‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে ঠিক কী বুঝতে হবে, সেটা এখনো আমার কাছে স্বচ্ছ নয়। আর সেটা নয় অনেক কারণেই। কার কাছ থেকে কে কিভাবে মুক্ত হয়েছিল, সেটা এখনো হয়ে আছে বিতর্কিত। প্রথম কথা, এখন যাকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ, এক সময় তাকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান। এর সীমান্ত রচিত হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ারই ফলে। বাংলাভাষী মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল বলেই তা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। এটা ছিল একটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন ব্যাপার। এখন এই ইতিহাসকে চলেছে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আসলে এই পাকবাহিনী ছিল না বাইরে থেকে আসা কোনো বাহিনী। তারা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল স্বাভাবিক কারণেই। এ সময় তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে যে সেনাবাহিনী ছিল, তাতে প্রায় ২৪ হাজার সৈন্য ছিল বাংলাভাষী। পাকবাহিনী কেবলই যে পাঞ্জাবি মুসলিম সেনাদের দ্বারা গঠিত ছিল, তা নয়। ১৯৬৫ সালে কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাঞ্জাবি মুসলিম সেনাদের ভেবেছে নিজেদের লোক হিসেবে। কিন্তু এই সেনাদের ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপটে বলা হতে থাকে ‘পাক হানাদার বাহিনী’। ১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিল অভিহিত হচ্ছে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
আরো আগের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। এর সৃষ্টি হতে পেরেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে এক বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে। এতে ছিল তদানীন্তন বাংলার মুসলিম জনসমাজের বিশেষ অবদান। দ্বিজাতিতত্ত্বের, অর্থাৎ হিন্দুরা হলেন একটি জাতি আর মুসলমানেরা হলেন আরেকটি জাতি’; এই ধারণার উদ্ভব হয় ব্রিটিশ শাসনামলের সময়। এর সাথে ছিল না প্যান ইসলামিক মতবাদের (নিখিল মুসলিম ভ্রাতৃত্ববাদের) সংশ্লিষ্টতা।
পাকিস্তান আন্দোলন ছিল এই উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যেই বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এতে একটি উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল ইসলাম ধর্ম। তবে ধর্মই এর একমাত্র উপাদান ছিল না। গ্রেট ব্রিটেনের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী হারবার্ট হেনরি অ্যাসকুইথ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্সে ১৯০৯ সালে বলেন, ভারতে হিন্দু-মুসলমান পার্থক্য শুধু ধর্মের পার্থক্য নয়। ঐতিহ্য ও সামাজিক রীতিনীতির দিক দিয়েও তারা স্বতন্ত্র।’ ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যাকে কেবল ধর্মীয় বিরোধ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে ভুল করা হয়। ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারে ভারতের মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এবং মুসলমানদের প্রদান করা হয় স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র নির্বাচনের রাজনৈতিক অধিকার। মর্লি-মিন্টোর সংস্কারে মুসলমানদের দেয়া হয়েছিল সংখ্যাতিরিক্ত আসন। এই নীতি অনুসারে তদানীন্তন বাংলার ব্যবস্থাপক সভায় সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলীতে মুসলমানদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার ছিল। অধিকন্তু বাংলার পাঁচটি বিশেষ মুসলিম আসন নির্দিষ্ট হয়েছিল স্বতন্ত্র নির্বাচনের ভিত্তিতে। অর্থাৎ দেয়া হয়েছিল এ পাঁচটি আসনে কেবল মুসলমান ভোটের মাধ্যমে কেবল মুসলিম সদস্যদের নির্বাচনের অধিকার।
