কমিউনিস্ট অভিধানে বাম-বিচ্যুতি (Left Sectarianism) বলতে বোঝায়, অতি বিপ্লবী মনোভাবকে; যা সাফল্য পেতে পারে না। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির বহু কর্মী মারা পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে পড়তে চায় জনবিচ্ছিন্ন অথবা জনধিকৃত।
তখন ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে। অর্থাৎ ব্রিটেন ভারত ত্যাগ করে চলে গেছে। ভারতে কংগ্রেস সরকার সবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জওয়াহেরলাল নেহরু। এ সময় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বি টি রণদিব। রণদিব ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় এসে বললেন, দেশে সশস্ত্র বিপ্লব করতে হবে। শাসনক্ষমতা দখল করে করতে হবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন। তিনি আওয়াজ তুললেন, ব্রিটেন ভারত ছেড়েছে, কিন্তু ভারত প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন হয়নি। অভুক্ত ভারতবাসীকে খেতে দিতে হবে। তাদের অভুক্ত রেখে স্বাধীনতা কখনো অর্থবহ হতে পারে না। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলল,
ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়
লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।
পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্টরা গান বাঁধলেন-
মাউন্ট বেটেন সাহেব ও,
তুমার সাধের বেটন কার হাতে থইয়া গেলায় ও
তুমার সুনার পুরী আন্ধার কইরা ও
তুমি কই চলিলায়,
সাধের বেটন কার হাতে থইয়া গেলায় ও।
সরদার কান্দে, পণ্ডিত কান্দে, কান্দে মৌলানায়,
কী রে হায় হায় হায়,
আর মাথাইয়ে যে মাথা কুটে, বলদায় বুক থাবড়ায়
তুমার শ্যামা চেট্টি ভক্তবৃন্দে ও
তারা ধুলায় গড়াগড়ি যায়,
সাধের বেটন কার হাতে থইয়া গেলায় ও।
ওপরের গানে বলা হয়েছে, স্বাধীন ভারতের প্রথম বড়লাট বা ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেন চলে গিয়েছেন, কিন্তু তার হাতের লাঠি বা বেটন দিয়ে গেছেন পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর হাতে। জওয়াহেরলালের সাথে আছেন সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। এরা তিনজনই একই পথের পথিক। এরা তিনজনই অনুসরণ করতে যাচ্ছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রিক শাসনব্যবস্থাকে। কংগ্রেসের প্রধান নেতারা ক্ষমতার দখল পেয়েছেন, অন্য দলের নেতারা পাননি। তারা ক্ষমতার জন্য কান্নাকাটি করছেন, কিন্তু এদের সবার আদর্শই এক। এদের লক্ষ্য ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিকে বজায় রাখা, সমাজতান্ত্রিক সমাজ জীবন গড়ে তোলা নয়। কমিউনিস্টদের তাই লক্ষ্য হতে হবে বল প্রয়োগ করে ক্ষমতা অধিকার করা। সে সময়ের খ্যাতনামা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার এক কবিতায় বলেছিলেন-
সিংহাসনটা তাকিয়ে দেখে সবাই ওঠে আঁতকে
রাজা নেই কিন্তু রাজার গোঁফটা আছে আটকে।
