ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে আমাদের দেশে এমনকি ভারতেও কোনো আলোচনা হয় না। ফিরোজ গান্ধী মোহন দাস করমচাঁন গান্ধীর সাথে রক্তের কোনো সম্পর্কে জড়িত নন। যদিও ফিরোজ গান্ধীর পূর্ব পুরুষ মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর (যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে খ্যাত) পূর্ব পুরুষের মতোই ছিলেন গুজরাটের অধিবাসী। ফিরোজ গান্ধীরা ছিলেন দক্ষিণ গুজরাটের লোক। ১৯২০-এর দশকে ফিরোজ গান্ধীর বাবাা মারা যান। যিনি ছিলেন একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বাবার মৃত্যু হলে তার মা এলাহাবাদে তার বড় বোনের (অবিবাহিতা) কাছে চলে আসেন। তিনি ছিলেন একজন শল্য চিকিৎসক। ফিরোজ গান্ধী (১৯১২-১৯৬০) লেখাপড়া করেন এলাহাবাদে বিদ্যামন্দির নামক হাইস্কুলে এবং যুক্ত হয়ে পড়েন কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে। ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ে করেন ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে। এর ফলে ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনীর নাম হয় ইন্দিরা গান্ধী। এর সাথে মহাত্মা গান্ধীর কোনো সুদূর সম্পর্ক নেই। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর গান্ধী পদবিটা এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে, তা মনে হয়েছে মাহাত্মা গান্ধীর সাথে যুক্ত। যেটাকে বলা চলে যে, রাজনৈতিক জালিয়াতি।
কথাটা এখন নতুন করে উঠছে এ জন্য যে, ইটালির মেয়ে সোনিয়া রাজিব গান্ধীকে বিয়ে করার জন্য হয়ে উঠেছেন সোনিয়া গান্ধী। তিনিও চাচ্ছেন মাহাত্মা গান্ধীর সাথে নিজেকে যুক্ত করতে। এটাকেও বলা চলে রাজনৈতিক জালিয়াতি। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ধর্মে হিন্দু। ফিরোজ গান্ধী ছিলেন অগ্নিপূজারী পার্সিক। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তার সন্তানদের পার্সিক হতে দেননি। মানুষ করেছেন হিন্দু হিসেবে। আর বর্তমানে সোনিয়া গান্ধী তার ছেলেমেয়োদের মানুষ করছেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হিসেবে। তাদের বিয়ে দিয়েছেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পরিবারে; হিন্দু পরিবারে নয়। অথচ গান্ধী পদবিটা পরিত্যাগ করতে চাননি। গান্ধী পদবিটার রাজনৈতিক জাদুকে তারা কাজে লাগাতে চাচ্ছেন আসন্ন ভারতীয় নির্বাচনে। কিন্তু বিষয়টি এখন এতই জানাজানি হয়ে গেছে যে, তা খুব কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নন।
তাই ভাবছেন প্রিয়াংকা ও রাহুল আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হবেন গান্ধীর সাথে যুক্ত হিসেবে। অথচ মহাত্মা গান্ধীর সাথে এদের তো সুদূর যোগাযোগ নেই। আমাদের সংবাদিকেরা যে কতটা দুর্বল তারও পরিচয় মিলছে তাদের এই সাংবাদিকতা থেকে। ফিরোজ গান্ধী কেবল রাজনীতিক ছিলেন না, তিনি একজন সাংবাদিকও ছিলেন। তিনি The National Herald এবং ‘নবজীবন’ (হিন্দি) নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন লক্ষ্ণৌ থেকে। ফিরোজ গান্ধীর সাথে বিয়ে হওয়ার ফলে ইন্দিরা গান্ধী দুই ছেলে সন্তানের জননী হন। কিন্তু তিনি তার এই সন্তানদের পার্সি হিসেবে মানুষ হতে না দেয়ার জন্য ফিরোজ গান্ধীর সাথে তার বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। যদিও ঠিক সরকারিভাবে নয়। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে এ কথা আসছে। গান্ধী নামের জাদু মনে হচ্ছে না খাটবে। মনে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি পেতে যাচ্ছেন অধিক সংখ্যায় ভোট।
নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের লোক। মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান থেকে তার জন্মস্থান খুব দূরে অবস্থিত নয়। মহাত্মা গান্ধীর মতোই তার মাতৃভাষা গুজরাটি। এখানে কিছুটা অবান্তর হলেও উল্লেখ করা চলে যে, মহম্মাদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষাও ছিল গুজরাটি। তিনি (জিন্নাহ) জীবনে প্রথম যে রাজনৈতিক রচনাটি লেখেন, তা ছিল গুজরাটি ভাষায় রচিত। জিন্নাহ বিয়ে করেছিলেন অগ্নিপূজারী পার্সি মেয়েকে। তার নিজের একমাত্র মেয়েও বিয়ে করেন পার্সি পরিবারে।
