষ্যতের প্রকাশ দেখেছেন। অনেকে আবার দেখাচ্ছেন সংশয়। পঞ্চম রেপুবলিক নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন মার্কিন অধ্যাপক হারমেনস। তাঁর মতে ফ্রান্সের পক্ষে স্থায়ী সুস্থ গণতান্ত্রিক জীবনধারা লাভ অসম্ভব নয়। যদিও তার ইতিহাস এতকাল উলটো কথাই বলে এসেছে। এবং পঞ্চম রেপুবলিক-এর গঠনতন্ত্রের মধ্যে থেকে গিয়েছে অনেক দুর্বলতা। আসলে একটা দেশের গঠনতন্ত্রই সবকথা নয়। বড় কথা বাস্তব রাজনৈতিক আবহাওয়া। আজকের ফ্রান্সের রাজনৈতিক আবহাওয়া খুবই ভাল। অনেক মতের ঘূর্ণিঝড়ে নেচেছে রূপসী ফ্রান্স। পেরিয়ে এসেছে অনেক বিপ্লব আর যুদ্ধ। ফ্রান্সের ইতিহাস আমাদের মনে রোমাঞ্চ আনে এই কারণেই। কিন্তু আজ ফরাসি জীবন চায় রাজনৈতিক স্থিতি। যা তার অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যে বিশেষ ভাবেই কাম্য। তার দ্যগোলের প্রতি ঝুঁকে পড়বার মূল কারণ এইটিই।
জাতি হিসাবে আজ ফ্রান্সের ভাবনা : সে যেন আর সবার থেকে নিদারুণ ভাবে পিছিয়ে না পড়ে। তাই আজকের ফ্রান্সে পরমাণু নিয়ে গবেষণা অনেক জোর পেয়েছে। ফ্রান্সের মন সাহারায় সাধারণ পরমাণু বোমা ফাটিয়েও পাচ্ছে তৃপ্তি। ভাবছে, সে যেমন পিছিয়ে পড়ছিল আর সবার থেকে-এখন সে অবস্থা আর নেই।
পরলোকগত সাহিত্যিক আলবের কামু-র একটি বিখ্যাত নিবন্ধ আছে-সিসিপাসের রূপকথা। কামুর মতে গ্রীক রূপকথার সিসিপাস মানব চেষ্টার ব্যার্থতার প্রতীক। কিন্তু ব্যর্থতা সত্বেও সিসিপাস-এর চেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। কারণ, এই চেষ্টা দিয়েই মানুষের, তথা তার মানবিক অস্তিত্বের পরিচয়। ফরাসি দেশের মানুষ মানব সমস্যা নিয়ে যত বেশী মাথা ঘামিয়েছে অন্য কোন জাতি ঠিক ততটা ঘামায় নি। ফরাসি স্বাধীনতা, সমতা, সখ্যতার আদর্শ ছিল অনেক উঁচু। এই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতে গিয়ে সে হয়েছে বারে বারে ব্যর্থ-বোধ হয় সিসিপাসের মতই ব্যর্থ। কিন্তু কেবল এই ব্যর্থতা দিয়েই তার আগামী জীবনের পরিচয় পুনরায় রচিত হবে, এমন কথা বুঝি আর মনে করা যায় না।