এই কবিতার মধ্যেও বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, আসলে ভারত স্বাধীন হয়নি। এই স্বাধীনতাকে বলা যেতে পারে এক নতুন ফিউডাল বা সামন্তবাদী ব্যবস্থা। এই সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সর্বহারাদের রাজত্ব। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্টদের বিপ্লব করার উপযোগী সংগঠন ছিল না। ছিল না জনসমর্থন। ক্ষমতা দখল করতে যেয়ে নেহরু সরকারের অধীনস্থ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা গেলেন কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্য। একটি হিসাব অনুসারে, সে সময়ের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মোট সদস্যের তিন ভাগের এক ভাগ মারা যান এভাবে ক্ষমতা দখল করতে যেয়ে। সারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি দল হিসেবে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। কমিউনিস্টদের মধ্যে রণদিবের নীতির বিরোধিতা শুরু হয়। ফলে রণদিব আর থাকতে পারেন না ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। তার স্থলে অজয় ঘোষ ১৯৫১ সালে নির্বাচিত হন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। তিনি সাধারণ সম্পাদক হয়ে ঘোষণা করেন, রণদিবের নীতি ছিল ভুল। এ ছিল এক চরম বাম-বিচ্যুতি।
তখন পাকিস্তান সবে হয়েছে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তখনো কার্যত চলেছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে। তারা ১৯৫০ সালে অনুসরণ করতে চেয়েছিল রণদিবের অতি বিপ্লবী নীতিকে। এর ফলে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির হয় ভয়ঙ্কর ক্ষতি। তখন পাকিস্তান কেবল হয়েছে। মানুষের কাছে কমিউনিস্টরা চিহ্নিত হয় পাকিস্তানবিরোধী হিসেবে। মানুষ তাদের দেশদ্রোহী হিসেবে করতে থাকে ঘৃণা। রণদিবের নীতি অনুসরণ করে ইলামিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটান ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি। সাঁওতাল ভাগচাষিরা নাচোল থানা দখল করে। নাচোল থানা দখল করতে যেয়ে তারা হত্যা করে নাচোল থানার দারোগা ও তিনজন পুলিশকে। এরা হলেন- তফিজ উদ্দিন মোল্লা (দারোগা), তপেশচন্দ্র আচার্য, শাহাদত আলী ও নওয়াজেশ আলী। কিন্তু নাচোল থানা তারা দখল করে রাখতে পারে না। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যায় অনেক সাঁওতাল। ইলামিত্র ভারতে পালাতে যেয়ে ধরা পড়েন তখনকার পূর্ব বাংলার সেনাবাহিনীর হাতে এবং হন চরম নির্যাতনের শিকার। তাকে দাঁড় করানো হয় বিচারের কাঠগড়ায়। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইলামিত্র বলেন, তিনি দারোগা ও পুলিশকে খুন করেননি। সাঁওতালদের তিনি দারোগা ও পুলিশকে খুন করতে বলেননি। সাঁওতালরাই করেছে এটা। এর জন্য তিনি মোটেও দায়ী নন। ইলামিত্রের দু’জন উকিল বলেন, সাঁওতালরা অসভ্য, আদিম, বর্বর। তাদের পক্ষে সব কিছুই করা সম্ভব। ইলামিত্র ভদ্রঘরের অতি উচ্চশিক্ষিতা গৃহবধূ। তার পক্ষে এ রকম কিছু কল্পনাও করা যায় না। ইলামিত্রের ফাঁসি হয় না; হয় সারা জীবনের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড। এরপর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ফজলুল হক হন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনি জেলে অসুস্থ ইলামিত্রকে চিকিৎসার জন্য যেতে দেন কলকাতায়। কিন্তু ইলামিত্র আর কলকাতা থেকে ফেরেন না। তিনি কলকাতায় রাজনীতি করতে শুরু করেন। পশ্চিম বাংলার বিধানসভায় বিধায়ক নির্বাচিত হন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি পরিত্যাগ করে যতদূর জানি যোগ দেন কংগ্রেসে। তিনি থাকেন না আর কমিউনিস্ট। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে তিনি একবার এসেছিলেন নাচোলে। এ দেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা ও ভারতের কংগ্রেসের প্রতি অনুরক্তরা তাকে নাচোলে প্রদান করেন বিপুল সংবর্ধনা। রাজশাহী শহরেও তিনি করেছিলেন একটি বিশেষ জনসভা। ইলামিত্রকে নিয়ে ২০০৯ সালে তৈরি করা হয় ‘নাচোলের রানী’ নামে একটি ছায়াছবি, যা পুরস্কৃত হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা। এভাবে চেষ্টা চলে ইলামিত্রকে একজন মহান বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে ফুটিয়ে তোলার। এ সময় ভারতের কংগ্রেস সরকার চাচ্ছিল ইলামিত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে। আর বোঝাতে চাচ্ছিল, হানাদার পাকিস্তান সরকার করেছিল ইলামিত্রের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন। জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব। অথচ পূর্ব বাংলার মানুষ ১৯৫০ সালে সবাই ছিল পাকিস্তানি আর ছিল ইলামিত্রবিরোধী। গোটা নাচোল থানার মুসলমানেরা ইলামিত্রের পক্ষে ছিলেন না। তখনকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তাই তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় আর কোনো জায়গায় নাচোলের মতো কোনো থানা দখলের ঘটনা ঘটতে পারেনি।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের খাপরা (অনেকে বলেন খাপড়া) ওয়ার্ডের কমিউনিস্ট বন্দীরা কিছু সাধারণ কয়েদির সাথে যোগসাজশ করে বিদ্রোহ করেন। তারা বলেন, উন্নত মানের খাবার দিতে হবে। বলেন, সাধারণ কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘোরানো চলবে না। চলবে না বলদের পরিবর্তে সাধারণ কয়েদিদের দিয়ে লাঙল টানিয়ে জেলখানার ক্ষেতে সবজির চাষ করা। এই বিদ্রোহ দমন করতে যেয়ে জেলপুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এখন বলা হচ্ছে, এই পুলিশেরা নাকি ছিল পাকিস্তান থেকে আসা। কিন্তু এরা সবাই ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা। যারা পুলিশের কাজ করতেন জেলখানায়। এখানেও চেষ্টা চলেছে পাকিস্তান বনাম বিপ্লবীদের সঙ্ঘাত হিসেবে সেদিনের ঘটনাকে চিত্রিত করার। কিন্তু সেদিনের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কমিউনিস্ট বন্দীরা যদি কয়েদিদের নিয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে আসতেন, তবে শহরের লোক তাদের ঘিরে ধরে খুন করত। তারা পেতেন না রাজশাহী শহরের মানুষের কোনো সহায়তা ও সহানুভূতি। কেননা, তখন এই শহরের মানুষ তাদের গণ্য করত দেশদ্রোহী হিসেবে। এটা ছিল এক চরম হঠকারিতা। এবং বাম-বিচ্যুতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু বাংলাদেশের এককালের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা, যাদেরকে এখন বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন ভারতের অনুদানপুষ্ট, তারা এসব অতি বিপ্লবীকে নিয়ে করতে চাচ্ছেন গৌরব। বোঝাতে চাচ্ছেন, এরা চেয়েছিলেন দেশকে পাক হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে। অথচ সেদিন এ দেশের মানুষ নিজেদের মনে করত পাকিস্তানি হিসেবে। পূর্ব বাংলার মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিলেন বলেই হতে পেরেছিল সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিব ছাত্রজীবনে ছিলেন বিশেষভাবেই পাকিস্তান আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা।
ব্রিটিশ শাসনামলে রাজশাহী জেলার সদর প্রথমে ছিল নাটোর। নাটোর থেকে ১৮২৫ সালে সদর দফতর উঠে আসে রাজশাহী। রাজশাহীতে কোনো বড় জেল ছিল না। খাপরা ওয়ার্ড দিয়ে নাকি শুরু হয়েছিল রাজশাহী জেল। পরে এর কাছে নির্মিত হয় এক বিরাট দোতলা ইমারত, যা পরিচিত হয় দোমহলা ব্যারাক নামে। ১৯১৪ সালে রাজশাহী জেল পায় সেন্ট্রাল জেলের মর্যাদা। ব্রিটিশ আমলে বহু রাজনৈতিক বন্দীকে আটকে রাখা হতো রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে। এদের ওপর করা হতো ভয়ঙ্কর নির্যাতন। রাজশাহী জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন লিউক (ঈ.অ.ড. খঁশব) নামে এক সাহেব। লিউক সাহেবকে রাজশাহীর একদল স্বদেশী রাজনৈতিক কর্মী জেলের কাছেই রাস্তায় রিভলবার দিয়ে গুলি করে। লিউক মারা না গেলেও গুরুতরভাবে আহত হন। এই ঘটনা ঘটে ১৯৩২ সালের ১৫ নভেম্বর। এর পর থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা কমে যায়। লিউকের ওপর গুলিবর্ষণ এ দেশের ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছে। লিউকের ওপর যারা গুলি চালান, তাদের কাউকে ধরা সম্ভব হয়েছিল না। তারা রাজশাহীতে আত্মগোপন করতে পারেন। কেননা রাজশাহীবাসী সাধারণভাবেই ছিলেন তাদের পক্ষে। কিন্তু ১৯৫০ সালের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। রাজশাহীবাসী কেউই ছিলেন না কমিউনিস্টের পক্ষে। জেল থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে কমিউনিস্টদের আত্মগোপন করা সহজসাধ্য হতে পারত না। রাজশাহী জেলের ঠিক পাশ দিয়েই পদ্মা নদী বয়ে গিয়েছে। পদ্মা পার হলেই পৌঁছানো যায় ভারতে। কিন্তু ভারতে পালিয়ে যেয়ে আত্মগোপন করাও হতো যথেষ্ট কঠিন কাজ। কেননা এ সময় নেহরু সরকার সে দেশে হুকুম দিয়েছিলেন ঢালাওভাবে কমিউনিস্ট নিধন করতে। কেবল পাকিস্তান সরকারই যে কমিউনিস্টদের ভাবছিল দেশদ্রোহী, তা নয়। ভারত সরকারও এ সময় কমিউনিস্টদের ভাবছিল দেশদ্রোহী হিসেবে।
রাজশাহী জেলে খাপরা ওয়ার্ড বলতে বোঝায় এক কক্ষবিশিষ্ট একটি ওয়ার্ডকে। ঘরটির দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট ও প্রস্থ ৫৪ ফুট। এর পশ্চিম পাশে ১২ ফুট চওড়া ও ৫৪ ফুট লম্বা একটি বারান্দা আছে। এই ওয়ার্ডের মেঝে সমতল মাটি থেকে তিন ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ওয়ার্ডটিকে খাপরা ওয়ার্ড বলা হয়, কারণ এর চাল এক সময় ছিল খোলার খাপরা দিয়ে ছাওয়া। এই কক্ষের জানালা ভেঙে জেল পুলিশ চালিয়েছিল গুলি (১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল)। যার ফলে সাতজন কমিউনিস্ট কর্মী মারা যান আর আহত হন ৩১ জন। এই হতাহতের জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সে সময়ের হঠকারী নীতিই ছিল বিশেষভাবে দায়ী। কমিউনিস্টরা নিজেরাই স্বীকার করেছিলেন, এটা ছিল একটি বাম-বিচ্যুতি। কিন্তু এখন এ বছর দেখা গেল, এ দেশের কমিউনিস্টরা এই বাম-বিচ্যুতি নিয়ে করছেন গৌরব। আর বোঝাতে চাচ্ছেন, এরা নিহত ও আহত হয়েছিলেন পাক পুলিশের গুলি চালানোর ফলে। এসব বিপ্লবী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার অগ্রপথিক। কিন্তু ১৯৫১ সালে অজয় ঘোষ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হয়ে ঘোষণা করেছিলেন বি টি রণদিবের সব নীতিই ছিল ভুল। এই নীতি ছিল একটি চরম বামপন্থী হঠকারিতা। তিনি বলেন, The tradition of our party, especially since the ‘people’s war’ period, has been to swing like pendulum from one extreme to another… we woke up suddenly like Rip Van Winkle at the end of 1947 to jump into left sectarianism which has brought the party and the mass movement to the present plight of total disruption. অজয় ঘোষের মতে, ‘জনযুদ্ধের’ আমল থেকেই রিপ ভন্ উইঙ্কেলের মতো কমিউনিস্ট পার্টি হঠাৎ ঘুম থেকে জাগল। এবং রাতারাতি এক দিক থেকে অপর দিকে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলতে শুরু করল। দুলতে শুরু করল দক্ষিণপন্থী চরমপন্থা থেকে বামপন্থী চরমপন্থার দিকে। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টি এসে পড়ল এক চরম অবস্থার মধ্যে। এখানে জনযুদ্ধ কথার একটু ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। ১৯৪১-এর ২২ জুন হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। ভারতের কমিউনিস্টরা শুরু করে ব্রিটিশরাজের সহযোগিতা। তারা বলেন, ব্রিটেন হারলে নাৎসি জার্মানি জিতে যাবে। সারা বিশ্বে থাকবে না আর কোনো কমিউনিস্ট পার্টি। তাই যুদ্ধ করতে হবে ব্রিটিশরাজের সহযোগিতায়। এই যুদ্ধ পরিণত হয়েছে জনযুদ্ধে। এ সময় তাদের একটি গানের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে-
কমরেড ধরো হাতিয়ার- ধরো হাতিয়ার
স্বাধীনতা সংগ্রামে নহি আজ একলা
বিপ্লবী সোভিয়েত, দুর্জয় মহাচীন
সাথে আছে ইংরেজ, নির্ভীক মার্কিন।
এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে মহাচীনকে দুর্জয় বলছে, তা তখন ছিল চিয়াং কাইশেকের চীন। চীনে কমিউনিস্টরা তখনো ক্ষমতায় আসেনি। অন্য দিকে তারা বলছেন, ইংরেজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা করতে। এ সময় ইংরেজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে বিবেচিত ছিল না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে। কিন্তু ভারত থেকে ব্রিটেন চলে যাওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। সারা বিশ্বে এখন বাম চিন্তায় নেমেছে বিরাট ধস। দেখা দিয়েছে আদর্শিক বিপর্যয়। সমাজতন্ত্রের দুর্গ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। রাশিয়ায় মানুষ এখন চাচ্ছে বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। রাশিয়া গ্রহণ করেছে ধনতন্ত্রের পথ। অন্য দিকে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় থাকলেও আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলছেন না। তারা চীনে গড়ে তুলছেন মুক্তবাজার অর্থনীতি। কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে কিছু কমিউনিস্টকে বলতে, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এদের চিন্তা-চেতনা মিলছে না বর্তমান বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের সাথে। পত্রিকার খবরে দেখলাম, (প্রথম আলো : ২৫ এপ্রিল ২০১৫) খাপরা ওয়ার্ডের ঘটনা নিয়ে একটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। গ্রন্থটির নাম ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০’। বইটি লিখেছেন মতিউর রহমান। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন ঢাকা থেকে। বইটি সম্পর্কে কামাল লোহানী বলেছেন, শহীদদের মৃত্যু হয় না। তার মতে, খাপরা ওয়ার্ডে যারা মারা গিয়েছিলেন, তারা সবাই হলেন মহান শহীদ। বইটি পড়ার সুযোগ আমার এখনো হয়নি। তবে এখন খোদ রাশিয়াতেই লেনিনের প্রস্তরমূর্তিতে সে দেশের মানুষ নাকি প্রস্রাব করছে। গোটা বিশ্বে কমিউনিস্টরা প্রাণ দিয়েছেন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আশায়। কিন্তু এদের সবার রক্তই আজ মনে হচ্ছে যেতে চলেছে বিফলে। আমরা কারো মৃত্যু নিয়ে কৌতুক করতে চাচ্ছি না। কিন্তু মিথ্যা আদর্শ নিয়ে লাড়াই করলে কারো মৃত্যু কোনো সাফল্য যোগ করতে পারে না, মানবসভ্যতায়।
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৯ এপ্রিল ২০১৫।