যে বয়সে ছাত্র রাজনীতি করার কথা ছিল, সে বয়সে আমি সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষকে নিয়ে সংগঠন করা শুরু করেছিলাম। আমার অধিক্ষেত্র ছিল রিকশা শ্রমিক, ঠেলাগাড়ি চালক, হোটেল শ্রমিক, মোটর শ্রমিক প্রমুখ দিনমজুর নিয়ে। কলেজ জীবনে হাতের লেখার সুবাদে শিক্ষকমণ্ডলী দেয়াল পত্রিকা লেখার দায়িত্ব দেন, কিন্তু সাহিত্য চর্চার যে ধৈর্য বা নেশা থাকার কথা সেটিও ছিল না। সমাজে প্রভাবশালীদের শোষণ অত্যাচার, রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের উপরে সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে একটি বিশেষ গোষ্ঠী কর্তৃক রাষ্ট্রের সব সুবিধা ভোগ, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধনী ও গরিবের মধ্যে আকাশ পাতাল দূরত্ব প্রভৃতি যখন মন মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকে তখন কয়েক বছর চেষ্টা তদবির ও সাধনার পর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে ‘গণডাক’ নামে একটি জাতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা শুরু করলেও সম্পাদনার সময়টি ভালো যায়নি, বরং কণ্টকময় ছিল; তিন-তিনবার শুধু আদালত অবমাননার মামলার আসামি হয়েছি। প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিউজ করায় গ্রেফতার হয়েছি। অবশ্য ‘গ্রেফতার’ আমার জীবনে নিত্যদিনের সাথী। এ জন্য এর দিনক্ষণ মনে রাখি না। তখন দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক আজাদ পত্রিকায় নিয়মিত আমার আর্টিকেল প্রকাশিত হতো।
জাতীয় রাজনীতিতে গভীর মনোনিবেশ, আন্দোলন-সংগ্রামে অধিক সময় ব্যয়, জেলহাজত মামলা-মোকদ্দমার ঘানি টানা, পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির চেয়ারম্যান পদে (২০০১-০৬) দীর্ঘ পাঁচ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের বিতর্কিত সরকার কর্তৃক কারাবরণ প্রভৃতি কারণে আমার লেখালেখির পাঠ চুকে যায়। ২৬ মাস কারা ভোগ করে জেল থেকে বের হওয়ার পর জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় অনিয়মিতভাবে আর্টিকেলগুলো প্রকাশিত হলেও ২০১৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য কয়েক মাস আত্মগোপনে থাকাবস্থায় দৈনিক নয়া দিগন্ত (শনিবার), দৈনিক ইনকিলাব (সোমবার), দৈনিক দিনকাল (বুধবার) পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করি, যা এখন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এরই মধ্যে হাতেগোনা দু-একজন লেখক যাদের কলাম পড়ে অনুপ্রেরণাসহ অনেক বিষয়ে সত্যের সন্ধান পেয়েছি; তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ। আমার ধারণা মতে, তিনি ছিলেন একজন ‘জাতীয় শিক্ষক’।
সিনিয়র অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের কলামের একজন নিয়মিত পাঠক ছিলাম এবং আমার মনে হয়েছে, কলাম লেখার বিষয়ে আমি তার একজন ছাত্র বটে। একজন ছাত্র যেমন একজন শিক্ষককে অনুসরণ ও অনুকরণ করে, আমি তাই করেছি; যদিও তার সাথে কোনো দিন ব্যক্তিগতভাবে আমার সাক্ষাৎ বা কথা হয়নি। তবে আমার বাসনা ছিল তার সাক্ষাৎ লাভের। নানাবিধ ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে তা হয়ে ওঠেনি। মনে মনে প্রবল ইচ্ছা ছিল সন্নিকটেই তার সাক্ষাৎ পাওয়ার। তবে অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তার পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলেছি।
অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ ১৯৪৮ সালে শিক্ষা সংঘ বিষ্ণুপুর (পশ্চিম বাংলা) থেকে মাধ্যমিক সমমানের পরীক্ষা ‘বি, কোর্স’ পাস করেন। আমার বাবা ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। বয়সের দিক থেকে তিনি আমার বাবার সমসাময়িক এবং শ্রদ্ধার দিক থেকে আমি তাকে সে আসনেই মনে করি। কারণ এ দুর্দিনে যেখানে ‘সত্য’ বলার পরিবর্তে সাহিত্যে চাটুকারিতার যে অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে, এর বিপরীতে ছিল এবনে গোলাম সামাদের কলাম।
