মানুষ কথা বলা প্রাণী। সে একমাত্র প্রাণী, যে অর্থবোধক শব্দ সাজিয়ে বাক্য রচনা করে ভাব প্রকাশ করে, অন্য প্রাণীরা যা পারে না। এসব বিষয় নিয়ে জীববিজ্ঞানীরা যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিম্পাঞ্জি শাবককে নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সিম্পাঞ্জি শাবক প্রথম দিকে থাকে মানব শিশুরই মতো। কিন্তু মানব শিশু যখন থেকে ভাষা শিখতে শুরু করে, তখন থেকে সে ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে সিম্পাঞ্জি শাবককে সব ক্ষেত্রেই ছাড়িয়ে যেতে থাকে। সিম্পাঞ্জি শাবককে ‘মাতা-পিতা’ বলতে শিখানো যায়। কিন্তু মাতা-পিতা বলতে কী বোঝায়, তা শেখানো যায় না। মানব শিশু শুধু শব্দ শেখে না, শব্দের সাথে জড়িত ভাবকেও সে শেখে। মানুষ ভাষার মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করে, চিন্তা করে এবং অর্জিত জ্ঞানকে ধরে রাখে। মানবজীবনে ভাষা পালন করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অন্যান্য প্রাণী ভয়, বিস্ময়, ক্রোধ, হর্ষ প্রভৃতি অনুভবকে বিভিন্ন শব্দ করে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু ভাষার উদ্ভব তাদের মধ্যে ঘটেনি। ময়না, কাকাতুয়া, টিয়াপাখি মানুষের ভাষার অনুকরণে অনেক কিছু বলতে পারে, কিন্তু তারা জানে না সেসবের প্রকৃত অর্থ।
মানবশিশু ভাষা শেখে, কিন্তু সে হরবোলা পাখি হয় না। মানবশিশু ভাষা শেখে স্বেচ্ছায়। কেন কী কারণে সে ভাষা শেখাকে আবশ্যক মনে করে, সেটা ব্যাখ্যা করা যায় না। বলতে হয়, ভাষা শেখা হলো মানুষের সহজাত ধর্ম। মানবশিশু ব্যাকরণ পড়ে ভাষা শেখে না। আসলে ভাষার জন্ম হয়েছে আগে। আর ব্যাকরণের জন্ম হয়েছে বহু যুগ পরে। রাষ্ট্রের এলাকা আর ভাষার এলাকা এক নয়। মানুষের সমাজজীবনে যখন রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভব হয়নি, তখনো মানুষ ভাষার মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করেছে। আর অনুমান করা চলে রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটি অবলুপ্তির পরেও মানবসমাজে ভাষার বিলুপ্তি হবে না। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলাম ভাষা ছিল বলেই। ভাষাটার উদ্ভব ছিল না কোনো রাষ্ট্রের উদ্ভবের সাথে জড়িত। বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়নি কোনো রাষ্ট্রকে নির্ভর করে। ইংরেজ আমলে বাংলাগদ্যের ঘটেছিল বিপুল বিকাশ। কিন্তু এই বিকাশ সাধিত হয়েছিল প্রধানত ব্যক্তি উদ্যোগে, রাষ্ট্রিক উদ্যোগে নয়। আমরা বাংলা একাডেমি গড়েছি বাংলা ভাষার উন্নয়নের লক্ষ্যে। কিন্তু ইংরেজি ভাষার কোনো একাডেমি নেই। তবু ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রধান উন্নত ভাষা। আমি এসব কথা বলছি কারণ, এখন শুনতে পাচ্ছি প্রমিত বাংলা চালু করার কথা। প্রমিত বাংলা বলতে ঠিক কী বুঝতে হবে সেটা আমার কাছে স্বচ্ছ নয়। একটা দেশে অনেক উপভাষা থাকে। বিভিন্ন উপভাষায় মানুষ কথা বলে। উপভাষার মধ্যে উদ্ভব হতে পারে নতুন শব্দের, যা লিখিত ভাষাকে সমৃদ্ধ করার সহায়ক হতে পারে। কোনো ভাষাই গড়ে ওঠেনি প্রমিত বা নির্দেশিতভাবে।
সব ভাষা এখনো লিখিত ভাষা হয়নি। যেসব মানুষ এখনো বনে বাদাড়ে থাকে, যাদের জীবন পড়ে আছে অনেক আদিম পর্যায়ে, তাদের ভাষা লিখিত নয়। একসময় সাঁওতালি ভাষা লিখিত ভাষা ছিল না। নরওয়ে থেকে আসা খ্রিষ্টান মিশনারিরা ভাষাটিকে লিখতে শুরু করেন রোমক বর্ণমালায়। কিন্তু বাংলা ভাষা বহুকাল আগে থেকেই লিখিত ভাষা। খ্রিষ্টান মিশনারিরা রোমক বর্ণমালায় যখন বাংলা লেখা শুরু করেন, তখনো বাংলা লিখিত ভাষা ছিল। মিশনারিরা রোমক বর্ণমালা বাদ দিয়ে বাংলা অক্ষরে শুরু করেন বাংলা গদ্যে বই লিখতে। একসময় সংস্কৃত ভাষা বাংলাদেশে বাংলা অক্ষরে লিখিত