আমরা জানি, একটা দেশের অর্থনৈতিক পণ্য উৎপাদন নির্ভর করে প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রমজীবী মানুষের শ্রম, উৎপাদনের সাজসরঞ্জাম এবং ব্যবসায়ীদের ওপর। ধনতন্ত্র বলতে এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে অর্থনৈতিক পণ্য উৎপাদনের কাজে জটিল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় এবং যা ব্যবহারের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় শ্রমজীবী। শ্রমজীবী বলতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এখন যা বোঝায়, আগে তো বোঝাত না। একজন কৃষক তার নিজের জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য শ্রম দেন, কিন্তু তিনি শ্রমজীবী নন। কেননা তিনি কী ফসল লাগাবেন, কতটা উৎপাদন করবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী। কিন্তু শ্রমজীবীরা এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী নন। তারা শ্রম করেন ব্যবসায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত অনুসারে। কলকারখানা অর্থনীতির আবির্ভাবের আগে শ্রমজীবী বলে কিছু ছিল না। কেননা মানুষ শ্রম করেছে নিজের ইচ্ছা অনুসারে, অপরের হুকুমে নয়। ক্ষেতমজুরেরা অবশ্য ক্ষেতখামারে কাজ করেছেন জমির মালিকের হুকুমে। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল, এবং এখন হয়ে আছে অনেক ভিন্ন। তারা ইচ্ছা করলেই ধর্মঘট করে পারেন না তাদের মজুরি বাড়াতে।
শ্রমজীবী শ্রেণীর উদ্ভব হতে পেরেছে যন্ত্র বিপ্লবের ফলে (মেকানিক্যাল রিভোলিউশন) অর্থাৎ যখন থেকে যন্ত্র চলেছে বাষ্পশক্তি নির্ভর করে। বিলাতে প্রথম শুরু হয় এই যন্ত্র বিপ্লব। ইংল্যান্ডে কাঠ-কয়লার অভাব দেখা দিলে আরম্ভ হয় পাথুরে কয়লার ব্যবহার। বিলাতে পাথুরে কয়লা ছিল মাটির এমন স্তরে, যা মাটি খুঁড়ে বের করা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। বিলাতে লোহার খনি ও পাথুরে কয়লার খনি ছিল কাছাকাছি। এটা সে দেশে কলকারখানা গড়তে সাহায্য করে। বিলাত হয়ে ওঠে লোহা-ইস্পাতের দেশ। ইস্পাত দিয়ে তৈরি হতে থাকে জটিল যন্ত্রপাতি। জেমস ওয়াটের আবিষ্কৃত স্ট্রিম ইঞ্জিন ব্যবহার হতে থাকে কলকারখানায়। বিলাতে ১৭৮৫ সালে প্রথম তাঁত চালানোর যন্ত্র স্ট্রিম ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। এরপর জর্জ স্টিফেনশন ১৮২৫ সালে স্ট্রিম ইঞ্জিন ব্যবহার করেন রেলগাড়ি চালাতে (আগে ছিল ঘোড়া টানা রেলগাড়ি)। বাংলাদেশে ১৮৫৭ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ১১১ মাইল রেলপথ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৬২ সালে এই রেললাইনে প্রথম রেলগাড়ি চলে। রেলকে কেন্দ্র করে এ দেশে প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এর আগে আধুনিক অর্থে এ দেশে শ্রমিক শ্রেণী বলে কিছু ছিল না।
বিলাতে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে চান তাদের মজুরি বাড়াতে, কাজের পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে এবং শ্রমের সময় কমাতে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বের মাধ্যমে। ব্রিটিশ ভারতে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ স্থাপন করেন লালা লাজপৎ রাই। ব্রিটিশ ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আইন পাস হয় ১৯২৬ সালে। এই আইন করা হয় ১৯১৩ সালে ‘ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট’-এর অনুকরণে। এই উপমহাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করলে দেখা যায়, ১৯০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম সমন্তিপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেন মজুরি ভিত্তির দাবিতে। ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে এই ধর্মঘটের নিষ্পত্তি হলে রেলশ্রমিকেরা কাজে যোগ দেন। এই ধর্মঘটের ফলে শ্রমিকেরা একটা দুর্ভিক্ষভাতা আদায় করেন। রেলকে কেন্দ্র করে এই পথে আরম্ভ হয় এই উপমহাদেশে শ্রমিক সঙ্ঘ গঠন আর শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য করতে থাকেন স্ট্রাইক বা ধর্মঘট।
ধর্মঘট কথাটির একটি বিশেষ ইতিহাস আছে। এ দেশে নীলচাষিরা ধর্মঠাকুরের ঘটকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তারা নীল চাষ করবেন না। নীলচাষিদের আন্দোলনের সময় ধর্মঘট কথাটি উদ্ভব ঘটে। নীলচাষিরা ঠিক শ্রমজীবী ছিলেন না। তাদের দিয়ে নীল চাষ করানো হতো গায়ের জোরে। আসলে একসময় এ দেশে জমির সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেতমজুরদের খাটতে হয়েছে বেগার। তারা কোনো মজুরি লাভের অধিকারী ছিলেন না। অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে তাদের বলা চলে না শ্রমজীবী বা মজুর। কারণ তারা তাদের শ্রমের জন্য পেতেন না কোনো মজুরি। যারা নিজের শ্রমের জন্য কোনো মজুরি লাভ করেন না তাদের বলা চলে না মজুর বা শ্রমজীবী। মজুর শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে। ফার্সিতে শব্দটি হলো মুজদুর। ফার্সিতে কারখানা বলতে বোঝাত এমন জায়গা, যেখানে সম্রাট ও বিত্তবানেরা লোক নিয়োগ করে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করতেন। যারা কারখানায় জিনিস তৈরি করতেন তারা তাদের শ্রমের জন্য পেতেন মজুরি।
শ্রমজীবীরা বিলাতে প্রথম গড়েন ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রম সঙ্ঘ, তারা প্রথম করেন ধর্মঘট বেতন বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু ধর্মঘট করে ইচ্ছামতো বেতন বাড়িয়ে চলা যায় না। কারণ বেতন বাড়লে বাড়ে পণ্য উৎপাদনের খরচ। পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়লে বাড়ে পণ্যের দাম। পণ্যের দাম বেশি বাড়লে তা চলে যায় ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। পণ্য বিক্রি হতে চায় না। পণ্য বিক্রি না হলে সেই ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ওই ব্যবসায়ে নিয়োজিত শ্রমিকেরা হারান তাদের জীবিকার উপায়। অর্থাৎ জীবিকার উপায় বজায় রাখতে হলে শ্রমিকদের সংযত হতে হয় ধর্মঘটের ক্ষেত্রে। শ্রমজীবী মানুষ এটা উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছেন। ফলে কমছে শ্রমিক ধর্মঘটের মাত্রা।
এসব কথা আমার মনে আসছিল ১ মেতে মে দিবস বা বিশ্ব শ্রম দিবসে। ১ মে বিশ্ব শ্রম দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট নামক স্থানে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবিতে শ্রমিকেরা ধর্মঘটের আহ্বান করেন। শ্রমিকদের সভায় বক্তৃতা করেন অগাস্ট-স্পাইস। অগাস্ট-স্পাইস ছিলেন অ্যানার্কিস্ট। তিনি মনে করতেন শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না ধনতন্ত্রকে উচ্ছেদ না করতে পারলে। তিনি ছিলেন বিপ্লবী, গায়ের জোরে ধনতন্ত্রকে অবসানের পক্ষে। এই শ্রমিক সভায় মারামারি শুরু হয় পুলিশের সাথে। এ সময় কোনো একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি পুলিশের ওপর হাতবোমা ছোড়ে। মারা যান ও আহত হন অনেকে। পরে জানা যায় শ্রমিকদের কেউ হাতবোমা ছোড়েননি। কিন্তু সে সময় প্রচারিত হয়েছিল শ্রমিকদের মধ্যে কেউ পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা ছুড়েছিল। এই হলো মে দিবসের ইতিহাস। এর পর থেকে শ্রমজীবীরা সমগ্র পৃথিবীতে পালন করছেন মে দিবস। মে দিবসকে পালন করা হচ্ছে জাতিসঙ্ঘ থেকে শ্রমদিবস হিসেবে। তবে এবারের মে দিবসে সে রকম কোনো মিছিল-মিটিং হতে দেখা গেল না। কেননা শ্রমজীবীদের অবস্থা বহু দেশেই আর আগের মতো হয়ে নেই। তাদের বহু দাবি পূরণ সম্ভব হতে পেরেছে। ঘটেছে শ্রমজীবীদের অবস্থার উন্নয়ন। এ ছাড়া সমাজের সব লোক শ্রমজীবী নন। এখন প্রশ্ন উঠছে ক্রেতার স্বার্থ নিয়ে। শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে গিয়ে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় নেয়ার। আরেক কথায় উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কমানোর। শ্রমজীবীদের এখন আর ভাবা হচ্ছে না একটি বিপ্লবী শ্রেণী হিসেবে। ভাবা হচ্ছে না তারা ঘটাবেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। সমাজতন্ত্র নিয়ে দেখা দিয়েছে অনেক প্রশ্ন।
মানুষের অর্থনীতির গোড়ার কথা হলো অভাব মোচন। অভাব মোচন করতে হলে বাড়াতে হবে অর্থনৈতিক দ্রব্যের উৎপাদন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে দ্রব্য উৎপাদনের পরিমাণ না বেড়ে কমে যতেই যায়। আমাদের চোখের ওপরে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ফলে সে দেশে উৎপাদন না বেড়ে কমে যেতেই চাচ্ছিল। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ ছাড়া অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অন্য আরো অনেক কারণও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন ইচ্ছা করলে প্রেসিডেন্ট শ্রমিকদের ধর্মঘট করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন ৮০ দিনের জন্য। যদি তিনি মনে করেন শ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ এখন মনে করা হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ধর্মঘট সমর্থনীয় নয়। বিবেচনায় নিতে হবে জাতীয় অর্থনীতির কথাও। মানুষ বাস করে জাতি হিসেবে, কোনো শ্রেণী হিসেবে নয়। জাতীয় অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে, কোনো জাতির সমবেত জীবন।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবী নিয়োজিত আছেন তৈরী পোশাক শিল্পে। এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমজীবীরা যদি ইচ্ছেমতো ধর্মঘট করে তৈরী পোশাকের দাম বাড়ান, তবে তা বিক্রি হবে না বিশ্ববাজারে। ফলে উঠে যাবে তৈরী পোশাক শিল্প। তৈরী পোশাকের চাহিদা খুবই নমনীয়। তাই তার দাম বাড়লে থাকছে বাজার হারানোর আশঙ্কা। আমাদের দেশে কেবল শ্রমজীবীদের কথা না ভেবে ভাবতে হবে সমগ্র জাতীয় অর্থনীতির কথা। কেননা জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি ছাড়া জাতি হিসেবে আমরা টিকতে পারব না। সব জাতিকেই তার উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু না কিছু কষ্ট করতে হয়েছে। আর তা আমাদেরও করতে হবে। অনেক অদ্ভুত কথা শুনতে পাচ্ছি আমরা। ক’দিন আগে একজন খ্যাতনামা নেত্রী সুলতানা কামাল বললেন, ‘নিরাপত্তা ছাড়া প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী করব?’ কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দেশে বাড়বে বেকারের সংখ্যা। বাড়বে আরো অপরাধপ্রবণতা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটা দেশে মানুুষের নিরাপত্তা বাড়ায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী করব, এই প্রশ্ন তাই তোলা মনে হয় খুবই অবান্তর।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/ ০৭ মে ২০১৬