এখন বলা হচ্ছে, দ্বিজাতিতত্ত্ব নাকি ছিল জিন্নাহর মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু জিন্না মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। তার মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার আগেই হয়েছিল মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কার। ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গ্রহণ করেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ প্রস্তাব। এ প্রস্তাবটি মুসলিম লীগের ওই সভায় উত্থাপন করেছিলেন তখনকার বাংলার বিখ্যাত নেতা এ কে ফজলুল হক। এখন বোঝার চেষ্টা হচ্ছে, বাংলাভাষী মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক ছিলেন না।’ কিন্তু সেটা ইতিহাস নয়। বাংলাভাষী মুসলমানের সমর্থনেই হতে পেরেছিল সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এখানে আমরা যা বললাম, তা যাচাই করা কঠিন নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে সহজেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। এগুলো সবই ঐতিহাসিক দলিলে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, যা এখনো উইপোকায় খেয়ে ফেলেনি।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন, সেটা এখনো আমাদের মতো অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ইতিহাসে বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতায় বলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। তিনি অর্থাৎ শেখ মুজিব হলেন একজন মধ্যপন্থী নেতা। তার সাথে আলোচনার পথ এখনো খোলা আছে। তার সাথে আলোচনার মাধ্যমে তাই পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান হতে পারে শান্তিপূর্ণভাবে।’ ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তান নামটি ব্যবহার না করে করেছিলেন পূর্ব বাংলা।
আমরা এখন অন্য একাধিক সূত্র থেকে জেনেছি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অথবা তার পরে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। আওয়ামী লীগের অন্য নেতা বলেছেন, তিনি (শেখ মুজিব) স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। যদি তাদের কথা সত্যিই হতো, তবে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আবার স্বাধীনতার ঘোষাণাপত্র পাঠের প্রশ্ন উঠত না। এতে বলা হয়েছে : পাকিস্তান সরকার যদি জাতীয় পরিষদকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে দিত, তবে প্রয়োজন হতো না বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর শেখ মুজিবের সাথে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের আলোচনা হয়। এই আলোচনা হয়েছিল বেশ গোপনে। কিন্তু এখন এই আলোচনার বিবরণ আর গোপনীয় হয়ে নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে তা প্রকাশ করা হয়েছে। কিসিঞ্জার-মুজিবের এই আলোচনার বিবরণীতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১-এর যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ না বলে বলা হয়েছে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ। আলোচনা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়। Civil war কথাটির বাংলা করলে বলতে হয় গৃহযুদ্ধ। এসব কারণে ১৯৭১-এর যুদ্ধের প্রকৃত রূপ অনেকের কাছে স্পষ্ট হতে পারেনি।
কথাগুলো বলার প্রয়োজন অনুভব করছি বিশেষ এক কারণে। সম্প্রতি ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হচ্ছে না ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকার কারণে।’ কিন্তু পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেরই আছে রাষ্ট্রধর্ম। যেমন, ব্রিটেনের রাষ্ট্রধর্ম হলো অ্যাংলিকান খ্রিষ্টধর্ম। কিন্তু তাই বলে ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি নজিরবিহীন রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের অনেক আগেই মালয়েশিয়া রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করেছে। কোনো দেশের রাষ্ট্রধর্ম থাকলেই সে দেশে অন্য দেশের লোকেরা বাস করতে পারেন না, এমন নয়। মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ হচ্ছে ভারতের তামিল বংশোভূত হিন্দু। কিন্তু তাদের যে মালয়েশিয়া পরিত্যাগ করে ভারতে চলে আসতে হচ্ছে, এমন নয়। ভারত মালয়েশিয়ার সমালোচনা করছে না ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার জন্য। কিন্তু ভারতের অনেক দল বাংলাদেশের সমালোচনা করছে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার জন্য। এমনকি ভারত ইসরাইলকে দিয়েছে স্বীকৃতি যার রাষ্ট্রধর্ম হলো ইহুদি ধর্ম। বাংলাদেশের কথিত মুক্তমনা ব্লগাররা ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক নন। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামের নবী সা: সম্পর্কে করে বসেছেন এমন অনেক মন্তব্য, যা এই দেশের মানুষকে করেছে ক্ষুব্ধ। এ পরিস্থিতিতে ঘটতে পেরেছে একাধিক ব্লগারের মৃত্যু।