লোকের ধারণা জিন্নাহ ছিলেন ভয়ঙ্করভাবে গোড়া মুসলমান। কিন্তু ইতিহাস তা বলে না। মহাত্মা গান্ধী গীতাভাষ্য রচনা করেছেন। বলেছেন, রামরাজত্ব গড়ার কথা। কিন্তু জিন্নাহ ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে কোনো বই লেখেননি। স্বপ্ন দেখেননি কোনো রামরাজত্ব স্থাপনের। অথচ কেউ গান্ধীকে গোড়া ধর্মবিশ্বাসী বলেন না। বলেন, কেবল জিন্নাহকেই ধর্মান্ধ রাজনীতিক। তবে যাই হোক, আগামী ভারতীয় নির্বাচনে জিন্নাহর কথা আসবে না, আসবে গান্ধী বনাম নরেন্দ্র মোদি প্রসঙ্গ।
নরেন্দ্র মোদি অর্থনীতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদে আস্থাশীল। ভারতে এখন আর সাবেক কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আদৃত নয়। সর্বোপরি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর। সমাজতন্ত্র কথা তাই অচল হয়ে পড়েছে। আমরা ভারতের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি। কেননা, বাংলাদেশ তিন দিক থেকে ভারতবেষ্টিত। আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে। ফিরোজ গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী তার শ্বশুর সম্পর্কে কোনো খোঁজ রাখেন বলেই মনে হয় না। নরেন্দ্র মোদি হিন্দুত্ববাদী। কিন্তু তার রাজনৈতিক শিকড় বিশেষভাবে প্রথিত ভারতের মাটিতে। যেটা বর্তমান কংগ্রেসের আর নেই।
আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে প্রচার করে চলেছেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি একসময় ভারতের রেল স্টেশনে নিজে হাতে চা তৈরি করে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তিনি নেতা হয়েছেন জনগণের মধ্যে থেকে। জওয়াহের লাল নেহরুর মতো কোনো ধনী পরিবারের সন্তান তিনি নন। তাকে তাই বলা যেতে পারে প্রকৃত জননেতা। ভারতের আর কোনো নেতা ঠিক এভাবে আপন চেষ্টায় নেতা হতে পারেননি। এদিক থেকে তাকে বলা যেতে পারে প্রকৃত ‘সর্বহারাদের’ নেতা।
ভারত এখন দুই ভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। আর্য-ভারত ও দ্রাবিড়-ভারত। হিন্দুত্ব আর্য-ভারতের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাম দক্ষিণ ভারতের মনে কোনো রাজনৈতিক আবেগ সৃষ্টি করে না। রামরাজত্ব কোনো দিন দক্ষিণ ভারতে ছিল না। ভারতে মানুষ এখন চাচ্ছে কাজ অর্থাৎ জীবিকার উপায়। চাচ্ছে আবাসন অর্থাৎ থাকার জায়গা। চাচ্ছে আবর্জনামুক্ত পরিবেশ। হিন্দুত্বের আবেগ তাদের কাছে বড় নয়। যদিও মুসলিমবিদ্বেষ ভোট লাভের একটা উপায়। উত্তর-ভারতে বহু লোক (হিন্দু) এখনো মনে করেন যে, রামমূর্তি অযোধ্যার বাবরি মসজিদের মেহেরাবে মাটি ফুঁড়ে উঠেছে। ১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর ৩০০০০০ (তিন লাখ) উন্মত্ত হিন্দু জনতা (কর সেবক) বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। রাজিব গান্ধী যার প্রতিবাদ করেননি। বরং জানান তাদের প্রতি সহানুভূতি। যদিও তার বাবা হিন্দু ছিলেন না; ছিলেন অগ্নিপূজারী পার্সিক। ভারতের রাজনীতিতে পার্সিকদের প্রভাব এখন আর মোটেও উল্লেখ্য নয়। কিন্তু একসময় ছিল বড় করে বলবারই মতো।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত প্রথম ভারতীয় এমপি দাদা ভাই নওরোজি ছিলেন পার্সিক। পার্সিকরা পরে রাজনীতি না করে ব্যবসা বাণিজ্যের দিকেই নজর দিয়েছেন বেশি। জমসেদজি টাটা (তাতা) গড়েছেন টাটা কোম্পানির মতো লৌহ-ইস্পাতের কারখানা; যা ব্রিটিশ শাসন আমলেই পৃথিবীর বারোটি লৌহ-ইস্পাত কারখানার মধ্যে একটি। ১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতের সেনাবাহিনীর মহাপরিচালক ছিলেন জেনারেল মানিক শ। তিনি ছিলেন পার্সিক, হিন্দু নয়। ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ কথা আমার মনে আসছে। মনে হচ্ছে পার্সিকরা ভারতের রাজনীতিতে আবার বেশ কিছুটা গুরুত্ব পেতেই যাচ্ছে। আমাদের সাংবাদিকেরা এখনো কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল। জানি না কেন?
লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায়, ০৫ এপ্রিল ২০১৯।