ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে বলা হয়েছে –
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা
পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্যা হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
এই গানে ভারতভাগ্যবিধাতা বলতে রবীন্দ্রনাথ কাকে বুঝিয়েছিলেন তা জানা যায় না। তবে মনে করা হয়, বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য তিনি বিলাতের সম্রাট পঞ্চম জর্জকে বলেছিলেন ভারতভাগ্যবিধাতা। এই গানে বঙ্গ, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, দ্রাবিড়, মারাঠাদের নাম থাকলেও আসামের নাম নেই। কেন নেই সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই গান যখন লেখা হয়েছিল, তখন সিন্ধুনদ ছিল তখনকার ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সবচেয়ে বড় নদী। কিন্তু আজ সিন্ধু হলো মোটামুটি পাকিস্তানের নদী। সিন্ধুনদের উদ্ভব হয়েছে তিব্বতের মানস সরবরের কাছ থেকে, যেখানে এসে জমে হিমালয়ের বরফগলা পানির একটা অংশ। কিন্তু সিন্ধুনদের সব পানিই যে আসে তিব্বত থেকে, তা নয়। সিন্ধুনদের আছে পাঁচটি উপনদী। ঝিলাম, বিপাশা, শতদ্রু, ইরাবতী ও চিনাব। ঝিলাম বয়ে এসেছে কাশ্মিরের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার
এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হল বৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি-
অব্যক্ত ধ্বনি পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।
রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তখন নিশ্চয় তিনি ভাবতে পারেননি ঝিলাম নদীর তীরে দারুণ যুদ্ধ হবে। কাশ্মিরে থাকবে না শান্তি। কাশ্মিরকে বলা হতো ভূস্বর্গ। বাইরে থেকে মানুষ সেখানে বেড়াতে যেত সিঃস্বর্গ-সৌন্দর্যের টানে। ১৯৪৭ সালের পর কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল (জাবাহিরলাল) নেহরু পাকিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য সমস্যাটিকে নিয়ে যান জাতিসঙ্ঘে। পাকিস্তান কাশ্মির সমস্যাকে জাতিসঙ্ঘে নিয়ে যায়নি। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে পাঁচবার বলে কাশ্মিরিরা পাকিস্তানে যোগ দেবে না ভারতে যোগ দেবে, সে সম্বন্ধে গণ-অভিমত (Plebiscite) গ্রহণ করতে। কিন্তু ভারত তা করতে সম্মত হয়নি। কাশ্মির বিভক্ত হয়ে আছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। কাশ্মিরের যে অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে তাকে উল্লেখ করা হয়, আজাদ কাশ্মির হিসেবে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কাশ্মিরের পূর্বাংশের লাদাখ জেলাকে চীন ১৯৬২ সালে দখল করে নিয়েছে। তা এখন আছে চীনের নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ সাবেক কাশ্মির এখন তৃভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক অংশ আছে ভারতের নিয়ন্ত্রণে; এক অংশ আছে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আরেক অংশ এখন চীনের। চীনের নিয়ন্ত্রণে আছে সাবেক কাশ্মিরের প্রায় ১২০০০ বর্গমাইল। ভারত চীনের কাছে এই এলাকা ফিরে পাওয়ার জন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ভারত কেবলই চাচ্ছে পাকিস্তানের সাথে কাশ্মির নিয়ে উত্তেজনা বজায় রাখতে। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানি-চুক্তি হয়। যা সিন্ধুনদের পানি-চুক্তি (Indus Water Trety) নামে খ্যাত হয়ে আছে। এই চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংক এই চুক্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিল ৯ বছর ধরে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রু নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে।
