যুদ্ধকে এখন একটা অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু যুদ্ধে যারা জেতে তাদের ভাবা হয় না যুদ্ধাপরাধী। যারা হেরে যায় কেবল তাদেরই বিচার হতে দেখা যায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। আসলে যুদ্ধ করাটা অপরাধ নয়, অপরাধ হলো যুদ্ধে হেরে যাওয়াটা। অতীতে যখন এখনকার মতো কোনো আন্তর্জাতিক আইন ছিল না, যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে তখনো যুদ্ধে যারা হেরেছে তাদের হয়েছে প্রাণদণ্ড। যুদ্ধে হারাটা তখনো হয়েছে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। ১৮৫৭ সালে ঘটেছিল সিপাহি অভ্যুত্থান। সিপাহিরা হেরেছিলেন, জিতেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিপাহি অভ্যুত্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছয় হাজার ব্যক্তিকে তিন মাসে দিয়েছিল ফাঁসি। ঘটনাটি এই উপমহাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সিপাহিরা যদি যুদ্ধে না হারতেন, তবে তাদের পরতে হতো না ফাঁসির রজ্জু গলায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হারে। এর জন্য জাপানি নেতাদের, যারা যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের বিচার হয়। ২৮ জনকে দাঁড়াতে হয়েছিল টোকিও ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। এসব অপরাধীর অপরাধকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় : পৃথিবীর বিরুদ্ধে অপরাধ, হত্যা এবং সাধারণ যুদ্ধাপরাধ। পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বলতে বোঝায়, আগ্রাসী যুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিচালনা। হত্যা বলতে বোঝায়, সামরিক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থাকার সময় সামরিক কর্মী ও বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা এবং যুদ্ধের নিয়ম ও ঐতিহ্য লঙ্ঘন করে নরহত্যা। যেমনÑ যুদ্ধবন্দীদের হত্যা, বেসামরিক লোকজনকে ব্যাপক হারে হত্যা। সাধারণ যুদ্ধাপরাধ বলতে বোঝায়, যুদ্ধবন্দী হত্যা। অন্তরীণ বেসামরিক ব্যক্তিদের সাথে অমানবিক ব্যবহার। টোকিওতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার উপলক্ষে গঠিত ট্রাইব্যুনাল সাতজনকে ফাঁসির হুকুম দেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন তোজো। তোজো ছিলেন যুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী। ১৬ জনকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একজনকে দেয়া হয় ২০ বছরের কারাদণ্ড। একজনকে দেয়া হয় ৭ বছরের কারাদণ্ড। ইনি ছিলেন যুদ্ধের সময় জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিচার চলাকালীন দু’জন অভিযুক্তের মৃত্যু হয়। একজনকে সাব্যস্ত করা হয় মানসিক ভারসাম্যহীন। একে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যুদ্ধের পক্ষে ভাবাদর্শ রচনার জন্য।
১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে শহর দু’টি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। নিহত ও বিকলাঙ্গ হয় প্রায় চার লাখ ৪৭ হাজার বেসামরিক নর-নারী। জাপান এই সময় হেরে যাওয়ার পথেই ছিল। কিন্তু তথাপি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান পরমাণু বোমা নিক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে যুদ্ধাপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিতেছিল যুদ্ধে। এ বিষয়ে বিখ্যাত ব্রিটিশ পরমাণুবিজ্ঞানী P. M. S. Blackett (যিনি তার পারমাণবিক গবেষণার জন্য ১৯৪৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান) তার Military and Political Consequences of Atomic Energy বইয়ে বলেন, এই বোমা ফেলা হয়েছিল সামরিক প্রয়োজনে নয়, রাজনৈতিক কারণে। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছিল যে, সে হলো এখন একা ভয়ঙ্কর অস্ত্রের অধিকারী। তাই বিশ্ববাসীকে মেনে চলতে হবে তার নির্দেশ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমা বানাবার কয়েক মাসের মধ্যেই ব্রিটেন পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম হয়। এর পরে পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম হয় তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিকার আর থাকে না পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর। সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটে পারমাণবিক অস্ত্রের বিশেষ উন্নতি। কেবল তা-ই নয়, সে-ই প্রথম মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণে সক্ষম হয়, যা থেকে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে অনেক সহজেই ও অনেক নিখুঁতভাবে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা সম্ভব। অর্থাৎ এক দিকে যেমন বলা হচ্ছে যুদ্ধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, অন্য দিকে তার পাশাপাশি চলেছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের উদ্ভাবনা ও তাকে নিক্ষেপের জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল। এসব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ হলে ঘটবে বহু বেসামরিক মানুষের মৃত্যু। বহু মানুষ হবে বিকলাঙ্গ। যুদ্ধে যারা জিতবে তারা যুদ্ধাপরাধী হবে না। যারা হারবে তাদের দাঁড়াতে হবে যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায়।
টোকিও ট্রাইব্যুনালের আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অপরাধী জার্মানদের বিচার হয়েছিল নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে। নুরেমবার্গ (Nuremberg) হলো জার্মানির ব্যাভোরিয়া প্রদেশের একটি শিল্পপ্রধান বড় শহর। এখানে ১৯৪৫ সালে ২১ নভেম্বর গঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। যে ট্রাইব্যুনাল করেছিল ২৪ জন জার্মান নাৎসি নেতার বিচার। যারা জড়িত ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে। এই সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল একজন মার্কিন, একজন ব্রিটিশ, একজন ফরাসি ও একজন সোভিয়েত বিচারককে নিয়ে। এই ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছিল চারটি আদালত। একটি আদালত বিচার করেছিল নাৎসি নেতাদের ষড়যন্ত্রের (Conspiracy of Nazism); আগ্রাসী সামরিক অভিযান (Wars of aggression); যুদ্ধাপরাধ (War crimes); এবং মানবতার বিপক্ষে অপরাধগুলোর (Crimes against humanity)। নাৎসি ষড়যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়, নাৎসি দর্শন গঠন ও তার সমর্থনে বাহিনী কর্তৃক অন্য রাষ্ট্র অধিকারের যুদ্ধকে। যুদ্ধাপরাধী বলতে ধরা হয়, যুদ্ধবন্দীদের হত্যা অথবা দুর্ব্যবহার : বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা, তাদের সহায়সম্পদ লুণ্ঠন এবং যুদ্ধের প্রয়োজন ব্যতীত বেসামরিক ঘরবাড়ি ধ্বংস। মানবতার বিপক্ষে অপরাধ বলতে গ্রহণ করা হয়, কোনো বিশেষ মানবধারা (Race), ধর্ম সম্প্রদায় (Religious group) অথবা ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসীদের হত্যা ও নির্মূলের অভিযানকে (Extermination) এবং এক জায়গার মানুষকে অন্য জায়গায় জোর করে নিয়ে গিয়ে বাস করতে বাধ্য করাকে। ২৪ জন নাৎসি নেতাকে এসব অপরাধে অভিযুক্ত করে দাঁড় করানো হয় বিচারের কাঠগড়ায়। যাদের মধ্যে ১২ জনকে দেয়া হয় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ। এই ১২ জনের মধ্যে ১০ জনের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয় ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে। বিখ্যাত নাৎসি নেতা গোয়েরিংয়ের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয় না। কারণ তিনি জেলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আর বোরমানকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। প্যাপেন (Papen), সাক্ট (Schacht), ফ্রিসকে (Fritsche) নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদের দেয়া হয় বিভিন্ন মাত্রার কারাদণ্ড। এ ছিল বিখ্যাত নুরেমবার্গের রায়। এ সময় নুরেমবার্গের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একজন নাৎসি নেতা বলেছিলেন, আমাদের বিচার হচ্ছে। কারণ, আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি। যুদ্ধে হেরে যাওয়াটাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। আমরা যুদ্ধে হেরে না গেলে আমাদের কোনো বিচার হতো না। আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য পেতে পারতাম প্রশংসা। এখনকার মতো কোনো নিন্দা নয়।