হতো, নাগরী অক্ষরে নয়। বাংলা অক্ষরের উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী অক্ষর থেকে। সম্রাট অশোক তার সম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রধানত ব্রাহ্মী অক্ষরে ওই সব অঞ্চলের প্রচলিত ভাষায় দিয়েছেন তার অনুশাসন (আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ)। অশোকের সাম্রাজ্য ছিল বিশাল; বর্তমান পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে চুনাপাথরের পিণ্ডের ওপর লিখিত অশোকের একটি অনুশাসন পাওয়া গেছে, যা ব্রাহ্মী অক্ষরে এবং অশোক প্রাকৃতে লেখা। অনেকে মনে করেন, সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। কেননা, সংস্কৃত ভাষায় অশোকের কোনো অনুশাসন পাওয়া যায়নি; পাওয়া গিয়েছে কেবলই বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত মাতৃভাষা। বাংলার উত্তরাঞ্চলে তখন ঠিক কী ভাষা প্রচলিত ছিল, আমরা তা জানি না। তবে ধরে নেয়া যায়, এই অঞ্চলে রাজ্যশাসন চলেছিল অশোক-প্রাকৃতে। আর এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই সম্ভবত হতে পেরেছে বর্তমান বাংলা ভাষার উদ্ভব, সংস্কৃত ভাষা থেকে নয়। বাংলা ভাষায় পরে অনেক সংস্কৃত শব্দ যুক্ত হয়েছে। যেমন- ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে ল্যাটিন শব্দ। কিন্তু তা বলে বলা যায় না, ইংরেজি ভাষার উদ্ভব ঘটেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। বাংলা ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ আছে, কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে বিশেষভাবেই ভিন্ন। ভাষার শ্রেণীবন্ধন করার সময় তা প্রধানত করা হয় তার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে। বাংলাকে সাধারণ স্থাপন করা হয় আর্য পরিবারভুক্ত ভাষার সাথে। কিন্তু বাংলা ভাষার বহুকিছুই অন্য আর সব আর্যভাষার মতো নয়। যেমন বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়ায় বাক্য রচনা করা চলে। একইভাবে দ্রাবিড় পরিবারভুক্ত ভাষাতেও ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য রচনা করা যায়। এছাড়াও দ্রাবিড় পরিবারের ভাষার সাথে বাংলাভাষার আরো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। দ্রাবিড় ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জোড়ালাগা শব্দ। এখানে দু’টি শব্দ জোড়ালেগে আর একটি তৃতীয় ভাব প্রকাশ করে, শব্দ দু’টি একত্রে মিশে যায় না। বাংলা ভাষাতেও এরকম জোড়ালাগা শব্দ থাকতে দেখা যায়। যেমন ছেলেগুলি, পাখিসব। এখানে ছেলে এবং গুলি শব্দ দু’টি আলাদা। কিন্তু একত্রে প্রকাশ করছে তৃতীয় একটি ভাব। পাখিসবের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। আমরা অবশ্য বলতে পারি ছেলেরা, পাখিরা। এভাবে বললে সেটা হবে অন্য অর্যভাষার সাথে সাদৃশ্যমান। কিন্তু ছেলেগুলি, পাখিসব বললে তারা হবে দ্রাবিড় ভাষার সাথে তুল্য। দ্রাবিড়ভাষীদের সাথে আমাদের সাংস্কৃতিক মিলও পরিদৃষ্ট হয়। যেমন দ্রাবিড়রা খান আমাদেরই মতো সিদ্ধ চালের ভাত। গ্রামে তারা বাস করেন আমাদেরই মতোন উলুখড়ের ছাওয়া মাটির ঘরে। দ্রাবিড়রা মাছ-তরকারি কোটেন বঁটি দিয়ে; উত্তর ভারতের মানুষের মতো ছুরি দিয়ে নয়। আমরা বাংলাদেশেও একই কাজে ছুরি ব্যবহার না করে, করি বটির ব্যবহার। আমাদের সাথে দ্রাবিড়দের ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিল আছে।
