কুলদীপ নায়ারের লেখা স্তম্ভ (কলাম) আমি মাঝে মধ্যে পড়তাম। তার লেখার ধরন আমার ভালো লাগত। যদিও অনেক সময় মনে হতো, তিনি সমস্যাকে দেখছেন খুব সরল করে। তিনি ভুগছেন সরলীকরণ দোষে। যেমন : তিনি বিশ্বাস করতেন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের, কিন্তু আলোচনা করতেন না শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিবন্ধক কারণগুলো নিয়ে। যুদ্ধের কারণ বজায় রেখে কখনোই সম্ভব হতে পারে না শান্তিপূর্ণভাবে দু’টি রাষ্ট্রের সহাবস্থান।
তিনি প্রতি বছর ১৪ ও ১৫ আগস্ট অমৃতসরের কাছে পাক-ভারত সীমান্তে মোমবাতি জ্বালাতেন দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তির প্রত্যাশা নিয়ে। আমি তাকে মানবতন্ত্রী বলছি কারণ, তিনি ছিলেন শান্তির পক্ষে; যুদ্ধের পক্ষে নয়। যদিও তিনি হতে পারতেন একজন চরম হিন্দুত্ববাদী। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। তিনি উঠতে পেরেছিলেন তার ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি ছিলেন ভিপি মেনন। তিনি বল্লভ ভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি না মানলে সারা ব্রিটিশ-ভারতজুড়ে শুরু হবে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধ এড়াতে হলে আপাতত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নেয়া উচিত। না হলে এই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে না। প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরু কৌশলগত কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে মেনে নেন। কিন্তু এরা প্রস্তাব রাখেন, তদানীন্তদন পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশকে ভাগ করার। এরা মনে করেন, পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে পাকিস্তান অর্থনৈতিক কারণে শেষ পর্যন্ত টিকবে না। তাকে এসে যুক্ত হতে হবে ভারতেরই সাথে। তারা তাই পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব রাখেন। ব্রিটেন এই প্রস্তাবে যে কারণেই হোক রাজি হয়। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার সাথে সাথে সাবেক পাঞ্জাবে শুরু হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। দাঙ্গা শুরু হয় এক পক্ষে পাঞ্জাবি মুসলমান, আর এক পক্ষে পাঞ্জাবি হিন্দু ও শিখ, এই দুই পক্ষের মধ্যে। এই দাঙ্গায় মারা যায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। যে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার কথা ভেবে বল্লভভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরু কৌশলগত কারণে মেনেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি, সেই গৃহযুদ্ধই সংঘটিত হলো সাবেক পাঞ্জাব প্রদেশে। পাঞ্জাবে যা ঘটল তাকে দাঙ্গা না বলে গৃহযুদ্ধ বলাই সঙ্গত।
সমস্ত উত্তর ভারতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শুরু হয় মার-দাঙ্গা। আর এর ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। মানব ইতিহাসে ইতঃপূর্বে যার কোনো নজির পাওয়া যায় না। পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা চলে যেতে থাকে ভারতে। তারা ভারতে চলে যেতে থাকে এই ভেবে যে, তারা চলে গেলে অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গ অচল হয়ে পড়বে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পাঞ্জাবে যে রকম দাঙ্গা হয়েছিল, বাংলাদেশে তেমন দাঙ্গা কখনো সংঘটিত হয়নি। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা অনুভব করেনি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ভারতে যাওয়া, যেমন পাঞ্জাবে হিন্দু ও শিখরা মনে করেছিল প্রাণ রক্ষার জন্য।
কুলদীপ নায়ার ১৪ আগস্ট ১৯২৩ সালে জন্মেছিলেন শিয়ালকোটে (কবি ইকবালের জন্মস্থান)। তিনি জন্মেছিলেন পাঞ্জাবি হিন্দু পরিবারে। তিনি লেখাপড়া শেখেন প্রধানত তদানীন্তন সমগ্র পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোর শহরে। তিনি লাহোরে খ্রিষ্টান মিশনারি কলেজ ফরমান খ্রিষ্টিয়ান কলেজ থেকে বিএ (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর লাহোর ল’ কলেজ থেকে আইনে এলএলবি ডিগ্রি গ্রহণ করেন, কিন্তু আরম্ভ করেন সাংবাদিকতা। পাঞ্জাবে এ সময় ছিল উর্দু ভাষার প্রবল প্রতাপ। কুলদীপ নায়ারের পারিবারিক ভাষাও হয়ে উঠেছিল উর্দু। তিনি প্রথম সাংবাদিকতা শুরু করেন ‘আঞ্জাম’ নামক উর্দু পত্রিকার একজন সাংবাদিক হিসেবে।
