ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাব অঞ্চল দখল করে ১৮৪৬ সালে। ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসন ১৯০১ সালে এই পাঞ্জাব অঞ্চল বিভক্ত করে গঠন করেন নর্থ-ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স। যাকে আমরা বাংলায় বলতাম উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ গঠনের সময় বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয় পস্তুভাষীদের কথা। যাদের হিন্দুস্তানি ভাষায় বলা হয় পাঠান; আর ফারসি ভাষায় বলা হয় আফগান। আফগান আর পাঠান সমার্থক। পস্তু ভাষাকে সাধারণত স্থাপন করা হয় ইরানি আর্য ভাষার সাথে; ভারতীয় আর্য ভাষার সাথে নয়। পশতুকে ইরানি আর্য ভাষার সাথে শ্রেণিবদ্ধ করা হলেও এতে তুর্কি ভাষার শব্দ আছে প্রচুর। ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক হার্বাট রিজলে ১৯০৮ সালে পাঠানদের নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বলেন একটি মিশ্র মানবধারা।
যাকে তিনি উল্লেখ করেন তুর্ক-ইরানীয় বলে (Turko-Iranian Type)। হার্বাট রিজলের মতে, দৈহিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইরানিদের চেয়ে মধ্য এশিয়ার তুর্কিদের সাথেই পাঠানদের মিল বেশি। হার্বাট রিজলের মতে, পাঠানেরা দৈহিক উচ্চতায় হলো মধ্যমাকৃতির কিছু বেশি। চেহারায় এরা ফর্সা। চোখের তারার রঙ কালো; তবে কখানো কখনো কটা হতে পারে। মুখে দাড়িগোঁফ যথেষ্ট হয়। মাথার আকৃতি চওড়া। নাকের আকৃতি মধ্যম, তবে উন্নত। কখনো কখনো নাক হতে দেখা যায় পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা (খগনাসা)। যাকে তিনি বলেছেন আর্মেনীয় প্রভাবের ফল। রিজলে পাঠানদের সাথে বালোচ ও ব্রাহুইদের স্থাপন করেছেন। হার্বাট রিজলে পাঞ্জাবিদের স্থাপন করেছেন ভারতীয় আর্য বিভাগে (Indo-Aryan Type)। পাঞ্জাবিদের সাথে তিনি স্থাপন করেছেন রাজপুত, কাশ্মিরি ও সিন্ধিদের। এরা উচ্চতায় লম্বা, দেখতে ফর্সা। এদের চেখের তারা কালো।
মাথার আকৃতি লম্বা। নাকের আকৃতি সরু এবং উঁচু এবং মুখে যথেষ্ট দাড়িগোঁফ হয়। নৃতত্ত্বের এসব কথা বলতে হচ্ছে, কারণ ইমরান খান বলছেন, তিনি পাঞ্জাবি নন, বালুচি নন, সিন্ধ নন; তিনি হলেন খাঁটি পাঠান। একজন খাঁটি পাঠান হিসাবেই তিনি অনুভব করতে চাচ্ছেন বিশেষ শ্লাঘা। সারা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ হলো পাঠান। ইমরান খানের পুরো নাম হলো ইমরান আহমদ খান নিয়াজি। ইমরান খান সাধারণত তার নামের শেষে নিয়াজি পদবি লেখেন না। তবে এখন তিনি নিয়াজি হিসাবেও নিজেকে তুলে ধরতে চাচ্ছেন। পাঠানদের মধ্যে নিয়াজি হলো একটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী।
১৯৭১ সালে তাদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। ইনিও পাঞ্জাবি ছিলেন না। পাঠানদের যে রকম কম বুদ্ধিমান ভাবা হয়, আসলে তারা কিন্তু তা নন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান জন্মেছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অ্যাবোটাবাদ শহরে। তিনিও ছিলেন পাঠান। যদিও ছিলেন না নিয়াজি গোষ্ঠীভুক্ত। এখন বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ইমরান আহমদ খান নিয়াজি। ইমরান খানকে কেবলই তুলে ধরা হচ্ছে একজন বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে। কিন্তু তিনি কেবলই একজন ক্রিকেট খেলোয়াড় নন। তিনি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। যিনি সারা বিশ্বের রাজনীতির যথেষ্ট খবরাখবর রাখেন।
ইমরান খান ১৯৫২ সালে জন্মেছিলেন লাহোরে। বেড়ে উঠেছেন প্রধানত পাঞ্জাব প্রদেশের পরিবেশে। তিনি প্রথমে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন লাহোরে এচিশন (Aitchison) কলেজে। পরে ইংল্যান্ডে পড়শোনা করেন ওরসেস্টার এর রয়েল গ্রামার স্কুলে। ১৯৭২ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত কেবল (কবনষব) কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তার পাঠ্য ছিল দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি; এই বিষয়ে। তার পিতা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি যথেষ্ট বিত্তবান ছিলেন। তিনি তাই পুত্রের উচ্চশিক্ষার জন্য পেরেছিলেন অর্থ ব্যয় করতে। ইমরান খান লেখাপড়ার সাথে অনেকভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি তাই হতে পেরেছিলেন বিলাতের ব্রডফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর (২০০৫ নভেম্বর থেকে ২০১৪ নভেম্বর)।