আমি এসব কথা বলছি কারণ, ভারত এখন বিভক্ত হয়ে পড়েছে প্রধানত দু’টি ভাষা বলয়ে। এর একটি হলো আর্য আর অন্যটি দ্রাবিড়। আর্য বলয়ের ভাষাদের প্রধান প্রতিনিধি হলো হিন্দি। আর দ্রাবিড় বলয়ের প্রধান ভাষা হলো তামিল (যদিও সংখ্যার দিক থেকে নয়, সংখ্যার দিক থেকে হলো তেলুগু)। প্রধানত তামিলদের বিরোধিতার জন্যই হিন্দি বাস্তবে এখনো ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পারেনি। আমি এসব কথা বলছি, কেননা, আমার এখন মনে হয়, আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূলে কাজ করেছিল আসলে একটা আর্য-দ্রাবিড় বিরোধ। এর মূল ছিল ইতিহাসের সুদূর গভীরে। উর্দু-হিন্দির ব্যাকরণ এক। আমাদের কাছে তা ছিল আর্য ভাষা। আমরা চাইনি আমাদের ওপর আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিপত্তি।
এবার আসা যাক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়ের রাজনীতির প্রসঙ্গে। এ ক্ষেত্রে নিচের সন তারিখগুলো মনে রাখা ভালো। ১৯৪৭, ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৪৭ সালের ২১ আগস্ট পূর্ববাংলার গভর্নর হন স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন (১৯৪৭-৫০)। পূর্ববাংলার তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন (১৯৪৭-৫১)। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যু। খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল (১৯৪৮-৫১)। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্রমিছিলে গুলি চলে, তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ (১৯৫১-৫৫)। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন (১৯৫১-৫৩)। আর বাংলার প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী শব্দটা এসেছে ভারত থেকে, পূর্ববাংলায় তখন বলা হতো প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন নুরুল আমিন (১৯৫১-৫৪)। ১৯৪৬ সালে তদানীন্তন বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের যে নির্বাচন হয়, তারপরে পূর্ব বাংলায় আর কোনো নির্বাচন হয়েছিল না। নুরুল আমিন ছিলেন ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে একজন নির্বাচিত এমএলএ। সেই সুবাদে তিনি হন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী। দেশে তখন কোনো সামরিক সরকার ছিল না। পূর্ব বাংলায়ও ছিল একটি নির্বাচিত সরকার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চলেছিল নুরুল আমিন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে; পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে নয়। কিন্তু এখন অনেকের লেখা পড়লে মনে হয়, গুলি চলেছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। সেটা আদৌ সত্য নয়। পূর্ব বাংলায় যদি নুরুর আমিন সরকার না থেকে অন্য কোনো সরকার থাকতেন, তবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা বন্ধ করার জন্য দিতেন গুলি চালাবার নির্দেশ। নুরুল আমিনকে এখন যেভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে, তিনি সম্ভবত অতটা খারাপ ব্যক্তি ছিলেন না। কেননা, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি কোনো কারচুপি করেননি। তাই জিততে পেরেছিল যুক্তফ্রন্ট। তিনি এ সময় দিয়েছিলেন যথেষ্ট গণতন্ত্রী মনের পরিচয়। হতে দিয়েছিলেন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। পুলিশ ছাত্র মিছিলে গুলি চালিয়েছিল, কিন্তু পুলিশ প্রশাসন গুলি চালিয়েছিল যথেষ্ট সাবধানে। না হলে আরো অনেক ছাত্র প্রাণ হারাতেন।
