মাঞ্চু রাজারা চীনে রাজত্ব করেছেন ১৬৪৪ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত। ১৯১২ সালে চীনের বিখ্যাত নেতা সান ইয়াৎ-সেন (১৮৬৬-১৯২৫) চীনে স্থাপন করেন আধুনিক চীন প্রজাতন্ত্র। তার প্রজাতন্ত্রের মূলনীতি ছিল তিনটি। চীনের জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জনসাধারণের আর্থিক উন্নয়ন। যাকে চীনা ভাষায় বলা হয় সান মিং চুই। তিনি গড়েন একটি জাতীয়তাবাদী দল।
বলা হয়, এ দল কার্যকর করবে এই নীতি। দলটির নাম রাখেন কুয়া মিং তাং। এই দল ছিল বিশেষভাবেই চীনা জাতীয়তাবাদী। এই চীনা জাতীয়তাবাদী দলকে উৎখাত করে ১৯৪৮ সালে চীনে ক্ষমতায় আসেন কমিউনিস্টরা। কুয়া মিং তাং দল সেনাপতি চিয়াং কাই সাকের (১৮৮৭-১৯৭৫) নেতৃত্বে চীনে থাকতে না পেরে ফরমুজা দ্বীপে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন। ফরমুজা নামটা জাপানি। বর্তমানে দ্বীপটির নাম দেয়া হয়েছে তাইওয়ান। তাইওয়ান থেকে কুয়া মিং তাংয়ের শাসন এখনো বিলুপ্ত হয়নি।
যাকে বলে মহাচীন, তা ঠিক এক জাতির দেশ নয়। চীনের মূল জাতিকে বলা হয় হান। চীনের ইতিহাস ও সভ্যতা বলতে প্রধানত এদের সভ্যতা ও ইতিহাসকেই বোঝায়। এরা বাস করেন মূলত ইয়াৎ সি ও হোয়াংহো নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। এখানে প্রধানত গড়ে ওঠে প্রাচীন চীনের সভ্যতা। যেমন কম্পাস, কাগজ, কাঠের অক্ষর দিয়ে ছাপার কাজ ও বারুদ। এ ছাড়া, এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় চীনামাটি দিয়ে বাসনপত্র তৈরির কায়দা। যার জন্য চীন পায় বিশেষ প্রসিদ্ধি। চীনের চীনামাটির শিল্পকলা খুব উন্নত হয় মিং রাজাদের সময় (১৩৬৮-১৬৪৩)।
এ ছাড়া, চীনারা কাঠ ও লোহার কাজ খুব নিপুণভাবে করতে পারত। চীনারা সাধারণত বাড়ি-ঘর বানাত কাঠ দিয়ে। বাড়ির ছাদগুলো হতো কতকটা তাঁবুর মতো উপর দিকে বাঁকা, যা চীনা স্থাপত্যকে দিয়েছে চৈনিক বৈশিষ্ট্য। যে ভৌগোলিক অঞ্চলকে বলে মাঞ্চুরিয়া, সেখানে বাস করতেন মাঞ্চু জাতি। এরা হান চীনা নন। তবে উভয়েই মানবধারার দিক থেকে মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত। মাঞ্চু রাজা এসে হানদের দেশ দখল করেন ১৬৪৪ সালে। ১১ জন মাঞ্চু রাজা (এদের চিং রাজাও বলে) চীনে রাজত্ব করেন।
মাঞ্চু রাজারা যখন হানদের দেশ জয় করে রাজত্ব শুরু করেন, তখন হানরা দলে দলে যেতে থাকেন মাঞ্চুরিয়ায়। এর ফলে হান এবং মাঞ্চুদের মধ্যে ঘটে বেশ কিছু মিশ্রণ। এখন চীনে খাঁটি মাঞ্চু এখানে সেখানে কিছু দেখা গেলেও, আর আগের মতো দেখা যায় না। মাঞ্চুরা এখন আর চীনে সংখ্যায় বেশি নন। হানরাই হচ্ছেন সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।
চীনা জাতি বলতে তাই হানদের কথাই প্রথম মনে আসে, কিন্তু চীনে অন্য জাতিও আছে। যেমন, উইঘুর মুসলমান। এরা চীনা ভাষায় কথা বলেন না। কথা বলেন প্রধানত তুর্কি পরিবারভুক্ত ভাষায়। উইঘুরদের দেশকে চীনা প্রজাতন্ত্রে একসময় উল্লেখ করা হতো সিনকিয়াং। এখন বলা হচ্ছে- জিংজিয়াং। উইঘুররা চীনে বাইরে থেকে আসেননি। তারা চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়েছেন।
