ইমরান আহম্মদ খান নিয়াজি এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। অনুমিত হচ্ছে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে আসবে অনেক পরিবর্তন। আমরা তাই ভাবতে পারি, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ আসতে পারে। আর সেই সুযোগ গ্রহণ করা উচিত হবে বাংলাদেশের জন্য। ১৯৭০ সালে সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে উঠেছিল জয়বাংলা ধ্বনি।
কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির ঘটেছে পরিবর্তন। তখন বাংলাদেশ ছিল না একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু এখন সে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র। তখন লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু এখন লক্ষ্য হলো অর্জিত স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ। এই সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের বেছে নিতে হবে মিত্রদের। আর মিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে আমাদের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা। আজকের বাংলাদেশ ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত হয়ে হয়নি; হয়েছে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে।
সাবেক পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়াটাকে যদি আমরা ভারতের মতো মনে করি, হয়েছে অযৌক্তিক, তবে বাংলাদেশের পৃথক স্বাধীন অস্তিত্বের কোনো খড়পঁং ঝঃধহফর থাকে না। বাংলাদেশ পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে ঐতিহাসিকভাবে জড়িত। আর বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তেইশ বছর ধরে ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি রাষ্ট্র। ছিল জাতিসঙ্ঘের সদস্য। আমরা দেখলাম ভারত সেটাকে ভেঙে দিতে পারল। কিন্তু পারল না পাকিস্তান ভেঙে সৃষ্ট বাংলাদেশকে যেভাবে সে গ্রাস করতে চেয়েছিল সেভাবে গ্রাস করতে। এই না পারার কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে কথা দিয়েছিলেন তিনি যুদ্ধ করবেন না। আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পূর্ববঙ্গে (পূর্ব পাকিস্তান শব্দটা তিনি ব্যবহার করেননি) উদ্ভূত সমস্যার সমাধান চান। কিন্তু তিনি তার কথা না রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শে আরম্ভ করেন যুদ্ধ। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ৯ আগস্ট ১৯৭১ সালে হয়েছিল ২০ বছরের এক মৈত্রী চুক্তি। যা আসলে ছিল একটা সামরিক চুক্তি। যার বলে বলিয়ান হয়ে ইন্দিরা গান্ধী স্থির করেন পাকিস্তান আক্রমণের। ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর দিল্লির মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন যে, ভারত যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য প্রদানে নিবৃত্ত না হয়, তবে পাকিস্তান পশ্চিম দিক থেকে ভারতকে আক্রমণ করবে। ১৯৭১ সালে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের অমৃতসর, অবন্তিপুর, আম্বালা, আগ্রা, জোতপুর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, উত্তরলাই শহরে বোমাবর্ষণ করে। একই সাথে পাক-স্থলবাহিনী আক্রমণ করে ভারতের সুলেমানকি, খেমকারান, ছাম্ব এবং পুঞ্চ শহরে।
শুরু হয় ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধ। পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু সে সেটা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর নামে ভারতের পেশাদার সৈন্য পাঠানোর কারণে। ভারত এ সময় মুক্তি বাহিনীর কথা বললেও তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চায়নি। কেননা, ইন্দিরা গান্ধী মনে করেছিলেন মুক্তিবাহিনীকে বিশ্বাস করা যায় না। তাদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে চীনপন্থী কমিউনিস্টরা। তাদের হাতে অস্ত্র দিলে তা আসলে চলে যাবে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের হাতে। যা ভারতের জন্য হয়ে উঠবে এক মারাত্মক সমস্যা। ভারত পড়েছিল দোটানায়। তাই মুক্তিবাহিনীর নামে সে পাঠাচ্ছিল পেশাদার ভারতীয় সৈন্যকে।
এর আগে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই বলেছিলেন, বহিরাক্রমণ থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য গণচীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চীন সম্পর্কে ভারত কোনো স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছিল না। ভাবছিল চীন মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তাদের সমর্থকদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব তোলে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ওঠায়। এই প্রস্তাব বিপুল ভোটে গৃহীত হয়। কিন্তু ভারত তা মানতে রাজি হয় না। ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে যাত্রা করতে বলেন। ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের জন্য আরেকটি প্রস্তাব তোলে। কিন্তু এবারেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। মার্কিন সপ্তম নৌবহর এগিয়ে আসতে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। কলকাতায় গুজব রটে যে, মার্কিন মেরিন সৈন্যরা চট্টগ্রাম বন্দরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। এ কথাও কলকাতার ট্রামে বাসে অনেককে বলতে শোনা যায় যে, মার্কিন মেরিন সেনারা আসতে পারে কলকাতা দখল করতে। সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন আক্রমণভীতি। কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীরও মধ্যে। সিদ্দিক সালিক ছিলেন পাকিস্তান পূর্ব কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির পিআরও। তিনি তার লিখিত Witness to surrender বইতে বলেছেন, নিয়াজি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাওয়ার আগে যান ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের সাথে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে। ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল এ বিষয়ে জানতে চান মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অভিমত। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অভিমত ছিল, ভারতের কাছে নিয়াজি আত্মসমর্পণ করবেন। নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। ঠিক হয় পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং পরে তাদের মুক্তি দেয়া হবে। মার্কিন চাপে ভারতকে রাজি হতে হয় বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে নেয়ার এবং পাকিস্তান থেকে ২৪ হাজার বাংলাভাষী সৈন্যকে বাংলাদেশে আসতে দেয়ার। যাদের মধ্যে ১১০০ জন ছিলেন অফিসার র্যাংকের। এরা আসার ফলে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা হতে পারে সুরক্ষিত।