২১ ফেব্রুয়ারিতে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তারা কেউই ছিলেন না ছাত্র মিছিলে। একজন দাঁড়িয়েছিলেন পথের ধারে। আরেকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে। আর একজন ছিলেন মেডিক্যাল হোস্টেলের ভেতরে। তখন পুলিশ প্রশাসন বিশেষভাবে মেনে চলতেন ব্রিটিশ শাসন আমলের বেঙ্গল পুলিশ কোড। তারা বেপরোয়া ছিলেন না। তারা বেপরোয়া হলে শহীদের সংখ্যা যে বাড়ত, সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সাহেব শহীদ বরকত সম্পর্কে বলেছিলেন যে, তিনি নাকি ছিলেন আসলে পুলিশেরই লোক। আমি কোনো বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু কথাটা খুব রটেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে এখন এমনভাবে লেখা হয়, যেন সেদিন যুদ্ধ বেধেছিল কোনো একটি বিদেশী সরকারের সাথে এ দেশের মানুষের। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার ছিল একটি জননির্বাচিত সরকার। আর তার নির্দেশেই চলেছিল গুলি।
আমরা এখন ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা যথেষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু এই ধর্মরিপেক্ষতার কথাটা এসেছে ভারত থেকে ১৯৭১ এর পর। ভারতে এখন সংস্কৃত ভাষায় কেউ কথা বলেন না। কিন্তু ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত প্রধান ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে তাকে দেয়া হয়েছে স্থান। কেননা, সংস্কৃত হচ্ছে ভারতের জাতীয়তাবাদের প্রতীক। রামায়ণ, মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। হিন্দি ভাষাকে এখন করে তোলা হচ্ছে সংস্কৃতবহুল। অর্থাৎ ভাষার দিক থেকে ভারতকে বলা যায় না ধর্মনিরপেক্ষ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হলো হিন্দুত্ববাদী। আর সংস্কৃত ভাষাকে বাদ দিয়ে হিন্দুত্ব বজায় রাখা কঠিন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখেছেন তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৭, ১৫ সেপ্টেম্বও এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়, যার নাম ছিল বাংলা না উর্দু। এই প্রতিষ্ঠানটির আগে কেউ সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনা ওঠায়নি। তমদ্দুন মজলিস প্রথম তোলেন বাংলা ভাষার দাবি। তমদ্দুন মজলিস একটি ইসলামপন্থী দল। এ দিক থেকে বলা যায়, ইসলামপন্থীরাই প্রথম উঠান বাংলাকে সাবেক পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। আরবিতে সংস্কৃতি শব্দের প্রতিশব্দ হলো তাহজিব। তাহজিব শব্দের অর্থ হলো ঘষে ঘষে পরিষ্কার করা। আরবিতে মদুন মানে হলো শহর। তমদ্দুন মানে হলো সভ্যতা বা নগর সংস্কৃতি। ইংরেজিতে ‘সিভিলাইজেশন’ শব্দটা এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে। সম্ভবত ভলতের (Voltaire) শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন নগর সংস্কৃতি বোঝাতে। আরবিতে তমদ্দুন শব্দটা উদ্ভবের মূলে আছে সম্ভবত ফরাসি প্রভাব। শব্দটা মনে হয় খুব পুরনো নয়। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে একসময় সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিবর্তে তাহজিব ও তমদ্দুন শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিল, কিন্তু এখন সংস্কৃতি ও সভ্যতা শব্দ দু’টি ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পর তা প্রভাব বিস্তার করে ভারতের রাজনীতিতে। শিখরা চান স্বাধীন হতে। আসামেও ওঠে স্বাধীনতার আওয়াজ। অসমীয়ারা (অহমিয়া) শুরু করেন স্বাধীনতার আন্দোলন। এই আন্দোলনকারীদের অনেকে গোপনে আসেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে তারা পরিচালনা করতে থাকেন আসামের স্বাধীনতা আন্দোলন। বাংলাদেশ যদি একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হতো এবং আসামের স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করত, তবে আসাম মনে হয় এতদিনে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হতো। অহমিয়া ভাষা বাংলা ভাষার খুব কাছাকাছি। দুই ভাষারই ব্যাকরণ এক। পার্থক্য কেবল উচ্চারণের ক্ষেত্রে। বাংলা ও অহমিয়া ভাষা লিখিত হয় একই লিপিতে। কেবল অহমিয়ায় র লেখা হয় ব-এর পেট কেটে। আসামের তিনটি জেলায় (ধুবরি, গোয়ালপাড়া