অন্য দিকে, সিন্ধু, ঝিলাম ও চিনাব নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়। পাকিস্তান মঙ্গলা ড্যাম ঝিলাম নদীর ওপর নির্মাণ করে ১৯৬৭ সালে, বর্ষার পানি ধরে রেখে পরে শুষ্ক মওসুমে সরবরাহ করার জন্য। মঙ্গলা ড্যাম অবস্থিত আজাদ কাশ্মিরের মিরপুর জেলায়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানি নিয়ে বিবাদ নিষ্পত্তি হতে পেরেছিল ১৯৬০ সালের চুক্তি অনুসারে। কিন্তু ভারত এখন এই চুক্তি না মানতে তৎপর হয়ে উঠেছে। যদিও এই চুক্তি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত কালের জন্য। ভারত একতরফাভাবে এই চুক্তিকে হঠাৎ অস্বীকার করতে পারে না। তার একতরফা অস্বীকৃতি হবে সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়মের বরখেলাপ। পাকিস্তান বাধ্য হবে পানির জন্য ভারতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে। আর এই যুদ্ধ বাধলে সেটা কেবল পাক-ভারতের মধ্যেই যে নিবদ্ধ থাকবে, তা বলা যায় না।
চীনও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর জড়িয়ে পড়তে পারে নেপাল। সিন্ধু এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় নদী। এর দৈর্ঘ্য ২৬৭০ কিলোমিটার। সিন্ধুনদ তিব্বতে উৎপন্ন হয়ে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে পড়েছে আরব সাগরে। একে তাই বলা চলে পাকিস্তানের নদী। সিন্ধু এখন আর কোনো মতেই ভারতের নদী নয়। অন্য দিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের দৈর্ঘ্য প্রায় সিন্ধু নদের সমান। তার উদ্ভব হয়েছে তিব্বতের মানস সরোবর থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদের প্রথম ১৪৪৩ কিলোমিটার পড়েছে তিব্বতের মধ্যে। কাজেই সেটি আসলে হলো তিব্বতের নদী। ভারতের মধ্যে তার যেটুকু পড়েছে তার দৈর্ঘ্য ৮০২ কিলোমিটার মাত্র। তিব্বতে নদীটির নাম সাংপো। সাংপো নদী যখন হিমালয়ের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ঢুকে দক্ষিণে এসে আসামের শেষ মাথায় পৌঁছেছে, সেখানে তার নাম হলো ডিহিং। সেখান থেকে সে যখন আসামের সমভূমিতে এসে পড়েছে, তখন তার নাম হলো ব্রহ্মপুত্র।
চীন যদি আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত নীতি না মেনে সাংপো নদীর পানি কৃষিকাজে একপক্ষীয়ভাবে ব্যবহার করতে চায়, তবে আসাম প্রায় জলশূন্য হয়ে পড়বে। অবশ্য আসামে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। কেবল বৃষ্টির পানির উপরেই প্রধানত তাকে নির্ভর করতে হবে। চীন সাংপোর পানি একতরফাভাবে নিলে বাংলাদেশে যমুনা নদীও শুকিয়ে যাবে। সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সমস্যারই কারণ। ভারত আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টনের সাধারণ নিয়ম না মানলে চীনও আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন নীতিমালা না মানতে চাইতে পারে। তাই ভারতের উচিত হবে না সিন্ধুনদের পানি চুক্তি, বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন কাঠামোর মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, তাকে ভঙ্গ না করা।
আন্তর্জাতিক আইন আসলে আইন কি না, তা নিয়ে আছে বিতর্ক। কেননা, কোনো দেশ আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক আদালতের নেই। আইনের বাস্তবতার জন্য প্রয়োজন হয় অনেক ক্ষেত্রেই বল প্রয়োগের। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এরকম বল প্রয়োগের কোনো ব্যবস্থা নেই। একটা দেশে আইন বলবৎ করার জন্য আছে পুলিশ বাহিনী। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন বলবৎ করার জন্য এরকম কোনো আন্তর্জাতিক বাহিনী নেই।
আন্তর্জাতিক আইন না মানলে অনেক ক্ষেত্রেই সূচনা হতে পারে যুদ্ধের। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এরকম যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। নরেন্দ্র মোদি যদি পাকিস্তানের সাথে ভারতের সিন্ধুর পানিচুক্তি ভঙ্গ করেন, তবে যুদ্ধ বেধে যাবে। কেননা, পানির অভাবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব হয়ে উঠবে মরুময় অঞ্চল। থাকবে না খাদ্যভাণ্ডার হয়ে। ব্রিটিশ শাসনামলে সিন্ধুনদের ওপরে নির্মিত হয়েছিল শুক্কর ব্যারাজ। তার ফলেই প্রথম সম্ভব হয় পাঞ্জাবে সেচব্যবস্থা করে বিপুল পরিমাণে গম উৎপাদন করা। ব্রিটিশ শাসনামলে একমাত্র পাঞ্জাবেই মানুষ ভরপেট খেতে পেয়েছে, অর্থাৎ প্রতিদিন লাভ করেছে দুই হাজার ৫০০ ক্যালোরি পরিমাণ শক্তি। পাঞ্জাবের সেচব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা চুপ করে থাকতে পারে না। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। পাকিস্তান এখন একটি পারমাণবিক অস্ত্র সম্পন্ন রাষ্ট্র। যুদ্ধে সে সেটা ব্যবহার করতেই পারে। ফলে ভারতের হতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। কেননা, ভারত এখন অনেক শিল্পসমৃদ্ধ দেশ। তার জনসংখ্যার বিরাট অংশ বাস করে শহরে। কিন্তু পাকিস্তানের মানুষ সে পরিমাণ নগরকেন্দ্রিক নয়। তাই পাকিস্তানের শহরে পরমাণু বোমা ফেললে পাকিস্তানের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, সেটা ভারতের তুলনায় বেশি হবে না।
ভারতের সমর-সম্ভার পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সমগ্র হিমালয় অঞ্চলে যুদ্ধ বেধে উঠলে সেটা সামাল দেয়া ভারতের পক্ষে যথেষ্ট সহজ হবে বলে অনুমান করা যায় না। ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। সে সময়ের চেতে ভারতের সমর শক্তি এখন যথেষ্ট বেশি। কিন্তু তথাপি তার বিরাট সীমান্ত রক্ষার জন্য যথেষ্ট বলা যায় না। ভারতের সমুদ্রসৈকত হলো ৪৮২৮ কিলোমিটার। এই সমুদ্রসৈকত রক্ষার মতো উপযুক্ত নৌবহর সে এখনো গড়ে তুলতে পারেনি। পাকিস্তানের গোয়াদারে চীন গড়ে তুলেছে বিশেষ বন্দর ও নৌঘাঁটি। সেখানে অবস্থান নিয়েছে একাধিক চীনা সাবমেরিন। যারা পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে, সেই যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। আক্রমণ করতে পারে মুম্বাই বন্দরকে। ১৯৬২ সালে যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেটা হয়েছিল কেবলই ভারত-চীন সীমান্তে। তখন পাকিস্তানের কোনো অংশে চীনা বন্দর ছিল না। কিন্তু এখন আছে।
ভারতে জাতিসত্তার সমস্যা এখনো বজায় আছে। শিখরা কী করবে তা বলা যায় না। তারা হয়তো পাকিস্তানের সাথেই হাত মেলাতে পারে স্বাধীন পাঞ্জাব রাষ্ট্র গড়ার জন্য। কাশ্মিরের ইতিহাসে আমরা দেখি, কাশ্মির একসময় ছিল একটি পৃথক সালতানাত। কাশ্মিরিদের আছে একটি পৃথক ভাষা। কাশ্মিরিরা তাই হতে চাইতে পারেন বাংলাদেশের মানুষের মতোই স্বাধীন। কাশ্মিরিরা ভারতে এখন লড়াই করছেন প্রকৃত প্রস্তাবে একটি পৃথক স্বাধীন কাশ্মিরি রাষ্ট্র গঠনের জন্য। যদিও দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের অনেক পত্রপত্রিকায় একে বলা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। কিন্তু এটা আসলে হলো কাশ্মিরিদের স্বাধীনতার প্রচেষ্টা। ব্রিটিশ শাসনামলে কাশ্মির ছিল একটি পৃথক দেশীয় রাজ্য। তখনো কাশ্মির ছিল না ভারতের অংশ। কাশ্মিরের এই পার্থক্য চেতনা তাদের উদ্বুদ্ধ করছে স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠনের। আমরা একে তাই বলতে পারি না বিচ্ছিন্নতাবাদ। ভারত তার স্বার্থ সাধনে অনেক কিছুই করতে পারে।
১৯৭১ সালে দু’জন কাশ্মিরি একটি ভারতীয় বিমানকে কাশ্মির থেকে হাইজ্যাক করে লাহোরে পুড়িয়ে দেয়। এটা ঠিক হাইজ্যাক ছিল না। এই নাটকের অবতারণা করে ভারত। ভারত ষড়যন্ত্র করে তার নিজের বিমান নিজের এজেন্টদের দিয়ে পোড়ায় লাহোরে। এতে পাকিস্তানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ভারত এই বিমান পোড়ানোর অজুহাতে ভারতের ওপর দিয়ে পাক বিমানকে বাংলাদেশে উড়ে আসতে দিতে অস্বীকার করে। ভারত এটা করেছিল ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে দিয়ে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উরি সেনাছাউনিতে ঢুকে ১৮ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা একটা সাজানো নাটকও হতে পারে। কেননা, অত সহজে সেনাছাউনিতে ঢোকা হামলাকারীদের পক্ষে মোটেও সহজ নয়। ঘটনাটিকে তাই মনে হচ্ছে যথেষ্ট রহস্যময়। এটা ১৯৭১ সালের কাশ্মির থেকে বিমান হাইজ্যাকের মতোই একটা যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য হয়ে থাকতে পারে। সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারিয়ে, পাকিস্তানকে অধিকার করে নেয়ার মতো ক্ষমতা ভারত এখনো অর্জন করতে পারেনি। ভারতের সমর প্রস্তুতি এখনো পারেনি সে পর্যায়ে পৌঁছাতে।