বৈজ্ঞানিকদের চিন্তার মূলে একটা বিশেষ বিশ্বাস কাজ করে। এই বিশ্বাসকে বলে প্রাকৃতিক নিয়মের একানুবর্তিতা (Principle of Uniformity of Nature)। এই বিশ্বাস ছাড়া বিজ্ঞান দাঁড়াতে পারে না। এক বায়ুচাপমাত্রার পানিকে ফুটাতে হলে সর্বত্রই লাগবে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। না হলে পানি ফুটবে না। এ হলো প্রাকৃতিক নিয়মের একানুবর্তিতার একটা সাধারণ দৃষ্টান্ত। এই বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিকদের চিন্তাভাবনা অগ্রসর হতে পারে না। আমি ‘মঙ্গলগ্রহ থেকে আসা প্রস্তরখণ্ড’ নামক প্রবন্ধে (২৩ জানুয়ারি ২০১২) বলেছিলাম, কতগুলো অনুকূল প্রাকৃতিক অবস্থার সমাবেশে প্রাণের আবির্ভাব সম্ভব। এটা আমার কোনো নিজের কথা নয়। এটা হলো বৈজ্ঞানিকদের সাধারণ বিশ্বাসের ব্যাপার। মো: বেলাল খান এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন- আমার বক্তব্য ইসলামি ধর্মচিন্তার পরিপন্থী । কিন্তু তা হলো বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাধারণ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমি কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার কথা আদৌ ভাবিনি। বৈজ্ঞানিক চিন্তার একটা ছক গড়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিখ্যাত ফরাসি বৈজ্ঞানিক লাভোয়াজিয়ে বলেন- যাকে বলা হয় জীবন, তা আসলে হলো কতগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমষ্টিমাত্র। তার বক্তব্যকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের জগতে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পেতে পেরেছে যে, জীবনের বাস্তবতার মূলে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়া আছে, যেখানেই তারা ঘটতে পারবে সেখানেই উদ্ভব হবে প্রাণবান বস্তু। বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেছেন, বহু বছর আগে মঙ্গলগ্রহের অবস্থা ছিল পৃথিবীর অনুরূপ। সেখানে তাই ঘটতে পেরেছে পৃথিবীর অনুরূপ রাসায়নিক বিক্রিয়া। আর তার ফলে সেখানে উদ্ভূত হতে পেরেছে সজীব বস্তু। মো: বেলাল খানের মতে, আমি যা বলেছি তা ইসলামের পরিপন্থী। কিন্তু আমি এই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। কারণ, ইসলামে কিয়াস স্বীকৃত। কিয়াস বলতে বুঝায়, দুইটি বিষয় বা বস্তুর মধ্যে তুলনা করে সিদ্ধান্তে আসা। পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহের অতীতের মধ্যে তুলনা করে কেউ যদি অনুমান করেন, সেখানে সজীব বস্তুর উদ্ভব হতে পেরেছিল, তবে তার চিন্তাকে ইসলামি চিন্তার পরিপন্থী বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। কারণ জ্ঞৈানিকেরা যা বলছেন, তা মঙ্গলগ্রহ ও পৃথিবীর অবস্থার মধ্যে তুলনা বা কিয়াস করে বলছেন। কিয়াস বা সাদৃশ্যমূলক যুক্তি (Analogical deduction) ইসলামি যুক্তিবিদ্যায় স্বীকৃত। বৈজ্ঞানিকেরা সিদ্ধা ন্তে আসেন সাধারণ ঐকমত্য বা ইজমার ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রেও ইসলামি যুক্তিবিদ্যার সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। বিজ্ঞানে মতবাদিক গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। তাই নতুন কোনো তথ্য জ্ঞাত হলে জ্ঞৈানিকেরা তা খোলা মনে মেনে নেন। যদি তারা দেখেন যে, নতুন তথ্য তাদের পুরনো কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত মতবাদের সাথে মিলছে না, তখন তারা নতুন করে ভাবতে আরম্ভ করেন। প্রয়োজনে দেন পুরনো মতবাদকে বাতিল করে। এমন একটি সম্ভাবনা খুব সম্প্রতি দেখা দিয়েছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে। আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে কোনো কিছুর গতিবেগ আলোকের গতিবেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, নিউট্রিনোর গতিবেগ আলোর কণা ফোটনের চাইতে অধিক হতে পারে। তাই প্রশ্ন উঠছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব ভিত্তিহীন হয়ে উঠতে চাচ্ছে।