কারণ, মাঞ্চু রাজা খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তাদের দেশ দখল করার কিছু আগে দিয়ে মাঞ্চু রাজারা দখল করেন তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া। এভাবেই সৃষ্টি হতে পেরেছে আজকের মহাচীন রাষ্ট্র। মঙ্গোলিয়া এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এর এক ভাগকে বলা হয় বহির্মঙ্গোলিয়া যা এখন পরিণত হয়েছে একটা পৃথক রাষ্ট্রে (১৯৪৫)। একে বলা হয় ভেতর মঙ্গোলিয়া, সেই অংশই এখন আছে কেবল মহাচীনের সাথে। চীনে দুই ধরনের মুসলমান দেখা যায়।
একধরনের মুসলমান হলেন উইঘুর- যারা এখন চীনের নাগরিক। অন্য দিকে চীনে আর একদল মুসলমান আছেন, যাদের বলা হয় হুই। এদের পূর্বপুরুষকে চীনে কাজ করার জন্য চেঙ্গিস খান ধরে আনেন আনাতোলিয়া, সিরিয়া, ইরাক, মধ্য এশিয়া ও পারস্য থেকে। এরা চীনের নানা জায়গায় আছেন। তবে চীনের কানসু প্রদেশে এদের সংখ্যা হলো বেশি। এরা খুব নিষ্ঠাবান মুসলমান।
এরা আরবিতে কুরআন পড়েন। এদের ছেলেমেয়েরা প্রথম মসজিদ-স্কুলে যায়। এদের নাম রাখা হয় আরবি-ফারসিতে। এরা বাইরে হানদের ভাষায় কথা বললেও বাড়িতে যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে আরবি-ফারসি শব্দ থাকে বেশি। উইঘুরদের সাথে এবং হুইদের সাথে চীনের কমিউনিস্ট প্রশাসন করছে চরম দুর্ব্যবহার। প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে এখন রাখা হয়েছে প্রায় বন্দী অবস্থায়।
কাশ্মিরের লাদাখ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে তিব্বত থেকে সিংকিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত বানানো হয়েছে চওড়া-পাকা সড়ক। তার মধ্য দিয়ে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার এখন খাস চীন থেকে তিব্বতের মধ্য দিয়ে লাদাখ হয়ে সিংকিয়াংয়ে পাঠাচ্ছে সৈন্য। যারা জঘন্য অত্যাচার করছে উইঘুর নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর। সিংকিয়াংয়ের গুরুত্ব চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এখন আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে। কেননা, সিংকিয়াংয়ে পাওয়া গেছে ইউরেনিয়ামের খনি। আমি ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কোনো এক লেখায় বলেছিলাম, চীন ১৯৬২ সালে ভারতকে আক্রমণ করেছিল।
এতে জনৈক পাঠক আমাকে খুব কড়া সমালোচনা করেছেন (৩ মার্চ ২০১৯, নয়া দিগন্ত)। আমার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, উইঘুর ও হুই মুসলমানদের ওপর চীন যে অত্যাচার করছে, সে সম্পর্কে তিনি কি কোনো কিছু ভাবছেন? যদি ভাবেন, তবে তার ভাবনার কথা পত্রিকা মারফত লিখে জানালে বাধিত হবো। চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে ভারতকে আগে আক্রমণ করেছিল না, কিন্তু যখন ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কিউবা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন সেই গোলযোগের সুযোগ নিয়ে চীন ভারতকে আক্রমণ করেছিল।
বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় হয়েছিল অনেক আলোচনা। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু এর আগে বলেছিলেন, হিন্দি-চিনি ভাই ভাই। এর পরেই চীনের তরফ থেকে আসে এই আক্রমণ। আন্তর্জাতিক আইন বলে, কাউকে আক্রমণ করতে গেলে, তাকে একটা চরমপত্র দেয়া দরকার; কিন্তু চীন ভারতকে কোনো চরমপত্র দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
চীন অবশ্য বলে, ভারত কোনো চরমপত্র না দিয়েই চীনকে আক্রমণ করতে এসেছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো, যুদ্ধ কেবল লাদাখে হয়নি, যুদ্ধ হয়েছিল লাদাখ থেকে অনেক দূরে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে; যা এখন হলো অরুণাচল প্রদেশ।
যাকে বলা হয়, ম্যাকমাহন লাইন, তা অঙ্কিত হয়েছিল ১৯১৪ সালে সিমলা সম্মেলনে। এই সম্মেলনে ব্রিটিশ-ভারতের সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ম্যাকমাহন। তিব্বতের প্রতিনিধি হিসেবেও ছিলেন একজন উপস্থিত। তিনি প্রায় স্বাধীন তিব্বতের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথকভাবে ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন খাস চীনেরও প্রতিনিধি।
তিব্বতের প্রতিনিধি তিব্বত ও ব্রিটিশ-ভারতের সীমানা হিসেবে ম্যাকমাহন লাইনকে মেনে নেন। কিন্তু চীনের প্রতিনিধি মানেন না। চীনের প্রতিনিধি লাদাখে ও অরুণাচলে ম্যাকমাহন রেখাকে চীন-ভারতের মধ্যে সীমানা বলে না মানলেও, একই ম্যাকমাহন লাইনকে উত্তর বার্মা (মিয়ানমার) ও চীনের মধ্যেকার সীমান্তরেখা বলে চীন মেনে নিয়েছে। চীন কেন একই ম্যাকমাহন লাইনকে দু’রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছে, সেটির অর্থ স্পষ্ট নয়। সে বার্মার সাথে ম্যাকমাহন লাইনকে সীমা বলে ধরছে, কিন্তু ভারতের সাথে ধরছে না।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, চীন ভারতের সাথে যেভাবে সীমানা ঠিক করতে চাচ্ছে, সেটি যদি মানতে বাংলাদেশ সরকার রাজি হয়, তবে বাংলাদেশকে দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু জায়গা চীনকে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা কি তাতে রাজি হবো? আমি আমার সমালোচকের কাছে এ বিষয়েও রাখতে চাই প্রশ্ন। আমি ভারতপন্থীও নই, চীনপন্থীও নই। আমি যা লিখি তা নিজের দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই লিখি।
ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, তিব্বতের রাজা প্রাচীনকালে প্রায় রংপুর পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন। তিব্বতের রাজার কথা যদি টানি, তবে সেই সূত্রে চীনকে রংপুরের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত হয়তো আমাদের হবে ছাড়তে। আমার লেখার সমালোচক বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের কী অধিকার আছে চীনের সীমানা ঠিক করার। তার কথার উত্তরে আমি আরো কিছু ইতিহাস উল্লেখ করতে চাই।
তা হলো- ১৯৩১ সালে জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে। ১৯৩৭ সালে সে চীনের মধ্য ভাগের খানিকটা দখল করে নেয়। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৯৪৫ সালে জাপান যদি যুদ্ধে পরাজিত না হতো, তবে গোটা চীনই সম্ভাবত চলে যেত জাপানের নিয়ন্ত্রণে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন ও আমেরিকা যুদ্ধে জিতেছিল বলেই আজকের চীন টিকে আছে।
৮ মার্চ, ২০১৯ এ লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্তে।