ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসের ১৭ দিনজুড়ে হয় ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধ। এতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে জয়ী হয় ভারত। হারে পাকিস্তান। ভারতের হাতে বন্দী হয় প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য। সিমলা চুক্তি অনুসারে এই ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীদের (POW) পাকিস্তানের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এদের কাউকেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হয় না। এ ছাড়া সিমলা চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই রাজি হয় যে, ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তার নিষ্পত্তি করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে, কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। চুক্তিটির নাম হয় সিমলা চুক্তি। কারণ এটি সম্পাদিত হয় ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলা শহরে। সিমলায় ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশরে প্রতিনিধিরা চুক্তির আগে দিয়ে করেন আলোচনা সভা, যা ইতিহাস-খ্যাত হয়ে আছে সিমলা সম্মেলন হিসেবে। এই সম্মেলনে ভারতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দেন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আর পাকিস্তানের পক্ষের নেতৃত্ব করেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকাই হয়নি। বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি এর একটা কারণ ছিল, জুলফিকার আলী ভুট্টোর আপত্তির কারণে। ভুট্টো আপত্তি তোলেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধ হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। বাংলাদেশ নামে তখন কোনো রাষ্ট্র ছিল না। পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে কোনো যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ করেছে ভারতের সাথে। ঢাকায় রমনার মাঠে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেন কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের কোনো সেনানায়কের কাছে পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেননি। তাই সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি থাকতে পারে না। যুদ্ধ বাংলাদেশ-পাকিস-ানের মধ্যে হয়নি। হয়েছে কেবল ভারত-পাকিস-ানের মধ্যে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথায় যুক্তি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাজিত হয়েছিল জার্মানি। জার্মান সৈন্য পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাপতিদের কাছে। অন্য দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, চীন, নেদারল্যান্ডস, আস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কাছে পৃথক পৃথকভাবে। অন্য দিকে ১৯৭১-এ পাক বাহিনী কেবলই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছিল এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। ভারত সে দিন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে আসতে দেয়নি রমনার মাঠে। যে কারণেই হোক, তাকে আটকে রাখা হয়েছিল কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টে। ভারত কেন এটা করেছিল তার কোনো ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আর এর ফলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ খাতাপত্রে পরিচিত হয়ে আছে কেবল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে। যদিও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে কখনই ভারতের পক্ষে জেতা সম্ভব হতো না।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তাতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গ্রহণ করেনি পাকিস্তানের পক্ষ। ভারত কেবল লড়াই করেছে তার পশ্চিম রণাঙ্গনে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যে যুদ্ধ হয়, তা শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বরে। ভারত একপক্ষীয়ভাবে ১৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি। ভারতের ব্রিগেডিয়ার আর এন মিশ্র যুদ্ধশেষে সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে যুদ্ধে জেতা সহজ হতো না। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাই আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হতে পেরেছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের বলেছে কোথায় কিভাবে পাক বাহিনী যুদ্ধে অবস্তান নিয়েছে। তারা দিয়েছেন আমাদের গোপন সংবাদ। এসব সংবাদ যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যকে বিশেষভাবে সাহাষ্য করেছে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় সৈন্যকে করেছে খাদ্য সরবরাহ। নৌকা দিয়ে সাহায্য করেছে নদী পার হতে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা ভারতের সেনাবাহিনীকে দিয়েছে মনোবল, দিয়েছে গতি। আর তাই ভারতীয় সৈন্য মরেছে কম। অনেক সহজেই যুদ্ধ করতে পেরেছে পাক বাহিনীর সাথে। মিশ্রর এই বিবৃতি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালের লড়াইয়ের চেহারা। কিন্তু পাক বাহিনী যেহেতু আত্মসমর্পণ করেছিল কেবল ভারতীয় সেনাদের হাতে, তাই যুদ্ধটা বিশ্ববাসীর কাছে এ সময় খ্যাত হয় কেবল পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে। আর সিমলা চুক্তি সম্পন্ন হয় কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। এতে বাংলাদেশ কোনো অংশ নিতে পারে না। কেন ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ককে রমনার ময়দানে আসতে দেয়নি সেটা আমরা বলেছি, এখনো আছে রহস্যময় হয়ে। তবে