বর্তমানে মানসিক দাসত্বের একটি প্রবণতা সাহিত্যে জগতে প্রবেশ করেছে। সত্যকে প্রকাশ না করে শাসকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়াই যেন লেখালেখির জগতকে টইটম্বুর করে দিয়েছে। বিদেশ থেকে কলাম লিখে পাঠাচ্ছেন সেখানেও একতরফা প্রশংসা, সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে বৈধ করে দেয়ার প্রতিযোগিতা। দেশের অভ্যন্তরে বসে যারা কলাম লিখছেন তাদের অনেকেই আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে, বিশেষ করে কলকাতাকে যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী মনে করেন।
এবনে গোলাম সামাদের কলামে জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদের মূলধারা, বঙ্গভঙ্গের মূলতত্ত্ব, ইসলামী ঐতিহ্যের গুণগত পরিচয় প্রভৃতি বিষয় বিভিন্ন রেফারেন্স উদ্ধৃতি দিয়ে লিখিত, যা পড়লে প্রকৃত তথ্য একজন সত্য পিপাসু পাঠকের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের বড় তিনটি রাজনৈতিক দলই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু দলীয় নেতাদের কাছ থেকে জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক উন্নতমানের সমৃদ্ধ ব্যাখ্যা দিয়েছেন অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ। কলকাতা-মনস্ক মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবীরা আত্মমর্যাদা যেভাবে বিক্রি করে দিয়েছেন, তারই প্রতিবাদে অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন একজন ভ্যানগার্ড।
অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের চতুর্মুখী মেধা, বহুবিধ প্রতিভা তার বিভিন্ন লেখনী ও বইতে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি জাতিসত্তার গোড়ায় প্রবেশ করেছেন এবং জাতীয়তাবাদের একটি পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা তার লেখনীতে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে লেখনীতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাকে সামনে তুলে এনেছেন, যা অনেকেরই অজানা। বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় তার লিখিত বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি, আত্মপক্ষ, আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মানুষ ও তার শিল্পকলা, নৃতত্তে¡র গোড়ার কথা, প্রাথমিক জীবাণুতত্ত্ব, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা এবং আরাকান সঙ্কট, ইসলামী শিল্পকলা, শিল্পকলার ইতিকথা, বাংলাদেশে ইসলাম ও ঐতিহ্য, বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ, বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, জীবাণুতত্ত্ব, উদ্ভিদ সমীক্ষা, নৃতত্ত্ব, আমার স্বদেশ ভাবনা ও বাংলাদেশে ইসলাম, বইগুলোতে।
অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ তার লেখনীতে কোথাও আপস করেননি। তিনি বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকে ‘আত্মপক্ষ’ নামে নিয়মিত আর্টিকেল লিখতেন। সরকারের রক্তচক্ষুকে পরিহারের জন্য পত্রিকার নীতিনির্ধারকদের নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপকের লেখার কিছু কথা কাটছাঁট করার অনুরোধ করা হলে তিনি সেই বহুল প্রচারিত সিরিজ ‘আত্মপক্ষ’ লেখা বন্ধ করে দেন। দীর্ঘ দিন তার লেখা না দেখতে পেয়ে স্বউদ্যোগে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে পত্রিকা অফিস থেকেই আমাকে এ কথা জানানো হয়। বিষয়টি বিস্তারিত জেনে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ স্বনামধন্য বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকায় লেখা ছাপার সুযোগ অব্যাহত না রেখে বরং তিনি তার ব্যক্তিত্বে অবিচল থেকেছেন। এ মহীয়ান লেখকের অভিমান ভাঙানোর জন্য দৈনিক নয়া দিগন্তের আমীর হামজাকে সাথে নিয়ে রাজশাহীতে লেখকের বাসভবনে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও করোনাসংক্রান্ত বাধাবিপত্তির কারণে যাওয়া হয়নি।
অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের লেখনীতে প্রমাণিত হয়েছে, তিনি একজন জীবন্ত ইতিহাস। সচরাচর ইতিহাসের পাতায় যা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তার লেখনীতে পাওয়া যায় পরিষ্কার ধারণা।
জীবিত অবস্থায় গুণীদের কদর বা যথাযথ স্থানে সম্মানিত করার সংস্কৃতি থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। এ শ্রেণীর ক্ষণজন্মাদের জাতীয়ভাবে সামনের সারিতে নিয়ে আসতে পারলে তার চেয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মই বেশি উপকৃত হতো। বাংলা একাডেমি নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে সরকারি মদদপুষ্ট লেখক না হলে সরকারি স্বীকৃত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে টেলিফোনে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। তিনি জীবিত থাকাকালে একটি স্মারক প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা প্রকাশিত হয়নি। ওই স্মারকে একটি আর্টিকেল জমা দেয়ার জন্য তার এক ভক্ত শাহাদাত সরকার যোগাযোগ করতেন।
একুশে পদকসহ জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কারগুলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়ে থাকে। ফলে প্রকৃত জ্ঞানীদের ভাগ্যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোটে না। তবে দেশের জনগণ তাদের স্মরণ রাখবে চিরকাল। ৯৪ বছর বয়সে ১৫ আগস্ট রাজশাহীর নিজ বাসভবনে এ জ্ঞানপিপাসু মৃত্যুবরণ করেছেন। তার উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। ১১ জন সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর লিখিতভাবে এবনে গোলাম সামাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। পত্রিকান্তরে দেখেছি, এ মহান জ্ঞানপিপাসুকে হাসপাতালের বারান্দায় রাখা হয়েছিল।
বর্তমান সরকার সব কিছুই রাজনৈতিক বিবেচনায় করছে। এবনে গোলাম সামাদ যদি তার লেখনীতে সরকারের চাটুকারিতা করতেন, তবে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য অর্থের অভাব হতো না এবং জীবিত থাকাবস্থায়ই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য বাংলা একাডেমি তার নাম সরকারের কাছে উপস্থাপন করত। কিন্তু জাতির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জাতির ‘মেধা’ আজ আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির ষড়যন্ত্রের শিকার। বিষয়টি আরো নির্মম যে, সরকার পক্ষের লেখকের না হলে বাংলা একাডেমি এবং জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ তার বইগুলো তালিকাভুক্ত করে না, অথচ এশিয়াটিক সোসাইটি তা তালিকাভুক্ত করে থাকে। মেধার ক্রমবিকাশ সরকার কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হলে বা সরকার যদি দলমত নির্বিশেষে মেধাকে বিকশিত হতে না দেয়, তবে নিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানগর্ভ প্রকাশনা বা সরকারের সমালোচনাপূর্বক তথ্য জনগণের কাছে অজানাই থেকে যাবে। জাতির বিবেক জাগ্রহ হোক। এবনে গোলাম সামাদের মতো জ্ঞানপিপাসু জাতির হৃদয়ে দীর্ঘজীবী হন এবং জাতির মেধা আমলাতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতির গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্তি লাভ করা।
লেখকঃ তৈমুর আলম খন্দকার; রাজনীতিবিদ, আইনজীবি এবং কলামিস্ট। লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্তে, ২২ আগস্ট ২০২১।