ইন্দিরা গান্ধী তার আত্মজীবনীমূলক গু ঞৎঁঃয গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ঘটনা তা ছিল না। কেবল পাকিস্তানে পূর্ব কমান্ডের সেনাপ্রধান ভারতের পূর্ব কমান্ডের সেনাপ্রধানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। গোটা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। ভারত একপক্ষীয়ভাবে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল। ফলে শেষ হয় ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধ।
১৯৭১-এর যুদ্ধকে সিমলা চুক্তিতে পাক-ভারত যুদ্ধ নামেই অভিহিত করা হয়েছে। এমনকি সিমলা সম্মেলনে ডাকা হয়নি বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিকে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য। সিমলা চুক্তি হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। বাংলাদেশের সাথে নয়। বাংলাদেশ কিন্তু ভারতের এই আচরণের কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুনছি ইমরান খান নাকি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি এরকম কোনো উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের উচিত হবে সেটাকে গুরুত্ব দেয়ার। কেননা, ভারত চেয়েছে বাংলাদেশকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কিন্তু পরিস্থিতি তার বিরূপ হওয়ার জন্য সে সেটা করতে পারেনি। কিন্তু এখনো সে তার সেই ইচ্ছা পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হয় না।
ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশকে কাশ্মিরের মতোই নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ডি পি ধর (দার), পি এন হাক্সার, টি এন কাউল, পি এন ধর (দার) ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ উপদেষ্টা। এরা সবাই ছিলেন কাশ্মিরি বংশোদ্ভব। ডি পি ধর ও পি এন হাক্সার ছাত্রজীবনে ছিলেন কাশ্মিরের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। ডি পি ধরের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। ইন্দিরা গান্ধীর প্রপিতামহ গঙ্গাধর নেহরু ছিলেন কাশ্মিরের অধিবাসী। সেখান থেকে এসে উপনিবিষ্ট হন ভারতের এলাহাবাদে। ইন্দিরা গান্ধীর মনে ছিল কাশ্মিরিদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি। কিন্তু তাদের উপদেশ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে কার্যকর হতে পারেনি। কেননা বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ছিল অনেক প্রখর। আর মার্কিন পরিকল্পনা বাংলাদেশকে যেতে দেয়নি ভারতের প্রভাব বলয়ে। যার আর একটা অর্থ হতো বাংলাদেশ সোভিয়েত প্রভাব বলয়ে পরোক্ষভাবে চয়ে যাওয়া। আমি এসব কথা বলছি এ কারণে যে, আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ভারতকে চিহ্নিত করতে চান বাংলাদেশের ত্রাতা হিসেবে। যেটা সত্য নয়।
শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন আমরা তা এখনো অনুমান করতে পারি না। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কেবল পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রার্থী দাঁড় করায়নি, প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল পাকিস্তানের অন্য প্রদেশ থেকেও। তারা নির্বাচিত হতে না পারলেও পেয়েছিলেন কিছু ভোট। আওয়ামী লীগ কখনোই দাবি করেনি যে, সে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের একটি দল। তাই দেখি শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের বক্তৃতায় বলছেন, আমি পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। তিনি নিজেকে দাবি করছেন না কেবল পূর্ব পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে। আমার মনে হয় তিনি এ সময় হতে চাচ্ছিলেন সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, কেবল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে নয়। যদিও আবার একই সাথে তিনি এ কথাও বলছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। যেটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের রাজনৈতিক দরকষাকষি।
২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এতে তিনি বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল ঠিক। তাই তিনি নিজে ছাত্রজীবনে ছাত্রনেতা হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে আরো বলেছেন যে, বাংলাভাষী মুসলমান ভাষার দিক থেকে বাঙালি হলেও তার মধ্যে বিরাজ করছে একটা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ। ভাষা এবং এই স্বাতন্ত্র্য চেতনা উভয়কেই বিবেচনায় নেয়া উচিত বাংলাভাষী মুসলমানের জাতিসত্তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। শেখ মুজিবকে তাই বলা যায় না, আদর্শগতভাবেই তিনি ছিলেন পাকিস্তানবিরোধী। সাংবাদিক Anthony Mascarenhas তার লিখিত Bangladesh A Legacy of Blood বইয়ে (২য় অধ্যায়) বলেছেন যে, শেখ মুজিব তাকে লন্ডনে ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি বলেন, তিনি (শেখ মুজিব) বর্তমান পাকিস্তানের সাথে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্ক ছেদ করতে চাচ্ছেন না। চাচ্ছেন একটা বিশেষ ধরনের সম্পর্ক (Link) বজায় রাখতে। আমার তাই মনে হয় না, বর্তমান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা হবে শেখ মুজিবুর রহমানের ধ্যান ধারণার পরিপন্থী।
লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২০১৮ সালে।