কিন্তু তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লাহোর ছেড়ে নয়া দিল্লি এসে আরম্ভ করেন ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সাংবাদিকতা এবং তিনি ইংরেজি ভাষাতেই লিখেছেন তার বিভিন্ন গ্রন্থ। তিনি দিল্লিতে The Statesman নামক ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। The Statesman পত্রিকা একসময় কেবল প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে। পত্রিকাটি ছিল মূলত ব্রিটিশ প্রশাসনের মুখপত্র। পরে তা যৌথভাবে প্রকাশিত হতে থাকে নয়া দিল্লি থেকেও। কুলদীপ নায়ারের মানসিকতা ছিল বেশ কিছুটা ব্রিটিশ প্রশাসন ঘেঁষা।
কুলদীপ নায়ার খ্যাত তার সাংবাদিকতার জন্য। কিন্তু তিনি বাস্তব রাজনীতিও করেছেন। জেলে গিয়েছেন রাজনীতির কারণে। তিনি জেলে যান ইন্দিরা গান্ধী যখন ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন (১৯৭৫-১৯৭৭)। কুলদীপ নায়ার জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে অংশ নেন এবং ধৃত হয়ে যান জেলে। কিন্তু পরে তিনি একপর্যায়ে (১৯৯০) গ্রেট ব্রিটেনে পান ভারতের হাইকমিশনার পদে নিযুক্তি। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি জাতিসঙ্ঘে যান ভারতের একজন ডেলিগেট হয়ে। পরে (১৯৯৭) তিনি ভারতের রাজ্যসভায় নোমিনেটেড সদস্য হন।
কিন্তু তিনি খ্যাতিমান হয়ে আছেন প্রধানত পত্রিকায় তার প্রকাশিত রাজনৈতিক স্তম্ভের কারণে। তিনি লিখেছেন ইংরেজিতে। পরে ভারতে বিভিন্ন ভাষায় তা অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ভারতের বিভিন্ন ভাষার পত্রিকায়। তার কিছু লেখা বাংলাদেশের পত্রিকাতেও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। কুলদীপ নায়ার ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর একটি সংবাদ নিবন্ধ লিখেন, The Birth of Bangladesh নামে। এতে তিনি বলেন, পাকিস্তানের উচিত হবে ১৯৭১ সালে পাকফৌজ বাংলাদেশের মানুষের ওপর যে অমানবিক আচরণ করেছিল, তার জন্য ক্ষমা চাওয়া।
এই ক্ষমা চাওয়া হবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উপযোগী। একপর্যায়ে ভারতে বিশেষ গুজব রটে যে, কুলদীপ নায়ার হলেন পাকিস্তানের গুপ্তচর। তার বিরুদ্ধে এই গুজব রটার একটি কারণ ছিল, পাকিস্তানের DAWN পত্রিকায় লেখা তার একটি প্রবন্ধ। যাতে তিনি লিখেন, হিন্দু চরমপন্থা ভারতে উৎসাহ পাচ্ছে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি যোগ দেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বলে যে, এই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ISI- এর আর্থিক আনুকূল্যে।
এই সভার আলোচ্য বিষয় ছিল, ভারতে হিন্দু জঙ্গিবাদের উত্থান। কুলদীপ নায়ার গত ২৩ আগস্ট ২০১৮ সালে প্রাণত্যাগ করলেন নয়া দিল্লির এক হাসপাতালে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেখা গেলো তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে। নরেন্দ্র মোদি কুলদীপ নায়ারকে উল্লেখ করলেন একজন সাহসী সাংবাদিক হিসাবে। কেউই তাকে তার মৃত্যুর পর সমালোচনা করলেন না পাকিস্তানের চর হিসেবে। যত দূর মনে পড়ছে, কুলদীপ নায়ার একবার ঢাকায় এসেছিলেন সরেজমিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতে।
এ সময় তিনি ঢাকার একাধিক বুদ্ধিজীবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। যেসব বুদ্ধিজীবীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন, শুনেছি বদরউদ্দীন উমর ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। অনেকের ধারণা যে, যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার উদ্ভাবক হলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ; কিন্তু ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাসে দেখি পাঞ্জাবের বিখ্যাত হিন্দু নেতা লালা লাজপৎ রাই ১৯২৫ সালে তার একটি রাজনৈতিক লেখায় বলেন যে, ব্রিটিশ ভারতের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধান করবার জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পশ্চিমাংশের মুসলিমপ্রধান এলাকা নিয়ে গড়তে হবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ। একইভাবে আরো একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়তে হবে ব্রিটিশ-ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে। এ থেকে বলা যায় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধারণা ঠিক মুসলমানদের মাথা থেকে আসেনি। এই ধারণার প্রথম আভাস পাওয়া যায় বিখ্যাত পাঞ্জাবি হিন্দু নেতা লালা লাজপৎ রাইয়ের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মধ্যে। কুলদীপ নায়ারের সাথে বেশ কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় লালা লাজপৎ রাইয়ের ধ্যানধারণার।
২০১৮ সালে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত।