আজকের বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে সাবেক পাকিস্তান ভেঙ্গে। তাই বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে হলে জানতে হয়, বুঝতে হয়, পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তানের জন্ম বৃত্তান্ত। আজকের রাষ্ট্র বাংলাদেশের সীমানা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হবার ফলেই হয় উদ্ভূত। পাকিস্তান হয়েছিল বলেই সম্ভব হয়েছে আজকের বাংলাদেশ নামক পৃথক রাষ্ট্রের উদ্ভব।
ইসলামের স্বাতন্ত্র্য
এই উপমহাদেশে ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, যেসব মুসলমান বাইরে থেকে এসে এই উপমহাদেশে সামাজ ও বসতি স্থাপন করেন, তাঁরা প্রধানত ছিলেন মধ্য এশিয়ার লোক। মধ্য এশিয়া থেকে মানুষ এর আগেও বহুবার এই উপ-মহাদেশে এসেছে- করেছে সাম্রাজ্য ও বসতি স্থাপন। যেমন মধ্য এশিয়া থেকে কুষাণরা এসে করেছে বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। কিন্তু কুষাণ ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত বিভিন্ন মানুষের দল ক্রমে ক্রমে মিশে গিয়েছে ভারতের জনসমষ্টির সঙ্গে। গ্রহণ করেছে হিন্দু ধর্ম, মেনে নিয়েছে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। কিন্তু মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা ঘটতে পারেনি। এই না পারার অন্যতম কারণ, ইসলামের স্বাতন্ত্র্য। যেহেতু মুসলমান ধর্ম অনেক বেশি সুসংহত আর যেহেতু মুসলমরা ছিলেন অনেক বেশি ধর্ম সচেতন, তাই তারা বিলুপ্ত হতে চান না হিন্দু জনসমাজের মধ্যে। ধর্ম প্রচারের ফলে এই উপমহাদেশে অনেকে গ্রহণ করেন ইসলাম ধর্ম। ইসলামকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে এই উপমহাদেশের সর্বত্র গড়ে ওঠে একটা পৃথক মুসলিম জনসমাজ।
অন্য দিকে হিন্দু সমাজের পক্ষেও নানা কারণে সম্ভব হয় না মুসলমানদের আপন করে নেওয়া। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় কারণ হলো হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম (Caste system) ও অস্পৃশ্যতার (Untouchability) ধারণা। হিন্দুরা সাধারণভাবে মুসলমানদের ভেবেছেন অশুচি। উত্তর আফ্রিকার বিখ্যাত আর পরিব্রাজক ইবন বতুতা। তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখেছেন, (ইবনে বতুতা পূর্ব বাংলায় আসেন ১৩৪৫-১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) এ দেশে তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি খেতে চাইলে হিন্দুরা তা দেন না। কারণ, তারা মনে করেন, এর ফলে বাসন অপবিত্র হবে। হিন্দু মুসলমান সমাজ তাই পাশাপাশি বাস করলেও এক হতে পারে না পৃথক থাকে। এই পার্থক্যকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়। সাবেক মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্ব। আর এর ফলেই বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্ভব হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের।
১৯৩০ সালের আগে পাকিস্তান বলে শব্দ ছিল অশ্রুত। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালে আবির্ভাব ঘটে প্রায় সাত কোটি লোক নিয়ে গঠিত একটি নতুন রাষ্ট্র, পাকিস্তানে। পাকিস্তান হবার সময় বিভিন্ন দাঙ্গায় মারা যায় প্রায় তিন লক্ষ (৩,০০,০০০) লোক। পাকিস্তান হবার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে উদ্বাস্তু হতে হয় প্রায় দেড় কোটি (১৪ মিলিয়ন) মানুষকে। পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত এর আগে এত লোক কখনও এত অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বাসভূমি চ্যুত হয়নি। এ এক বিরাট ঘটনা। কিছু লোকের রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ অথবা মাত্র কয়েক বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাহায্যে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যাখ্যা পেতে হলে যেতে হয় এই উপমহাদেশের ইতিহাসের অনেক গভীরে। মনে রাখতে হয় এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান বিরোধের বৃহত্তর পটভূমি।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এক ঐতিহাসিক বলেছেন : “অপ্রিয় হইলেও ঐতিহাসিক সত্যকে উপেক্ষা করা উচিত নহে- কারণ তাহা হইলে ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যায় না। পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে যে কেবল সৈয়দ আহম্মদ ও জিন্নার অবদান আছে তাহা নহে, মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে হিন্দুদিগের চিরন্তন মনোভাবও তাহার জন্যে কতক পরিমাণে দায়ী।”
উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতি
ইংরেজ আমলে হিন্দু মুসলমান সমস্যা খুবই জটিল আকার ধারণ করে। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা- যা এই উপমহাদেশে মুসলমান আমলে ছিল অজানা- তা হয়ে দাঁড়ায় একটা সাধারণ (common) ঘটনা। ফলে এই উপমহাদেশের মুসলমানরা ভাবতে আরম্ভ করেন, একদিন ইংরেজ এই উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে। কিন্তু ক্ষমতা যদি সবই চলে যায় হিন্দু সমাজের হাতে, তবে কি দাঁড়াবে মুসলমানদের ভাগ্যে! এই উপমহাদেশে মুলমানরা সর্বত্র অনুভব করতে থাকেন এক সাধারণ নিরাপত্তা বোধের অভাব-অস্তিত্ব, বিলুপ্তির ভীতি। এই ভীতিই তাদের একত্রিত করে পাকিস্তান আন্দোলনের পশ্চাতে। ঠিক ধর্ম নয়, বাঁচার জৈব প্রেরণাই তাদের উদ্বুদ্ধ করে পাকিস্তান আন্দোলনে। বাঙালি মুসলমানের মনেও ছিল এই নিরাপত্তা বোধের অভাব। ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্তির ভয়। তাই তাঁরাও স্বেচ্ছায় এসে শরিক হন এই আন্দোলনে।
একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ পাকিস্তান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন:
Pakistan was created to be the state organization of the Muslim nation of the Indian subcontinent. It does not prossess a history of national unity, it bas no common language nor uniform culture, and it is neither a geographical por an economic unit. The force behind its establishment was based very largely on a feeling of insecurity.
মুসলিম ঐক্যে ভাঙন
কিন্তু পাকিস্তান হবার পর এই পরিস্থিতি পরিবর্তন হলো। ইংরেজ আমলের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা মুসলিম ঐক্যে দেখা দিল ভাঙন। সাবেক পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে ভৌগোলিক যোগাযোগ না থাকায় ও অন্য কারণে বিরোধ দেখা দিল এবং বেড়ে চললো এই বিরোধ। বাংলাদেশে (সাবেক পূর্বপাকিস্তানে) বাইরে থেকে আগত উর্দু ভাষী মুসলমান প্রধানত তাদের সঙ্গে করে আনলেন উত্তর ভারতের দরবারি সংস্কৃতি তারা বাংলার মুসলমান ও তার সনাতন সংস্কৃতিকে। দেখতে থাকলেন অবজ্ঞার চোখে। এতে বিশেষভাবে আহত হলো বাঙালি মুসলমানের আত্মসম্মানের বোধ সৃষ্টি হলো এক বিশেষ প্রতীপ মানসিক ক্রিয়া।
অর্থনীতির ক্ষেত্রেও দেখা দিল জটিলতা আর স্বার্থের সংঘাত। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে কোনো সম্প্রদার শ্রেণি ছিল না। ব্যবসা ছিল না তার জীবিকার উল্লেখযোগ্য উপায়। বাংলাদেশের পাটের ব্যবসা ও বড় বড় দোকান পসরা ছিল প্রধানত রাজস্থান থেকে অগিত মারোয়াড়িদের হাতে। পাকিস্তান হবার পর মারোয়াড়িরা চলে যেতে থাকলো। তার জায়গায় অধিকার করতে লাগল পশ্চিম ভারত (মহারাষ্ট্র গুজরাট) থেকে আগত খোজা, বোহ্রা, মেমন। এরা ধর্মে মুসলমান হলেও বিশেষ বিশেষ ধরনের মুসলমান। খোজা ও বোইরা-রা শিয়া এবং আলাদা আলাদা ইমামে বিশ্বাসী। মেমনদের মধ্যে সুন্নি থাকলেও অন্ধভাবে তারা আপন পীরের অনুসারক। এরা সবসময় সর্বত্র থাকে পৃথক সমাজ গঠন করে। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে চায় না কোনো বন্ধন গড়তে। অন্য মুসলমানদের সঙ্গে এক মসজিদে এক কাতারে নামাজ পড়ার কথা পর্যন্ত এরা চিন্তা করতে পারে না।
