বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হচ্ছে। যার লক্ষ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা। দেশে কোনো শক্তিশালী নীতিনির্ভর সরকার প্রতিষ্ঠিত করা নয়। এ রকম যুক্তফ্রন্ট সরকার কোনো একটি দেশকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উপযোগী হয় না। আমাদের নিজেদের দেশের ইতিহাস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৫৪ সালে আমাদের দেশে, অর্থাৎ তাদানীন্তন পূর্বাবাংলা প্রদেশে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। যার লক্ষ্য ছিল, সে সময়ের পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ে গড়তে সক্ষম হয় না কোনো স্থিতিশীল শক্তিশালী সরকার। পূর্ববাংলায় রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা। পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদে স্পিকার খুন হন পরিষদের মধ্যেই। প্রধানত, পূর্ববঙ্গের এই বিশৃঙ্খলার অজুহাতকে নির্ভর করে সেনাপতি আইয়ুব খান আসেন পাকিস্তানের ক্ষমতায়।
গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রচলিত হয় সেনানিয়ন্ত্রিত তথাকথিত বুনিয়াদি গণতন্ত্র (Basic Democracy)। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল প্রধানত তিনজন নেতার নেতৃত্বে। এরা হলেন- আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শাহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জেতার পরপরই এদের মধ্যে শুরু হয় ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত। দেখা যায় নীতিগত বিরোধ। এবারে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হচ্ছে প্রধানত ড. কামাল হোসেন ও খ্যাতনামা চিকিৎসক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে। ড. কামাল হোসেন একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগের, অন্য দিকে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপিতে। কামাল হোসেনকে আওয়ামী লীগ ছাড়তে হয় শেখ হাসিনার চাপে। অন্য দিকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপি ছাড়তে হয় তারেক জিয়ার কারণে। অত্যন্ত অশিষ্টভাবেই তাকে নিষ্ক্রান্ত করা হয়েছিল বিএনপি থেকে। কিন্তু এখন সেই বিএনপি থেকেই তাকে আবার ডাকা হচ্ছে নেতৃত্বে। খালেদা জিয়া জেলে আছেন। তিনি জেল খাটছেন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে নয়। তিনি জেল খাটছেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট্রের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে। তিনি এই অভিযোগ থেকে ছাড়া পাবেন কি না, আমরা বলতে পারি না। সেটা দেখবে উচ্চ আদালত। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে আসছে আর তাই বিএনপিকে বাধ্য হতে হবে নির্বাচনে অংশ নিতে। না হলে দলটি হারাবে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব।
লক্ষ্য করার বিষয় বিএনপির নেতারা বিশেষ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুক্তফ্রন্ট গঠনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। দল হিসেবে বিএনপি সর্বসাধারণের মধ্যে এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয়। কিন্তু মির্জা সাহেব যাচ্ছেন না দেশের মানুষের কাছে। তিনি ছুটছেন জাতিসঙ্ঘে ও যাচ্ছেন মার্কিন প্রশাসনের কাছে। জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কেননা, বাংলাদেশ একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার ঘরোয়া রাজনীতি জাতিসঙ্ঘের নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা নয়।
মির্জা সাহেব ছুটছেন মার্কিন প্রশাসনের কাছে। কিন্তু তিনি মার্কিন প্রশাসনের কাছে একজন আদ্রিত ব্যক্তি নন। কারণ, তিনি তাদের কাছে পরিচিত একজন চীনঘেঁষা ব্যক্তি হিসেবে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে ভাবছে প্রতিদ্বন্দ্বী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে এ দেশে চীনবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে। তাই সে ইতোমধ্যে বলতে আরম্ভ করেছে চীনে ইউঘুর মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হওয়ার কথা। বাংলাদেশ একটা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলাম হলো তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইতে পারে তার সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। কিন্তু ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরী মনে করছেন জামায়াতবিরোধী কথাবার্তা বলে তারা পেতে পারবেন মার্কিন সহানুভূতি। যেটাকে মনে করা যেতে পারে তাদের রাজনৈতিক চিন্তার একটা বড় ঘাটতি।