এর একটা কারণ হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৩ ডিসেম্বর তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজকে বাহরাইন থেকে পাঠায় বঙ্গোপসাগরে। অন্য দিকে ভিয়েতনাম থেকে পাঠায় তাদের সপ্তম নৌবহরের একাধিক জাহাজ। এ সময় আমি ছিলাম কলকাতায়। কলকাতায় মানুষকে বলতে শুনেছি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নাকি বলেছেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ থামাতে। না হলে মার্কিন সৈন্য অবতরণ করবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। তারা ধরে নেবে পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে পাকিস্তানের অংশ। পাকিস্তানের সাথে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সামরিক চুক্তি। যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করতে বাধ্য। মার্কিন চাপ ১৯৭১- এর ডিসেম্বরের যুদ্ধকে প্রশমিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে। তার ছিল ভিন্ন রকম পরিকল্পনা। সে ভেবেছিল বাংলাদেশে অনেক সহজে সে তার প্রভাব বিস্টার করতে পারবে। আর বাংলাদেশ হবে পাকিস্তানের চেয়ে তার অনুগত রাষ্ট্র। শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করেছেন মার্কিন সমর্থনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই ধরেই নিয়েছিল একটা পৃথক বাংলাদেশ হবে তার জন্য বিশেষ সহায়ক রাষ্ট্র; বৈরী রাষ্ট্র নয়। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। এর মূলেও ছিল মার্কিন চাপ। ভারত স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য সরায়নি। মার্কিন চাপেই সে বাধ্য হয় সৈন্য সরিয়ে নিতে। এসব কথা শুনেছি, একাধিক লোকের মুখে, কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর।
আমি চাকরি করতাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অনেক অধ্যাপকের কাছে অনেক কথা শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন পাকিস্তানের সমর্থক অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক অধ্যাপক। আর ছিলেন ভারতের সমর্থক অধ্যাপকও। নানা রকম আলোচনা শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় মহলে। এ থেকে যে ধারণা আমার মনে গড়ে উঠেছে, তা হলো ১৯৭১-এর যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ খুবই প্রবলভাবে। ১৯৭১-এর যুদ্ধের গতি প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে করা যায় না। অন্য দিকে ১৯৭১-এ হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে বিশেষ মৈত্রী চুক্তি। এই যুদ্ধে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেরও ছিল বিশেষ ভূমিকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে যুদ্ধে সাহায্য করেছিল নেপথ্যে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে কথা দেয় যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পেতে পারবে নৌঘাঁটি গড়ার অধিকার; যদি সে সেটা চায়। চট্টগ্রাম বন্দর থাকবে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে। সোভিয়েত নৌবাহিনীর জাহাজ ছিল দক্ষিণ ভারতের বিশাখাপত্তম বন্দরে। সোভিয়েত জাহাজ থেকে টর্পেডো ছুড়ে ডুবিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানের ডুবোজাহাজ গাজীকে। গাজী আসলে পাকিস্তানের জাহাজ ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা পাকিস্তানকে ধার দিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। নৌযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন অংশ নিয়েছিল। রুশ সেনাপতিরা ১৯৭১-এ ভারতকে রণকৌশল গঠনে দিয়েছিল বিশেষ সাহায্য-সহযোগিতা। পাকিস্যুতানেরদ্ধ কেবল হয়ে থাকেনি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ। ১৯৭১-এর যুদ্ধ পরোক্ষভাবে হয়েছিল পাকিস্তান-সোভিয়েত যুদ্ধ। রণনীতিতে ভারতীয় সৈন্য উন্নত কৌশল প্রদর্শন করতে পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা বিশেষজ্ঞদের কারণে। অর্থাৎ ১৯৭১-এর পাক- ভারত যুদ্ধ কেবল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ ছিল না। এতে জড়িয়ে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ইন্দিরা গান্ধী চাননি যুদ্ধ একটা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করুক। ভারত তাই যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করে। আর চায় না পাকিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে। সে খুশি হয় সাবেক পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে পেরেই। আজ যখন আমি ’৭১-এর যুদ্ধকে ফিরে দেখি, তখন এ রকমই মনে হয় আমার কাছে।
সিমলা চুক্তি নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন ভারতের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পিলু মোদি (Piloo Mody)। পিলু মোদি একটা বই লেখেন ১৯৭৩ সালে। বইটির নাম Zulfi my Friend|। পিলু মোদি ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাল্যবন্ধু। তিনি তার বইয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন। অনেক কিছু লিখেছেন সিমলা সম্মেলন সম্পর্কে। যা থেকে পাওয়া সম্ভব ইতিহাস লেখার বেশ কিছু উপকরণ। পিলু মোদি হিন্দু সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি নন। তিনি হলেন ভারতীয় পারসি (Parsi) ধর্ম সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি। ভারতে পারসি সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক খেকে খুবই নগণ্য। কিন্তু অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে এরা হলেন খুবই প্রতিপত্তিশালী। ভারতের সবচেয়ে বড় শিল্পপতি ছিলেন জমসেদজী টাটা (তাতা)। যিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন টাটা কোম্পানি। ভারতের রাজনীতিতে পারসিরা রেখেছেন বিশেষ প্রভাব। ভারতের বিখ্যাত রাজনৈতিক দাদাভাই নৌরজি ছিলেন পারসি। নৌরজি প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন। এটা ছিল সে সময় একটা বিরাট ঘটনা। মিনুমাসানি ছিলেন ভারতের একজন বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক নেতা। তিনি তার লেখার মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে রেখেছেন বিশেষ প্রভাব। ভারতের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হোমি জাহাঙ্গীর ভবা হলেন পারসি সমপ্রদায়ভুক্ত। মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে এর গবেষণা হয়ে আছে খুবই খ্যাত। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এস এইচ এফ জে মানিক শ (পরে মার্শাল) ছিলেন পারসিক সমাজভুক্ত। পিলু মোদি ছিলেন ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য এবং ভারতীয় স্বতন্ত্র দলের একজন খুবই নামকরা নেতা। ১৯৭২ সালে যখন সিমলা সম্মেলন হচ্ছিল তখন তিনি যান সিমলায়। দেখা করেন ভুট্টোর সাথে। তিনি তাকে দেন বহুবিধ পরামর্শ। এ রকম করাটা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কারণেই। ইন্দিরা গান্ধী তাকে বিরত রাখতে পারেননি ভুট্টোর সাথে দেখা ও উপদেশ প্রদান করা থেকে। অন্য কোনো ব্যক্তি হলে তাকে চিহ্নিত হতে হতো ভারতীয় আইনানুসারে দেশদ্রোহী হিসেবে। কিন্তু পিলু মোদিকে তা হতে হয়নি। পিলু মোদি তার বইয়ে বলেছেন- ইন্দিরা গান্ধী সিমলা সম্মেলনে ওঠান যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার প্রসঙ্গটি। জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, এতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু বিচার হতে হবে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধবন্দী হত্যা হলো অন্যতম যুদ্ধাপরাধ। জেনেভা কনভেনশনানুসারে যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা যায় না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ইপিআর তাদের হাতে ধরা পড়া পাক বাহিনী সৈন্যকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করেছে। জেনেভা কনভেনশনানুসারে হতে হবে তাদের বিচার। পিলু মোদি তার বইয়ে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উঠতে পারত কাদেরিয়া বাহিনী সম্পর্কে। কাদেরিয়া বাহিনীর নেতা কাদের সিদ্দিকী অমানবিকভাবে নির্বিচারে বিহারি হত্যা করেছেন। সেটাও পড়তে পারে যুদ্ধাপরাধেরই মধ্যে। ইন্দিরা গান্ধী তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে আর বেশি দূর অগ্রসর হতে চাননি। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গেলে দেখা দিত সমূহ জটিলতা। যুদ্ধাপরাধ ঘটেছে দুই পক্ষ থেকেই। এক পক্ষ থেকে নয়।
আন্তর্জাতিক নিয়মে করতে হতো যুদ্ধাপরাধের বিচার। আর আন্তর্জাতিক নিয়মে বিচার হলে, বিচারে পাকিস্তান পেতে পারত অধিক সুবিধা। এ কথা বলেছেন, পিলু মোদি তার লেখা Zulfi my Friend বইয়ে। পিলু মোদির মতে, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ ছিল যথেষ্ট গভীর। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন বিশেষভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন সিন্ধি। কিন্তু তিনি কখনোই তোলেননি সিন্ধি জাতীয়তাবাদের ধ্বনি। কিন্তু শেখ মুজিব চেয়েছেন পাকিস্তানের মধ্যে থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বনি তুলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। জনাব ভুট্টো মেনে নিতে পারেননি পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। তিনি মনে করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেবে সাবেক পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে। পরবর্তী ঘটনা ভুট্টোর ধারণাকে, পিলু মোদির মতে, যথার্থ প্রমাণ করেছে।
সিমলা চুক্তি অনুসারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ আর ওঠা উচিত ছিল না। কিন্তু এখন নতুন করে উঠছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। এর একটি কারণ, বিশ্বরাজনীতির ধারা বিশেষভাবেই বদলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সময় তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেছে কমিউনিজম রোধের লক্ষ্য সামনে রেখে। এখন তাকে পেয়ে বসেছে জঙ্গি ইসলাম আতঙ্কে। বর্তমানে বাংলাদেশে যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হচ্ছে তাদের প্রায় সবাই সাধারণভাবে পরিচিত ইসলামপন্থী হিসেবে। ১৯৭১ সালে এরা সবাই ছিলেন অত্যন্ত তরুণ। এরা কতটা যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন সেটা তর্কের বিষয়। শেখ মুজিব চাননি এদের বিচার করতে। কিন্তু এখন এদের উঠতে হচ্ছে বিচারের কাঠগড়ায়। মনে হচ্ছে, সারা দেশে অনেক যুদ্ধাপরাধী আছে। আর তারা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান সমস্যা। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। মনমোহন সিং বাংলাদেশে সফরে আসার ঠিক আগে দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ ভরে উঠেছে মুসলিম মৌলবাদে। মুসলিম মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ। পরে তিনি তার এই বক্তব্যকে প্রত্যাহার করে নেন। মনে হচ্ছে জামায়াতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিশেষ করে উঠানো হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি। এ ক্ষেত্রে আছে ভারতেরও একটি ভূমিকা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন লাভের আশায় উদ্যোগ নিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের। অথচ ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তি অনুসারে এ রকম বিচার অনুষ্ঠান হওয়া উচিত ছিল না। সিমলা চুক্তির কোনো মূল্য এখন আর নেই।