বিজ্ঞানের দু’টি দিক আছে। একটি হলো জ্ঞানের দিক আর একটি হলো সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণসাধনের দিক। মানুষ এক সময় জানত না, মানুষের অনেক রোগের কারণ হলো রোগজীবাণু। কিন্তু আমরা এখন জানি, রোগজীবাণু মানুষের অনেক রোগের কারণ। আর তাই চাই রোগজীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ করে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের দেশের ইতিহাস থেকে একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যেতে পারে। হিন্দুরা মনে করতেন, কলেরা বা ভেদবমি রোগ হয় ওলাইচণ্ডী দেবীর প্রকোপে। বাংলাদেশের মুসলিম চিন্তায়ও পড়েছিল এর প্রভাব। ওলাইচণ্ডীকে মুসলমানেরা বলতেন ওলাবিবি। ওলাবিবি যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে, যে জন্য মৌলভীরা করতেন ঘরবন্ধ। এই ঘরবন্ধ করতে গিয়ে তারা বলতেন- আল্লাহ হলেন তালা, মুহাম্মদ হলেন খিল, আমার ঘর বন্ধ করেন ফিরিশতা জিব্রাঈল। কিন্তু এখন আর আমরা এভাবে ঘরবন্ধ করি না। কলেরার জীবাণুমুক্ত পানি ও অন্যান্য খাবার খেয়ে চাই কলেরার জীবাণুর আক্রমণ থেকে মুক্ত হতে। কলেরার আক্রমণ হলে আমরা গ্রহণ করি ওরস্যালাইন। কলেরা এখন আর মারাত্মক রোগ নয়। এ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণা আমাদের বিরাট কল্যাণ করতে পেরেছে। আমি তাই মনে করি, ধর্মবিশ্বাস ও বিজ্ঞানকে একত্র করে ভাবতে যাওয়া ঠিক নয়। ধর্ম আর বিজ্ঞানের জগৎ হলো বিশষভাবেই আলাদা। অনেক দিন আগে বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ (১১২৬- ১১৯৮ খ্রি:) এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি দেন তার দুই সত্যের মতবাদ (Doctrine of twofold truth) যাতে তিনি বলতে চান যে, দর্শন বা বিজ্ঞানের সত্যের সাথে ধর্মের সত্যকে এক করে দেখা যাবে না। আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে এই দুই জগৎকে রাখতে হবে পৃথক করে। ইবনে রুশদের প্রভাব ইউরোপে আনে নবজাগরণ। ইউরোপে মানুষ এগিয়ে চলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়। যার জের এখনো চলছে। মুসলিমবিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ার একটা কারণ হলো ধর্মীয় গোঁড়ামির উত্থান। এ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। ধর্মের নামে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। বিজ্ঞানের অগ্রগতি অন্য অনেক দেশে হতে পারলেও আমাদের দেশে হতে পারবে না। যেটা হয়ে উঠবে যথেষ্ট ক্ষতিরই কারণ।
আমার জীবন কেটেছে কঠোর জীবন সংগ্রাম করে। ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আমার সেভাবে হয়নি। তবুও এ বিষয়ে জানার কিছুটা যে চেষ্টা করিনি তা নয়। যত দূর জানি, বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম আল-গাজ্জালি (মৃত্যু-১১১১) তার বিখ্যাত মিশকাত-উল-আনওয়ার নামক গ্রন্থে বলেছেন- কুরআন শরিফের সূরা নূর-এর ৩৫ নম্বর আয়াতের অর্থ হতে পারে ৭০ হাজার। আমরা জানি, কুরআন শরিফে আছে ৬৬৬৬ আয়াত। তাই কুরআন শরিফের বিভিন্ন অংশের অনেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। কোন ব্যাখ্যাটি সঠিক সেটা নির্ণয় করা সহজ নয়। সূরা নূর-এ বলা হয়েছে, আল্লাহ হলেন ‘আলোর আলো’। এ কথার একটা অর্থ এই হতে পারে যে, আল্লাহ হলেন সব শক্তির শেষ উৎস। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ হজরত আদমকে কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করার পর তার মধ্যে প্রবিষ্ট করে দেন তাঁর (আল্লাহর) আপন নিঃশ্বাস ( সূরা- ১৫:২৯)। এ কথা পড়ে আমার মনে হয়েছে, মানুষের মধ্যে আছে আল্লাহর সৃজনী শক্তির অংশ। যাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ পারে তার আপন সমস্যার সমাধান করতে। মানুষকে তাই আত্মশক্তিতে আস্থাশীল হতে হবে। যেটার অভাব আমাদের দেশে যথেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। বাঁচতে হবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে।
ভারতের প্রচারমাধ্যম প্রচার করে চলেছে যে, বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদীরা অগণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে। ইসলামি মৌলবাদ কথাটা বিশেষভাবেই অর্থহীন। কারণ কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, ধর্মের নামে কোনো জবরদস্তি নেই (সূরা-২:২৫৬)। বলা হয়েছে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে (সূরা-৫:৮০)। বলা হয়েছে, মানুষকে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে ধর্মের কথা বোঝাতে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে (সূরা-৪২: ৩৮)। ইসলাম কোনো স্বৈরশাসনে উৎসাহ জোগায় না। তবে ইসলামে জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে বলা হয়েছে। জিহাদ ইসলামে জায়েজ। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আক্রমণকারীকে পছন্দ করেন না এবং তোমরা জিহাদে মাত্রা ছাড়িও না (সূরা-২:১৯০)।