অনেক দিন আগের কথা, আমি তখন স্কুলে উঁচু কাসের ছাত্র। মনে আছে এসব কথা। আমি পড়েছিলাম সংবাদপত্রে। সে সময় নিয়মিত সংবাদপত্র আমি পড়তাম। জানতে ইচ্ছুক হয়ে পড়েছিল বিশ্বরাজনীতির ধারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইটালি ও জাপান ছিল এক পক্ষে। অপর পক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাপান জয় করেছিল বার্মা (মিয়ানমার)। জাপান এসে পড়েছিল বাংলাদেশের দোরগোড়ায়। জাপান কয়েক দিনের জন্য দখল করেছিল মহেশখালী। বোমা ফেলেছিল তখনকার বাংলার রাজধানী কলকাতায়। যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বিশেষ বিবেচ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সামরিক নেতাদেরও বিচার করার জন্য বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। দেয়া হয়েছিল তাদেরও শাস্তি। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনাল নুরেমবার্গের মতো অতটা খ্যাতি পায়নি।
জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দিয়ে উদ্ভব ঘটে নাৎসি রাজনৈতিক দর্শনের। নাৎসি দার্শনিকেরা বলেন, আর্যরা ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। জার্মানরা বহন করছে খাঁটি আর্য শণিতের ধারা। জার্মানরা হলো আর সব জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ। তাই জার্মান জাতির অধিকার আছে, বিশ্বের নানা দেশ জয় করে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করার। নাৎসিরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত না। তারা বিশ্বাস করত অতি মানবের (Superman) নেতৃত্বে। নাৎসিদের কাছে তাদের নেতা হিটলার ছিলেন একজন অতিমানব। হিটলার অবশ্য নাৎসি দলের প্রতিষ্ঠাতা নন। যখন তিনি নাৎসি দলে যোগ দেন, তখন এর সদস্যসংখ্যা ছিল সাতজনের মতো। কিন্তু হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দল দ্রুত গড়ে উঠতে থাকে। আর একপর্যায়ে এসে জার্মান রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারা অবশ্য গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করেনি। হিটলার প্রথম ক্ষমতা দখল করেন ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু পরে হয়ে ওঠেন জার্মান ডিকটেটর (Dictator)। নাৎসিরা ছিল চরমভাবে ইহুদিবিদ্বেষী। তারা বহু ইহুদিকে হত্যা করেছিল। একটি হিসাব অনুসারে প্রায় ৬০ লাখ। তবে অনেকে এই হিসাবকে এখন মনে করেন অতিরঞ্জিত বলে। নুরেমবার্গ বিচারে নাৎসি নেতাদের দেয়া হয়েছিল শাস্তি (অধিকাংশের হয়েছিল প্রাণদণ্ড)।
ওপরের নুরেমবার্গ বিচারের কথা আমরা কিছুটা বিস্তারিতভাবে বললাম। কেননা, অনেকে আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে তুলনা করতে চাচ্ছেন নুরেমবার্গের বিচারের সাথে। কিন্তু এই তুলনাকে কোনোভাবেই যথাযথ বলা চলে না। কেননা, জার্মানি করেছিল অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ। কিন্তু সাবেক পাকিস্তান ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি রাষ্ট্র। পূর্বপাকিস্তান ছিল তার একটি প্রদেশ। আর এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগে থেকেই ছিল। বিদেশী কোনো বাহিনী হিসেবে নয়, স্বদেশী বাহিনী হিসেবে। ১৯৭১-এ এ দেশের একটি উল্লেখযোগ্য জনসমষ্টি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল ছিলেন। তারা সমর্থন করেছিলেন তদানীন্তন সামরিক সরকারকেই। তারা ছিলেন ভারতের আগ্রাসনবিরোধী। শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো আমরা বাঙালি’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ- ২০১২; পৃষ্ঠা-৪৭)। ১৯৭১ সালে এ দেশে একদল বাংলাভাষী মুসলমানের মধ্যে মুসলিম চেতনা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল। তারা সমর্থন করেছিলেন আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকারকে। অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার জার্মানবাহিনী আর পাকবাহিনীর মধ্যে কোনো তুলনা হতে পারে না। এ সময় তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে বাংলাভাষী মুসলমান পাকিস্তানি ফৌজের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজারের ওপর। অর্থাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে কেবল পাঞ্জাবি খান সেনাদের নিয়ে গঠিত ছিল, এটা বলা যায় না। যদিও মোটের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাংলাভাষী ফৌজের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫ ভাগের কাছাকাছি। এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো আলোচনা পাওয়া যায় শর্মিলা বসু লিখিত ‘ডেড রেকনিং’ নামক বইয়ে। এতে তিনি বলেছেন, “১৯৭১-এর সঙ্ঘাতকে অনেক বাংলাদেশী গৃহযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করতে আপত্তি করেছেন, যদিও এটা ছিল বাস্তব।… বাংলাদেশী সাহিত্য ও প্রকাশনায় বাঙালি বিদ্রোহীদের (মুক্তিযোদ্ধা) ‘বীর’, ‘বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা’ ও ‘বিচ্ছুরা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তান সমর্থিত বাঙালিদের উল্লেখ করা হয়েছে ‘রাজাকার’ হিসেবে, যা মূলত এখন গালি হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে মুক্তিলাভ করে ইংল্যান্ড হয়ে ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবার উদ্দেশ্যে দেশে ফেরার পথে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘রাজাকার’ কী?… বাঙালি মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি বাহিনীকে দখলদার বাহিনী বা আগ্রাসী বাহিনী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেন ওই পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ করেই উদয় হয়েছিল কোনো ভিন দেশের মাটি থেকে।… এটা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা ও জোর দেয়া প্রয়োজন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের সঙ্ঘাত ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি ও তার মিত্রদের দিয়ে ইউরোপে কয়েক মিলিয়ন ইহুদি, অন্যান্য সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন মতাদর্শের লোকদের হত্যার কোনো তুলনা করা যায় না। নির্বোধের মতো এরকম তুলনা করা নাৎসিদের হাতে নিহত এবং ১৯৭১ সালের সংঘর্ষে নিহতদের নিছক বিদ্রƒপ করাই শামিল (অধ্যায় ৯)।”
অনেকে বলছেন, শর্মিলা বসু তার বই নাকি লিখেছেন পাক-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আর্থিক অনুগ্রহ লাভ করে। কিন্তু এই অভিযোগ মেনে নেয়ার কোনাে ভিত্তি নেই। তিনি কলকাতার বিখ্যাত বসু পরিবারের মেয়ে। তাদের সম্পদ কিছুমাত্র হেলাফেলার নয়। শর্মিলা বসু খুবই উচ্চশিক্ষিতা। তিনি পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে গবেষণায় নিরত থেকেছেন বিলাতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাথে। শর্মিলা বসু জন্মেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে। তার পিতা অধ্যাপক শিশির কুমার বসু ছিলেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। যিনি ছেলেন বিখ্যাত বাঙালি বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসুর পুত্র। শরৎচন্দ্র বসু বাংলা প্রদেশ বিভক্ত হোক এটা চাননি। তিনি ১৯৪৭ সালে উঠান পৃথক স্বাধীন যুক্ত বাংলার দাবি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দুজনেই একসময় ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দলে। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাস হন কলকাতা করপোরেশনের মেয়র। চিত্তরঞ্জনের দল থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হন কলকাতার ডেপুটি মেয়র আর সুভাষচন্দ্র বসু হন প্রধান কর্মাধ্যক্ষ। শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে লিখেছেন, “আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হত, ইংরেজের চেয়ে জাপানই বোধ হয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনো দিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হতো, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কী হবে? আবার মনে হতো, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনো দিনই সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম (পৃষ্ঠা- ৩৫-৩৬)।” তাই আমাদের দেশে যেসব কথিত বাম বুদ্ধিজীবীরা শর্মিলা বসুকে বলতে চাচ্ছেন পাকিস্তানের অর্থপুষ্ট লেখিকা, তাদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা যায় না। বরং তাদের নিন্দাই করতে হয়। আজ সারা ভারতে সুভাষচন্দ্র বসুর নতুন মূল্যায়ন করা শুরু হয়েছে। যাতে করে, ইন্দিরা গান্ধীর পিতা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর ভাবমর্যাদা বিবর্ণ হতেই চলেছে। জওয়াহেরলাল নেহরু ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর একজন কঠোর সমালোচক।
Piloo Mody ছিলেন ভারতের বিখ্যাত স্বতন্ত্র নামক দলের সেক্রেটারি। তিনি ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর সতীর্থ এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু। ১৯৭২ সালে যখন বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিমলা চুক্তি হচ্ছিল, তখন তিনি সিমলাতে ছিলেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে দেখা করেন। তিনি তার বহুল পঠিত Zulfi my Friend নামক বইয়ে বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধী ভুট্টোকে বলেন, পাকবাহিনী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। ভুট্টো বলেন, এতে তার কোনো আপত্তি নেই। তবে সব পক্ষের যুদ্ধাপরাধেরই বিচার হতে হবে। পাকবাহিনীর সাতজন অফিসারকে ইপিআর বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেছে, যা যুদ্ধাপরাধ। নিরস্ত্র বিহারি হত্যা যুদ্ধাপরাধ। এসব অপরাধেরও বিচার হতে হবে। শ্রিমতী গান্ধী দেখেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গেলে আইনগত পরিস্থিতি খুবই জটিল হবে। তিনি তাই প্রসঙ্গটি স্থগিত করেন। সব পাক যুদ্ধবন্দীকে বিনা শর্তে ভারত সরকার মুক্তি দেন। কিন্তু এখন অনেককে বলতে শোনা যাচ্ছে, ভুট্টো নাকি কথা দিয়েছিলেন পাকবাহিনীর ১৯৫ জনের বিচার করা হবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। কিন্তু পিলু মোডির বইটি পড়লে তা মনে হয় না। উল্লেখ্য যে, পিলু মোডি হিন্দু নন। তিনি অগ্নিপূজারী পারসিক। তিনি তাই তার লেখায় হতে পেরেছেন যথেষ্ট নিরপেক্ষ। যদিও বা তার বন্ধু ভুট্টোর জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে করে ফেলেছেন পক্ষপাতিত্ব। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতের পদাতিক বাহিনীর চিফ অব দি স্টাফ ছিলেন শ্যাম মানেকশ (Sam Manekshaw)ি। মানেকশও ছিলেন পারসিক। পিলু মোডি ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনেক খবর রাখতের পিলু মোডি, যা অন্যেরা রাখতেন না। পিলু মোডির বইতে এমন অনেক তথ্য আছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে।
এখন সারা বিশ্বে আবার বাজতে শুরু করেছে রণদামামা। অনেকে মনে করছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে। শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর পাহারা দিতে এসেছে একাধিক চীনা সাবমেরিন। এই বন্দরের সাথে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশকে সংযোগকারী রাস্তাকে পাহারা দেয়ার জন্য পাকিস্তানে এসেছে ১০ হাজারের বেশি চীনা সৈন্য। চীন সৈন্য সমাবেশ করছে ম্যাকমাহান লাইন বরাবর। ভারতে শিখরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের। সব উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মানুষ চাচ্ছে স্বাধীন হতে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আমরা তা জানি না। পাকিস্তান তার পরমাণু বোমা বহনকারী সব ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে সাজিয়েছে দিল্লির দিকে। ভারত হয়ে উঠেছে খুবই উদ্বিগ্ন। এই উপমহাদেশে আবার যুদ্ধ হতে পারে। তার ফলাফল কী দাঁড়াবে আমরা তা বলতে পারি না। এক পক্ষ জিতবে আরেক পক্ষ হারবে। যারা হারবে, তাদের দাঁড়াতে হবে যুদ্ধাপরাধের কাঠগড়ায়।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/১৯ মার্চ ২০১৬