বাংলাদেশের দু’জন খ্যাতনামা শিাব্রতী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্বদানের প্রসঙ্গ পত্রপত্রিকায় বিশেষভাবে এসেছে। এদের একজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়। আরেকজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরেটাস প্রফেসর আনিসুজ্জামান (পদ্মভূষণ)। অজয় রায়ের পুত্র মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায় ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। আনিসুজ্জামান নিজেই হয়েছেন হত্যার হুমকির সম্মুখীন। অভিজিৎ রায় সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানি না। কিন্তু তার পিতা অজয় রায় সম্পর্কে শুনেছিলাম, তিনি নাকি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থাৎ সিপিবির একজন তাত্ত্বিক গুরু। ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান দখল করে, তখন সিপিবি বলেছিল, বাংলাদেশেও করতে হবে আফগান স্টাইলে বিপ্লব। এটা বলা হয়েছিল ঢাকায় ১৯৮০ সালের ১৩ জানুয়ারিতে এক বিশেষ সভায়। অজয় রায় ছিলেন তখন সিপিবির একজন তাত্ত্বিক। আমি যা শুনেছিলাম, তাতে ভুল থাকা সম্ভব। তবে অজয় রায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন ভক্ত ছিলেন, সেটা একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকেই পেরেছিলাম জানতে। তথাপি আমার তথ্যে ভুল থাকতে পারে।
অন্য দিকে আনিসুজ্জামান সাহেবও এক সময় মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের সাথে ছিলেন হার্দিক। তাকে ১৯৭১ সালে কলকাতায় মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট বলে পরিচিত মহলের সাথে ওঠাবসা করতে দেখেছিলাম। তিনি কলকাতায় গড়েছিলেন একটি নাচগানের দল। এই নাচগানের দল নিয়ে ঘুরেছিলেন সারা ভারতের বড় বড় শহরে। এর ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নাচগানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতীয় জনমত গঠন। তারা তাদের এই কাজে পেয়েছিলেন ভারত সরকারের অনুদান। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর দু’জন প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। একজন হলেন পি এন হাক্সার; অপরজন হলেন ডি পি ধর। এরা দু’জন ছিলেন এই নাচগানের দলের সহায়ক। এদের পরামর্শে ইন্দিরা সরকার আনিসুজ্জামানকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন।
সে সময় থেকেই সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে ভারত সরকারের সাথে। অনেক পরে ভারতের কংগ্রেস সরকার তাকে প্রদান করেছে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব। আনিসুজ্জামান সাহেব নিয়েছেন এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ উদ্যোগ, ভারত সরকার বাংলাদেশের আর কাউকে পদ্মভূষণ সম্মান প্রদান করেনি। পদ্মভূষণ সম্মান নেয়ার জন্য আনিসুজ্জামান গিয়েছিলেন দিল্লি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। তিনি চিত্র পরিচালক হিসেবে পেয়েছেন বিরাট খ্যাতি। ঋত্বিক ঘটক একসময় ছিলেন রাজশাহী শহরের লোক। সেই সুবাদে তাকে আমি চিনতাম। আনিসুজ্জামানকে ঠিক কী কারণে ভারত সরকার পদ্মভূষণ খেতাব দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে, আমরা তা জানি না। কিন্তু তিনি যে ভারতের প্রিয়পাত্র, এটা আন্দাজ করতে পারি। সম্প্রতি তিনি পেয়েছেন কোনো মহল থেকে হত্যার হুমকি। তাকে নিয়ে তাই পত্রপত্রিকায় বিশেষ আলোচনা।
কয়েক দিন আগে (প্রথম আলো, ১৯ নভেম্বর ২০১৫) তাকে নিয়ে লেখা একটি সংবাদ-নিবন্ধ পড়লাম। একজন নিবন্ধকার লিখেছেন, ‘কারা হত্যার হুমকি দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে; তারচেয়েও গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, ক্রমাগত এই হুমকি ও হামলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। জনগণের মধ্য থেকেও তেমন জোরালো প্রতিবাদ ল করছি না।’ লেখক আনিসুজ্জামানের একজন খুবই ভক্ত বলে মনে হলো আমার কাছে। তিনি তার লেখায় আনিসুজ্জামানকে বলতে চেয়েছেন, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে একজন প্রথম শ্রেণীর গবেষক। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘আনিসুজ্জামান সাহেব ব্রিটিশ লাইব্রেরির দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে প্রমাণ করেন যে, ঔপনিবেশিক শক্তি এ দেশে আসার অনেক আগেই বাংলা গদ্য চালু ছিল।’ কিন্তু যত দূর জানি, ইংরেজ এই দেশে আসার আগেও যে এ দেশে বাংলা গদ্য ছিল সে কথা আরো অনেক ব্যক্তি বলেছেন। এক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান সর্বপ্রথম ব্যক্তি নন।
বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ হলো পর্তুগিজ পাদ্রি Manuel da Assumpcao মানুয়েল-দা-আসসুম্পাসাওঁ লিখিত Crepar Xaxtrer Orthbhed ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’। বইটি ছাপা হয় ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে। মানুয়েল দা তার এই বই লিখেছেন রোমক বর্ণমালায় পর্তুগিজ উচ্চারণে, বাংলা অক্ষরে নয়। এই বইতে যে গদ্য ব্যবহৃত হয়েছে তা খুবই প্রাঞ্জল। আগে থেকেই বাংলা গদ্য প্রচলিত না থাকলে মানুয়েল-দার পক্ষে বাংলা শিখে এত ভালো গদ্য লেখা সম্ভব হতো না। মানুয়েল তার বই লিখেছিলেন ঢাকার কাছে ভাওয়ালে বসে। অর্থাৎ তিনি বাংলা শিখেছিলেন ঢাকাতে। ঢাকাতে প্রচলিত ছিল সাধু বাংলা লেখার চল। পাদ্রি মানুয়েল-দা পর্তুগিজ ভাষায় রচনা করেন বাংলা ব্যাকরণ। সঙ্কলিত করেন বাংলা-পর্তুগিজ অভিধান।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গবেষণা করে তাই বাংলা গদ্যের ইতিহাস আনিসুজ্জামান সাহেব কী করে উদ্ধার করেছিলেন, আমাদের কাছে সেটা খুব স্পষ্ট নয়। তার সম্পর্কে মনে হচ্ছে তার ভক্তরা অনেক অতিরঞ্জিত কথার অবতারণা করছেন। আনিসুজ্জামান বর্তমান বাংলাদেশে জন্মেছিলেন না। তার জন্ম পশ্চিম বাংলার সাবেক চব্বিশপরগনায়। সেখান থেকে পাকিস্তান হওয়ার পর আসেন ঢাকায়। এ রকমই শুনেছি। তিনি পূর্ব বাংলার মানুষকে খুব ভলোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি থেকেছেন ‘বাঙালদের’ থেকে দূরে। তিনি চেয়েছেন, বাংলাদেশে প্রমিত বাংলার ব্যবহার, যার অর্থ হলো, পশ্চিম বাংলার গদ্যকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা যে গদ্য লিখছি, তার উৎস ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চল। কিন্তু এই বাংলার ওপর পড়ছে পূর্ববঙ্গের বাগধারারও প্রভাব। যেটা আনিসুজ্জামানের কাছে পছন্দনীয় নয়। তিনি যে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, সেটা হলো বাঙালবিরোধী ‘ঘটি’ মনোভাব। বাঙালকে এক সময় নানাভাবেই ব্যঙ্গ করা হয়েছে। যেমন,
‘বাঙ্গাল মনুষ্য নহে
উড়ে এক জন্তু
লাফ দিয়ে গাছে ওঠে
লেজ নাই কিন্তু।’
আনিসুজ্জামানের বিপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়ার এটাও একটা কারণ। কেবল যে তারা ধর্মীয় কারণেই তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তা নয়। যদিও এখন প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে কেবল ধর্মীয় কারণেই তিনি পেতে পারছেন প্রাণনাশের হুমকি। তার ঢাকায় আসার বহু যুগ আগে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন চলতি বাংলাকে অনুমোদন দেয়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করেছিল এর সমালোচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা চেয়েছিলেন, সাধু বাংলাই হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত বাংলা গদ্যের ধারা। কেননা, তা বাংলার কোনো বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা নয়। যাই হোক, আনিসুজ্জামান সাহেব এ দেশের তেমন আপনজন হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
অনেক কিছুই ঘটছে, যার কথা আগে ভাবা যায়নি। আমরা যেন ফিরে যেতে চাচ্ছি এক ধর্মযুদ্ধের যুগে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ক্রুসেডের যুগ। আরব উপদ্বীপে ক্রুসেড হতে পেরেছিল খ্রিষ্টান ও মুসলমানের জেরুসালেম শহরকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে। ক্রুসেডে বিশেষ নেতৃত্ব দিয়েছিল ফ্রান্স। আজো যেন সে ওইরকম একটা নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছে। ক্রুসেডে গ্রিক অর্থোডকস গির্জা অংশ নেয়নি। রাশিয়া ছিল গ্রিক অর্থোডকস গির্জার আওতাধীন নেতৃস্থানীয় দেশ। কিন্তু সিরিয়ার গণ্ডগোলে সেও জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতার প্রভাব এসে পড়তে শুরু করেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেয়ে মুসলিম চেতনা প্রধান হয়ে উঠতে চাচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতেও। ১৯৭১-এর বিশ্ব পরিস্থিতি আর আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি এক নয়। যারা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি করার কথা, তাদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে।
(১৮.১১.২০১৫, দৈনিক নয়াদিগন্ত)