রাজনীতির ক্ষেত্রে আসে সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্ন। ইসলামে বলা হয়েছে, জনকল্যাণের নীতি (ইসতিসলাহ) অনুসরণ করতে। ইসলামের মধ্যে সম্পৃক্ত রয়েছে কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা। ইউসুফ আ:-এর কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই যে, মিসরের রাজা (ফেরাউন) তাকে ধর্মগোলার ভার দিয়েছিলেন, যাতে করে দুর্ভিক্ষের সময় ধর্মগোলায় সঞ্চিত খাদ্যশস্য অভাবী মানুষদের মধ্যে ঠিকমতো বণ্টিত হতে পারে। ইসলামি শাসনব্যবস্থায় তাই বলা হয় ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’। মানুষ সৎ না হলে কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র সাফল্য পেতে পারে না। ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার একটা নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। একে মৌলবাদ বলে চিহ্নিত করতে যাওয়া ভুল। বাংলাদেশে মুসলিম চিন্তাবিদেরা মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত হতে পারেন না। কারণ, বাংলাদেশে অনেক ইসলামপন্থী দল আছে। কেবল একটি ইসলামপন্থী দল নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত নয়। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরাও চান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র। চান রাজনৈতিক দল গড়ার স্বাধীনতা। তারা একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন দিচ্ছেন না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ইসলামি দল হলো জামায়াতে ইসলামী। এই দল বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলছে। এই দলের ভূতপূর্ব আমির গোলাম আযমকে এখন যুদ্ধাপরাধী বলে বিচার করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি যুদ্ধাপরাধের সাথে কতটা জড়িত ছিলেন, সেটা নিয়ে থাকছে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ। বলা হচ্ছে, তিনি চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। কিন্তু এই না চাওয়াটা যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে না। যুদ্ধাপরাধের আছে কতগুলো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা। যেমন, বন্দীকে হত্যা করা যুদ্ধাপরাধ। গোলাম আযম কোনো বন্দীকে হত্যা করতে বলেছিলেন অথবা হত্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এ রকম প্রমাণ উত্থাপন করতে হবে যুদ্ধাপরাধ বিচারের আদালতে। কিন্তু সেটা কি আসলেই করা হবে? মনে হচ্ছে বিচারের আগেই যেন শাস্তি প্রদান হয়ে গেছে। আমার মনে পড়ে, ১৯৪৮-এর কথা। গোলাম আযম সে সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন অকুণ্ঠভাবে। তিনি তখন জামায়াতে ইসলামের সদস্য ছিলেন না। গোলাম আযম জামায়াতে ইসলাম করলেও চেয়েছেন সংসদীয় শাসনব্যস্থা, মুজতাহিদদের ইজমানির্ভর শাসনব্যবস্থাকে নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট নই। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতা আমাকে যথেষ্ট চিন্তিত করে তুলেছে। আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞান পথ দেখাতে পারে। কারণ বিজ্ঞান কোনো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে তার সমাধান অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বিজ্ঞান আবেগনির্ভর নয়। বিজ্ঞান বিশ্লেষণনির্ভর। বিজ্ঞান ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মুসলিমবিশ্বে যে চিন্তার সমস্যার উদ্ভব হতে পারছে, এক সময় খ্রিষ্টানবিশ্বেও তা হতে পেরেছিল। ব্রিটিশ দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বলেন, উন্নত ধর্মবিশ্বাসের মূল কথা হলো মানুষের জন্য মানুষের সহানুভূতির চর্চা। বিজ্ঞানের নামে একে খাটো করে দেখা উচিত হবে না।