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তফ্রন্ট গড়তে গিয়ে বিএনপি জামায়াতকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাচ্ছে। অথচ জামায়াতের সমর্থন বিএনপিকে একসময় জুগিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। বাংলাদেশে জামায়াত একটা বড় দল ছিল না। জামায়াত শক্তিশালী হয়েছে বাংলাদেশ হওয়ার পরে। প্রধানত তার ভারতের আধিপত্যবাদবিরোধী নীতির কারণে। ঠিক ইসলামি মূল্যবোধের কারণে নয়। কেননা, সে কখনো বলেনি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হতে হবে ইসলাম।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যখন তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট। তিনি এটা করেছিলেন মালয়েশিয়ার অনুসরণে। এসব কথা আমরা আমাদের আগের একটা লেখায় বলেছি। বিখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্প্রতি তার একটি লেখায় বলেছেন, আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও যারা ধর্মনিরপেক্ষতা বাদে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে। কিন্তু শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় ধর্মনিরপেক্ষতার কথা একেবারেই বলছেন না। তিনি বরং সমালোচনা করছেন সুদখোরদের। সুদখোর বলতে সম্ভবত তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন ড. ইউনূসকে। ড. ইউনূসের পরামর্শে বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের অনুরোধ করেছিলেন হিলারি ক্লিন্টনকে ভোট দিতে। জানি না বেগম জিয়া কেমন করে, কী কারণে ভাবতে পেরেছিলেন, হিলারি ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে তিনি আবার হতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো পক্ষ গ্রহণ করেছিল না।
বর্তমানে মির্জা ফখরুল ইসলাম যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনেরই কাছে, যদিও তিনি মার্কিন প্রশাসনের কাছে একজন বাঞ্ছিত ব্যক্তি নন। বিএনপিরই এই মার্কিন প্রশাসনের কাছে ছোটাছুটি দেখে মনে হচ্ছে, তাদের নীতিনির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের যোগ্যতার অভাব। তাদের এই অযোগ্যতা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, বিএনপির নেতারা তাদের হাতে থেকে দেশের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে করতে চাচ্ছেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ও ড. কামাল হোসেনের লেজুড়বৃত্তি। যখন তাদের উচিত হচ্ছে, জনসাধারণের কাছে যাওয়া ও বিএনপির নিজের নীতিকে ব্যাখ্যা করার। ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরী চাচ্ছেন বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে ছুড়তে আর বিএনপি তাতেই হচ্ছে সম্মত। জানি না কী করে বিএনপি নেতাদের হতে পারছে এতটা অধগতি।
হাওয়ায় এখন নানা কথা ভাসছে। আমরা জানি না এসব কথায় কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত। সম্প্রতি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত Kathmandu Tribune নামক পত্রিকায় বলা হয়েছে, (সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৮) বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সামরিক একনায়কত্বের দিকে (Bangladesh heading towards military dictatorship)। নেপালের এই পত্রিকার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের ‘দৈনিক দাবানল২৪’ পত্রিকায় (অনলাইন) প্রচার করা হয়েছে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে সেনাশাসন, শেখ হাসিনা যাবে জেলে : নেপালের পত্রিকার খবর (সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮)। আমরা জানি না নেপালের পত্রিকা কতটা নির্ভরযোগ্য আর দাবানল২৪ পত্রিকা যা বলেছে তাইবা কতটা সঠিক। কিন্তু দাবানল পত্রিকার খবর জনমনে প্রশ্ন তৈরি করছে আসলে কি যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন হবে? না জাতীয় নির্বাচন স্থগিত হতে যাচ্ছে! আমরা এ ব্যাপারে কামাল হোসেন ও বি. চৌধুরীর কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো পাইনি। মনে হচ্ছে তারা বিষয়টি নিয়ে মোটেও ভাবিত নন; ভাবিত নন বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও। অতীতে আমাদের সেনাবাহিনী রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিএনপির জন্ম হয়েছিল সেনাশিবিরে। কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছিলেন প্রায় ২৪ হাজার বাংলাভাষী সৈন্য। এদের মধ্যে এগারো শ’ ছিলেন অফিসার পর্যায়ের। এরা ছিলেন ভারতের আধিপত্যবাদবিরোধী এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতি অনুরক্ত। এরা সবাই সমর্থন করেছিলেন জিয়াউর রহমানকে। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল শক্ত হাতে দেশকে এক চরম সঙ্কট মুহূর্তে নেতৃত্ব দেয়ার। সেনাবাহিনী রেখেছিল আমাদের ইতিহাসে একটা ইতিবাচক ভূমিকা। আমাদের সেনাবাহিনী অগণতান্ত্রিক নয়। তারা চলতে চান জনগণের সাথে সহযোগিতা করে। এরশাদ ক্ষমতায় এসেছিলেন বন্দুকের নল উঁচু করে। কিন্তু তাকে ক্রমেই হতে হয়েছিল নমনীয়। আর ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল গণআন্দোলনের চাপেই।