ও কাছার) চলে বাংলা ভাষা। এই তিনটি জেলাকে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে কেটে নিয়ে আসামে যোগ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে বহু লোক ব্রিটিশ শাসনামলে গিয়েছেন আসামে। এরা জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে উপনিবিষ্ট হয়েছেন এবং শুরু করেছেন চাষাবাদ। বাংলাদেশের সাথে এ দিক থেকেও আসামের আছে নিকট সম্বন্ধ। তাই বাংলাদেশের মানুষ অনুভব করছেন আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি। বর্তমান সরকার অবশ্য আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখাতে ইচ্ছুক নয়।
আমি ১৯৬০ এর দশকে গুজব শুনেছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি চাচ্ছেন পূর্বপাকিস্তান ও আসামকে একত্র করে একটা ফেডারেশন গঠন করতে, যার নাম হবে বাসাম। অর্থাৎ বাংলাদেশ আসাম ফেডারেশন। কিন্তু পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এই পরিকল্পনা থেকে সরে যেতে থাকে। এর একটি কারণ হলো, শেখ মুজিবের সাথে মার্কিন প্রশাসনের মতবিরোধ। আমি কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার (২ কার্তিক, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ) পত্রিকায় পড়েছিলাম, মার্কিন অর্থের বিনিময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের সন্দ্বীপসহ দু’টি দ্বীপ মার্কিন সরকারকে ইজারা দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দু’টি দ্বীপে নৌঘাটি গাড়বে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরকম নৌঘাটি করার প্রস্তাব শেখ মুজিবকেও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব তাতে সম্মত হননি। ঠিক কী ঘটেছিল আমরা তা জানি না। কিন্তু বাসাম গড়ার ইচ্ছা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্থগিত করেছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। চীন আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানচিত্রে আসতে পারে অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তন। আর এর ফলে আসামের সাথে গড়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বিশেষ সম্বন্ধ। অহমিয়া ভাষা বাংলা ভাষীর পক্ষে শেখা কঠিন নয়। অন্য দিকে অহমিয়াদের পক্ষেও বাংলা ভাষা শেখা যথেষ্ট সহজ। ব্রিটির শাসন আমলে আসামের চা চালান গেছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। আসাম একটি ভূমিঘেরা দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ তা নয়। আসাম তাই চাইতে পারে বাংলাদেশের সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়তে। কিন্তু এসব হলো ভবিষ্যৎ জল্পনারই কথা। কিন্তু এসব ভাবা একেবারেই ভিত্তিহীন নয়।
এই উপমহাদেশের ভাষা নিয়ে প্রথম বিশেষভাবে গবেষণা করেন ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন। তার ভাষা জরিপের বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করেন Linguistic Survey of India নামক গ্রন্থাবলিতে, যার বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে। এতে তিনি বাংলা ভাষার একাধিক উপভাষার উল্লেখ করেছেন। চাকমারা যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাকে তিনি বলেছেন বাংলা ভাষারই একটি উপভাষা। কিন্তু এখন চাকমাদের ভাষাকে অনেকে বলতে চাচ্ছেন একটা ভিন্ন ভাষা। তবে আমাদের কাছে চাকমাদের ভাষাকে মনে হয় চট্টগ্রামের উপভাষার সাথে বিশেষভাবে যুক্ত। বাংলাদেশে উপনিবিষ্ট সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু তারা এখন শিখেছেন বাংলা ভাষা। তারা হাট-বাজারে, অফিস-আদালতে কথা বলছেন বাংলা ভাষাতেই। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অনেক রাজবংশীর বাস। একসময় তাদের ছিল আরেকটা ভিন্ন ভাষা। কিন্তু এখন তারা আর সেই ভাষা ব্যবহার করেন না। এখন বাংলাই হয়ে উঠেছে তাদের ভাষা। ধরে নেয়া যায়, বাংলাদেশে সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ধীরে ধীরে বাংলা হয়েই যাবে। যেমন হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। একসময় ইংল্যান্ডে কিছু লোক কর্নিশ ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু এখন আর সেই ভাষাটির কোনো অস্তিত্ব নেই। কেবল তার কথা পাওয়া যায় ভাষাতাত্ত্বিকদের আলোচনায়। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলছেন, ক্ষুদ্র নৃ-জাতিদের ভাষাকে সংরক্ষিত করার কথা। কিন্তু তারা বলছেন না, কেন কী কারণে এটা করতে হবে? ভারতে ঝাড়খণ্ড প্রদেশের সরকারি ভাষা করা হয়েছে হিন্দি। যদিও সেখানকার জনসমষ্টির মধ্যে সাঁওতালেরা হলেন সংখ্যাগুরু। আমি বুঝি না, ক্ষুদ্র নৃ-জাতিক গোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণের জন্য বাম বুদ্ধিজীবীদের এত মাথাব্যথা কেন? বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এতে কেবল ক্ষুদ্র নৃ-জাতিক গোষ্ঠীর কথাই বলা হয়নি, বলা হয়েছে এ দেশের অনেক ছোটখাটো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীরও কথা; যা পড়লে মনে হয় বইটি যেন ছাপা হয়েছে এ দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্যই। যে প্রচেষ্টাকে আমরা সাধুবাদ জানাতে পারি না। বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক গিয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছেন বিলাতে। কিন্তু তারা যদি দাবি করেন যে, ব্রিটিশ সরকারকে তাদের ভাষা সংরক্ষণ করতে হবে, তবে সেটা কি যুক্তিযুক্ত হবে? যাদের বাংলাদেশে বলা হচ্ছে, আদিবাসী (Aborigine), তারা কেউই এ দেশের আদিবাসী নন। এ দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টিই হচ্ছেন এ দেশের আদিবাসী। যে অর্থে অস্ট্রেলিয়ার কালো মানুষকে বলা হয় আদিবাসী, এখানে সে অর্থে কাউকেই আদিবাসী বলা চলে না। এখানে কোনো মানুষের সংস্কৃতি পড়ে নেই প্রাচীন ও নব্য-প্রস্তর যুগে। এখানে জুম চাষ করা হয় লোহার অস্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়ে। কিন্তু এখন অনেকে বলছেন, এ দেশের আদিবাসীদের দিতে হবে স্বতন্ত্র আবাসভূমি। আর এ জন্য গড়ে উঠেছে আদিবাসী ফোরামের মতো দল। আমরা আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে তাদের কথাবার্তা বলার বিরোধী নই। এমনকি মারমাদের ক্ষেত্রে এখন প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে মারমা ভাষায়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষাতেই এদের শিক্ষা সমাপ্ত হবে না। উচ্চতর শিক্ষা নিতে গেলে শিখতে হবে বাংলা ভাষাই।
ইউরোপে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃত্রিম আন্তর্জাতিক ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। এসব কৃত্রিম ভাষার মধ্যে এসপেরান্তো (Esperanto) হলো একটি। ভাষাটি সৃষ্টি করেন পোল্যান্ডের Dr. Zamenhop ১৮৮৭ সালে। কিন্তু এরকম কৃত্রিম আন্তর্জাতিক ভাষা প্রতিষ্ঠা পেতে পারেনি। কৃত্রিম ভাষা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। ইংরেজি ভাষা মোটামুটি হয়ে উঠছে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। আমাদের উচিত ইংরেজিকে আন্তর্জাতিক হিসেবে শেখা। মাতৃভাষার প্রতি কোনো অবহেলার প্রশ্ন উঠছে না। কিন্তু বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে যোগাযোগ রাখতে গেলে ইংরেজি ভাষার প্রতি অনীহা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। সেটা উচিত হবে না।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।