এরা এ-দেশে এসে চেয়েছে বাঙালি মুসলমানদের থেকে ও পৃথক থাকতে। এর ফলে বৃটিশ আমলের রাজনৈতিক কাঠামোতে হিন্দু আধিপত্যের ভয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে যে ঐক্য চেতনার সৃষ্টি হয় তাতে দেখা দেয় ভাঙন। বাঙালি মুসলমান দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে চাকরিতে যোগ দিতে যায়নি। তাই সেনাবাহিনীতে তার স্থান ছিল না বলেই হয়। পরে পাকিস্তান আমলে সে কিছু কিছু ফৌজ হবার প্রতি আকৃষ্ট হয়। পাকিস্তানে কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা সম্ভব হলো না ও ক্ষমতা চলে গেল সামরিক বাহিনীর হাতে এবং যেহেতু সামরিক বাহিনী মানেই দাঁড়াল অবাঙালি কর্তৃত্ব- বিশেষ করে পাঞ্জাবি কর্তৃত্ব- তাই বাঙালি মুসলমানের মনে জেগে উঠতে থাকলো বিশেষ ক্ষোভ, অপমান ও অবহেলার দাহ। বাঙালি মুসলমান নতুন করে তার আত্মপরিচয় খুঁজে দেখতে চাইল: ভাষার মধ্যে, সাহিত্যের মধ্যে, ইতিহাস ও লোকঐতিহ্যের মধ্যে। এর ফলে গড়ে উঠল এক আলাদা জাতীয় মানসিকতা একটা পৃথক দেশাত্মবোধ। ভাষা, ভূগোল, অর্থনৈতিক স্বার্থ- সব কিছুই কাজ করতে থাকলো এই চেতনার অনুকূলে।
বাংলাদেশের জাতীয়তা
কিন্তু এত বিরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ প্রথমেই তোলেনি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। তারা বিশেষভাবে দাবি করতে থাকে অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ তাদের শেষ পর্যন্ত পূর্ণ স্বাধীনতার পথেই ঠেলে দেয়। যেসব রাজনৈতিক ঘটনা রয়েছে আজকের বাংলাদেশ হবার মূলে, তার অনেক কথাই আছে সাধারণ মানুষের কাছে এখনও অজ্ঞাত হয়ে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের ঘটনাই সব কথা নয়। আজকের বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবোধের বিশ্লেষণ পেতে হলেও খোঁজ নিতে হয় ইতিহাসের ও দূর অতীতের ছোট বড় অনেক ঘটনার।
আমরা দেখেছি, মানবধারার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ অনেক আলাদা। এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষের মাথার খুলির আকৃতি লম্বা, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দেখা যায় গোল-মাথা মানুষের প্রাধান্য। অর্থাৎ তার বৈপ্লবিক উৎপত্তির ইতিহাস বহুলভাবেই আলাদা। মানবধারার পরেই আসে ভাষার প্রশ্ন। আমরা দেখেছি বাংলা হলো প্রান্তিক আর্য উপশাখার ভাষা- মধ্যদেশিক আর্য-উপশাখার নয়। এক্ষেত্রেও একটা বিভেদ চলে আসছে অতি প্রাচীন কাল থেকে।
প্রাক ইতিহাসের আলোচনায় আমরা দেখেছি, এদেশের মানুষের জীবন যাপনের ধারা সুপ্রাচীনকাল থেকে রয়েছে পৃথক। ধানচাষ ও মৎস্য শিকারকে কেন্দ্র করে এদেশে গড়ে উঠেছে প্রথমে জনপদ- যব গমের মতো ফসল এবং গবাদি পশু প্রতিপালনকে কেন্দ্র করে নয়। বাংলাদেশের মানুষের জীবন এখনও ভাত ও মাছের জীবন। ভাত মাছই হলো তার সনাতন সংস্কৃতির বস্তুগত বুনিয়াদ। ইতিহাসের যুগে আমরা দেখেছি, এই উপমহাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে যখন বৌদ্ধধর্ম প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে, তখন বাংলাদেশে তা ছিল প্রবল প্রতাপে।
মধ্যযুগে বৌদ্ধরা অধিকাংশই গ্রহণ করেন ইসলাম। মধ্যযুগে বিভিন্ন মুসলমান সুলতানের অধীনে বাংলাদেশ থাকে দুশো বছরের ওপর একটা স্বাধীন পৃথক রাজ্য হয়ে। বাংলার মুসলমানের বৈশিষ্ট্যময় সংস্কৃতির বুনিয়াদ রচিত হয় প্রধানত এই সময়েই। এই সময়েই রচিত হয় বাংলা ভাষার বিশেষ ভিত্তি। তাই বলতে হয় বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান জাতীয়তা বোধের মূলে ইতিহাসের বহুবিধ উপাদান কাজ করে চলেছে। আর এদের সবার কথাই ভেবে দেখতে হয়, আজকের বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাকে বুঝতে গিয়ে।