ইমরান খান কেবল রাজনীতি করেননি, করেছেন জনহিতকর কর্মও। যেমন তিনি তার মাতা শওকত খানমের নামে গড়েছেন শওকত মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র এবং গড়েছেন নামাল কলেজ।
ইমরান খান ১৯৯৬ সালে গঠন করেন তার রাজনৈতিক দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (ন্যায়বিচারপন্থী)। ২২ বছর আগে তিনি গড়েন তার রাজনৈতিক দল। কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে হলে এই সময়কালই কি যথেষ্ট নয়? আমি জানি না, আমাদের পত্রপত্রিকায় কেন প্রচার করা হচ্ছে, ইমরান খান আসলে একজন রাজনীতিবিদ নন, কেবল ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবেই অর্জন করতে পেরেছেন বিশেষ জনপ্রিয়তা। অনেক পত্রিকায় বলা হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ক্ষমতায় এনেছে; কিন্তু সেনাবাহিনী ভোটে কারচুপি করলে তাকে নিরঙ্কুুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা তিনি পাননি। তাই তাকে জোট গড়তে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য অন্য সংখ্যালঘু দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের সাথে। তিনি কেমন প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা আমরা বলতে পারি না। পাকিস্তানের সমস্যা কম নয়। কাশ্মির-সমস্যা তো আছেই। এ ছাড়া ভারতের সাথে ঝিলম নদীর পানি নিয়ে দেখা দিচ্ছে তার সমস্যা। নদীর পানি ছাড়া পাকিস্তানের সেচব্যাবস্থ অচল হয়ে পড়বে।
সেচ ছাড়া পাকিস্তানে হবে না চাষাবাদ। আমাদের পত্রপত্রিকায় যা লেখা হচ্ছে তাতে মনে হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছে পরজীবী। কিন্তু নদীর পানি পেতে হলে প্রয়োজন হতে পারে যুদ্ধের। যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে তার অস্তিত্ব রাখা সম্ভবপর হবে না। পাকিস্তান আজাদ কাশ্মিরে মঙ্গলাড্যাম ঝিলম নদীর ওপর বানিয়েছিল ১৯৬৭ সালে। ভারত এতে তখন আপত্তি তোলেনি। এই ড্যাম নির্মিত হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায়। কিন্তু ভারত এখন তুলছে আপত্তি। ফলে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হয়ে উঠতে চাচ্ছে আগের তুলনায় জটিল।
১৯৭১ সালে কলকাতায় ছিলাম। তখন কিছু ভারতীয় বিশেষজ্ঞকে বলতে শুনেছি, পূর্ব পাকিস্তান যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তবে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ পারবে না টিকে থাকতে। কেননা, তদানীন্তন সমগ্র পাকিস্তানের মোট নাগরিকের অর্ধেকের বেশি বাস করেন পূর্ব পাকিস্তানে। তারা জোগান দেয় সমগ্র পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্বের অর্ধেকের বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা ও ছাগলের চামড়া হলো পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পণ্য। পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হয়ে গেলে, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ পড়বে বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয়েরই মধ্যে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। যা ছিল সাবেক পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ, তা টিকে আছে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তানের পদাতিক সেনাবাহিনী সংখ্যার দিকে থেকে বিশ্বের পঞ্চম। পাকিস্তান এখন একটি পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র।
উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে তা রূপ নেবে ভয়াবহ। এ ছাড়া পাকিস্তান চীনকে দিয়েছে গোয়াদা নৌ-বন্দরে সাবমেরিন ঘাঁটি গড়ে তোলার অধিকার। ভারত-পাবিস্তান যুদ্ধ বাধলে চীন তাতে অনিবার্যভাবে পড়বে জড়িয়ে। যুদ্ধ নেবে আন্তর্জাতিক রূপ। ইমরান খান বলছেন, তিনি যুদ্ধ চান না। ভারত যদি কাশ্মির-সমস্যা সমাধানে এক পা অগ্রসর হয়, তবে তিনি দুই পা অগ্রসর হবেন।